উপন্যাসঃ পাহাড়ে মেঘের ছায়া
পর্ব – ৪৪
(নূর নাফিসা)
.
.
মেঘ তার ঠোঁটে ছুয়ে দিয়ে তাকে থামিয়ে দিয়ে বললো,
– আর কখনো যদি কিছু নিয়ে সন্দেহ হয়, তাহলে আগে জিজ্ঞেস করে শিওর হয়ে নিবে। আর এমন বোকামি ভুলেও করবে না! মারিশা তোমার সঙ্গী কেড়ে নিতে চেয়েছে আর তুমি চুপচাপ বসে ছিলে কেন! যদি আমাকে ভালোবেসেই থাকো তাহলে আঁকড়ে ধরতে পারলে না কেন! বরং উল্টো হার মেনে চলে এসেছো! এখন আমি যদি রাগ করে বসে থাকতাম! না পারতে এদিকে তুমি বাচতে আর না পারতাম আমি! মেঘা, নিজের জিনিসকে আঁকড়ে ধরে বাচতে শেখো! নিজের অধিকার আদায় করতে শেখো! অন্যের ভালোর কথা চিন্তা করে নিজেকে শাস্তি দেওয়া বোকামি ছাড়া কিছুই না! প্রতিবাদী হও! না হলে সুখ জিনিসটা জীবনে ধরা দিবে না কভু! পৃথিবীতে সবাই স্বার্থপর, কেউ কাউকে নিয়ে ভাবে না! সবাই নিজকে চিনে! নিজের স্বার্থ বুঝে, তাহলে তুমি কেন হাল ছেড়ে দাও! নিজ দাবি আদায় করতে শেখো, অন্যের জন্য ফেলে রেখো না কিছু! আমি যদি অন্যমনস্কও হয়ে যাই কখনো, তোমার উচিত আমাকে ঘিরে রাখা! না হলে সব হারিয়ে নিস্ব হয়ে যাবে একদিন! চেষ্টা না করলে তো কোনোকিছুই লাভ করা যায় না এটা জানো না?
– আল্লাহ যদি সবার জীবনেই এমন একটা মেঘ রাখতো তাহলে কেউ দুখ জিনিসটা উপলব্ধি করতে পারতো না কখনো!
মেঘ মুচকি হেসে বললো,
– আর তুমি পেয়েও হারাতে বসেছো!
নাফিসা মেঘ থেকে চোখ সরিয়ে নিলো! নিজেকে নির্বোধ মনে হচ্ছে তার! হঠাৎই মেঘ মধুময় সুরে বলে উঠলো,
“জীবন ফুরিয়ে যাবে,
তবুও ফুরাবে না, এ তৃপ্তি আমার!
দিন কাটবে, রাত কাটবে,
কবু কাটবে না নেশা, প্রতি তোমার!”
মেঘের স্পর্শে মাতাল শিহরণ বয়ে যাচ্ছে নাফিসার মনে! যতবারই স্পর্শ করে, পাগল হয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়! মেঘকে থামিয়ে দেওয়ার জন্য বললো,
– এই, গোসল করবে না!
মেঘ নাফিসাকে ছেড়ে উঠে বসলো। শার্ট খুলতে খুলতে বললো,
– ছি! মেঘা, কেমন খাটাশ তুমি! শীতকাল ঠিকমতো না আসতেই তোমার গোসল বন্ধ! ভাবতে অবাক লাগে, তুমি নাকি বাচ্চার মা হবে! নিজেই খাটাশ, বাচ্চারা কি হবে!
নাফিসা তো হতবাক! এসব কি কথাবার্তা! সে কখন বললো গোসল করবে না! মনে মনে ভাবা বন্ধ করে মেঘকেই জিজ্ঞেস করলো,
– আমি কখন বললাম গোসল করবো না!
– গোসল করার ইচ্ছে থাকলে কি আর বিছানায় এসে ঘুমানোর প্রস্তুতি নিচ্ছো!
– আমি এসেছি নাকি তুমি নিয়ে এসেছো বিছানায়!
– প্রমাণ কি?
– আমি নিজে প্রমাণ!
– তাহলে বসে থাকো তুমি তোমার প্রমাণ নিয়ে! নিজ প্রমাণে আদালতে রায় দেয়া হয় না!
নাফিসা আর কথা বাড়ালো না। মেঘ যে কতটা দুষ্টু সেটা তার অজানা নেই! তার সাথে কথায় পারবে না তাই চুপচাপ জামাকাপড় নিতে লাগলো। মেঘ দরজা খুলে বেরিয়ে গেলো নাফিসাও জামাকাপড় নিয়ে পিছু পিছু বের হচ্ছে। আম্মিকে দেখতে পেয়ে মেঘ বললো,
– আম্মি, বরাবর শীতেই কি নাফিসা গোসল বন্ধ করে দেয়?
