পাহাড়ে মেঘের ছায়া পর্ব-৫৭

0
799

উপন্যাসঃ পাহাড়ে মেঘের ছায়া
পর্ব – ৫৭
(নূর নাফিসা)
.
.
৫৩.
সবাই কেবিনের ভেতরে এলো। নাফিসাকে হেলান দিয়ে বসিয়ে রাখা হয়েছে সিটে। প্রথমেই মেঘ প্রবেশ করলো তার পিছু সৈকত মির্জাকে প্রবেশ করতে দেখে নাফিসা চমকে উঠলো! পরক্ষণে দেখলো তার আম্মি ও মারিশাসহ সবাই প্রবেশ করেছে। সৈকত মির্জা জিজ্ঞেস করলো,
– কেমন আছো আব্বু?
নাফিসা কোনো জবাব দিলো না শুধু মেঘ, মারিশা, মির্জা সাহেব ও তার আম্মির দিকে তাকাচ্ছে বারবার! আম্মিকে কেমন যেন চিন্তিত লাগছে! এই লোকটা এখানে এসেছে কেন! মেঘ! মেঘ কি জানিয়ে দিয়েছে সবটা! সৈকত মির্জা আবারও বললো,
– রাগ করে আছো আব্বুর সাথে! তোমার আম্মির কাছে ক্ষমা চেয়েছি তো। তোমার আম্মি বলেছে তোমার অভিমান কাটাতে পারলেই ক্ষমা করবে আমাকে। তুমি কি ক্ষমা করবে না আমাকে? জানিতো আমি, বাবা হিসেবে একদমই ভালো না। সেদিন চোখের সামনে দেখেও চিনতে পারিনি মেয়েকে!
নাফিসা তার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে অন্যদিকে তাকিয়ে রইলো। এই লোকটাকে অসহ্য লাগছে তার কাছে! নাফিসার এই মুখ ফিরিয়ে নেওয়া মেঘের একটুও পছন্দ হয়নি। এভাবে বড়দের অসম্মান করা হয়! অবশ্য তার কষ্টটা বুঝেই মেঘ চুপ করে আছে। মির্জা সাহেব বুঝতে পারছে মেয়ে তার কথা শুনতে চাচ্ছে না। তার প্রতি টান থাকলে প্রথম দেখার পরই পরিচয় দিয়ে দিতো। অবশ্য সে এটারই প্রাপ্য ছিলো। মোহিনী নার্সের কাছ থেকে বাচ্চাকে নিয়েছে। সৈকত মির্জার কাছে এসে বললো,
– ভাই সাহেব, এই যে আপনার নাতনী।
“মাশাল্লাহ” বলে মির্জা সাহেব হাত বাড়াতেই নাফিসা দাতে দাত চেপে বললো,
– মেঘ, ওই লোকটা কোলে নিলে আমি আমার মেয়েকে ছুয়েও দেখবো না!
– মেঘা! এসব কি বলছো তুমি! আংকেল অনুতপ্ত উনার কর্মের জন্য।
– মেঘ প্লিজ!
সবাই হতম্বর নাফিসার কথায়। রোকসানা যা নিয়ে চিন্তিত ছিলো সেটাই ঘটলো। নাফিসা মানবে না তার বাবাকে। মির্জা সাহেব আর বাচ্চাকে কোলে নিলো না। মোহিনীকে উদ্দেশ্য করে বললো,
– থাকুক ভাবি। দূর থেকেই দোয়া করি।
মির্জা সাহেব নাফিসার পায়ের কাছে এসে বসে নাফিসার পা স্পর্শ করতেই নাফিসা পা সরিয়ে নিতে চাইলো। কিন্তু পা ব্যাথার কারণে পারলো না। মির্জা সাহেব মেয়ের পায়ে হাত বুলিয়ে বললো,
– পাপ তো করেছিই। আল্লাহও নারাজ আমার উপর। পারলে এই হতভাগা বাপকে মাফ করে দিস মা। যদি মৃত্যুর পরে একটু শান্তি পাই তাতে। অবশেষে ক্ষমা তো চেয়ে যেতে পারলাম, এটাই আমার পরম সৌভাগ্য। না হয় আফসোস থেকে যেতো।
নাফিসার ভেতরটা ফেটে যাচ্ছে। চোখ মুখ খিচে রেখে বেডশিট আঁকড়ে ধরেছে সে! পা টাকেও সরিয়ে আনার জন্য ছটফট করছে! মেঘ তার অবস্থা দেখে কাছে এসে দাড়াতেই নাফিসা মেঘকে জড়িয়ে ধরে কান্না করে দিলো। কাদতে কাদতে বললো,
– মেঘ আর পারছি না আমি! চলে যেতে বলো। সহ্য করতে পারছি না! চলে যেতে বলো ওদের! মরে যাবো আমি!
