পার্থক্য পর্ব-২৬

0
1447

পার্থক্য

২৬ পর্ব।

#রিফাত_হোসেন।

তারিন কিছুতেই ফোন রিসিভ করার সাহস পাচ্ছে না। এমনিতে আশিক কেন আশিকের বাপ থাকলেও ভয় পেতো না তারিন। কারণ রিফাত ওর পাশে সব সময় আছে। কিন্তু এখন হঠাৎ করে ফোন চলে আসাতে খুব ভয় হচ্ছে। ফোনের ওপাশের মানুষটা যে আশিক তার কী কোন নিশ্চয়তা আছে। না নেই, তাহলে কেন এত ভয় পাচ্ছে তারিন? হয়তো এই আশিক নামক ভয়তে অভ্যস্ত হয়ে গেছে। তারিন স্পষ্ট অনুভব করছে আশিক আশেপাশেই আছে। হয়তো ডানে বা বামে কিংবা ফোনের ওপাশে। তারিন আস্তে আস্তে বিছানা থেকে নিচে নামলো। ঢোক গিলতে গিলতে ফোনের কাছে গেল। কাঁপা কাঁপা হাতে ফোনটা তুলে নিলো। কিন্তু ফোন স্কিনের দিকে তাকিয়ে মুহূর্তের মধ্যেই মুখে ভয়ের ছাপ কেঁটে গিয়ে হাসি ফুটে উঠেছে। কিন্তু তারিন এটা ভেবে পেলো না এতক্ষন কেন আশিক কে অনুভব করেছে। কেন বার বার মনে হয়েছে আশিক আশেপাশেই আছে।
তারিন কিছুক্ষন ভেবে নিজেই নিজের মাথায় একটা টোকা মারলো। তারপর একটা হাসি দিয়ে বলল – ‘যেখানে ভালোবাসা নেই সেখান আজাইরা চিন্তা ভাবনা ছাড়া অন্য কিছু তো আসার কথা নয়। রিফাত কে যেভাবে অনুভব করতে পারে তারিন। আশিক কে ঠিক সেভাবে পারে না। রিফাত অনেকটা দূরে থাকলে ও তারিন বুঝতে পারে তার ভালোবাসার মানুষ, তার প্রিয় মানুষ, খুব কাছেই আছে।

এদিকে ফোন বেজেই চলেছে। তারিনের কোন হুশ নেই। এমন ভাবে দাঁড়িয়ে আছে যেন তারিন বেশামাল হয়ে গেছে। ওপাশ থেকে তিশা ফোন দিয়েই যাচ্ছে। কিন্তু তারিন ফোন রিসিভ করছে না।
রিফাত ঘরে এসে দেখে তারিন টেবিলের সামনে চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে। আর হাতে থাকা ফোনটা অনবরত বেজেই চলেছে। দরজার সামনে থেকেই বলল – ‘তারিন তোমার ফোন বাজছে।’

রিফাতের কথায় অনেকটা চমকে উঠেছে তারিন। তড়িঘড়ি করে ফোনটা রিসিভ করলো। তারিন কিছু বলার আগেই ওপাশ থেকে তিশা বলল – ‘কি রে এতক্ষণ লাগে ফোন রিসিভ করতে।’
– ‘আরে এমনি একটু বাহিরে ছিলাম।’
– ‘ওহ্। কেমন আছিস?’
– ‘আমি তো ভালো আছি। তুই কেমন আছিস।’
– ‘আমিও ভালো আছি। আচ্ছা শোন আমি আর আরিফ কালকে ঢাকা আসছি।’
– ‘সত্যি।’
– ‘হুম। সত্যিই।

তারিন খুশিতে লাফ দিয়ে উঠলো। রিফাত অবাক হয়ে তারিনের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো – ‘কী হলো এভাবে বাদরের মতো লাফালাফি করছো কেন?’