রোকসানা অবাক হয়ে একবার মেঘের দিকে এবং একবার নাফিসার দিকে তাকালো! আম্মির দৃষ্টি বুঝতে পেরে নাফিসা বললো,
– আম্মি, ও বললো আর তুমি বিশ্বাস করে নিলে! আমি কি গোসল মিস করেছি কখনো!
মেঘ মিটিমিটি হাসতে হাসতে বাথরুমের দিকে চলে গেলো। আম্মি তাদের দুষ্টুমি বুঝতে পেরে হেসে উঠলো! নাফিসাকে জিজ্ঞেস করলো,
– তোর গাল লাল কেন! কি হয়েছে, এলার্জি নাকি! দেখি?
নাফিসার মনে হতেই বড় বড় চোখ করে তাকালো এবং দ্রুত পায়ে বাথরুমের দিকে যেতে যেতে বললো,
– আম্মি কিছু না! তুমি চোখে বেশি দেখো!
রোকসানা মেয়ের আচরণ না বুঝতে পেরেও আর মাথা ঘামালো না, নিজের কাজে চলে গেলো। নাফিসা বাথরুমে এসে কাপড়চোপড় রাখলো এবং ভেতর থেকে দরজা লাগিয়ে দিলো। মেঘ নাফিসার জামাকাপড় দেখে বুঝতে পেরেছে নাফিসা তার সাথে গোসল করতে এসেছে! তাই একটু ভাব নিয়ে বললো,
– আরে, তুমি এখানে কেন!
– বাথরুমে আবার কেন আসে! গোসল করবো।
– আমি এসেছি দেখছো না!
– তো, কি হয়েছে!
– কি হয়েছে মানে! আমার সাথে গোসল করবে!
– হুম!
– ইশ! কি বলো এসব! আমার লজ্জা লাগে না বুঝি!
– হুহ্! লজ্জা কাকে বলে জানা আছে নাকি আপনার!
– হ্যাঁ, খুব ভালো জানা আছে! বউয়ের কাছে শিখে গেছি। যাও বের হও।
– না।
– না, আমি তোমার সাথে গোসল করবো না! বের হও!
মেঘ টেনে নাফিসাকে দরজার কাছে নিয়ে এলো। নাফিসার ভালো লাগছে না মেঘের আচরণ! ইচ্ছে করছে তার সাথে গোসল করতে তবুও মেঘ ঠাই দিচ্ছে না! আহ্লাদী কন্ঠে বললো,
– মেঘ!
– কি, মেঘা? যাও, বের হও!
মেঘের এমন আচরণে আর কিছু না বলে নাফিসা মুখ ফুলিয়ে রাগ করে বের হতে যাচ্ছিলো, এমন সময় মেঘ তার উপর এক মগ পানি ঢেলে ভিজিয়ে দিলো! নাফিসা অবাক হয়ে পেছনে তাকাতেই মেঘ হেসে বললো,
– কোথায় যাচ্ছো, মিসেস মেঘা চৌধুরী? গোসল করবে না?
এমন কাণ্ডে নাফিসা চোখ ছোট করে বিরক্তি নিয়ে তাকালো। মেঘ হেসে তার কাছে এসে বললো,
– ভাবলে কিভাবে, গোসল না করিয়ে বের হতে দেবো! তুমি চাইলেও বের হতে পারবে না! আজ তো গোসল খুব ভালো জমবে বেগম! পারিবারিক গোসল হবে, বাবা-মা ও বাচ্চারা!
– বারবার বাচ্চারা বলছেন কেন! কয়জন বাচ্চা?
– হবে হয়তো, তোমার আমার বয়সের সমষ্টি যতো!
মেঘ হাহা করে হেসে উঠলো আর নাফিসা তার হাসি দেখে মৃদু হাসি ফুটিয়ে তুললো মুখে!
৪২.
