উপন্যাসঃ পাহাড়ে মেঘের ছায়া
পর্ব – ১২
(নূর নাফিসা)
.
.
১৪.
দুপুরের শেষ দিকে অর্থাৎ বিকেলের শুরুতে বৃষ্টির সমাপ্তি ঘটলো। পুরোটা সময় আজ তাবুতেই কাটাতে হয়েছে সবাইকে। বৃষ্টি শেষে ভেজা প্রকৃতির সৌন্দর্য উপভোগ করতে তাবু থেকে বেরিয়ে এলো সবাই। আকাশ বৃষ্টির কাছে এলো।
– তোমার ফ্রেন্ডরা কোথায় আছে?
– কেন?
– কেন আবার! তোমাকে এগিয়ে দিয়ে আসবো।
– জানি না আমি, তারা কোথায় আছে!
– জানো না মানে! কল করে জানোনি?
– ফোন নেই আমার কাছে।
– এখানে অন্যদের সবার কাছেই ছিলো। আর আমার কাছেও চাইতে পারতে! এই নাও, ফোন করো।
বৃষ্টির তো এখান থেকে যেতেই ইচ্ছে করছে না! এই আকাশ আবার হাতে ফোন ধরিয়ে দিলো! এখন কি করা যায়!
তার ফোন তো অফ করা, তাই বৃষ্টি তার নিজের নম্বরে ডায়াল করলো। বারবার বলছে সংযোগ দেয়া সম্ভব না।
– ফোন বন্ধ।
– অন্য জনের কাছে দাও।
– আর কারো নম্বর জানা নেই।
– তোমার নিজের ফোনে দাও। সেটা তো তোমার ফ্রেন্ডের কাছেই।
– সেদিন কথা বলে আমারটা অফ করে দিতে বলেছিলাম। বাবা-মা যাতে কিছু না জানতে পারে।
– হোয়াট! এখন যাবে কিভাবে!
– আপনাদের সাথে থাকবো। আর তারা হয়তো ঢাকা ফিরে গেছে। আজ আমাদের ঢাকা ফেরার কথা ছিলো।
– এই মতলবে আছো তাহলে! ফ্রী তে থাকা খাওয়া পাচ্ছো, বেশ আরামে আছো, তাই যেতে চাচ্ছো না।
– কি মানুষরে বাবা! খায়িয়ে আবার খোটা দেন! হিসাব করে রাখেন, ঢাকায় ফিরে পরিশোধ করে দিবো।
– তুমি এখানে থাকতে পারবে না। বাবার নম্বর তো জানা আছে, বাবাকে বলো এসে নিয়ে যেতে।
– কেন! আমার তো কোনো অসুবিধা হচ্ছে না।
– কিন্তু আমাদের হচ্ছে।
– আপনার সাথে থাকি নাকি! যে আপনার অসুবিধা হচ্ছে! অথৈ আপু, ঝুমুর আপু তোমাদের কি কোনো অসুবিধা হচ্ছে আমার সাথে থাকতে?
বাকি যারা কথা শুনছে তারা কোন উত্তর না দিয়ে মিটিমিটি হাসছে। বৃষ্টি আবার বললো,
– দেখেছেন, ওদের কোন সমস্যা হচ্ছে না।
– ওদের সমস্যা না হলেও তুমি থাকতে পারবে না।
রিজভী বলে উঠলো,
– থাক না আকাশ। গার্লফ্রেন্ড কে কেউ এভাবে তাড়িয়ে দেয়!
সবাই হাহাহোহো করে হেসে উঠলো। আকাশ রেগে তাকালো রিজভীর দিকে।
– আর একবার এসব উল্টাপাল্টা কিছু বললে আমি তোদের সাথে এক মুহুর্তের জন্যও থাকবো না।
সবাই চুপ হয়ে গেল। আকাশ বৃষ্টিকে উদ্দেশ্য করে বললো,
– তুমি তোমার বন্ধুদের কাছে কিভাবে যাবে তা তুমিই জানো। কিন্তু এটা ক্লিয়ার, আমাদের সাথে থাকতে পারবে না।
আকাশ চলে গেলো সেখান থেকে। বৃষ্টি ভেংচি কেটে বিড়বিড় করে বললো,
– উউহ! আমাদের সাথে থাকতে পারবে না! যেন তার মাথায় চড়ে বসে আছি যে, আমাকে সহ্য হচ্ছে না! ইডিয়ট একটা!
