পাহাড়ে মেঘের ছায়া পর্ব-৩৯

0
520

উপন্যাসঃ পাহাড়ে মেঘের ছায়া
পর্ব – ৩৯
(নূর নাফিসা)
.
.
সে আকাশকে দেখতে দেখতে কখন যে রেস্টুরেন্টের ভেতরে চলে এসেছে খেয়ালই করেনি! আকাশ বললো,
– বৃষ্টি, তাকিয়ে দেখো তোমার পরিচিত কেউ আবার এসে বসে আছে কি-না?
বৃষ্টির ধ্যান ভাঙলো। সে রেস্টুরেন্টে চোখ বুলিয়ে দেখলো অত:পর মাথা নেড়ে না জবাব দিলো। আকাশ তাকে একপাশে এনে বসতে বললো আর বৃষ্টি জিজ্ঞেস করলো,
– বসে কি করবো?
– কি আর করবে! টেবিলে মার্ডার প্যাটার্ন আঁকো!
বৃষ্টির মনে পড়ে গেছে সেই জঙ্গলে কাটানো দিনের কথা! ইশ! ভাবতেই শিহরণ বয়ে যায় অঙ্গে! যদি আবার যেতে পারতো! প্রত্যেকটা দিন সেভাবেই কাটাতে পারতো! বৃষ্টি চেয়ারে বসে পড়লো। আকাশ খাবার অর্ডার করেছে। বৃষ্টির মুখ এখনো হুতোম প্যাঁচার মতো হয়ে আছে! আকাশ প্রথমে বিপরীত দিকে বসলেও এখন উঠে বৃষ্টির কাছে বসলো। খাবারের প্লেট সামনে টেনে বললো,
– আহ! ক্ষুধায় একেবারে মুখটা শুকিয়ে গেছে! সকালেও খাওনি নাকি!
– হুহ! ঢং দেখাতে আসছে এখন!
আকাশের ফোনে কল এলে আকাশ দেখলো রিজভীর কল। বৃষ্টির দিকে তাকিয়ে দেখলো বৃষ্টি তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তার দিকেই তাকিয়ে আছে। আকাশ ফোন রিসিভ না করে টেক্সট করলো এখন ব্যস্ত আছে। ফোন টেবিলের উপর রেখেই খাবারের প্লেট বৃষ্টির সামনে দিয়ে বললো,
– এখন আবার খায়িয়ে দিতে বলো না। রেস্টুরেন্টে অনেক লোক আছে তাছাড়া আমি খায়িয়ে দিতে পারিনা!
বৃষ্টির হাসি পাচ্ছে কিন্তু হাসছে না! গম্ভীর মুখেই বললো,
– আপনি খেলে আমি খাবো না।
– হোয়াট! উল্টো বললে না কথাটা?
– না, ঠিকই বলেছি। আপনি খেলে আমি খাবো না।
– আমি কিন্তু লাঞ্চ করিনি। তোমাকে নিয়ে এসেছি লাঞ্চ করার জন্য।
– এতো কথা আমি জানতে চাইনি! আমার কথা আমি বলেছি। আপনি খেলে আমি খাবো না!
– ওকে আমি খাবো না। খাও তুমি।
বৃষ্টি নিজে খেতে খেতে বললো,
– আপনি কি সত্যিই আমার জন্য এসেছেন?
– তোমার কোচিং শেষ হয় বারোটায়, আমি এসেছি এগারোটা পঞ্চাশে। তুমি বেরিয়েছো বারোটা চৌদ্দ মিনিটে। পুরো চব্বিশ মিনিট দাড়িয়ে ছিলাম আমি তোমার জন্য। এতো লেট করে বেরিয়েছো কেন?
– এমন ভাব দেখাচ্ছেন যেন আমাকে আগে জানিয়ে দিয়েছেন আপনি আসবেন! কালকে দেখা করার কথা বলতেই কেমন আচরণ করেছেন! আজ এসেও আমাকে কাদিয়েছেন! এমন বিহেভ করার হলে এসেছেনই বা কেন!
– এসেও ভুল করে ফেলেছি!
– আপনি জানেন কিভাবে আমার কোচিং এর সময়?
– সেন্টারের নাম জানিয়েছো এটা জানা ব্যাপার নাকি!