মেঘ আসার পরপরই রোকসানা রান্না বসিয়েছিলো। মেঘ নাফিসা উভয়ই গোসল সেড়ে দুপুরের খাবার খেয়ে নিলো। সকাল থেকে এ পর্যন্ত তারা কেউই কিছু মুখে দেয়নি। এখন শান্তি। নাফিসা প্লেট নিয়ে রাখছে রান্নাঘরে। এর মাঝেই বমি এসে পড়েছে! উঠুনের এক কোনে এসে বমি করলো নাফিসা। রোকসানা দৌড়ে এসে মেয়েকে ধরলো। মেঘ শব্দ পেয়ে বাইরে এসে দেখলো নাফিসা বমি করছে! যা খেয়েছে সব উপচে দিয়েছে! মেঘ মগে পানি নিয়ে এগিয়ে গেলো। নাফিসার উদ্দেশ্যে বললো,
– মাত্র খেয়েছো, এখনই নড়াচড়া করার কি খুব প্রয়োজন ছিলো!
নাফিসা রুমে যাওয়ার জন্য উঠে দাড়ালো। রোকসানা বললো,
– জার্নি করে এসেছিস, এমনিতেই তো দুর্বল দেখাচ্ছে। একটু যত্ন নিবি না নিজের প্রতি! প্লেট তো আমিও আনতে পারতাম! স্বভাব খারাপ! পেটে যা ছিলো সব ফেলে দিয়েছে! চল, আবার খেয়ে নে।
– মাথা খারাপ তোমার!
– হ্যাঁ, আমার মাথা খারাপই! চল!
মেঘ মগ নিয়ে বাথরুমের দিকে যেতে যেতে বললো,
– আম্মি, ঠিক বলেছে মেঘা! খেয়ে নাও আবার। এমনিতেই এখন তোমার ডবল খাওয়া প্রয়োজন! আগে এক প্লেট খেয়েছো, এখন নতুন অতিথির জন্য দু প্লেট করে খাবে!
আম্মি নতুন অতিথির কথা শুনে অবাক হয়ে নাফিসার দিকে তাকালো! আর নাফিসার মেঘের উপর প্রচন্ড রাগ হচ্ছে! তাকে ফাসিয়ে দিয়ে সে চলে গেলো! আম্মি বললো,
– নতুন অতিথি মানে?
নাফিসা আমতাআমতা করে জবাব দিলো,
– নতুন অতিথি মানে নতুন অতিথি!
– কিসের নতুন অতিথি?
– এই মনে করো শীতকালে নতুন অতিথি পাখি আসে!
– নাফিসা! স্পষ্ট বুঝতে পারছি কথা ঘুরাচ্ছো! তার সাথে তোমার খাওয়ার কি সম্পর্ক! নতুন অতিথি কি তোমার পেটে?
নাফিসা অপরাধী দৃষ্টিতে রোকসানার দিকে তাকিয়ে মাথা নেড়ে ইতিবাচক জবাব দিলো। রোকসানা অবাক হয়ে গেছে তার উত্তরে! গলার আওয়াজ নিচু করে রোকসানা বললো,
– এতো তাড়াতাড়ি কেন! আরও কিছুদিন অপেক্ষা করতে পারতে!
নাফিসা চিন্তিত হয়ে বললো,
– মেঘ খুশি আমি খুশি! আম্মি, তুমি খুশি হওনি?
রোকসানা হেসে মেয়ের কপালে চুমু দিলো। চোখ তার ছলছল করছে! নাফিসার দু গাল ধরে বললো,
– খুশি হইনি মানে! আমার খেলার সাথী আসছে, আমি খুশি হবো না তো কে খুশি হবে! আমি তো ভাবতেই পারছি না আমার মেয়েটা এতো বড় হয়ে গেছে! আজ সে-ও নাকি মা হতে চলেছে!
নাফিসা হেসে আম্মিকে জড়িয়ে ধরলো। মেঘ দূর থেকেই মা মেয়ের মমতা দেখে মুখে হাসি ফুটিয়ে ঘরের দিকে এগোতে লাগলো। রোকসানা নাফিসাকে ছাড়িয়ে মেঘকে দেখে বললো,
– মেঘ! তোমার স্বভাব তো আরও বেশি খারাপ দেখছি! নতুন অতিথির খবর শুনিয়েছো তাও আবার মিষ্টি ছাড়া!
– আম্মি, আমার কোনো দোষ নেই! মেঘা কিন্তু আমাকে এখানে আসার পর জানিয়েছে অতিথির কথা!
অভিমান নিয়ে নাফিসার উক্তি,
– হ্যাঁ, সব দোষ আমার। এখন সবাই মিলে আমাকে মাইর দাও ইচ্ছেমতো!
– হ্যাঁ, এখন না খেলে দিবো তোকে ইচ্ছে মতো মাইর! চল!
রোকসানা নাফিসাকে টেনে নিজের রুমে নিয়ে গেলো। মেঘ নিশব্দে হেসে ঘরে চলে গেলো।