উপন্যাসঃ পাহাড়ে মেঘের ছায়া
পর্ব – ২৪
(নূর নাফিসা)
.
.
– হুম তার কারণটা এবার জানো। ওরা যে বাসায় থাকছে ওটা আমার বাসা মানে আমার বাবার বাড়ি। বাবার চাকরির বদলিতে আমার পরিবার ঢাকা থাকতেন আর হাই স্কুল থেকে রোকসানা আমার ফ্রেন্ড। কলেজ পর্যন্ত পড়েছি একসাথে এরপর রোকসানা আর পড়েনি। নাফিসার বাবা আছে ঢাকাতেই। নাফিসার বাবার নাম সৈকত মির্জা। তার বাবা মায়ের লাভ ম্যারেজ। রোকসানার ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষার কিছুদিন আগেই পালিয়ে বিয়ে করেছে তারা। যার ফলে রোকসানাকে তার পরিবার থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে। সৈকত তাকে নিজ বাসায় না নিয়ে ভাড়াটে বাসায় রেখেছে। বলেছিলো পরিবারকে ম্যানেজ করে বাসায় নিবে। একসময় সে জানায় পরিবার তাদের মেনে নিবে না তাই তাদেরকে ভাড়াটে বাসায়ই থাকতে হবে। রোকসানা এতে রাজি হয়েছে। সৈকত নিজ দায়িত্বে তাকে ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষা দিতে অনুপ্রাণিত করেছে। কিন্তু রোকসানা আর ভার্সিটিতে ভর্তি হয়নি। বিয়ের প্রথম বছরই তাদের কোলে নাফিসা এসেছে। নাফিসার নামটা তার বাবাই রেখেছে। মির্জা নূর নাফিসা। খুব আদর করতো মেয়েকে। আমি আমার শিক্ষাজীবন ঢাকাতেই শেষ করেছি। সেখানেই ভাড়াটে বাসায় থাকতাম আমিও। সেটা তাদের বাসা থেকে একটু দূরে ছিলো। দিনকাল তাদের ভালোই চলছিলো। সৈকত একটা কোম্পানিতে চাকরি করতো কিন্তু বেতন নাকি অল্প পেতো! এই অল্প উপার্জনে তাদের সুখের সংসার চলতো। মাঝে মাঝে সে তার নিজ বাড়িতে থাকতো আবার মাঝে মাঝে রোকসানার কাছে। এভাবে আট বছর কেটে যায়। পাচ বছর বয়সে নাফিসাকে কিন্ডারগার্টেনে ভর্তি করা হয়। সাত বছর বয়সে যখন ক্লাস টু তে পড়ে নাফিসা, হঠাৎ করেই সৈকতের এ বাড়িতে আসা বন্ধ হয়ে যায়! রোকসানা কল করে তাকে পায়না! সে বেশ চিন্তিত হয়ে পড়ে! তার বাসা সে চিনতো, বড়লোকের ছেলেই সে। যোগাযোগ বন্ধ হওয়ার দুদিন পরই নাফিসাকে নিয়ে স্কুল থেকে ফেরার পথে সে তার বাড়িতে যায়। বাড়ির গেইটে নক করতেই এক মহিলা বেরিয়ে আসে। বয়স তার চেয়ে বড়জোর চার পাচ বছর বেশি হবে! মহিলাটি বলে,
– কে আপনি? কাকে খুজছেন?
– জ্বি, এটা কি সৈকত মির্জার বাড়ি?
– হ্যাঁ।
– তিনি কি বাসায় আছেন?
– উনি বাবার সাথে একটু হসপিটালে গেছে।
– হসপিটালে কেন?
– চারদিন আগে তার একটা এক্সিডেন্ট হয়। পায়ে একটু আঘাত পেয়েছে ওটারই ট্রিটমেন্ট করাতে গেছে। আপনি উনাকে খুজছেন কেন?
– একটু দরকার ছিলো।
– তাহলে ভেতরে এসে বসুন। এসে পড়বে কিছুক্ষণের মধ্যে।
– আপনি কে হন উনার?
– আমি উনার স্ত্রী।
কথাটা শুনে রোকসানার মনে হচ্ছে পায়ের নিচ থেকে মাটি সরে গেছে! সে নিজেকে শক্ত করে বললো,
– উনি বিয়ে করেছেন কবে?
