উপন্যাসঃ পাহাড়ে মেঘের ছায়া
পর্ব – ১৩
(নূর নাফিসা)
.
.
আকাশ রেগে বললো,
– আর একবার এমন কিছু বললে খুন করে ফেলবো।
বিন্দু মাত্র ভয় না পেয়ে, অশ্রু ভেজা চোখে আকাশের দিকে তাকিয়ে বৃষ্টি বললো,
– তবুও বলবো, ভালোবাসি তোমাকে।
আকাশ বুঝতে পারছে না বৃষ্টি কেন এমন করছে! যদি সেটা আবেগ হয় তাহলে তার আবেগ কাটাতে হবে। এদিকে বৃষ্টির জেদ একবার যেহেতু পদক্ষেপ হাতে নিয়েছে, এই পাষাণের মন গলিয়েই ছাড়বে! সেও দেখতে চায় কিভাবে আকাশ সবাইকে অবহেলা করতে পারে! বৃষ্টিকে নিয়ন্ত্রণে আনতে আকাশ বললো,
– বৃষ্টি, থেমে যাও। এসব তোমার আবেগ। ভালোবেসো না আমাকে। আমি কখনো ভালোবাসতে পারবো না কাউকে।
– কেন পারবে না? কখনো বিয়ে করবে না? সন্যাসী হয়ে থাকবে? মানুষ একা বাস করতে পারে না আকাশ। জানিনা কীজন্য তুমি এমন হয়ে আছো। কিন্তু এই একঘেয়েমি বেড়াজাল থেকে বেরিয়ে আসো।
– বৃষ্টি, আর কিছু বলো না প্লিজ। আমি নিজেকে সামলাতে পারবো না। তোমার জীবন নিয়ে নিতেও আমি দ্বিধাবোধ করবো না। দয়া করে আমাকে উল্টাপাল্টা কিছু করতে বাধ্য করো না।
– আমিও দেখতে চাই তুমি কি করতে পারো। বারবার বলবো, আমি ভালোবাসি তোমাকে, আকাশ।
আকাশ আচমকা বৃষ্টির চুলের মুঠি ধরে একদম তার মুখের কাছে এনে বললো,
– শুধু শুধু আমাকে রাগিয়ে দিচ্ছিস কেন? বলেছি না আমি কাউকে ভালোবাসতে পারবো না। ভালোবাসার মানে তুই বুঝিস কিছু? ভালোবাসা কাকে বলে জানা আছে তোর?
– আমি তোমাকে বুঝি, তোমাকে জানি আর তোমাকেই চাই। আর কিছু বুঝতে ও জানতে চাই না। তুমি থাকলেই হবে আমার কাছে।
বৃষ্টি আকাশের চোখে তাকিয়ে কথা বলছে আর তার চোখ থেকে টুপটাপ পানি পড়ছে। আকাশের চোখও রাগে লাল হয়ে গেছে। আকাশ বৃষ্টিকে ধাক্কা দিয়ে মাটিতে ফেলে চলে গেলো তাবুর দিকে। বৃষ্টি সোজা হয়ে গাছের গোড়ায় হেলান দিয়ে মাটিতেই বসে রইলো। দু’পায়ের হাটু জড়িয়ে ধরে চাদের দিকে তাকিয়ে আছে। সাথে তার চোখে অশ্রুর ঝর্ণা বইছে। আজ প্রথম তার সাথে এমন হলো! কারো মন পরীক্ষা করতে গিয়ে তাকে আঘাত পেতে হলো!
এদিকে আকাশকে হনহনিয়ে তাবুর দিকে যেতে দেখে সবার মুখ চুপ হয়ে গেছে। ওর আবার কি হলো হঠাৎ! কেউই বুঝতে পারছে না কিছু। বৃষ্টিই বা কোথায়! সিমি জোর গলায় বৃষ্টিকে ডাকতে লাগলো। সিমির ডাকে বৃষ্টির ধ্যান ভাংলো। সে চোখমুখ ওড়না দিয়ে মুছে যথেষ্ট স্বাভাবিক হয়ে তাবুর দিকে গেলো। আগুনের আলোতে বৃষ্টির মুখটাও মলিন দেখাচ্ছে। সিমি জিজ্ঞেস করলো,
– কি হয়েছে, বৃষ্টি?