নার্স বলছে, “হচ্ছে কি এসব! সিজারিয়ান রোগীর সমস্যা হবে এভাবে!”
মেঘ বললো,
– আংকেল, নাফিসা অসুস্থ!
সৈকত মির্জা চোখ মুছে বেরিয়ে যেতে যেতে বললো,
– ভালো থেকো। আমার মেয়েটাকে ভালো রেখো মেঘ! অনেক কষ্ট করেছে, আর কষ্ট পেতে দিও না! রোকসানা, ক্ষমা করো না আমাকে। একটু দোয়া করো যেন তারাতাড়ি পরকালে গমন করি। মারিশা, তোমার বোন ছোট থেকেই অনেক অভিমানী। ভুল বুঝো না তাকে। কখনো বাবার কথা মনে হলে চলে এসো দেখা করতে। কাউকেই জোর করবো না কোনোকিছুতে। আমার জন্যই আজ তোমরা সবাই এলোমেলো!
অন্য কেউ আর সুযোগই পেলো না কিছু বলার। রায়হান চৌধুরী বেরিয়ে গেলো মির্জা সাহেবকে থামানোর জন্য। রোকসানা বেরিয়ে গেলো নিরবে কান্না করতে করতে। মারিশা সহ একে একে সবাই বেরিয়ে গেলো। কেবিনে আছে শুধু মেঘ, বৃষ্টি আর মোহিনী। মেঘের যাওয়াটা জরুরি ছিলো কিন্তু নাফিসার জন্য পারছে না! কে জানে রায়হান চৌধুরী থামাতে পেরেছে কিনা! পরিবেশটা খুব নিরব, শুধু নাফিসার হুহু কান্নার আওয়াজ ভেসে আসছে। মেঘ নাফিসার মাথায় হাত বুলিয়ে থামানোর চেষ্টা করছে,
– মেঘা, প্লিজ চুপ করো। প্রব্লেম হবে তোমার। এভাবে কান্না করছো কেন! আংকেল চলে গেছেন, সোজা হও তুমি। কান্না থামাও। মেঘা, সবাই চলে গেছে। শান্ত হও। মেঘা!
মেঘ থামতে বলছে, বৃষ্টি ও মোহিনীও থামানোর চেষ্টা করছে। নাফিসা থামছে না। অবশেষে মেঘ রেগে গিয়ে এক ধমক দিলো এবং এক ঝটকায় ছুটিয়ে নিলো।
– এতো জেদ কেন তোমার! যা চাইছো তাই হচ্ছে! কোনো বাবা এসে মেয়ের পা পর্যন্ত স্পর্শ করে ক্ষমা চেয়েছে! সম্মান তো পেলোই না তোমার কাছে! এখন কাদছো কেন? নিজের সাথে কি বাচ্চার ও আমার সর্বনাশও করতে চাইছো!