– জ্বি, আমাদের বিয়ে হয়েছে তেরো বছর চলছে।
ঠিক তখনই স্কুলের ড্রেস পড়া এক মেয়ে এসে ঢুকলো রোকসানার পাশ দিয়ে আর সেই মহিলাটিকে উদ্দেশ্য করে বললো,
– মা, বাবা আর দাদু কি এখনো আসেনি?
– না এসে পড়বে। যাও তুমি, ভেতরে গিয়ে ফ্রেশ হও। আপা আপনি আসুন ভেতরে।
রোকসানা জিজ্ঞেস করলো,
-ও কি আপনার মেয়ে?
– জ্বি।
– ছেলেমেয়ে কয়জন আপনার?
– আল্লাহ একজন মেয়েই রেখেছে আমার ভাগ্যে। একি! আপনার মেয়ের চোখে পানি কেন? কি হয়েছে মামনি তোমার?
রোকসানা মহিলাটির কথায় নাফিসার দিকে তাকিয়ে দেখলো নাফিসা গাল ফুলিয়ে চোখে পানি নিয়ে রেগে আছে! সেও আর ভেতরে না গিয়ে সেখান থেকে নাফিসাকে নিয়ে চলে এলো। বাসায় ফিরে রোকসানা নিজের কষ্ট চাপা রেখে নাফিসাকে জিজ্ঞেস করলো,
– কি হয়েছে মা? তুমি রেগে আছো কেন?
– আম্মি, আব্বুর বউ না ওই আন্টিটা? আব্বু আরেকটা বিয়ে করেছে না? আব্বু আমাকে রেখে ওই আপুটাকে চকলেট কিনে দিয়েছে না?
এইটুকু মেয়ে এতোকিছু বুঝে গেছে আর সেই কষ্টে চোখে পানি এনেছে সেটা দেখে রোকসানা নিজের কষ্ট চাপা রাখতে পারেনি! রোকসানা মেয়েকে জড়িয়ে সেদিন হাউমাউ করে কেদেছে! সেদিন বিকেলেই সে নাফিসাকে নিয়ে আমার বাসায় এসেছে আমাকে সবটা বলে অনেক কেদেছে আমার কাছে! কোন আশ্রয়স্থল নেই তার! আমি তাকে শান্তনা দিয়ে সৈকত সম্পর্কে খোঁজ নিয়ে দেখি সত্যিই সে বিয়ে করেছে। ঘরে বউ রেখেই সে রোকসানাকে বিয়ে করেছে। আমি একজন বান্ধবী না, তাকে আমার বোনের মতো দেখেছি। সেও আমার সাথে বোনের সম্পর্ক গড়েছিলো। সৈকতের সাথে সরাসরি কথা বলতে চেয়েছিলাম আমি কিন্তু রোকসানা সেটা হতে দেয়নি। সে এই প্রতারকের নাম মুছে ফেলতে চেয়েছে নিজের জীবন থেকে। সে চেয়েছে নাফিসাকে এতিমখানায় দিয়ে নিজের জীবন শেষ করে দিবে। আমি তাকে বুঝিয়ে আমাদের বাড়িতে নিয়ে আসি। বিপদের সময় যদি পাশে না দাড়াতে পারি তাহলে কিসের বোন আর কিসের বন্ধু হলাম! এখানে এসে নিজের সামর্থ্য অনুযায়ী তাকে বুঝানোর চেষ্টা করি তারপর থেকে সে জীবিকা নির্বাহের পথ ধরে। আমার ভাইয়া ঢাকাতেই থাকে আর আমি আমার শশুর বাড়ি। এই বাড়িতে এখন রোকসানা থাকে আর তার আপন বলতে এখন সে আমাকেই মানে। বলেছিলাম তাকে বিয়ে করতে কিন্তু সে তার মেয়েকে নিয়েই বাচতে চেয়েছে, চা বাগানে কাজ করে নতুন সংসার বেধেছে। এসএসসি পরীক্ষার পর থেকে গত দুবছর যাবত মাকে অব্যাহতি দিয়ে নাফিসা নিজে সংসারের হাল ধরেছে। নাফিসা তার বাবার প্রতারণা দেখে কোন পুরুষ মানুষকে বিশ্বাস করে না আর তাই সে তোমার সাথেও এমন করে। আর ঢাকার মানুষতো একদমই দেখতে পারে না! তোমাদের বিয়ের দিনের ঘটনা আমি সেদিন রাতেই শুনেছি কিন্তু সিলেট না থাকায় আসতে পারিনি। মানুষ সবাই সবার জীবন নিয়ে ব্যস্ত! আমি ওদিকে সব ফেলে রেখে সময় করে ছুটে এসেছি তোমাকে জানানোর জন্য। রোকসানা বারবার নিষেধ করছিলো কিন্তু আমার মনে হয়েছে সবটা তুমি না জানলে নাফিসাকে মানাতে পারবে না। তোমার ভেতর আমি চেষ্টা দেখেছি। তোমার কাছে সবটা বলে এখন নিজেকে হালকা লাগছে আমার। পারবে তুমি মেয়েটার জীবন রাঙিয়ে দিতে?