তারিন রাগি মুড নিয়ে কিছুক্ষন তাকিয়ে থাকলো। তারপর রিফাতের কানের কাছে গিয়ে বলল – ‘তোমার ব্যবস্থা একটু পর করছি, আগে একটু কথা বলে নেই।’

তারিন তিশা কে বলল – ‘আমাদের বাড়িতে আসবি কিন্তু।’
– ‘অবশ্যই যাবো, কারণ এখন থেকে ঢাকায় থাকবো। আরিফের ঢাকায় একটা অফিসে চাকরি হয়েছে। আর অফিস থেকেই একটা ফ্লাট দিয়েছে।’
– ‘বাহ্, এটা তো খুব ভালো খবর। কিন্তু তোরা যেখানে থাকবি তার ঠিকানা টা বল।’
– ‘আমি এত কিছু জানিনা। কিন্তু আরিফ বলল তোদের বাড়ির খুব কাছেই।’
– ‘ওহ্,
– ‘আচ্ছা এখন রাখছি পরে কথা হবে।’
– ‘ঠিক আছে।’

ফোন রেখে দিয়ে তারিন রিফাতের দিকে তাকালো। রিফাত আমতা আমতা করে বলল – ‘এভাবে তাকিয়ে আছো কেন?’

তারিন রাগি কন্ঠে বলল – ‘আমি বাদর।’
– ‘হি হি হি আমি তো মজা করছিলাম।’
– ‘তাহলে আমিও একটু মজা করি’
– ‘মানে।’

তারিন কোন কথা না বলে রিফাত কে জড়িয়ে ধরলো। রিফাত বলে উঠলো – ‘এইরকম মজা তো আমি সব সময় করতে চাই। তুমিই তো শুধু বল এখন উল্টো পাল্টা কিছু করা যাবে না।’
রিফাত ও শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো তারিন কে। আস্তে আস্তে বিছানায় কাছে গেল। তারিন রিফাত কে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে রিফাতের মুখের দিকে এগুতে লাগলো। দু’জনের ঠোঁট একত্র হতেই তারিন জোরে রিফাতের ঠোঁটে কামড় বসিয়ে দিল। রিফাত ব্যথায় চেঁচিয়ে উঠলো। পাশের ঘর থেকে আরিয়ান এসে দেখে রিফাতের উপরে তারিন শুয়ে আছে। আরিয়ানা চোখদুটো বন্ধ করে বলল – ‘এভাবে দরজা খোলা রেখেছিস কেন?

আরিয়ানের কথা শুনে দু’জন দু’দিকে ছিঁটকে পড়লো। যেন কারেন্ট শক খেয়েছে । আরিয়ান নিজেই এক হাত দিয়ে চোখ ধরে আরেক হাত দিয়ে দরজা বন্ধ করে চলে গেল।
আরিয়ান চলে যাওয়ার পর রিফাত আবার তারিন কে নিজের কাছে নিয়ে আসলো। তারিন কে কিছু বলতে না দিয়ে রিফাত তারিনের পুরো মুখে চুমু দিতে শুরু করলো। তারিন রিফাতের বুকে দু’হাত দিয়ে ঘুসি মারলো। রিফাত থেমে গিয়ে বলল – ‘কী হলো মারছো কেন’
– ‘রাতের খাবারের সময় হয়ে গেছে। এক্ষুনি মা ডাক দিবে।’
– ‘আজ আর রাতের খাবার খাবো না।’
তারিন অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো – ‘তাহলে কী খাবো।’
– ‘আজ রাতে শুধু চুমু খাবো।’

রিফাতের কথা শুনে তারিন লজ্জায় মাথা নিচু করে ফেললো। রিফাত নিজের হাত দিয়ে তারিনের মুখটা উপরে তুলে বলল – ‘তাহলে শুরু করে দেই।’

তারিন রিফাত কে ধাক্কা দিয়ে বিছানায় ফেলে দিয়ে দৌড়ে বাহিরে চলে এলো। বাহিরে এসে দেখে আয়শা বেগম টেবিলে খাবার দিচ্ছে। তিনি তারিন কে দেখেতে পেয়ে বলল – ‘রিফাত কোথায়?’
– ‘ঘরেই আছে এসে পড়বে।’
– ‘ঠিক আছে তুই বসে পড়।’

কিছুক্ষন পর রিফাত ও আরিয়ান চলে এলো। ইকবাল হোসেন এখনো বাড়িতে আসেনি। খাওয়ার মাঝে তারিন বলল, কালকে তিশা আর আরিফ ভাইয়া আসবে।
আরিয়ান বলল – ‘হ্যাঁ, আরিফ সাহেব আমাকে ফোন দিয়েছিলো। এখানেই উনার খুব ভালো একটা জব হয়েছে।’
– ‘বাহ্, এটা তো খুব ভালো খবর। আমাদের বাড়িতে আসতে বল তাহলে।( আয়শা বেগম)
– ‘সে তো আসবেই। কিন্তু অফিস থেকেই ওদের একটা ফ্লাট বরাদ্দ করে দেওয়া হয়েছে।'( আরিয়ান)