মেঘ ছেড়ে দেওয়াতে নাফিসা দু’হাতে মুখ লুকিয়ে কাদছে। বৃষ্টি এসে অন্যপাশে বসলো এবং নাফিসাকে শান্তনা দেওয়ার চেষ্টা করলো। নাফিসা হাত সরিয়ে এবার পেটে ধরেছে। কান্না থামানোর চেষ্টা করছে নিজেই কিন্তু পারছে না। সে যে পেটে চেপে ধরেছে মেঘের চোখে এড়ায়নি সেটা। মেঘ দ্রুত নাফিসার পাশে বসে পড়লো। নফিসার হাতের উপর হাত রেখেই বললো,
– কি হয়েছে? পেটে ব্যাথা লাগছে না এখন! নার্স, প্লিজ কল ডক্টর!
নার্স দ্রুত বেরিয়ে গেলো। মেঘের মেজাজ প্রচুর খারাপ হচ্ছে তবুও রাগ দেখাতে পারছে না। ডাক্তার এসে চেকাপ করলো, তাকে কোনো রকম চাপ নিতে নিষেধ করলো। বিশ্রাম নিতে বললো। চিন্তিত হয়ে মেঘ কিছুক্ষণ পাশে বসে রইলো। পরক্ষণে মোহিনী তাকে বাসায় গিয়ে একটু বিশ্রাম নিতে বললো। বৃষ্টি আর মোহিনী ‌‌আছে পাশে। মেঘ রোকসানাকে সাথে নিয়ে বাসায় ফিরলো। খেয়েদেয়ে ফ্রেশ হয়ে আবার এসেছে। নাফিসা বসে আছে, পাশে বসে আছে বৃষ্টি। মেঘকে দেখে বৃষ্টি বেরিয়ে গেলো। মেঘ এসে নাফিসার পাশে বসলে নাফিসা ছলছল চোখে তাকিয়ে বললো,
– নিষেধ করেছিলাম না কাউকে কিছু জানাতে!
– জানানোটা প্রয়োজন ছিলো বিধায় জানিয়েছি।
– আমাকে আর আম্মিকে অশান্তির মাঝে ফেলার জন্য কি খুব প্রয়োজন ছিলো তোমার!
– কথা আস্তে বলো এবং শান্ত হয়ে বলো। প্রব্লেম হবে তোমার। আমি অশান্তি আনার জন্য বলিনি, বরং শান্তি আনার জন্য বলেছি।
– কোনো প্রয়োজন ছিলো না অতিরিক্ত শান্তির। ভালো কাটছিলো দিন, খুব সুখে ছিলাম এতোদিন।
– না জানালে এই সুখটুকুও পেতে না তুমি।
– মানে!
– এটা নিশ্চয়ই তোমার মনে আছে, মারিশা উঠেপড়ে লেগেছিলো আমাকে পাওয়ার জন্য! সে যেকোনো মুল্যে তোমার কাছ থেকে আমাকে দূরে সরিয়ে দিতো। বুঝিয়েছিলাম তাকে, কিন্তু কাজ হয়নি! শেষ মুহুর্তে জানিয়ে দিতে বাধ্য হয়েছি তুমি ওর বোন। আর তখনই থেমেছে সে। না হলে সর্বনাশ করে দিতো তোমার জীবন আর তার জন্য তুমি দোষারোপ করতে আমাকে। তুমি ওর বোন সেটা জানার পর থেকেই সে তোমার সাথে ভালো আচরণ করতে শুরু করেছে। কেননা, পরিবারকে খুব ভালোবাসে সে। এক সে আর তার বাবা ছাড়া কেউই নেই তার পরিবারে। মাঝে মাঝে আসতে চাইতো তোমার সাথে একটু দেখা করার জন্য, কিন্তু নিজেই আটকে রাখতো নিজেকে। কারণ সে জানতো তুমি তাকে তোমার কাছে আসতে দেখলে সন্দেহ করবে আর আমাকে হারানোর ভয় পাবে। তাই আসেনি। বাদ দাও। যা করার তা তো করেছোই তুমি! এবার নিশ্চয়ই খুব ভালো আছো। বিশ্রাম নাও। আর প্রেশার দূর করো।
– কাল থেকে এখানে পড়ে আছো। তোমার বিশ্রামের প্রয়োজন। অসুস্থ হয়ে পড়বে এভাবে!
