পার্থক্য পর্ব-৩

0
3299

পার্থক্য

৩য় পর্ব

#রিফাত_হোসেন।

রিফাতের এভাবে তাকিয়ে থাকা তারিন কিছুটা হলেও বুঝতে পেরেছে । তারিন মনে মনে হাসতে লাগলো।
তারপর যা বলল তা শুনে রিফাত ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলো।

তারিন বলল- ‘ আপনি তো মিয়া খুব লুচ্চা।’

তারিনের কথা শুনে রিফাত হা করে তাকিয়ে রইলো । মুখ দিয়ে কোন কথা বের হচ্ছে না। তারিন এইরকম কিছু বলবে রিফাত কখনো ভাবেনি। তবুও রিফাত নরম কন্ঠে বলল – ‘আপনি এসব কী বলছেন।’

– ‘যেভাবে আমার দিকে তাকিয়ে ছিলেন তাতে সবাই এটাই বলবে।’
– আমি মোটেও আপনার দিকে তাকিয়ে ছিলাম না।
– ‘দেখলাম তো সেই কখন থেকে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন।’
– ‘না মানে….।’
– ‘হয়েছে আর মানে বলতে হবে না।’

রিফাত আর কিছু বলল না। এভাবে যে ধরা পড়ে যাবে ভাবেনি রিফাত।
দু’জনেই চুপ করে রইলো। রিফাত লজ্জায় আর তারিনের দিকে তাকাতে পারছে না। বয়স্ক লোকগুলো বসা থেকে উঠে তাদের গন্তব্যের দিকে হাঁটা শুরু করলো।
রাত যত গভীর হচ্ছে চারদিকে আরও চুপচাপ হয়ে যাচ্ছে।
রিফাত মনে মনে ভাবছে এভাবে তো চুপ করে থাকা যায় না। পাশে এত সুন্দর একটা মেয়ে বসে আছে, কিন্তু কথা বলতে পারছে না। কী দিয়ে কথা শুরু করবে কিছুই বুঝতে পারছে না।
কিছু বলতে চেয়েও কিছু বলতে পারছে না। আবার যদি লুচ্চা বলে এই ভয়ে চুপ করে রইলো।
কিন্তু রিফাত কে অবাক করে দিয়ে তারিন জিজ্ঞেস করলো,- ‘আপনার বাসায় কে কে আছে?’

রিফাত খুব স্মার্টলি উত্তর দিলো,- ‘আমি, বাবা-মা আর একটা ছোট ভাই। আপনার বাসায় কে কে আছে?’

– ‘আমি আর বাবা-মা।
– ‘ওহ্।’
– ‘রংপুর কোথায় যাবেন গান করতে।’
– ‘ (………)জায়গায়।’

রিফাত জায়গায়র নাম বলাতে তারিন খুব খুশি হয়ে বলল,- ‘আরে আমার বাসা ও তো ওখানে।’

– ‘ওহ্।’
– ‘এভাবে চুপ করে বসে থাকতে ভাল লাগছে না, একটা গান শোনান তো।
– ‘কী গান শুনবেন?’
– ‘আপনার সব থেকে পছন্দের গানটাই শোনান।
– ‘ওকে।’

তারপর রিফাত গিটার হাতে নিয়ে গান শুরু করলো।

“নীর ঘুম চোখ জানালায়, আমি নিজেকে শোনাই নিজের গান।”
“স্বপ্নরা জেগে থাক..।”
“মনের ভিতর চলছে তুফান…. তুফান…।”
“অগোছালো সব আশাগুলো জ্বল নিবু নিবু শত তারা..গুলো চোখে চোখ রেখে যায় বহুদূরে”
“জমে থাকা চিৎকারের……”