একটু পর তারা সবাই একসাথে জংগল থেকে বেরিয়ে পাহাড়ের দিকে ঘুরতে এলো। মাঝারি আকৃতির পাহাড়ের চূড়ায় উঠে পূর্বাকাশে খুব সুন্দর রংধনু দেখে সবাই আনন্দিত হলো। বৃষ্টি খুশিতে লাফানো শুরু করেছে। লাফানোর ফলে অসমতল পাহাড়ে উঁচুনিচুতে পা পিছলে পড়ে যেতে নিলে পাশে থাকা আকাশের টিশার্ট ধরে ফেললো। আকাশ বিরক্তিকর দৃষ্টিতে তাকালো বৃষ্টির দিকে। বৃষ্টিও মন খারাপ করে আবার তাকে ছেড়ে দিয়ে অন্যদিকে দাড়ালো। রংধনুর জন্য আকাশটা খুব সুন্দর দেখাচ্ছে। সবাই যার যার ফোনে রংধনুর সাথে ছবি তোলায় ব্যস্ত! আকাশও রংধনুর ছবি তুলছে। বৃষ্টির কাছে ফোন না থাকায় ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও ছবি তুলতে পারছে না। সে পাহাড়ের একপাশে এসে বসে পড়লো এবং দু’পায়ের হাটু ঝাপটে ধরে রংধনুর দিকে তাকিয়ে রইলো। মনটা খারাপ থাকলেও রংধনুর দিকে তাকিয়ে মন ভালো হয়ে গেছে। তাই মুখে মিষ্টি হাসি ফুটিয়ে রংধনুর সৌন্দর্য উপভোগ করতে লাগলো বৃষ্টি। একটু পর বৃষ্টির কাছে এসে অভ্র বসে পড়লো।
– মন খারাপ নাকি বৃষ্টি! সবাই তো এদিক সেদিক ঘুরে বেড়াচ্ছে, তুমি এখানে বসে আছো কেন?
– রংধনু নিয়ে একটা কবিতা শুনান দেখি, কবি ভাই!
– হা হা হা! এখন উপভোগ করার সময়। আগে উপভোগ করি পরে কবিতা বানাবো।
– চেষ্টা করলে অনেক বড় কবি হতে পারবেন।
– থাক! প্রতিযোগী হয়ে উঠলে বড় বড় কবিরা আবার আমার প্রতি রেগে যাবে।
– হিহিহি….
– রংধনু তো মিশে গেলো । চলো, তাবুতে ফিরে যাবো।
– আচ্ছা।
সূর্যাস্তের সময় তারা তাবুতে ফিরে এসেছে। বৃষ্টি হওয়ায় পরিবেশটা খুব ঠান্ডা ঠান্ডা লাগছে। মুরগির রোস্ট রান্না করা আছে সেটা দিয়েই রাতের খাবার হয়ে যাবে। কুড়িয়ে রাখা শুকনো পাতার সাহায্যে এখন শুধু ভাত রান্না বসিয়েছে। তাবুর মাঝখানে জ্বালিয়ে রাখা আগুনের চারপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে সবাই বসে আছে। অথৈ বলে উঠলো,
– রিজভী একটা গান শুনা।
– টাকা দে।
– ঘুষখোর কোথাকার! ঘুষ খাইলে তোর গলায় পেটেসহ সর্বাঙ্গে সমস্যা দেখা দিবে।
– এমন বদ দোয়া দিলে গান কেন! গানের গা ও শুনতে পাবি না।
– যা, শুনবো না তোর গান। তোর গান নিতুকেই শুনা। আকাশ আর রওনক গেয়ে শোনা।
আকাশ জবাব দিলো,
– মুড নাই!