– আমার কিছু হবে না। তোমরা ভালো থাকলেই আমি ভালো থাকি।
– আম্মি কোথায়?
– বাসায় রেখে এসেছি, বিশ্রাম নেওয়ার জন্য।
– তুমিও যাও। এখন ঘুমাবে একেবারে সন্ধ্যায় উঠবে। যাও।
– উহুম। ঘুম আসবে না। দেহ গেলেই কি, মন এখানেই পড়ে থাকবে।
– এদিকে চেপে হেলান দাও।
– না, কাজ আছে।
– এটাও কাজই, বাকি কাজ পরে করো। এসো এদিকে।
মেঘ নাফিসার কথামতো নাফিসার দিকে একটু চেপে বসেছে। নাফিসা চোখ বন্ধ করে থাকতে বললো। দু মিনিট পরেই বাচ্চার ঘুম ভেঙে গেলো। সাথে সাথেই মেঘ কোলে নিয়ে বসলো। নাফিসা বললো,
– চোখ বন্ধ করোনি তুমি!
মেঘ প্রতুত্তরে মুচকি হাসি দিয়ে বাচ্চার সাথে কথা বলতে লাগলো। নাফিসা বললো,
– আরেকটু পরে জাগলে কি হতো! বাবাকে একটু বিশ্রাম নেওয়ার সময় দেওয়া যেতো না, পচা মেয়ে!
– এতেই যে তার বাবার সুখ সেটা জানে সে।
পাচদিনের মাথায় বিকেলের দিকে নাফিসাকে হসপিটাল থেকে বাসায় নিয়ে আসা হয়েছে। বৃষ্টি ও আকাশ এখানেই আছে। রোকসানা ও মোহিনী নাতনীর যত্ন ভালো ভাবেই নিচ্ছে।
আজ মেঘ ধীর্ঘ সময় নিয়ে ঘুমিয়েছে। সকালে নাস্তার পর যে ঘুমিয়েছে, জেগেছে দুপুরের শেষ দিকে। খাওয়ার পর মেঘ রুমে এলে বৃষ্টি রুম থেকে বেরিয়ে গেলো। নাফিসা খেয়াল করলো এখন তাকে দেখে মনে হচ্ছে, তার সব ক্লান্তি দূর হয়ে গেছে। এই ক’দিন একটুও শান্তি দেয়নি তারা মা মেয়ে। নাফিসা ভেবেই মৃদু হাসলো। মেঘ নাফিসার মুখে হাসি দেখে কাছে এসে বললো,
– এতো হাসির কারণ কি?
– তুমি।
– কেন, পোশাক আশাকে ত্রুটি আছে নাকি কোনো দিক থেকে!
– ক্লান্তিতে ত্রুটি আছে।
– সেটা কেমন?
– গত কয়েকদিনের মধ্যে আজ ফ্রেশ লাগছে তোমাকে।
– তুমি কি ফ্রেশ আছো?
– হুম।
– তাহলে কিছু কথা বলি। মনযোগ দিয়ে ধৈর্যসহকারে শুনবে একটু?
– কি কথা?