রিফাত গান গাইছে, তারিন খুব মন দিয়ে গান শুনছে। যেভাবে তাকিয়ে আছে মনে হচ্ছে তারিন নিজেই এখন লুচ্চা হয়ে গেছে।
তবুও তারিনের খুব ভালো লাগছে। এইরকম একটা মানুষের সাথে পরিচিত হতে পেরে তারিন খুব খুশি হয়েছে। তারিন মনে মনে ভাবছে, “দু’টো মানুষের মাঝে কতটা পার্থক্য। যাকে ভালবেসে গ্রামে থেকে বাবা-মা কে মিথ্যে কথা বলে শহরে এলাম শুধু একটাবার দেখা করার জন্য। আজ সেই আমাকে এভাবে ধোঁকা দিলো। সে আমাকে ভালবাসেনি, আমার শরীর কে ভালবেসেছে। আচ্ছা আশিক কী সব ভুলে গেছিলো।
আমি আশিক কে কতটা ভালবাসি, সেটা কী আশিক ভুলে গেছে। ওকে তো আমি জীবনের থেকেও বেশি ভালবাসতাম।
তাহলে কেন আশিক আমার সাথে এইরকম করলো। কেন আমার ভালবাসাটা নিয়ে এভাবে খেলা করলো। কী অপরাধ ছিল আমার।

সত্যি এই পৃথিবীতে কত ধরণের মানুষ আছে। যে ছেলে আমাকে ভাল করে চিনেও না, সেই ছেলে আমাকে এত সাহায্য করছে। আমার সাথে এই শীতের রাতে বসে আছে। রিফাত ইচ্ছে করলেই বাড়িতে চলে যেতে পারতো। শুধু আমার জন্য রিফাত বাড়িতে না গিয়ে এত কষ্ট করছে।
মানুষ চিনতে এতটা ভুল করলাম আমি।
তারিন নিজেকে নিজেই গালাগালি করছে। কেন যে ওই মানুষ রূপে পশুর কথাতে এই শহরে এসেছিলাম?


রিফাতের গান শেষ হয়ে গেছে। তারিনের দিকে তাকিয়ে দেখে অন্যমনস্ক হয়ে আগুনের দিকে তাকিয়ে আছে। মনে হচ্ছে একটা ঘোরের মধ্যে আছে। খুব মন দিয়ে কিছু নিয়ে চিন্তা করছে। রিফাত কয়েকবার ডেকেছে, কিন্তু তারিন কোন সারা দেয়নি। তারপর একটু জোরে ডাক দিতেই তারিনের ঘোর কেঁটে গেলো। তারিন অবাক হয়ে রিফাতের দিকে তাকিয়ে রইলো।

রিফাত বলল,- ‘কী হলো এত মন দিয়ে কী ভাবছিলেন?’
– ‘না মানে একটু বাড়ির কথা মনে পড়ে গেছিলো।’
– ‘তার মানে আপনি আমার গান শোনেন নাই?’
– ‘না শুনবো না কেন? আপনার গান শুনেই তো অন্য রাজ্যে হারিয়ে গিয়েছিলাম।’

রিফাত তারিনের কথায় চমকে উঠলো। বুঝতে পারলো না তারিন কোন রাজ্যে হারিয়ে যাওয়ার কথা বলছে। তাই তারিনকে জিজ্ঞেস করলো, – ‘কোন রাজ্যে হারিয়ে যাওয়ার কথা বললেন?’
– ‘সে আপনি বুঝবেন না।’
– ‘ওহ্।’
– ‘আপনার গানটা খুব সুন্দর হয়েছে।’
– ‘ধন্যবাদ। আচ্ছা, আপনি এখনও বললেন না আপনার কী হয়েছিল? কেন আপনি ঢাকায় এসেছেন? আর কে আপনাকে মারতে চায়?’