রওনক বললো,
– সবসময় আমাদের গান শুনতে ইচ্ছে করে কেন! তোরা গেয়ে শোনা আজ।
অথৈ বিরক্তি নিয়ে বললো,
– বাবারে বাবা! এক এক জনের কি দাপট! মনে হয় বিশ্বের শ্রেষ্ঠ গায়ক!
সিমি বললো,
– শুধু শুধু কেন বলতে যাস তাদের! আমাদের সামনে গান গাইলে তাদের প্যাস্টিজে লাগবে। আরেক কুখ্যাত কবি! সারাক্ষণ ভাবনায় বিলীন থাকে!
– দোস্ত বিরক্ত করিস না তো! একটা লাইন মেলাতে পারছিনা এমনিতেই!
আজ বৃষ্টি অনেক চুপচাপ! সিমি বৃষ্টিকে উদ্দেশ্য করে বললো,
– বৃষ্টি গান গাইতে পারো না?
– গান কে না গাইতে পারে আপু! কেউ প্রকাশ্যে, কেউ গোপনে! কিন্তু গান সবাই গাইতে পারে।
– বাহ! এখন তুমি কিভাবে গাও? প্রকাশ্যে নাকি গোপনে?
– আমি পরিস্থিতির স্বীকার।
– আচ্ছা, তাহলে এখন বললে গেয়ে শুনাবে?
– কি ধরনের গান শুনতে চাও?
– সেটা তুমিই ডিসাইড করে নাও, আমাদের কি ধরনের গান শুনাতে চাও!
বৃষ্টি গান গাইতে শুরু করলো,
তোর মন পাড়ায়
থাকতে দে আমায়
আমি চুপটি করে দেখবো
আর ডাকবো ইশারায়
তুই চাইলে বল
আমার সঙ্গে চল
ওই উদাস পুরের বৃষ্টিতে
আজ ভিজবো দুজনায়
অভিমানী মন আমার
চায় তোকে বারেবার
তাই বলি আয় রে ছুটে আয়
তোর মন পারায়,থাকতে দে আমায়
আমি চুপটি করে দেখবো
আর ডাকবো ইশারায়!
সম্পূর্ণ গান বৃষ্টি আকাশের দিকে তাকিয়ে গাইছে। এখানে উপস্থিত সবাই বিষয়টি লক্ষ্য করেছে। আকাশও বুঝতে পেরেছে তাই গানের মাঝখানেই উঠে অন্ধকারে অন্য পাশে চলে গেছে। বৃষ্টির গান শেষ হলে সবাই তার কণ্ঠের প্রশংসা করলো। সবাই মুগ্ধ! সিমি বলে উঠলো,
– বাহ! খুব সুন্দর গাও তুমি। আমার মনে হচ্ছিলো কোন আর্টিস্ট এর গাওয়া গান শুনছিলাম!
– বেশি বললে আবার গলে যাবো!
সবাই একসাথে হেসে উঠলো। সিমি হেসে আবার বললো,
– বেশি বলছি না। সত্যিই অসাধারণ গেয়েছো তুমি। প্রোগ্রামে পার্টিসিপ্যান্ট করো নিশ্চয়ই?
– আগে করতাম। ছোট বেলায় গানের ক্লাসে ভর্তি করিয়েছে বাবা। অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত বিভিন্ন প্রোগ্রামে পার্টিসিপ্যান্ট করেছি। এরপর বাবা-মা নিষেধ করায় আর কোথাও পার্টিসিপ্যান্ট করিনি।
– নিষেধ কেন করলো?
– গান গাওয়া ভালো না। বাবা মা আগে সাপোর্ট করেছে কিন্তু একটু ধার্মিক হওয়ার পর নিষেধ করেছে। ভালো না যেহেতু তাই সেদিকে অগ্রসর না হওয়াটাই ভালো।
– অহ, আচ্ছা!
ঝুমুর রিজভীকে বললো,
– দেখলি তো বয়সে ছোট মেয়েটা কত সুন্দর গেয়েছে! আর তোদের গান এর ধারে কাছেও ঘেষবে না! তোরা শুধু ছাগলের মতো ভ্যা ভ্যা ই করতে পারছ!