কেউ আর কোন কথা বলল না। খাওয়া শেষ করে যে যার ঘরে চলে গেল। রিফাত ল্যাপটপে অফিসের কাজ করছে। তারিন বেলকনিতে দাঁড়িয়ে আছে। আর ভাবছে আজকে বিকেলে ঘটে যাওয়া ঘটনা। তারিন কিছুতেই বুঝতে পারছে না আশিকের পাল্টে যাওয়ার কারণ। তারিন আশিকের নম্বরে একটা ফোন দিল। কিন্তু কোন লাভ হলো না কারণ আশিকের নম্বর বন্ধ ছিলো। নেট অন করে একবার ফেসবুক ঢুকলো । অনেকদিন পর ফেসবুক অন করলো তারিন৷ সেই ভয়ংকর রাতের পর আর ফেসবুকে ঢুকা হয়নি। টেক্সট বক্সে গিয়ে দেখে আশিকের আইডিটা সাদা হয়ে আছে। অনেকদিন আগেই ডি-এক্টিভ করে দিয়েছে। আশিকের সাথে যোগাযোগ করার কোন উপায় নেই। নম্বরটা মুখস্থ ছিলো বলে ফোন দিতে পেরেছে। কিন্তু সেটা ও বন্ধ।
এখন একমাত্র উপায় হলো সেই বাড়িটা। যেখানে আশিকের সাথে দেখা করেছিলো। কিন্তু সেখানে গিয়ে যদি কোন বিপদ হয়।

হঠাৎ রিফাতের স্পর্শ পেয়ে শিউরে উঠলো তারিন। পিছনে তাকিয়ে দেখে রিফাত দাঁড়িয়ে আছে। রিফাত তারিন কে জিজ্ঞেস করলো – ‘কী হলো এখানে দাঁড়িয়ে আছো কেন?’

তারিন কোন কথা না বলে রিফাতের বুকে মাথা রাখলো। রিফাত তারিন কে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলল – ‘আমার বৌ এমন মনমরা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে কেন?’
– ‘যদি রাগ না করো তাহলে একটা কথা বলবো।’

রিফাত বেশ কৌতূহল নিয়ে জিজ্ঞেস করলো – ‘কী?’
– ‘ওই ছেলেটা সত্যিই আশিক।’

রিফাত তারিনের মুখে হাত দিয়ে বলল – ‘আশিকের নাম আর মুখে আনবে না।’
– ‘হুম’

বাহির থেকে ঠান্ডা হাওয়া আসছে। বেলকনিতে তারিন ও রিফাত একে অপরকে জড়িয়ে ধরে আছে। কেউ কোন কথা বলছে না। মন দিয়ে একে অপরের শরীরের স্পর্শ অনুভব করছে। তারিন রিফাতের বুকে মাথা রেখে ভাবছে, যেভাবেই হোক আশিকের আসল রূপ সবার সামনে আনতেই হবে। কিন্তু সেটা রিফাতের আড়ালে। রিফাত আশিক কে সহ্য করতে পারে না। রিফাত চায় না আমাদের মাঝে আশিক নামটা ও আসুক। অবশ্য এটাই স্বাভাবিক। কারণ রিফাত কখনো চাইনি অতীতের কালো ছাঁয়া আমার বর্তমান জীবনে সুখের বাধা হয়ে দাঁড়াক।

তারিনের ভাবনার ছেদ পড়লো রিফাত কোলে নেওয়াতে। তারিন অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো – ‘এখন কোলে নিলে কেন?’
– ‘তোমাকে এভাবে চুপ করে থাকতে দেখে আমার ভালো লাগছিলো না।