রিফাতের কথা শুনে তারিন নীরব হয়ে গেলো। একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল,- ‘ আজ থেকে একবছর আগে ফেসবুকে একটা ছেলে রোজ ম্যাসেজ দিয়ে বিরক্ত করতো। দু একবার ব্লক ও দিয়েছিলাম। কিন্তু কোন লাভ হয়নি। আবার অন্য আইডি দিয়ে ম্যাসেজ দিতো। ম্যাসেজ দিয়ে শুধু বলতো আপনার ফ্রেন্ড হতে চায়। ছেলেটা দেখতেও তেমন খারাপ ছিলো না। তাই আমিও রাজি হয়ে গেলাম। তারপর থেকে ওর সাথে প্রতিদিন কথা হতো। খুব ভাল ববন্ধুত্ব হয় আমাদের মাঝে।
আস্তে আস্তে বন্ধুত্ব টা ভালবাসায় পরিনত হয়। কিছুদিন পর ও নিজে আমাকে প্রপোজ করে। যেহেতু আমিও ওকে ভালবেসে ফেলেছি, তাই আমি আর না করিনি। তারপর থেকে আমাদের ভালবাসা শুরু হয়। মাঝে মাঝে আমরা দেখা করতাম।
আশিক নিজেই আমাকে দেখার জন্য ঢাকা থেকে গ্রামে যেতো।পাশের গ্রামে আমার খালার বাসা। ওখানে আমরা দেখা করতাম। সারাদিন দু’জনে একসাথে ঘুরতাম। সন্ধ্যাবেলায় নদীর পাড়ে দু’জনে বসে থাকতাম। আমি ওর কাধে মাথা রেখে মাঝিভাই দের গান শুনতাম। খুব ভালই যাচ্ছিলো আমাদের দিনগুলো। হঠাৎ একদিন ওর খুব শরীর খারাপ হয়। আমার সাথে দেখা ও করতে পারছিল না। কোন উপায় না পেয়ে আমি বাধ্য হয়ে ঢাকায় আশিকের বাড়িতে যাই। কিন্তু সেখানে গিয়ে দেখি সব কিছু মিথ্যে, আশিকের কিছুই হয়নি। সব কিছু ছিলো আমাকে ফাঁদে ফেলে আমার শরীর ভোগ করার মিথ্যে নাটক। তারপর যখন আশিক একটু একটু করে আমার কাছে আসার চেষ্টা করে। তখন আমি কাচের জগ দিয়ে ওর মাথায় খুব জোরে আঘাত করে পালিয়ে আসি। তারপর পর কী হলো সব তো জানেনই।

এতক্ষন রিফাত সব কিছু মনোযোগ দিয়ে শুনছিল। রিফাতের মন ও খারাপ হয়ে গেলো। রিফাত তারিনকে বলল,- ‘এরা কী মানুষ? ধিক্কার জানাই এইসব মানুষদের, যারা ভালবাসা নামক মিথ্যে নাটক করে মানুষকে ধোঁকা দেয়।

কিন্তু রিফাতের একটা বিষয় ভাবাচ্ছে।তাই তারিনকে জিজ্ঞেস করলো, – ‘আপনি বলছেন, ওই ছেলেটির মাথায় আঘাত করেছেন।তারপর আশিক কী করলো
– ‘ও আর কী করবে। যেভাবে মেরেছি, মাথা দিয়ে রক্ত বের হয়ে গেছে। তারপর মাটিতে পরে অজ্ঞান হয়ে গেছে।

এই কথা শোনার পর রিফাত অবাক হয়ে তারিনের দিকে তাকিয়ে রইলো।

তারিন বলল, – ‘কী হলো আপনি এভাবে তাকিয়ে আছেন কেন?’
– ‘আপনার মাথায় কী কোন বুদ্ধি নেই।’
– ‘এই কথা বললেন কেন?’
– ‘আরে এখন যদি ছেলেটা মরে যায়।’
– ‘আরে কিছু হবে না।’
– ‘আপনি বুঝতে পারছেন।মাথায় আঘাত করেছেন, এতে ওনার মৃত্যু ও হতে পারে।’
– ‘আমি কী করবো বলুন। ওকে না মারলে তো আমার জীবন টা শেষ হয়ে যেত।’
– ‘তাই বলে এভাবে মারবেন।’
– ‘তখন কী এত কিছু ভেবে মেরেছি নাকি। সামনে যা পেয়েছি, তা দিয়ে নিজের সব শক্তি দিয়ে মাথায় আঘাত করেছি।’
– ‘হু ভাল করছেন।’

তারিন নিজেকে শান্তনা দিতে পারলেও মনে মনে খুব ভয় পাচ্ছে। আশিক কে নিজের মন থেকে এখনও সরাতে পারছে না তারিন। বার বার শুধু আশিকের কথা মনে পড়ছে। খুব কষ্ট হচ্ছে তারিনের।
কিন্তু কিছু করতে পারছে না। ভিতর টা বার বার কেঁদে উঠছে। পাশে রিফাত থাকাতে মন খুলে কাঁদতে ও পারছে না।