– আমি তো সেই প্রথম থেকেই চেষ্টা করছি এখন সবটা জেনে আমার রাস্তা ক্লিয়ার। ইনশাআল্লাহ আমি সর্বোচ্চ চেষ্টা করে যাবো। কিন্তু নাফিসার চেহারা একটু একটু চাকমাদের মতো দেখায় কেন?
দিপা মুচকি হেসে বললো,
– পরিবেশের কারণে এমনটা হয়ে থাকে। সে তো ছোট থেকেই এ অঞ্চলে আছে, তাই স্থানীয়দের মতো অনেকটা।
– অহ! কিন্তু আম্মি জানাতে চায়নি কেন আমাকে?
– নিজেদের বিষয়ে অন্যকাউকে জানাতে ইচ্ছুক নয় তাই চাপা রাখতে চেয়েছে। অনুরোধ একটাই, ধোকা দিয়ো না নাফিসাকে।
– আরে কি বলছেন! আপনি আমার বড়, অনুরোধ করবেন কেন! আপনি সে ব্যাপারে নিশ্চিত থাকুন। আমি কোনোভাবে তাকে ধোকার সম্মুখীন হতে দিবো না। পাহাড় থেকে নেমে অন্যদিকটায় ঘুরবেন?
– না, চলো বাসায় ফিরে যাই।
মেঘ দিপা চাকমার সাথে বাসায় ফিরে এলো। বিকেলে দিপা চাকমা চলে যেতে চাইলে নাফিসাও তার সাথে যাওয়ার জন্য বায়না ধরলো। নাফিসার মা নিষেধ করলো কিন্তু দিপা চাকমা বললো,
– চুপ থাক তুই। অনেকদিন হলো মেয়েটা আমার সাথে থাকে না। যাবে সে আমার সাথে।
– দিপা কি বলছিস তুই! মেঘ এখানে আর সে বেড়াতে যাবে!
– সমস্যা কি? মেঘও তো সাথে যাবে।
মুহূর্তেই নাফিসার মুখ মলিন হয়ে গেছে! সে তো মেঘ থেকে বাচতেই এখান থেকে পালাতে চাইছে! এখন মেঘও তার সাথে যাবে! নাফিসার মলিন মুখ দেখে মেঘ মুচকি হেসে বললো,
– খালামনি আমি যাবো না। আমার কিছু কাজ আছে। নাফিসা যেতে চাইলে আপনি নাফিসাকে নিয়ে যান।
– সে কি কথা! নতুন বউ একা একা ঘুরবে কেন! তুমিও যাবে সাথে।
– না, কাজটা একটু ইম্পর্ট্যান্ট। যেতে পারছি না।
– আচ্ছা তাহলে নাফিসা দ্রুত তৈরি হয়ে নাও।
মেঘ যাবে না তাই, নাফিসা খুশি মনে জামাকাপড় গুছিয়ে খালামনির সাথে চলে গেলো।
২৫.
বৃষ্টি আকাশের সাথে মৌলভীবাজার চলে এলো। সিমি আপুর সাথে দেখা হতেই উৎফুল্ল হয়ে জড়িয়ে ধরলো আপুও অনেক খুশি হয়েছে বৃষ্টিকে দেখে! রিজভী বলে উঠলো,
– ঝড়বৃষ্টি যেতে না যেতেই এতো তারাতাড়ি চলে এলো!
– কথা বলবেন না আমার সাথে! আপনারা সবাই খুব খারাপ! সবাই জানতেন আমাকে মিথ্যে বলে রেখে আসবে অথচ কেউ একবারও বলেননি!
