পাহাড়ে মেঘের ছায়া পর্ব-৩৬

0
1069

উপন্যাসঃ পাহাড়ে মেঘের ছায়া
পর্ব – ৩৬
(নূর নাফিসা)
.
.
কিছুক্ষণ পরেই মেঘ বৃষ্টি ও নাফিসাকে নিয়ে বেরিয়ে পড়লো শপিংয়ের উদ্দেশ্যে। সারাদিন ঘুরেফিরে বিকেলে বাসায় ফিরে এসেছে।
মেঘের কাজিনরা এসেছে। সবাই মেতে আছে বিয়ে বাড়িতে! নাফিসা তো এমনিতেই কম কথা বলে এর উপর এখানে কাউকেই চিনে না! বৃষ্টির সাথে প্রয়োজনে দু একটা কথা বলে শুধু। মোহিনী নাফিসাকে নিজের রুমেই বসে থাকতে বললো। মেঘ ফ্রেশ হয়ে ছাদে গেছে ফুলগাছ গুলো দেখতে। তার অনুপস্থিতিতে বৃষ্টি ভালোই যত্ন নিয়েছে। একটা সাদা গোলাপ হাতে নিয়ে আবার নিচে এলো। রুমে এসে দেখলো তার কাজিনরা সব নাফিসার পাশে বসে গল্প করছে আর নাফিসা চুপচাপ বসে আছে। মেঘের হাতে ফুল দেখে কাজিনরা বললো,
– ওয়াও! তোমার গাছের ফুল!
এদিকে একজন বলে, “ভাইয়া আমাকে দাও!” তো ওদিকে আরেকজন বলে “ভাইয়া আমাকে দাও!”
– সর, বউ থাকতে তোদের দিবো কেন! তোদের হাতে ফুল মানায় না। ফুল তো মানায় রমনীর খোপায়!
মেঘ তাদের টপকিয়ে নাফিসার কাছে এসে মাথা থেকে ওড়না ফেলে খোপায় পড়িয়ে দিলো। সবাই অদ্ভুত শব্দ করে তাদের প্রেমে অভ্যর্থনা জানালো! অন্য একজন বললো,
– হাউ রোমান্টিক! আই উইশ মেঘ ভাইয়ার মতো প্রিন্স আসবে আমার লাইফে!
বৃষ্টি ধমক দিয়ে বললো,
– চুপ থাক! আমার ভাই ভাবির উপর নজর দেওয়া শুরু করেছিস! মেট্রিক পাশ করেনি, এখনি লাইফের প্রিন্স খোজা শুরু করেছে! দাড়া চাচির কাছে বলে নেই!
– ছি আপু! তুমি এতো বেশি রিয়েক্ট করছো কেন!
মেঘ বেরিয়ে গেছে, তারা এদিকে হাসি ঠাট্টা করছে! মাগরিবের নামাজ পড়ে এসে মেঘ নাফিসাকে একা পেয়েছে রুমে। মাথায় ওড়না পেচিয়ে রেখেছে নাফিসা। হয়তো নামাজ পড়েছে তাই রুমে একা। দরজা লক করে মেঘ পড়নের টিশার্ট চেঞ্জ করে অন্য একটা পড়লো। নাফিসা জানালার পাশে দাড়িয়ে ছিলো। মেঘ এসে তাকে স্পর্শ করে বললো,
– মেঘা, কাল যদি আমাদের বৌভাত হয় তাহলে আজ কি?
– আজ আবার কি?
– এটাও জানো না দেখছি!
মেঘ কানে কানে ফিসফিস করে বললো,
– কাল যদি হয় বৌভাত, আজ আমাদের বাসর রাত! এটাও মাথায় নেই তোমার!
নাফিসা বড় বড় চোখ করে তাকালো মেঘের দিকে! মেঘ মুখে হাসি ফুটিয়ে বললো,
– এভাবে দেখলেও লাভ নেই, ভিন্নভাবে দেখতে হবে! প্রস্তুত থেকো!
এদিকে দরজায় খটাখট শব্দ করে যাচ্ছে মেঘের ভাইবোনরা! মেঘ বিরক্ত হয়ে দরজা খুলে বললো,
– কি হয়েছে তোদের?