– আগেই বলে নেই, মানো আর না মানো। শুনতে তো আর ক্ষতি নেই। ঠান্ডা মাথায় একটু শোনো।
– বলো।
– জীবনে প্রথম দেখা কোনো স্বামী তার স্ত্রীর কাছে হাত জোর করে ক্ষমা চায়! জীবনে প্রথম দেখা কোনো বাবা তার মেয়ের পা ধরে ক্ষমা চায়! মানুষ তো সবাই ভুল করে। হয়তো কারো ভুলের পরিধি বড় আর কারোটা ছোট। কিন্তু বিনিময়ে শাস্তি পায় উল্টো।
– মেঘ প্লিজ, প্রসঙ্গ পাল্টাও। এসব নিয়ে আমি কিছু শুনতে চাই না।

– মেঘা, আগেই বলেছি ধৈর্য ধারণ করে শুনো একটু। আংকেল ভুল করেছে আর সেজন্য তিনি অনুতপ্ত। কিন্তু আমার মতে তিনি কোনো ভুল করেননি। আমাকে ভুল বুঝো না, আমি কিন্তু কারো পক্ষ নিচ্ছিনা। শুধু তোমাকে জানাতে চাইছি যেটা তোমার অজানা। আংকেল প্রথম স্ত্রী রেখে আম্মিকে বিয়ে করেছে সন্তানের আশায়। কেননা উনার প্রথম স্ত্রী দ্বিতীয়বার সন্তান জন্ম দিতে অক্ষম ছিলো। প্রথম সন্তান তাও আবার কন্যা সন্তান। এতে তিনি অসন্তুষ্ট ছিলেন না কিন্তু বংশের প্রদীপ হিসেবে ছেলে সন্তান প্রত্যাশিত ছিলো উনার এবং উনার পরিবারের। সন্তান জন্ম দিতে অক্ষম সেটা কাউকে জানতে দেয়নি তারা দুজন। তাহলে হয়তো প্রথম স্ত্রীকে তাড়িয়েও দিতে পারতো উনার বাবা মা। সেদিকে আশ্বাস দিয়েছে মারিশার মাকে কিন্তু বাকিরা কষ্ট পাবে বলে কাউকে না জানিয়েই দ্বিতীয়বার বিয়ে করে। ভেবেছিলেন পুত্র সন্তানের জন্ম হলে দ্বিতীয় স্ত্রী নিয়ে বাড়িতে উঠবেন। কিন্তু এ সংসারেও জন্ম হয় কন্যা সন্তান। তিনি বাড়িতে নিয়ে যাওয়ার আর সাহস পায়নি তোমাদের। কেননা তার পরিবার যদি তোমাদের গ্রহণ না করে! পড়ে যান দোটানায় এবং পুত্র সন্তান জন্মের অপেক্ষায় থাকেন। এখানে উনার কি দোষ থাকতে পারে বলো। সবাই তো একাধিক সন্তানের প্রত্যাশা করে। আমাদের এক মেয়ে আছে, তুমি কি চাইবে না আরেক ছেলে আসুক? তাহলে উনার ইচ্ছায় দোষ কি ছিলো!
– উনি আম্মিকে ধোকা দিয়েছে, মিথ্যে বলেছে দিনের পর দিন।
– বললামই তো, দোটানায় পড়ে ঘটেছে সবটা। সব ঘটনা শুনে আম্মিও তো উনাকে ক্ষমা করে দিয়েছে তাহলে তুমি কেন পারছো না!
– আম্মি কখনোই ক্ষমা করবে না।
– করেছে মেঘা। আম্মি সেদিন বলেছে তোমার অভিমান ভাঙ্গাতে পারলেই ক্ষমা হয়ে যাবে। কিন্তু তুমি তো সেই সুযোগই দিলে না!
– মেঘ, কি করে দেই আমি সেই সুযোগ! আমি নিজ চোখে দেখেছি আম্মি দিনের পর দিন কেদেছে ওই লোকটার জন্য। কতটা কষ্ট করে আজও বেচে আছে সেটা আমি দেখেছি মেঘ! যেই বয়সটা বাচ্চারা বাবার সাথে দুষ্টুমি করে হেসে খেলে কাটায় সেই বয়সটা আমি নিজের ও আম্মির চোখের জল মুছে কাটিয়েছি। চোখের সামনে দেখেছি কঠিন বাস্তব। সারাদিন পরিশ্রম করে দু পয়সা রোজগার করে সংসার চালিয়েছে, আমার পড়াশোনা চালিয়েছে, শখের খেয়াল রেখেছে আমার আম্মি। তোমার কাছে সহজ মনে হলেও আমার কাছে সহজ না সেটা। ভুলিনি আজও, কত দৌড়াদৌড়ি করে স্কুলের জরিমানা মওকুফ করিয়েছি। আম্মির কষ্ট সহ্য করতে না পেরে নিজেই লুকিয়ে কাজ করতাম। ধরা পড়ে যাই আম্মির কাছে আর আম্মি রাগ করে আমি কাজ করেছি বলে। তবুও নিজের দিকটা দেখেনি তিনি। এই সময়টাতে তো খুব প্রয়োজন ছিলো উনাকে! কোথায় ছিলেন তিনি সেদিন! বেচে থাকতেও আমাদের এতো কষ্ট সহ্য করতে হলো কেন!