– কই! কিছু না আপু।
– এদিকে আসো।
– না আপু। আমার একটু খারাপ লাগছে। আমি ঘুমাবো।
– আচ্ছা, খাবার খেয়ে ঘুমাতে যাও।
– খেতে ইচ্ছে করছে না।
সিমি বারবার খেয়ে যাওয়ার জন্য বলছিলো কিন্তু বৃষ্টি তাবুতে চলে গেলো। একপাশে এসে কাথাটা টেনে গায়ে দিয়ে শুয়ে পড়লো বৃষ্টি। একটু পর আকাশ বেরিয়ে এলো তাদের তাবু থেকে। এখানে সবাইকে দেখলো বৃষ্টিকে ছাড়া। বৃষ্টি কি এখনো সেখানে আছে! আকাশ আবার সেই গাছের কাছে গেলো। বৃষ্টিকে না পেয়ে বন্ধুদের কাছে জিজ্ঞেস করলো,
– বৃষ্টি কোথায়?
ঝুমুর ঠাট্টা করে বললো,
– হঠাৎ বৃষ্টিকে খুজছিস! ব্যাপারটা কি!
– বেশি কথা না বলে যা জিজ্ঞেস করছি তার উত্তর দে।
– হুহ্! তাবুতে গিয়ে শুয়ে পড়েছে।
– খাওয়ার জন্য ডেকে আয়।
– খাবে না বলে দিয়েছে।
– আরেকবার ডেকে আয়।
আকাশের কথায় ঝুমুর এসে আবার ডেকে গেলো। বৃষ্টি ঘুমের ভান করে শুয়ে আছে, ঝুমুরের ডাকে আর কোন সাড়া দিলো না। ঝুমুর ফিরে এসে বললো ঘুমিয়ে পড়েছে। সিমি জিজ্ঞেস করেছিলো কি হয়েছে তাদের মাঝে। আকাশ বলেছে কিছুই হয়নি। তাদের মাঝে আবার কি হবে! আকাশও অল্প খাবার খেয়ে উঠে চলে গেলো। বাকিরা খাওয়াদাওয়া শেষ করে ঘুমিয়ে পড়লো। লুকিয়ে লুকিয়ে কেদে বৃষ্টি সারারাত পার করে দিলো। খুব কষ্ট লেগেছে তার। তার বাবা-মা ও আজ পর্যন্ত তার উপর হাত তুলেনি! আকাশ তার গায়ে হাত তুলেছে সেজন্য একটুও কষ্ট লাগতো না, যদি আকাশ তাকে একটু বুঝতে চেষ্টা করতো! মানুষ এতোটা পাষাণ কিভাবে হতে পারে!
১৫.
লোকগুলো নাফিসা আর মেঘকে নিয়ে নাফিসাদের বাসায় এলো। উঠুনে থেকে নাফিসার আম্মিকে জোরে জোরে ডাকতে শুরু করলো। নাফিসার আম্মি রোকসানা ঘর থেকে বেরিয়ে এলো। নাফিসা আর মেঘকে দেখে তিনি অবাক হলেন। কিন্তু কিছুই বুঝতে পারছেন না। লোকগুলো আশেপাশের লোকজনকেও ডেকে আনলো। কয়েক মিনিটের মধ্যে বাড়িতে এলাকার মেম্বারসহ লোকেদের ভীড় জমে গেছে। এসব দেখে রোকসানা জিজ্ঞেস করলেন,
– কি হয়েছে? আপনারা কি শুরু করেছেন এসব!
– শুরু আমরা করছি! আমাগো এলাকায় আইয়া পড়ছো! অসহায় বইলা থাকার জায়গা দিছি। এহন নিজের হুড়িরে দিয়া নোংরামি শুরু করছো!
– কি বলছেন এসব!