– তুমি এখানে কি করো! তোমার বন্ধুরা ডাকছে যাও! আমাদের কাজের লেট হয়ে যাচ্ছে! আর শুনো, আজকের জন্য ভাবিকে ছেড়ে দাও। ভাবি আমাদের সাথে থাকবে। ভাবির সাথে অনেক গল্প জমা আছে! সারারাত গল্প করবো।
– এক ঘন্টা সময় দিলাম।
– রাখো তোমার ঘন্টা সময়! একে তো না জানিয়ে বিয়ে করেছো সেটার উশুলই তুলিনি এখনো! আবার আসছে ঘন্টা নির্ধারণ কিরতে! আমরা চলে গেলে তারপর পাবে ভাবিকে!
– হুম ভাইয়া! আজ আমাদের সাথে থাকবে ভাবি!
বৃষ্টিও তাদের সাথে জোট বেধেছে! নাফিসা যে মনে মনে খুশি হয়েছে মেঘ সেটা বুঝতে পেরেছে! তাই নাফিসার দিকে তাকিয়ে ঠোঁটের কোনায় হাসি ফুটিয়ে বেরিয়ে গেলো সে।
ড্রয়িং রুমে নাফিসাকে সাথে নিয়ে তাদের মেহেদী অনুষ্ঠান শেষ করলো। মেয়েগুলো একেকজন সীমাহীন আনন্দ করেছে। আর বাকিরা কাজে ব্যস্ত! সন্ধ্যা শেষে রাত ঘনিয়ে এসেছে। অবশেষে মেঘ তার বোনদের ঘুষ দিয়ে নাফিসাকে রুমে এনেছে! নাফিসার মনের ভেতর ঢিপঢিপ করছে! সে যথাসম্ভব তারাতাড়ি এসে শুয়ে পড়লো খাটে! মেঘ ফ্রেশ হয়ে এসে দেখলো নাফিসা চোখ বন্ধ করে আছে! মুচকি হাসি দিয়ে সে পাশে গেলো। নাফিসার হাতদুটো ধরে মেহেদী দেখলো, গাঢ় রঙে রাঙানো হাতে চুম্বন করলো। নাফিসার চোখের পাতায় কম্পন ধরে গেছে! মেঘ মাতাল সুরে বললো,
” অপূর্ব এই রাঙানো হাত,
আরও রাঙিয়ে দিবো!
মধুময় এই বাসর রাত,
আরও মাধুর্য করে তুলবো!
মেঘা, যাবে কি আমার সাথে
ছোট্ট প্রেমের তরীতে?
বাধবো ঘর তোমায় নিয়ে,
ভালোবাসা নামক দীপে!”
– একি, চোখে কেন অশ্রু?
নাফিসা আর চোখ বন্ধ রাখতে পারলো না। লুকিয়ে রাখতে চাইলেও বারবার মেঘের মুখোমুখি হতে সে বাধ্য! মেঘকে অবহেলা করার সাধ্য যেন তার মাঝে নেই! লোকটা বারবার তাকে শিহরিত করে তোলে! তাই সে চোখ খুলে তাকালো, মুখে হাসি ফুটিয়ে তুললো। অত:পর শুধালো,
“যেথা নিয়ে যাবে তুমি,
সঙ্গী হবো আমি,
আর থাকবো তোমারই মতো!
হয়নাকো মন্দ,
ভালোবাসা নামক দীপে,
যদি রাজ্য ছেড়ে ওঠো!”
– জনাব, এ তো সুখের অশ্রু!
.
বৌভাতের প্রোগ্রাম হয়েছে কমিউনিটি সেন্টারে। সারাদিন সকলের আনন্দেই কাটলো কিন্তু পুতুলের মতো বসে থাকতে থাকতে নাফিসা বোরিং! দুপুরের পর থেকেই নাফিসাকে কেমন ভয়ার্ত দেখাচ্ছে! মেঘের চোখ এড়ায়নি সেটা! সে নাফিসার কাছে এসে জিজ্ঞেস করলো,
– কি হয়েছে, মেঘা? এমন দেখাচ্ছে কেন তোমাকে?
– আমরা বাসায় যাবো কখন?
– প্রোগ্রাম শেষ হলেই বিকেলের দিকে।
– আমি এখন যাবো।
– এভাবে কথা বলছো কেন? খারাপ লাগছে তোমার? বলো আমাকে!
– কিছু হয়নি! মেহমানরা কি আমাদের বাসায় যাবে?
– মেহমানরা আমাদের বাসায় গিয়ে আর কি করবে! আম্মির কথা মনে পড়ছে?
