পাহাড়ে মেঘের ছায়া পর্ব – ২৮

0
576

উপন্যাসঃ পাহাড়ে মেঘের ছায়া
পর্ব – ২৮
(নূর নাফিসা)
.
.
২৮.
মেঘের আজ সকালের নাস্তা মেঘার হাতের বিরিয়ানি। নাফিসা তার সাথে বসেই নাস্তা করেছে। সবকিছু গুছিয়ে চা বাগানে যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে। মেঘ তাকে প্রস্তুত হতে দেখে হাত ধরে বাধা দিলো,
– বাচ্চাদের পড়াও সমস্যা নেই, চা বাগানের কাজ করতে যেও না। আমি দায়িত্ব নিয়েছি তো, ভরসা রাখো আমার উপর।
– আজ যাই, হিসেব নিকেশ মিটিয়ে কাল থেকে আর যাবো না।
– ওকে, যাও।
– আপনি কি চলে যাবেন?
মেঘ ফোনের দিকে তাকিয়ে ঠোঁটের কোনায় হাসি ফুটিয়ে বললো,
– তুমি কি চাও?
আশ্চর্য! সে কি জানে না কি চায়! নাফিসা এমন উত্তর আশা করেনি। ভেবেছিলো মেঘ সরাসরি “না” জবাব দিবে! মেঘ ফোন থেকে দৃষ্টি সরিয়ে তার দিকে তাকিয়ে দেখলো মুখ মলিন করে নাফিসা মেঘের দিকে তাকিয়ে আছে! ফোন পকেটে রেখে মেঘ নাফিসাকে কাছে টেনে দাড় করিয়ে দুহাত নাফিসার কাধে রেখে বললো,
– এমন গাল ফুলিয়ে আছো কেন! কেমন যেনো দেখাচ্ছে তোমাকে! একেবারে বারবি ডল!
নাফিসা হাত সরিয়ে দিয়ে চলে যেতে নিলে মেঘ তাকে জড়িয়ে ধরে বললো,
– টাকা দিয়ে টিকেট কাটলাম, টাকা গুলো জলে ভেসে যাবে না?
– যাক জলে।
– বাবা-মাকে তোমার কথা জানাতে হবে না?
– ফোনে জানিয়ে দিন।
– এভাবে বললে তো উনারা কষ্ট পাবে!
– আপনার বাবা না এসেছিলো, তখন বললেন না কেন?
– আমার বাবা তোমার কি হয়?
নাফিসা সামনাসামনি লজ্জা পেলো! এটা বলা উচিত হয়নি! মেঘ কি কষ্ট পেয়েছে! কয়েক সেকেন্ড নিজের সাথেই কথা বলে নাফিসা নিচু স্বরে আবার বললো,
– বাবা না এসেছিলো, তখন বললেন না কেন?
– চেষ্টা করেছিলাম, সাহস পাইনি!
– যদি উনারা মেনে না নেয়!
– যদি টা না হয় পরেই ভাবি। আগে যাই বাসায়।
– না, যাবেন না।
– তুমি চা বাগানে যাবে না?
– আগে বলুন, আপনি যাবেন না।
মেঘ নাফিসার কপালে ঠোঁট ছুয়ে বললো,
– আচ্ছা যাবো না। যাও, আর আজই হিসেব নিকেশ মিটিয়ে কাজ ছেড়ে দিবে।
– আচ্ছা।
নাফিসা চা বাগানে চলে গেলো। মেঘ বাসায় বসে তার কাজ কমপ্লিট করেছে। খুব শীঘ্রই রিসোর্টের কাজ শুরু করবে। তার প্লানিং আপাতত কমপ্লিট। সারাদিন ঘরে বসে কাজ করে বিকেলে নাফিসার সাথেই পাহাড়ে এসেছে বাচ্চাদের পড়াতে। সাথে খরগোশ ছানাদেরও এনেছে। বাচ্চাদের ছুটি হলে নাফিসাসহ কিছুক্ষণ খেলা করেছে। বাচ্চারা চলে গেলে নাফিসা মেঘের পাশে এসে কাধে মাথা রেখে বসেছে। খরগোশ ছানা পাশেই দৌড়াদৌড়ি করছে। মেঘ বললো,
– এখানে বসলে যে?