– ভ্যা ভ্যা আমরা করি না তুই করছ, এই যে প্রমাণ দিছোস।
– হিহিহি…. আমাকে বলতে গিয়ে তো তুইও করলি!
এভাবে তারা দলবেঁধে একে অপরের সাথে ঝগড়া লেগে গেলো। কেউ হাসছে, কেউ মুখে বুলি ছুড়ছে! বৃষ্টি তাদের মাঝ থেকে উঠে অন্ধকারের দিকে চলে গেলো, যেদিকে আকাশ গিয়েছে। আগুনের আলোর আড়ালে এসে পূর্নিমার দেখা পেল বৃষ্টি! গাছের পাতার ফাকে টুকরো টুকরো ভাবে আকাশটা দেখা যাচ্ছে। সাদা মেঘ ভেসে বেড়াচ্ছে আকাশে আর চারিদিকে চাদের আলো ছড়িয়ে পড়েছে। আশেপাশে একটু চোখ বুলিয়ে অল্প আলোতে আকাশকে দেখতে পেল বৃষ্টি। আকাশ একটা গাছে হেলান দিয়ে চাদের দিকে তাকিয়ে আছে। বৃষ্টি দৃঢ় পায়ে আকাশের কাছে এসে দাড়ালো।
– এভাবে এখানে দাড়িয়ে আছেন কেন?
– তোমার কাছে জবাবদিহি করতে হবে না নিশ্চয়ই!
– হুম, হবে না।
– এখানে এসেছো কেন?
– আপনার সাথে সময় কাটাতে।
– আমার কাছ থেকে দূরে থাকবে।
– যদি না থাকি!
– বাবার আদুরে মেয়ে মনে হচ্ছে! সুতরাং জেদটা বাবার কাছেই দেখিয়ো। বাইরের কাউকে দেখিয়ো না। অনেক বিপদের সম্মুখীন হবে।
– এতো ভাবেন আমাকে নিয়ে!
এই মুহুর্তে বৃষ্টিকে পাগল মনে হচ্ছে আকাশের কাছে। আকাশ বুঝাতে চাইছে একটা আর মেয়েটা বুঝ নিচ্ছে আরেকটা! তাই আর কিছু না বলে আবার আকাশ পানে চেয়ে আছে। আর বৃষ্টি তাকিয়ে আছে গাছে হেলান দেয়া আকাশের দিকে। চাদের মৃদু আলোয় এই আকাশকে অনেক সুন্দর দেখাচ্ছে। এই ছেলেটার সবকিছু এতো ভালো লাগে কেন তার কাছে! ভেবে পায় না বৃষ্টি! নামটাও কেমন মিলে গেছে, আকাশ আর বৃষ্টি! ভাবতেই মুখে হাসির রেখা ফুটে উঠলো বৃষ্টির। আকাশ চাদের দিকে তাকিয়েই বুঝতে পারছে বৃষ্টি পলকহীন তাকিয়ে আছে তার দিকে। তাই বললো,
– এভাবে তাকাবে না আমার দিকে।
– কেন? তাকালে কি হবে?
– অনেক কিছু হয়ে যেতে পারে।
– যেমন?
– যেমন প্রেম হয়ে যেতে পারে।
– সমস্যা কোথায়?
– আমার এসব পছন্দ না।
– যদি বলি, ইতিমধ্যে প্রেম হয়ে গেছে!
আকাশ হেলান ছেড়ে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে বৃষ্টির দিকে তাকিয়ে বললো,
– কি বলেছো?
– প্রথম দিন থেকেই একটু একটু করে আমি প্রেমে পড়ে গেছি তোমার।
আকাশ আর কিছু না বলে খুব জোরে একটা থাপ্পড় বসিয়ে দিলো বৃষ্টির গালে। টাল সামলাতে না পেরে বৃষ্টি স্থির জায়গা থেকে কিছুটা পিছিয়ে গেলো আর গালে থাপ্পড় পড়ার সাথে সাথে মুখ থেকে একটি শব্দ বের হলো,
– ভালোবাসি!