নাফিসা মাথা ঝাকিয়ে হ্যাঁ জবাব দিলো। মেঘ বুঝতে পারছে হয়তো একা একা বসে থাকায় বোরিং লাগছে। সে বৃষ্টিকে ডেকে এখানে স্থিরভাবে বসিয়ে রাখলো। বৃষ্টি বসে বসে বকবক শুরু করলো সাথে তার বন্ধুবান্ধবও আছে। আকাশকে কল করে দাওয়াত করেছিলো, কিন্তু আকাশ আসেনি। আর আসবে না যে, সেটা আগেই বলে দিয়েছে। সিলেট থেকে ফেরার পর আকাশের সাথে ফোনে মাত্র তিনবার কথা হয়েছে তাও অল্প সময়ের জন্য! নিজে তো কল করেই না! বৃষ্টি কল করলেও রিসিভ করে না!
প্রোগ্রাম শেষ হতেই সন্ধ্যায় তারা বাসায় ফিরে এসেছে। নাফিসাকে রুমে রেখে বৃষ্টি নিজের রুমে চলে গেলো। কিছুক্ষণ পর মেঘ রুমে এসে দেখলো দরজা ভেতর থেকে লক করা! সে নাফিসাকে ডাকলো, নাফিসা এসে দরজা খুলে নিচের দিকে চোখ রেখেই সরে এলো। জানালার পাশে দাড়িয়েছে সে! মেঘ দরজা লাগিয়ে এসে নাফিসাকে তার দিকে ঘুরিয়ে দাড় করালো। মুখখানা ধরে বললো,
– তুমি কেদেছো?
– কোথায়?
– এখন তুমি রুমে বসে কেদেছো! সেন্টারে থাকতেও মনে মনে কেদেছো! কি হয়েছে তোমার? বলো আমাকে। লুকাবে না কিছু, বলো?
নাফিসা সাথে সাথেই মেঘকে জড়িয়ে ধরে হুহু করে কেদে উঠলো! মেঘ ভেবে পাচ্ছে না তার কারণ! নাফিসা তো কখনো এভাবে কাদে না!
– এই মেঘা, কি হয়েছে? কাদছো কেন?
– আমি আম্মির কাছে যাবো। থাকবো না এখানে। আম্মির কাছে যাবো আমি! খুব দেখতে ইচ্ছে করছে আম্মিকে!
– এই পাগলী, চুপ করো! এভাবে কেউ কাদে! বাবা মা শুনলে কি ভাববে! চুপ, আর কিছুদিন এখানে থেকে আমরা সিলেট যাবো। দুদিন হলো এসেছি, এখনই যদি চলে যাই তাহলে বাবা মা নারাজ হবেন! একটু কষ্ট করে মানিয়ে নাও। দেখবে আর দুতিনদিন যেতেই ভালো লাগছে। আম্মির সাথে কথা বলবে?
– হুম।
– ওকে, আমি কল করছি। কাদবে না বলে দিচ্ছি। কাদলে কথা বলতে পারবে না! দেখি তাকাও আমার দিকে। বউ সেজে বসে আছে আবার কান্না করে! লোকে দেখলে কি বলবে! এতো বড় মেয়ে, দুদিন পর বাচ্চার মা হবে অথচ এখনো বাচ্চাদের মতো কাদে!
নাফিসা মেঘের কথা শুনে তার হাত থেকে রুমাল নিয়ে নিজেই চোখ মুছতে লাগলো! মনে মনে ফুসছে সে! এমন ভাবে বুঝ দিচ্ছে যেন সে এক বাচ্চা! আর কিছু হলেই বাচ্চার কথা তুলে বসে!
মেঘ তার মুখের ভঙ্গি দেখে হেসে উঠলো এবং বললো,
– কি? মনে মনে আমাকে বকছো?
– এতো খারাপ কেন আপনি?
– কতো কেজি খারাপ যেনো?
নাফিসা ফিক করে হেসে উঠলো! মেঘ পকেট থেকে ফোন বের করে নাফিসার হাতে দিয়ে বললো,
– এভাবে হেসেই আম্মির সাথে কথা বলবে এখন। না হলে দ্বিতীয়বার ফোন হাতে পাবে না বলে দিচ্ছি!