– যদি বলি এর জন্য আম্মি দায়ী!
– মেঘ!
– মেঘা তুমি অবুঝ না। বুঝো সবটাই। দেখো সেদিন যদি আম্মি তোমাকে নিয়ে পালিয়ে না আসতো তাহলে কি এমন জীবনের সম্মুখীন হতে তোমরা! কোনো কিছুরই তো অভাব ছিলো না আংকেলের । তোমরা নিজেদের অধিকার নিয়ে উনার দুয়ারে দাড়াতে পারলে না কেন! ঠাই হবে না সে ভয় ছিলো? তাহলে দেশে আইন ছিলো, আইনের আশ্রয় নিতে পারতে। তাছাড়া সমাজে কি একাধিক বিয়ে করে না কেউ, তাই বলে কি সবার জীবন এভাবে চলে! তোমাদের প্রাপ্যটুকু তো পেলেই হতো। আংকেল তো আর তাড়িয়ে দেয় নি। নিজের দিকটা তো খুব ভালো দেখলে, একবার নিজেকে ওই লোকটার জায়গায় দাড় করিয়ে দেখো তো, বিবেক কি বলে! আংকেল খুজেছে তোমাদের। এমনকি মারিশার মা যখন শুনেছে তিনি দ্বিতীয় বিয়ে করেছে তখন রাগ না করে তিনি নিজেও খুজেছে তোমাদের। অথচ রাগ করার অধিকার ছিলো তার। কারণ প্রথম স্ত্রী থাকতেও দ্বিতীয় বিয়ে করেছেন এটা সবাই মেনে নিতে পারে না। তুমি পুরোই আম্মির স্বভাবের। নিজের অধিকারটুকু আদায় করে নিতে জানো না। স্বার্থপর এই পৃথিবীতে বেচে থাকা খুব কঠিন মেঘা। নিজ স্বত্তাকে চিনতে শেখো। অন্যের আশায় ফেলে রেখো না কিছু। এটা বোকামি ছাড়া কিছুই না! আংকেল খুব কষ্ট পেয়েছে মেঘা, এতো বছর পর নিজের স্ত্রী আর সন্তানকে কাছে পেয়েছে তবুও তাদের মনে ঠাই পেলো না। আম্মি বুঝতে পেরেই আংকেলের সাথে স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করেছেন। এমনকি মারিশাকে আম্মি বলে ডাকার অধিকারও দিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু তোমার জন্য আর এগোতে পারলো না৷ শুধু মাত্র তোমার মুখ চেয়ে। লক্ষ্য করেছো তুমি? আম্মি কিন্তু একটা কথাও বলেনি সে সম্পর্কে। এমনকি প্রয়োজনীয় কথা ছাড়া কোন অতিরিক্ত কথাও বলেনি তোমার সাথে। তুমি তো মূল্যহীন স্বার্থপর হলে। একবার কি আম্মির কথাটা চিন্তা করেছো! আম্মি যে নিজের মেয়ের বাড়িতে থেকে কতটা লজ্জিত ও ইতস্তত বোধ করে সেটা একবারও পড়েছে তোমার নজরে! মেয়ের শ্বশুর বাড়ির লোকদের সম্মুখীন হতে হবে বলেই আম্মি আসতে চায়নি এ বাড়িতে। আত্মসম্মানবোধ আছে উনার। কিন্তু আমি মায়ের সম্মান দেই সর্বদা আম্মিকে আর আমার পরিবারও যথেষ্ট সম্মান করে সেটা তোমার নিজ চোখে দেখা। তবুও দেখো আম্মি তোমাকে ও আমাকে জিজ্ঞেস করে সব কাজ করে৷ উনার স্বামীর বাড়ি হলে কিন্তু সেটা কখনোই করতেন না। নিজের ইচ্ছেটাকে প্রাধান্য দিতেন। আম্মি তোমার কথা ভেবে আজও চুপ। ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও আংকেলের সম্মুখীন হতে চাচ্ছেন না। আমার বাবা মাও তোমার সাথে এ নিয়ে কথা বলতে চেয়েছিলো কিন্তু আমি তাদের থামিয়ে দিয়েছি। কেননা আমার বিশ্বাস তুমি অতি শীঘ্রই বুঝতে পারবে সবটা। সবার জীবনেই সঙ্গী প্রয়োজন, কেউই একা থাকতে পারে না। আম্মিও নিজের সুখদুখ কারো সাথে শেয়ার করতে চায়। তবে সবটা সবার সাথে শেয়ার করা যায় না। যেমন ধরো তুমি আমার সাথে যতোটা গল্প করো, আম্মির সাথে কিন্তু ততটা সময় দাও না। ওদিকে আংকেলও একই পরিস্থিতির সম্মুখীন। তোমাদের কথা মারিশা জানার পর সেও তার বাবার সাথে কথা বলা বন্ধ করে দিয়েছে। তাহলে আর উনার কাছে থাকেই বা কি বলতে পারো? বাবার সাথে রাগ করে নিহনকে বিয়ে করেছে স্বেচ্ছায়। তারপর থেকে পড়ে আছে শ্বশুর বাড়ি। সেদিন শুধু আংকেলের সাথে সিলেট এসেছিলো তোমাকে দেখতে। আজ তোমার বাবা সামনে থাকতেও অবহেলা করছো। কোনো দিন হয়তো এই বাবার জন্য কাদবে দেখে নিও। কিন্তু সেদিন হয়তো আর পাশে পাবে না! আফসোস করবে খুব! খুজবে তবু মিলবে না কভু!
নাফিসার দুচোখে অনবরত ঝরছে অশ্রু। মেঘ কাছে এসে দু’হাতে চোখের পানি মুছে দিয়ে বললো,
– তুমি সব বুঝো মেঘা। বুঝার বয়স হয়েছে তোমার। বাচ্চার মা ও হয়ে গেছো, দুদিন পর নিজের মেয়েকে বুঝাতে শুরু করবে। তখন কি শিক্ষা দিবে মেয়েকে, বলোতো? এটাই কি শিক্ষা দিবে? বাবা ভুল করলে বাবাকে আশ্রয় দিবে না! বাবা মন না রাখলে বা সময় না দিলে এমন অবহেলা ও অভিমান করবে যাতে সারাজীবনেও না ভাঙে সে অভিমান! কি এসবই শিখাবে? তারপর যদি বাবা এসে পায়ে ধরে ক্ষমাও চায় তবুও মুখ ফিরিয়ে নিবে!
নাফিসা দু’হাতে কান চেপে ধরে বললো,
– মেঘ, চুপ করো প্লিজ! আর শুনতে পারছি না আমি এসব! ঠিক সেই মুহুর্তটা আমার দম বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছিলো! এমন কিছু ঘটার আগে আমার মরণ হলো না কেন!
নাফিসা হুহু করে কেদে উঠলো! চিৎকার করে কাদতে ইচ্ছে করছে কিন্তু পারছে না! মেঘ তাকে কাদতে বাধা দিচ্ছে না বরং নিজের বুকে ঠাই দিয়েছে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here