– আজ সূর্যাস্ত দেখবো।
– চা বাগানে যাবে না?
– উহুম! কাজ শেষ আর যাবো না।
– মেঘা, আজকে আবার লোকগুলো আমাদের ধরে নিয়ে আরেকবার বিয়ে দিলে ভালো হবে না?
নাফিসা কাধ থেকে মাথা উঠিয়ে বড় বড় চোখ করে তাকালো মেঘের দিকে! এভাবে তাকাতে দেখে মেঘ হেসে আবার বললো,
– আরেকবার বিয়ে হবে, আরেকবার নতুন বউ পাবো, আরেকবার বাসর হবে! আহ! ভাবতে পারছো! এবার সবকিছু কতটা আনন্দের সাথে এনজয় করতে পারবো!
নাফিসা মেঘকে ধাক্কা দিয়ে উঠে দাড়িয়ে বললো,
– খুব খারাপ লোক আপনি! আপনি একটা….!
– কি?
– ইদুর!
মেঘ হাহাহোহো করে হেসে বসা থেকে দাড়িয়ে বললো,
– তাহলে তুমি ইঁদুরের বউ! আই মিন, মিসেস রেট!
– ছি!
নাফিসা খরগোশ ছানাদের ধরতে যাচ্ছিলো মেঘ তাকে টেনে দাড় করিয়ে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে কাধে থুতনি রেখে বললো,
– কোথায় যাচ্ছো এখনি! সূর্যাস্ত দেখবে না!
– খুব ভালো ফটোগ্রাফার আপনি! সেদিনের ছবিটা অনেক সুন্দর ছিলো।
– কিন্তু আমি ফটোগ্রাফার তো না! প্রকৃতির সৌন্দর্য ক্যামেরা বন্দী করা আমার শুধুমাত্র শখ!
– এটা কি হলো!
– কি?
– আমার দিকে না, আকাশে তাকান।
মেঘ আকাশে তাকিয়ে দেখলো সূর্যাস্তের আগেই কালো মেঘের ছায়ায় সূর্য ঢেকে গেছে!
– সূর্যাস্ত আর দেখা হবে না! সব আপনার দোষ!
– আমার দোষ কেন! আমি কি করলাম!
– তাহলে কার দোষ বলুন?
– অবশ্যই কালো মেঘের দোষ।
– কালো হোক আর ধলো হোক! দোষ তো মেঘেরই, তাই না?
এবার মেঘ বুঝতে পেরে হেসে উঠলো! তার নামকে ইঙ্গিত করেই কথা বলছে নাফিসা! তাই নাফিসার ঘাড়ে নাকমুখ ডুবিয়ে বললো,
– এতো দুষ্ট তুমি, ধারণার বাইরে! আমি তো ভেবেছিলাম আনরোমান্টিক, মনমরা মেয়ে তুমি! নিজেকে প্রস্তুতও করে ফেলেছিলাম এই ভেবে, তোমাকে স্বাভাবিক জীবন উপভোগ করার দিকে নিয়ে যেতে আমাকে অনেক কষ্ট করতে হবে!
– বাসায় যাবেন না?
– আর কতো বলবে আপনি আপনি! একটুও তো চেষ্টা করছো না!
নাফিসা কিছু না বলে খরগোশ ছানা কোলে নিতে গেলো। মেঘও একটা ছানা কোলে তুলে নিয়ে বললো,
– এক কাপ চায়ে চুমুক দেয়ার সময় হবে?
– খরগোশ ছানা নিয়ে সম্ভব না! অন্যদিন ভাবলে কি সমস্যা হবে?
– তোমার ইচ্ছে, চলো।
দুজনেই খরগোশ ছানা কোলে নিয়ে কথা বলতে বলতে রাস্তা দিয়ে হাটছে। হঠাৎ মেঘ বললো,
– মেঘা, মনে কর তুমি যেমন আছো তেমনই! আমি যেমন আছি তেমনই!
– এটা আবার কেমন কথা!