নাফিসা ফোন নিয়ে আম্মির সাথে কথা বললো। এই সময়টুকু মেঘ রুমেই ছিলো। বৃষ্টি এসে ডাকলে মেঘ বলে দিলো সে আম্মির সাথে কথা বলছে। নাফিসা কথা বলা শেষ করে মেঘের সাথে রুম থেকে বের হলো। নাফিসা চেঞ্জ করতে চেয়েছিলো মেঘ নিষেধ করলো। মোহিনী দেখে এগিয়ে এসে বললো,
– কি হয়েছে আমার মেয়েটার? মুখটা এমন মলিন কেন? আম্মির সাথে কথা হয়েছে?
নাফিসা মুখে মুচকি হাসি ফুটিয়ে মাথা নেড়ে হ্যাঁ জবাব দিলো। মোহিনী আবার বললো,
– খুব ঝগড়া করবো আমি তোর আম্মির সাথে! মেয়ে বিয়ে দিয়েছে, শ্বশুর বাড়ি কি একটু ঘুরে দেখে যাবে না! দেখা হোক একবার, কঠিন ঝগড়া করবো!
এদিকে বৃষ্টি এসে বললো,
– মা, তোমার ঝগড়া আন্টির সাথে। সেটা সময় হলে করো। আমি এখন ভাবিকে নিয়ে যাই! ভাবি চলো!
নাফিসা বৃষ্টি ও তার কাজিনদের সঙ্গে একটু গল্প করলো। কাজিনরা যারা ছিলো একটু পরই চলে গেলো সবাই। রাতে খাবার খাওয়ার সময় মোহিনী নাফিসার পাশে বসে মাছের কাটা বেছে দিতে দিতে বললো,
– যাক, একটা দোষ পেলাম খোটা দেওয়ার মতো! মাছের কাটা বেছে দিয়ে আদর করবো তোকে!
মেঘ মিটিমিটি হেসে প্লেটের দিকে তাকিয়ে খাচ্ছে। নাফিসা মেঘের দিকে তাকালো করুন দৃষ্টিতে! মেঘই মা কে জানিয়েছে সে নিশ্চিত! কোনো কিছু গোপন রাখবে না! জঘন্য লোক একটা! বৃষ্টি বললো,
– মা, দেখোতো। আমার মাছেও কাটা বেশি মনে হচ্ছে আজ!
– দিবো একটা মাইর এখন! হিংসুটে মেয়ে কোথাকার!
বৃষ্টি হিহিহি করে হেসে উঠলো! খাওয়া শেষে মোহিনী নাফিসাকে কিছু করতে দিলো না। রুমে পাঠিয়ে দিলেন। মেঘ আগেই চলে গেছে, এখন নাফিসাও রুমে চলে এলো। রুমে পা রাখতেই মেঘ তাকে দাড় করিয়ে দরজা লক করলো। অত:পর নাফিসাকে কোলে তুলে বিছানার দিকে এগিয়ে গেলো। ফুল দিয়ে সাজানো হয়েছে আজ! মেঘ মুচকি হেসে বললো,
– মেঘা, জানো? আজ যে আমাদের ফুলসজ্জা!
নাফিসা মেঘের চোখেই তাকিয়ে আছে! প্রতিদিন প্রতিটি মুহুর্তে এতো রোমাঞ্চ কোথা থেকে আসে এই লোকটার মাঝে, ভেবে পায় না সে! মৃদু স্বরে বললো,
– চেঞ্জ করবো না আমি?
– এখনই কিসের চেঞ্জ! আমি তোমাকে দেখেছি নাকি!
– দেখো নি?
– উহুম, এখন দেখবো!
নাফিসা অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে! সারাদিন তার আশেপাশে ছিলো আর এখন বলছে সে দেখেনি! মেঘ তাকে বিছানায় নামিয়ে নিজেও পাশে শুয়ে হাতে মাথা ভর করে পলকহীন তাকিয়ে আছে! নাফিসা একটু তাকাতেই চোখ সরিয়ে নিলো। তার ভেতরে তোলপাড় চলছে! এভাবে কেউ তাকিয়ে থাকে! দৃষ্টিতে খুন হয়ে যায়না মানুষ! প্রতিদিন প্রতিরাত এই অদ্ভুত প্রকৃতির লোকটা তাকে ভিন্ন জগৎ থেকে ঘুরিয়ে আনে এবং ভিন্ন ভিন্ন অনুভূতির জন্ম দেয়! এতো শিল্প থাকে একটা মানুষের মাঝে সেটা মেঘকে না পেলে কখনো বুঝতেই পারতো না সে!

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here