তারিন আর কোন কথা বলেনি। রিফাত তারিন কে বিছানায় শুইয়ে দিল।

৪০.
সকালে তারিনের ডাকে ঘুম ভেঙে যায় রিফাতের। রিফাত কে জাগিয়ে তোলে তারিন আয়শা বেগম এর সাথে রান্না করতে চলে যায়। রিফাত ফ্রেশ হয়ে অফিস যাওয়ার জন্য রেডি হয়। আজকে অফিসে একটা মিটিং আছে। তাই তাড়াহুড়ো করে খাওয়া শেষ করেই অফিসের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে যায় রিফাত। আরিয়ান খাওয়া শেষ করে রুমে চলে যায়। তারিন নিজের সব কাজ শেষ করে আরিয়ান এর ঘরে দিকে যায়। দরজার বাহিরে দাঁড়িয়ে বলল – ‘আরিয়ান ভাইয়া আসবো।’

আরিয়ান সামনে তাকিয়ে দেখে তারিন দাঁড়িয়ে আছে। আরিয়ান বলল – ‘ওহ্, তারিন তুমি। হ্যাঁ এসো।’
– ‘ভাইয়া আপনার একটা হেল্প আমার খুব প্রয়োজন।’

আরিয়ান অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো – ‘আমার কী হেল্প প্রয়োজন তোমার?’
– ‘আগে আমাকে কথা দিতে হবে এই কথাটা কাউকে বলবেন না।’
– ‘আচ্ছা ঠিক আছে কাউকে বলবো না।’
– ‘আপনার আর রিফাতের ফ্রেন্ড ইরা, উনার নম্বর টা আমাকে একটু দিবেন প্লিজ।’
– ‘ইরা’র নম্বর দিয়ে তুমি কী করবে।’
– ‘উনার সাথে আমার কিছু কথা আছে।’

আরিয়ান আর কোন কথা না বলে নম্বর দিয়ে দিল। তারিন নম্বর নিয়ে নিজের ঘরে চলে এলো। ঘরে এসে সেই নম্বরে ফোন দিল। ওপাশ থেকে একটা মেয়েলি কন্ঠে ‘হ্যালো’ বলল।
তারিন বলল – ‘আমি তারিন। রিফাতের স্ত্রী।
ইরা খুব সহজেই বুঝে গেল এটা কালকের সেই মেয়েটা। ইরা বিরক্তি নিয়ে বলল – ‘আমাকে ফোন দিয়েছেন কেন?’
– ‘আসলে কালকের ব্যাপারটা নিয়ে আমি দুঃখীত। আমি সরি বলতেই ফোন দিয়েছি।’

এই সরি শব্দটায় এক অদ্ভুত মায়া কাজ করে। শরীরে হেব্বি রাগ থাকার পরেও এই সরি শব্দটা শুনলে বুকটা কেঁপে উঠে। তার উপর মায়া জন্মে যায়। তারিন যেহেতু নিজের ভুল বুঝতে পেরেছে তাই ইরা আর রাগ করে থাকতে পারলো না। মুহূর্তের মধ্যেই সব রাগ শেষ হয়ে গেল। ইরা একটু হাসি দিয়ে বলল – ‘হুম ঠিক আছে ভাবী।’

ভাবী শব্দটা শুনে তারিন খুব সহজেই বুঝে গেল ইরা আর ওর উপর রেগে নেই।
তারিন বলল – ‘আমি একটু আপনার সাথে দেখা করতে চাই।’
– ‘ঠিক আছে। কোথায় দেখা করবেন বলুন।’
– ‘আমি তো বেশি কিছু চিনি না। কিন্তু রিফাত কে না জানিয়ে দেখা করতে হবে।’

ইরা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো – ‘রিফাত কে না জানিয়ে কেন?’
– ‘আপনার সাথে খুব দরকারি কিছু কথা বলবো। যা রিফাত জানতে পারলে সমস্যা হবে। শুধু রিফাত নয় অন্য কাউকে ও বলবেন না। এটা শুধু আমার আর আপনার মধ্যে থাকবে।’
– ‘আচ্ছা ঠিক আছে। আপনাদের বাড়ি থেকে কিছুটা দূরে একটা রেস্টুরেন্ট আছে। যেটা রিফাতের অফিসের উল্টো দিকে। আমরা সেখানেই দেখা করবো।’
– ‘ওকে তাহলে বিকেলে আমি সেখানে চলে যাবো।’

ফোন কেটে দিয়ে তারিন চুপ করে বসে রইলো। এখন শুধু বিকেল হওয়ার অপেক্ষা।

চলবে………..?

বিঃদ্রঃ ভুলত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here