বৃষ্টি আর কিছু না বলে খেয়ে যাচ্ছে আর আকাশের দিকে তাকাচ্ছে! দুতিন মিনিট পাড় হতেই আকাশ বললো,
– আমি বিল দিয়ে চলে যাই তাহলে? তুমি খাবে আর আমি বসে বসে দেখবো তা তো আর হয় না!
বৃষ্টি খাওয়ার মাঝেই হিহি করে হেসে উঠলো! কোনো জবাব না দিয়ে আরেকটু খেয়ে পানি খেয়ে মুখ মুছে নিলো। তারপর আকাশের প্লেট তার দিকে এগিয়ে দিয়ে বললো,
– এবার খাও তুমি।
– একবার আপনি একবার তুমি! আমার মতে আপনি টা-ই ঠিক আছে!
– আমার যা ইচ্ছে বলবো, না শুনতে পারলে কান বন্ধ করে রাখো। ক্ষুধা না লেগেছে? এবার চুপচাপ খাও।
– এতোক্ষণ আমাকে বসিয়ে রাখলে কেন? নিজের পেট শান্তি তো সব শান্তি! তাই না?
– উহুম! আমার ক্ষুধা লাগেনি। তুমি আমার সাথে খেলে এখন খাওয়া শেষ হয়ে যেত আর তুমি চলে যেতে! তাই বসিয়ে রেখেছি, এখন তুমি খাও, আমি দেখবো তোমাকে!
– আবার ডান্স করবে না তো?
বৃষ্টি লজ্জা পেয়ে মুচকি হাসলো শুধু। আকাশ খাচ্ছে, আর বৃষ্টি তাকে দেখছে! সেই যে কবে দেখেছে আজ কতোদিন পর আবার দেখা! অনেকটা ফ্রেশ লাগছে আকাশকে! মেয়েদের মতো ক্রীম ট্রীম মাখে নাকি! আগে তো এতোটা ফ্রেশ লাগেনি! বৃষ্টি মনে মনে হাসছে। তার মনের হাজার রঙ তুলিতে আকাশকে রঙিন করছে! ভাসছে আকাশের মাঝে, বুনছে রংধনুর ন্যায় হাজার স্বপ্ন! চোখের ইশারায় আকাশের মাঝে আঁকিবুঁকি করছে অজানা স্বপ্নের জগৎ! পলকহীন তাকিয়ে আছে তার সামনে বসা মানব, আকাশের পানে!
এদিকে আকাশ খাওয়ায় ব্যস্ত! নিজের খাবার শেষ করে বৃষ্টির অবশিষ্ট খাবারও খেয়ে নিলো। তা দেখে বৃষ্টি বললো,
– এতো ক্ষুধা লেগেছে! আমার প্লেটও সাফ!
আকাশ সম্পূর্ণ খাওয়া শেষ করে জবাব দিলো,
– ক্ষুধা বেশি লাগেনি তবে খাবার নষ্ট করা ঠিক না! এতো নষ্ট করো কেন তুমি! চলো…
– আরেকটু বসো। দেখা শেষ হয়নি আমার!
– অনেক দেখেছো, উঠো! না হলে তুমি থাকো আমি চলে যাই!
– আকাশ আর দশ মিনিট।
আকাশ তার হাত ধরে টেনেই বেরিয়ে এলো রেস্টুরেন্ট থেকে। রিকশা ডেকে বৃষ্টিকে উঠতে বললো। এদিকে রিজভী কল করেই যাচ্ছে! অন্য এক রিকশা নিয়ে সে নিজেও চলে গেলো। দুজন দুদিকে! এতোকিছুর পর বৃষ্টির মনটা আবার খারাপ করে দিলো আকাশ ! আর বিষন্ন মনে বৃষ্টি বাসায় ফিরে এলো।
৩৭.
সন্ধ্যায় মেঘ, তার বাবা ও মারিশার বাবা একসাথে বাসায় ফিরেছে। নাফিসা মোহিনীর সাথে কিচেনে ছিলো। মেঘ কিচেনে এসে বললো,
– মা, আংকেল এসেছেন।
– কোন আংকেল? মারিশার বাবা?
– হ্যাঁ।
মোহিনী কিচেন থেকে বেরিয়ে ড্রয়িং রুমের দিকে চলে গেলো। এই সুযোগে মেঘ নাফিসাকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে বললো,
– কি রান্না করছো, বেগম সাহেবা?