সিমি বললো,
– আমি তো বলতে চেয়েছিলাম, আকাশের জন্য পারিনি!
– না বলে ভালোই করেছো!
– কেন?
– তা না হলে কি আর জংলী দেখতে পারতাম!
ঝুমুর হাসতে হাসতে বললো,
– জংলী তো আগেই দেখেছো, জংলীর সাথে থেকেছও।
আকাশ জবাব দিলো,
– এই জংলী না, জঙ্গলের প্রকৃত জংলী দেখে এসেছে!
সবাই চমকে একসাথে বলে উঠলো,
– হোয়াট!
– হ্যাঁ, কাল ফ্রেন্ডের কাছে দিয়ে আসতে পারিনি। সেখান থেকে বেরিয়ে জঙ্গলের ভেতর চলে গেছে আর আটকা পড়েছে জংলীদের হাতে। পুলিশ দিয়ে মুরগী পাঠিয়ে ফিরিয়ে এনেছি। আরেকটু দেড়ি করলে হয়তো জংলীদের পেটে খুজতে হতো!
সবাই অবাকের শীর্ষ পর্যায়! তারা এক একজন এক এক প্রশ্ন জিজ্ঞেস করে বৃষ্টিকে ক্লান্ত বানিয়ে ফেলছে!
কিছুক্ষণ পর সবাই একসাথে ডিনার করলো। সিমি বৃষ্টিকে নিয়ে ছাদে চলে এলো।
– বৃষ্টি, সত্যি করে বলোতো কি হয়েছে? তুমি আজ এতো খুশি কেনো? আকাশও দেখলাম ভালো বিহেভ করছে তোমার সাথে!
– বুঝতে পারোনি কিছু?
– উহুম!
– আই এম সাক্সেস ফুল! আকাশ আজ আমার প্রতি তার লুকানো ভালোবাসা প্রকাশ করে দিয়েছে!
বৃষ্টির কথা শুনে সিমি হা করে আছে আর বৃষ্টি মিটিমিটি হাসছে!
– সত্যি! হাউ দিস পসিবল!
– আকাশকে জিজ্ঞেস করো, বিশ্বাস হয়ে যাবে।
– আমি কিন্তু অনেক এক্সাইটেড!
– হিহিহি আমিও!
– কাল রাতে থেকেছো কোথায়?
সেখানকার রিসোর্টে একটা রুম নিয়েছিলাম।
– একটা রুম! আকাশ কোথায় থেকেছে?
সিমিকে উৎফুল্ল হতে দেখে বৃষ্টি কথায় আরও মধু মাখিয়ে বললো,
– এক রুমে এক সোফায় এক কম্বলের নিচে দুজন থেকেছি।
– কি বলছো তুমি এসব! আমি তো পাগল হয়ে যাচ্ছি! না, তুমি পাগল! এ টু জেড বলো।
বৃষ্টি সব ঘটনা বললে, সিমি অবাক হয়ে আছে!
– এক দিনেই এতোকিছু!!! শেষ পর্যন্ত এই পিচ্চিটাই জিতে গেলো!
– আচ্ছা অথৈ আপুর কি একটুও হিংসে হচ্ছে না?
– উমম! মে বি না।
– কেন?
– এই মেয়ে, সবার লাইফেই কেউ না কেউ আছে। অথৈ কি এখনো আকাশের জন্য বসে আছে নাকি! তার বিয়ে ঠিক হয়ে আছে।
– ওহ!
পেছন থেকে কেউ বলে উঠলো,
– আরও কিছু বাকি আছে বলার?
দুজনেই পেছনে ফিরে দেখে আকাশ! বৃষ্টি জ্বিভ কেটে তাকিয়ে আছে! আর সিমি হেসে তাদের নিয়ে মস্করা শুরু করেছে। আকাশ বৃষ্টির দিকে নিজের ফোন এগিয়ে দিতেই বৃষ্টি বললো,
– আমি কি করবো?
– দাদু কথা বলবে।
– দাদুকেও সবটা বলে দেই?
আকাশ বিরক্তি দৃষ্টিতে তাকালো আর বৃষ্টি হিহি করে হেসে ফোন নিয়ে দাদুর সাথে কথা বলতে লাগলো।