– এতোদিন ধইরা এই পোলারে বাড়িত রাখছো! কে জানে আর কি কি ঘটাইছো মা বেটি মিলা! যেই আশেপাশের লোক মন্দ বলা শুরু করছে বাড়ি থেইক্কা বাইর কইরা এহন দিন নাই রাইত নাই পাহাড়ে, রাস্তাঘাটে নোংরামি করায়! আইজ একটু আগে পাহাড় থেইক্কা নামছে। আমাগো দেইখা তারাতাড়ি দৌড়াইয়া আইছে আবার আন্ধাইরে মাঝ রাস্তায় জড়াজড়ি শুরু করছে! এতোদিন থাকছো থাকছোই! এহন এই এলাকা ছাড়ো। না হয় চুনকালি মাখাইয়া জলে ভাসায় দিমু।
নানান লোকের মুখে নানান কথা! কারটা রেখে কারটা শুনবে, মনে যে হানছে তীব্র ব্যাথা! রোকসানার বিশ্বাস হচ্ছে না এসব। কি যা তা বলে যাচ্ছে। তার মেয়ে এমন না। আর এই ছেলেটাকেও খারাপ ভাবেনি সে। কিন্তু এখন লোকেদের মুখ কিভাবে বন্ধ করবে! নাফিসা নিরবে কান্না করেই যাচ্ছে। আর মেঘ অনেক কথা বলতে চাচ্ছে কিন্তু তাকে কিছুই বলার সুযোগ দেয়া হচ্ছে না। সব বিবেচনা করে এলাকার মেম্বার বললেন, হয় এই মুহূর্তে মেঘ নাফিসাকে বিয়ে করে তার পুরো পরিবারের দায়িত্ব নিবে। আর না হয় চুনকালি মেখে তাদের এলাকা থেকে তাড়া করবে। রোকসানা স্তব্ধ হয়ে গেছে। নাফিসাও কান্না করেই যাচ্ছে। মেঘের মনে অন্যরকম এক ভয় কাজ করছে। অচেনা অজানা লোকজন, কাউকে নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা তার হাতে নেই এখন! সে তার জন্য তাদের এতো বড় সর্বনাশ হতে দিবে না। প্রয়োজনে এখন বিয়ে করবে সে। তাই রোকসানার পায়ের কাছে বসে পড়লো।
– আন্টি আমি নাফিসাকে বিয়ে করতে চাই। আন্টি, নাফিসাকে আমার হাতে তুলে দিবেন? কথা দিচ্ছি, বিন্দুমাত্র আচ লাগতে দিবো না তার উপর। কেউ আঙুল তুলে কথা বলতে পারবে না তার সাথে। আন্টি, আপনি অনুমতি দিবেন কি?
রোকসানা আঁচলে মুখ চেপে নিরবে চোখের পানি ফেলছে। এতোগুলো লোক দাড়িয়ে তামাশা দেখছে। ভাবতেও পারেনি তার জীবনে এমন সময়ও আসবে! খুব কঠিন গলায় তিনি বললেন,
– মেঘ যদি সম্পূর্ণ দায়িত্ব নিজে নেয়, তাহলে নাফিসার সাথে মেঘের এখন বিয়ে হবে।
– আমি সমস্ত দায়িত্ব নিবো।
মেঘ পায়ের কাছ থেকে উঠে দাড়ালো। নাফিসা দৌড়ে এসে তার মায়ের সামনে দাড়িয়ে বললো,
– আম্মি, কি বলছো এসব! আম্মি আমি এই ছেলেকে বিয়ে করবো না।
রোকসানা সাথে সাথে নাফিসার গালে একটা থাপ্পড় বসিয়ে দিয়ে বললো,
– তাহলে গিয়েছিলি কেন নোংরামি করতে! রাত ক’টা বাজে তুই বাড়ির বাইরে কেন! আর একটা কথাও বলবি না। আজ এখন তোর বিয়ে হবে মেঘের সাথে।
নাফিসা স্তব্ধ হয়ে গেছে। মায়ের মুখ থেকে এসব শুনবে ভাবতে পারেনি সে! মেম্বার পাশের গ্রাম থেকে কাজী এনে নাফিসা আর মেঘের বিয়ে পড়িয়ে দিলেন। আর পাড়ার লোকজন যেন তাদের নিয়ে উল্টাপাল্টা কিছু না বলে সেজন্য সবাইকে সতর্ক করে দিলেন। মেঘকেও সচেতন করে দিলেন যাতে পালিয়ে না যায়। দায়িত্ব যখন নিয়েছে, তা যেন ঠিকঠাকভাবে পালন করে। লোকজন চলে গেলো। এ বাড়িতে এখন দুজন ব্যাক্তি আছে। রোকসানা আর নাফিসা । পুরো বাড়ি স্তব্ধ হয়ে আছে। শুধু বাইরে ঝিঝি পোকার ডাক শুনা যাচ্ছে। অতিরিক্ত কোন শব্দ নেই। নাফিসা তার আম্মির রুমে এসে খাটে শুয়ে কান্না করে যাচ্ছে। সন্ধ্যা পর্যন্ত দিনটাকে খুবই ভালো লাগছিলো তার কাছে। মনে হচ্ছিলো তার জীবনের শ্রেষ্ঠ একটা দিন। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে আজকের দিনটা তার জন্য অলক্ষুণে। কি থেকে কি হয়ে গেলো সবটা ভাবনার বাইরে। বিয়ে পড়ানোর পর মেঘকে মেম্বার সাথে নিয়ে গেছে তার জন্মপরিচয় নেয়ার জন্য। মেঘ মেম্বারের কাছে পরিচয় দিয়েছে। আর অনুরোধ করে এটাও বলে দিয়েছে তার পরিবারকে যেন এখন কিছু না জানায়। হঠাৎ করে জানলে তার পরিবার মানবে না, তাই সে সুযোগ বুঝে সবটা জানাতে চায়। মেম্বারের সাথে কথা বলে মেঘ বুঝতে পেরেছে তিনি একজন ভদ্র ও জ্ঞানী লোক। সেখান থেকে ফিরে এসে দেখলো বারান্দায় খুটির সাথে হেলান দিয়ে রোকসানা বসে আছে। মেঘ কাছে এসে হাটু গেড়ে মাটিতে বসে পড়লো। রোকসানা বললো,
– ঘরে যাও।
– আন্টি, আমি কিছু কথা বলতে চাই। একটু শুনুন প্লিজ। সবটা লোকেদের ভুল ছিলো। বিপদে আপনারা আমাকে আশ্রয় দিয়েছিলেন সেজন্য আমি আপনাদের কাছে কৃতজ্ঞ। আপনি আমার মায়ের মতো। আজ মা পাশে থাকলেও আমি মাকে কথাগুলো বলতাম। এ বাড়িতে আসার আগেই পাহাড়ে, চা বাগানে নাফিসাকে আমি দেখেছি। প্রথম দেখার পরই তাকে ভালো লাগে খুব। তবুও আমি এক ধাপও এগিয়ে যাইনি তার কাছে। সেদিন শ্রীমঙ্গল ছেড়ে চলেই যাচ্ছিলাম। কিন্তু দেখুন ভাগ্যের কি পরিহাস!পাহাড় থেকে পড়ে আপনাদের বাসায় উঠতে হলো! এখানে আসার পর আমি নাফিসার প্রতি আরো দুর্বল হয়ে গেছি। এখান থেকে যাওয়ার পরও নিষেধ করা সত্ত্বেও নাফিসার সাথে পাহাড়ে, চা বাগানে দেখা করতাম। ভেবেছি কয়েকদিন পর ঢাকা ফিরে বাবা-মা কে বলবো আপনাদের বাসায় আসতে। আর আপনার সম্মতিতে নাফিসাকে আমাদের বাসার বউ করে নিতে। কিন্তু ঘটেছে অন্যকিছু! নাফিসা ইচ্ছে করে যায়নি আজ। সকালে বাজার থেকে নাফিসার সাথে ফেরার পথে বৃষ্টি নামলে আমার ফোন আর ওয়ালেট বাজারের ব্যাগে রাখি। আমি ভিজে রিসোর্টে ফিরে আসি। কিন্তু ওগুলো নিতে মনে ছিলো না। বিকেলে এগুলো ফেরত দিতেই নাফিসা পাহাড়ে যায়। সেখান থেকে নেমে টংয়ের দোকানে এক কাপ চা খেতে অনুরোধ করি। চা খেতে খেতেই দেড়ি হয়ে যায়। তাই নাফিসাকে এগিয়ে দিতে এ পথে আসি। আর ওই লোকগুলো যে আমাদের ফলো করে যাচ্ছে তা বুঝতে পারিনি। দয়া করে তাদের মতো আপনি ভুল বুঝবেন না আমাদের। ঘটনা এতোদূর এসে পৌছাবে ভাবতে পারিনি। ক্ষমা করা যায় না আমাকে?
– ক্ষমা কিভাবে করবো, অপরাধ করোনি তো! ভালোবাসা অপরাধ না। তবে ভালোবাসার নাটক করা অপরাধ। খুব বড় অপরাধ, যার ক্ষমা হয় না। আমার মেয়ের সাথে অন্তত ভালোবাসার নাটকটা করো না। লোকের সামনে তো বলেছো দায়িত্ব নিবে, এখন কি পিছু হাটতে চাইছো?
– কি বলছেন এসব! আমি পিছু হাটার জন্য দায়িত্ব নেই নি। আমার সর্বোচ্চ চেষ্টা আমি করবো। আপনি কি আমাকে মেয়ের জামাই হিসেবে মেনে নিয়েছেন?
দুজনের চোখেই পানি। রোকসানা মৃদু হেসে বললেন,
– আমার মেয়েটা খুব কঠিন। খুব জ্বালাতন করবে তোমায়। পারবে সামলাতে?
মেঘও মৃদু হেসে বললো,
– মায়েদের দোয়া থাকলে সন্তানের পক্ষে অবশ্যই সম্ভব।
– হাতমুখ ধুয়ে ঘরে যাও।