– ছি, ছাড়ো! কিচেনে আছি।
– আমিও তো দেখতেই পাচ্ছি কিচেনে আছো! প্রব্লেম হলে বেডরুমে চলো!
– ছাড়ো তো! মা এসে পড়বে!
মেঘ মাথায় মাথা ঠুসে ছেড়ে দিয়ে দাড়ালো। কাটা টমেটো থেকে এক টুকরো টমেটো নিয়ে মুখে দিলো। নাফিসা জিজ্ঞেস করলো,
– গোসল করবে এখন?
– তুমি করলে করবো।
মেঘের দুষ্টুময় কথা শুনে নাফিসা চোখ রাঙিয়ে একবার তার দিকে তাকিয়ে আবার নিজের কাজে মনযোগ দিলো। মেঘ বললো,
– আংকেলের জন্য কিছু নাস্তা রেডি করো। বক্সে দেখো কি আছে।
– এটা নাড়া দাও।
– বাবাহ! আমিও আজ মেয়েলি কাজে!
– কেন, ছেলেরা রান্না করে খায় না?
– খায়, বাধ্য হয়ে।
– শখেও খায়।
– দেখেছো কাউকে?
নাফিসা আর কোনো জবাব দিলো না। মেঘ বললো,
– বৃষ্টি কোথায়?
– রুমে, পড়ছে হয়তো।
মেঘ এখানে থেকেই বৃষ্টিকে ডাকলো। মোহিনী এসে বললো নাফিসাকে দেখতে এসেছে মারিশার বাবা। তাই নাফিসাকে যেতে বললো। কেক, বিস্কুট আর ফ্রিজ থেকে মিষ্টি নিয়ে ট্রে তে নিলো মোহিনী। আর নাফিসাকে বললো পানির জগ নিয়ে যেতে। মেঘ রুমে চলে গেলো, আর নাফিসা চুলা বন্ধ করে ওড়না দিয়ে মাথায় ঘোমটা টেনে জগ নিয়ে মোহিনীর পিছু পিছু যাচ্ছে। মোহিনী ট্রে এনে টেবিলে রাখলো। নাফিসা এসে সালাম দিলো। মারিশার বাবাও সালামের জবাব দিলো। নাফিসা লোকটিকে দেখে জগটা ঠিকমতো রাখতে পারলেও গ্লাসটা রাখতে পারেনি! মেঝেতে পড়ে ঠাস করে ভেঙে গুড়ো হয়ে গেছে! এ কাকে দেখছে সে! এই লোকটা মারিশার বাবা! গ্লাস পড়ে যাওয়ায় সবাই তার দিকে তাকিয়ে আছে! নাফিসার চোখ অশ্রুতে ভীড় জমে গেছে! সে বসে “সরি” শব্দটা উচ্চারণ করে তাড়াতাড়ি ভাঙা কাচ তুলতে লাগলো। মোহিনী বললো,
– কিছু হয়নি, আমি গ্লাস এনে দিচ্ছি। ধরো না নাফিসা, হাত কেটে যাবে। উঠো।
– সরি মা, আমি বুঝতে পারিনি পড়ে যাবে!
– আরে বোকা মেয়ে, একটা গ্লাস ভেঙেছে এতে কি হয়েছে! উঠো।
এদিকে রায়হান চৌধুরী ও সৈকত মির্জাও নিষেধ করছে কাচ ধরতে। নাফিসা উঠে দাড়ালো আর মোহিনী একটা গ্লাস এনে দিলো। নাফিসা ওড়না দিয়ে চোখ মুছে নিচের দিকে তাকিয়ে আছে। রায়হান চৌধুরী বললো,
– মির্জা সাহেব, বউ মা কিন্তু পাহাড়ি মেয়ে।
– হ্যাঁ, চেহারায় কিছুটা ভাসে। কোথায় তোমাদের বাসা?
নাফিসা নিচু স্বরে বললো,
– সিলেটের শ্রীমঙ্গলে।
– ওহ, পড়াশোনা সেখানেই?
– হ্যাঁ।
– কিসে পড়ো?
– এইচএসসি পরীক্ষা দিয়েছি।
– ভালো, এবার এদিকে ভালো ভার্সিটিতে ভর্তি হয়ে যাও। কি চৌধুরী, পড়াশোনার সুযোগ নেই?