– আরে আগে শুনো। মনে কর তুমি যেমন আছো তেমনই! আমি যেমন আছি তেমনই! আর খরগোশ ছানা দুটো বেবি মানে মানুষের বাচ্চা। এই মুহূর্তে আমাদের দেখে কেমন লাগছে জানো? এই মুহূর্তে আমাদের মনে হচ্ছে একটা পরিবার রাস্তায় হাটছে। আমি বাবা, তুমি মা, আর দুজনের কাছে দুইটা একইরকম বেবি! দেট’স মিন, আমাদের টুইন বেবি!
নাফিসা তারাতাড়ি তার হাতের ছানাটা মেঘের হাতে ধরিয়ে দিলো।
– আরে! কি হলো!
– আপনি বাবা সাথে দুইটা টুইন খরগোশ বেবি! আমি নাই!
নাফিসা হাসতে হাসতে রাস্তার বিপরীত পাশে চলে গেলো। মেঘ মুখটা মলিন করে একটু থেমে আবার হাটতে হাটতে খরগোশদের উদ্দেশ্য করে বললো,
– বাচ্চাদের ও বাচ্চাদের বাবাকে একা পথে রেখে বাচ্চাদের মা চলে গেছে! বাহ! ভালোই তো! যাক, কিছুই বলবো না আমি।
নাফিসা আবার রাস্তার এপাশে অর্থাৎ মেঘের কাছে চলে এসে পাশাপাশি হাটতে হাটতে বললো,
– আপনি কেমন লোক! খরগোশ ছানাদের মানুষের বাচ্চা বানিয়ে দিয়েছেন!
– আমি তো জাস্ট এক্সাম্পল দিচ্ছিলাম!
নাফিসা এবার মেঘের হাত থেকে একটা ছানা নিতে গেলে মেঘ দিতে চায়নি। কিন্তু নাফিসা জোর করেই নিয়ে মেঘের পাশাপাশি হাটতে লাগলো।
– মেঘা, আমাদের যদি প্রথম টুইন বেবি হয়! খুব ভালো হবে না? বেড়াতে যাওয়ার সময় কারো কোলই খালি থাকবে না! একজন তোমার কোলে আর একজন আমার কোলে থাকবে!
নাফিসা এক কানে আঙুল দিয়ে বললো,
– চুপ! চুপ! একদম চুপ! বড্ড বেশি কথা বলতে পারেন!
মেঘ হাহাহোহো করে হেসে বললো,
– এক কান ধরলেই কি, অন্য কান যে খোলা!
– আপাতত সেটা বন্ধ করতে পারছি না। এখন আপনার মুখ বন্ধ করলেই হয়!
– তুমি তো দেখছি আমাকেও তোমার মতো বোবা বানিয়ে ছাড়বে! আমি তো বেশি বেশি কথা বলে তোমাকে একটু চতুর বানানোর চেষ্টা করছি। এতো চুপচাপ থাকা যাবে না।
– প্রসঙ্গ পাল্টান।
মেঘ নাফিসার আরও কাছ ঘেঁষে বললো,
– এতো লজ্জা পেলে কিভাবে! একদিন না একদিন তো এমন জীবনের মুখোমুখি হতেই হবে। তখন কোথায় পালাবে মিসেস? বাচ্চারা তো ডেকে ডেকে বাহানা দিয়ে ঠিকই খুজে বের করে ফেলবে!
নাফিসা আর কোনো প্রতুত্তর করলো না। জঘন্য লোক! থামতে বললে কথা আরও বাড়িয়ে দেয়! তার চেয়ে প্রতুত্তর না করাই ভালো।
নাফিসাকে লজ্জা পেতে দেখে মেঘ প্রসঙ্গ পাল্টে অন্য কথা বলতে বলতে বাসায় ফিরে এলো। রাতে নাফিসা তার খাবারসহ মেঘের জন্য খাবার নিয়ে এলো। নাফিসা তরকারি নিয়েছে কিন্তু আজও মাছ নেয়নি! মেঘ নিজের হাতে নাফিসার প্লেটে মাছ তুলে দিলো। নাফিসা তাকাতেই মেঘ বললো,
– মাছ খাও না কেন? সবটুকু শেষ করবে।
নাফিসা কিছু না বলে, ভাত নাড়াচাড়া করলো। তারপর বললো,
– ওই রুমে গিয়ে খাই?