রাত প্রায় ৩ টা বেজে গেছে। তারিন চুপ করে বসে আছে। রিফাত দোকানদারের সাথে কথা বলছে।
দোকানদারের সাথে কথা বলে তারিনের কাছে আসলো রিফাত।
তারপর বলল, – ‘দোকানদারের সাথে কথা বললাম।পাশেই তার বাড়ি। সেখানে শুধু তার স্ত্রী থাকে। আপনি তার কাছে গিয়ে শুয়ে পরুন।’
– ‘আর আপনি।’
– ‘ আমি এখানেই থাকি।’
– ‘সেটা কী করে হয়। আপনি এখানে শীতে কষ্ট করবেন। আর আমি ঘরে গিয়ে শুয়ে পরবো।
– ‘আমার কোন অসুবিধা হবে না।’
– ‘না, আমিও এখানেই থাকবো।’
– ‘এত শীতে থাকতে পারবেন।’
– ‘এতক্ষন যখন পেরেছি, বাকি রাত টা ও পারবো।’

রিফাত আর জোর করলো না তারিন কে। দোকানদারের সাথে আড্ডা দিতে দিতে ভোর হয়ে গেলো। সকালের দিকে গাড়ি চলতে শুরু করলো। দোকানদার রিফাত আর তারিন কে বাসে উঠিয়ে দিলো। বাস দ্রুত গতিতে চলতে শুরু করলো।
কিছুক্ষন পর তারিন জানালা কিছুটা খুলে দিলো। বাহির থেকে ঠান্ডা হাওয়া এসে দু’জনের শরীরে কাঁপুনি দিয়ে উঠলো। তারিন তবুও জানালা বন্ধ করছে না। রিফাতের খুব শীত করছে, কিন্তু কিছু বলছে না। বাতাসে তারিনের চুলগুলো রিফাতের মুখে এসে পড়েছে। রিফাত হাত দিয়ে চুল না সরিয়ে সেভাবেই বসে রইলো।
তারিনের চুলের ঘ্রাণ রিফাত কে পাগল করে দিয়েছে। এক মনে চুলের ঘ্রাণ নিতে লাগলো।
তারিন ও বাহিরে দিকে তাকিয়ে আছে। তারিন বুঝতে পারেনি ওর চুলগুলো রিফাতের মুখে এসে পড়েছে।
হঠাৎ পিছনের সিটে বসা একটা লোক বলল, – ‘দাদা জানালাটা বন্ধ করে দিন না।

লোকটার কথাতে তারিন রিফাতের দিকে তাকালো। আর তাকিয়ে দেখে ওর চুলগুলো রিফাতের মুখে এসে পড়েছে। তারিন তাড়াতাড়ি করে চুলগুলো সরিয়ে নিলো।

রিফাত পিছনের সিটে বসা লোকটাকে বলল, – ‘আমরা আমাদের সিটের জানালা খুলে হাওয়া খাচ্ছি তাতে আপনার কী?’

রিফাতের কথা শুনে লোকটা
তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠলো।
তারপর বলল, – ‘এতই যখন হাওয়া খাওয়ার ইচ্ছে, তাহলে এখানে না থেকে গাড়ির ছাদে উঠে হাওয়া খান গিয়ে। যত্তসব পাগলের দল।’

লোকটার কথা শেষ হতেই তারিন জানালা আটকে দিয়ে মিটমিট করে হাসতে লাগলো।

রিফাত মনে মনে লোকটা কে গালি দিতে লাগলো। এই লোকটার জন্য শান্তিময় চুলের ঘ্রাণ টা ও নিতে পারলাম না। রিফাত আর কিছু না বলে চুপ করে রইলো। কিছুক্ষন পর তারিন রিফাতের কাধে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়লো।
সারারাত জেগে ছিলো বলে তারিনকে আর ডাকলো না রিফাত।
কিছুক্ষনের মধ্যে রিফাত ও ঘুমিয়ে পড়লো।

চলবে……?

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here