– থাকবে না কেন! মেয়েকে পড়াচ্ছি, নাফিসাও তো আমার মেয়েই।
নাফিসা একটু চুপচাপ স্বভাবের এটা জানে বিধায় মোহিনী বুঝতে পারছে নাফিসা হয়তো অপরিচিত লোকের সামনে দাড়িয়ে থাকতে অসস্তি বোধ করছে। তাছাড়া এখন গ্লাস ভেঙে বোধহয় আরও অসস্তি বোধ করছে, তাই নাফিসাকে নিয়ে চলে আসতে চাইলো। সৈকত মির্জা উঠে সালামি স্বরূপ নাফিসাকে কিছু টাকা দিতে চাইলো কিন্তু নাফিসা নিচ্ছে না। মোহিনীও প্রথম না করছিলো, কিন্তু স্বেচ্ছায় সালামি স্বরূপ দিতে চাইছে না নিলে বেয়াদবি হবে। তাই মোহিনী নাফিসাকে ইশারা করলো নেওয়ার জন্য। মির্জা সাহেবকে ডিনার করে যাওয়ার জন্য বলে নাফিসাকে সাথে নিয়ে কিচেনে চলে এলো। নাফিসার আর সহ্য হচ্ছে না! পারছে না ভেতরের কষ্ট চাপা রাখতে! সে মোহিনীকে বললো,
– মা, আমি একটু রুমে যাচ্ছি।
– যাও।
নাফিসা চলে গেলো আর মোহিনীও ঝাড়ু নিয়ে ড্রয়িং রুমে গেলো ভাঙা কাচ পরিষ্কার করতে।
রুমে এসে দরজা লাগিয়ে দৌড়ে এসে খাটের কোনে বসলো। হাতের টাকা ফেলে ওড়না দিয়ে মুখ চেপে রাখলো তবুও কান্না দমাতে পারছে না! মেঘ ড্রেসিং টেবিলের আয়নায় তাকে দেখে দ্রুত এসে পাশে বসলো।
– মেঘা? কি হয়েছে তোমার?
নাফিসা কোন জবাব দিচ্ছে না! মেঘ দেখলো খাটে এক হাজার টাকার নোট! মুখ থেকে নাফিসার হাত টেনে সরানোর চেষ্টা করতে করতে বললো,
– এই, কাদছো কেন তুমি? কি হয়েছে, বলো আমাকে! মেঘা!
নাফিসা ওড়না ছেড়ে দিয়ে মেঘের টিশার্ট খামচে ধরে বুকে মুখ লুকিয়ে আরও জোরে কাদতে লাগলো! কিন্তু মুখ লুকিয়ে রাখায় কান্নার শব্দ বেশি পাওয়া যাচ্ছে না!
নাফিসা কাদতে কাদতে বললো, “মেঘ ওই লোকটা আবার এসেছে কেন এ বাড়িতে! বারবার আসে কেন এখানে!”
কথা অস্পষ্ট হওয়ায় মেঘ কিছুই বুঝতে পারছে না! তাই বললো,
– কি বলেছো, বুঝিনি। আবার বলো।
– ওই লোকটা বারবার আসে কেন! দেখতে পারিনা আমি! একদম দেখতে পারি না!
– কার কথা বলছো তুমি?
– জানি না! আমি থাকবো না এখানে! আর থাকবো না এক মুহুর্তও! সিলেট রেখে আসুন আমাকে!
এমন অস্পষ্ট কথা আর কান্না মেঘের মোটেও ভালো লাগছে না। তবে মাথা খাটিয়ে কিছু একটা আন্দাজ করতে পেরেছে মেঘ!
দীপা চাকমা যখন বলেছিলো নাফিসার বাবার নাম সৈকত মির্জা তখনই মারিশার বাবার কথা মনে পড়েছিলো। কিন্তু মোটেও এমন কিছু সন্দেহ করেনি তাকে নিয়ে, শুধু মাত্র নামের মিলটা পেয়েই মনে হয়েছিল। কিন্তু এখন তো অনেকটা সন্দেহ করছে, নাফিসা এখন সৈকত মির্জাকে দেখেই কাদছে! তাহলে কি তিনিই নাফিসার বাবা!

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here