মেঘ তার দিকে তাকিয়ে মুখটা মলিন করে ফেললো! আবার প্লেটের দিকে তাকিয়ে বললো,
– যেখানে খুশি যাও। না করেছে কে? আমি কি তোমাকে আমার সাথে বসে খেতে বলেছি নাকি!
– রাগ করছো কেন! মাছের কাটা বেছে খেতে পারি না আমি। আম্মি বেছে দেয়। তাই বলছিলাম!
মেঘ অবাক হয়ে তার দিকে তাকালো! মুচকি হেসে বললো,
– আমি বেছে দিবো?
– আপনি খাবেন কখন!
– আবার আপনি! এই মাত্র না তুমি করে বললে!
– কখন! মনে নেই।
মেঘ মাছের কাটা বেছে দিতে দিতে বললো,
– আরেকবার আপনি বলে দেখো, এরপর আমি স্পেশালভাবে মনে করিয়ে দিবো। এই জিনিসটা আমার খুব ভালো লেগেছে! একটা দোষ তো পেলাম যেটা দিয়ে তোমাকে খোটা দিতে পারবো! আবার নিজেই সে কাজ করে দিবো। আর কি পারো না, বলো আমাকে?
– চেষ্টা করেছি পারিনি এমন কোন কাজ নেই। আর থাকলেই সেটা বলবো নাকি! খোটা শুনতে কে চায়!
মেঘ মুচকি হেসে বললো,
– আচ্ছা! তাহলে কাটা বেছে খেতে পারো না কেন?
– গলায় কাটা ফুটেছে কয়েকবার৷ তাই মাছ খেতেই ভয় পাই।
– তোমার সব ভয় গুলোকে আমি জয় করে নিবো মেঘা।
– খেয়ে কোথাও যাবে না। পাহাড়ি অঞ্চলে রাতে ঘুরাফেরা ভালো না।
– যথা আজ্ঞে, মহারানী। তবে তোমাকে গল্প করতে হবে। আমি তো সারাদিনই চেষ্টা করলাম। এবার দেখি, কতটা বাড়াতে পেরেছি তোমার কথা বলার স্পীড। বৃষ্টি থাকলে ভালো হতো। একদিনেই তোমাকে বাচাল বানিয়ে ফেলতো।
– সিলেটই তো ছিলো বৃষ্টি। আমাদের এখানে থাকলেই পারতো।
– আমাকেই তো তাড়িয়ে দিচ্ছিলে তুমি, বৃষ্টিকে জায়গা দিতে?
নাফিসা মুখ মলিন করে ফেললে মেঘ আবার হাসানোর চেষ্টা করলো। টুকটাক গল্প করতে করতে দুজনেই খাওয়া শেষ করলো।
সকালে নাস্তা করার পর মেঘ কোথাও যাওয়ার জন্য রেডি হচ্ছে। তাই নাফিসা জিজ্ঞেস করলো,
– কোথাও যাচ্ছেন নাকি?
মেঘ শার্টের হাতা ফোল্ড করতে করতে নাফিসার কাছে এসে দাড়ালো। ঠোঁটের কোনায় দুষ্টুমি হাসি ফুটিয়ে একটা হাত নাফিসার কোমড়ে রেখে কাছে টেনে বললো,
– কি বলেছো? আরেকবার বলো।
মেঘের স্পর্শে কেপে উঠে নাফিসা আমতা আমতা করে বললো,
– কোথাও যাচ্ছো?
– এটা বলোনি তো! আগে যেটা বলেছো সেটাই বলো।
– আমি তো এটাই বললাম!
মেঘ কানের কাছে মুখ এনে কানে আলতো করে কামড় দিয়ে বললো,
– খুব চালাক, হুম? পানিশমেন্ট পরে পাবে, কাজে বের হচ্ছি। দুপুরের দিকে ফিরবো। আজ শাড়ি পড়বে, পাহাড়ি অঞ্চল ঘুরবো তোমায় নিয়ে। আসি, আল্লাহ হাফেজ।
– আল্লাহ হাফেজ।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here