উপন্যাসঃ পাহাড়ে মেঘের ছায়া
পর্ব – ৬
(নূর নাফিসা)
.
.
৮.
বিকেলে বাচ্চাদের পড়ানোর জন্য সেই ছোট পাহাড়ে এলো নাফিসা। গোল হয়ে বসে বাচ্চারা খেলা করছিলো। নাফিসাকে দেখতেই বাচ্চারা সোজা হয়ে দাড়িয়ে গেলো। শুধু একজনই বসে ছিলো, সেটা বড় বাচ্চা মেঘ! নাফিসা তাকে দেখে অবাক হলো! সে কি ঢাকা ফিরে যায়নি কাল! আজ বিকেল হয়ে গেছে এখনো শ্রীমঙ্গলে আছে! এখন আবার কার বাসায় উঠেছে! বাচ্চাদের বসতে বলে মেঘকে জিজ্ঞেস করলো,
– আপনি এখানে কেন?
– কেন কোথায় থাকার কথা ছিলো?
– কোথায় থাকার কথা ছিলো তা আমি জানি না। কিন্তু আপনি এই বাচ্চাদের মাঝে কেন?
– এসেছি বাচ্চাদের সাথে খেলতে আর বাচ্চাদের টিচারের কাছে কিছু শিখতে।
– উঠুন, উঠুন বলছি।
মেঘ বসা থেকে উঠে দাড়ালো,
– আচ্ছা, উঠলাম। এবার বলুন ম্যাডাম।
– চলে যান এখান থেকে। এই পাহাড় থেকে নেমে যান।
– বাড়িটা আপনাদের ছিলো কিন্তু পাহাড়টা নিশ্চয়ই আপনাদের না! সুতরাং আমি এখানে থাকতেই পারি।
– আমি এখানে যতক্ষণ আছি, ততক্ষণের জন্য আপনি থাকতে পারবেন না।
– কেন আমি তো তোমাকে বিরক্ত করছি না!
– আপনার সাথে কথা বলে আমার সময় নষ্ট হচ্ছে। দয়া করে যান এখান থেকে।
– ওকে, পড়াও।
মেঘ নেমে এলো পাহাড় থেকে। পাহাড়ের রাস্তায় কিছুক্ষণ হাটাহাটি করলো, কিছুক্ষণ পাহাড়ের গা ঘেঁষে বসে বাচ্চাদের পড়া শুনলো। একটুপর যখন লাইন ধরে বাচ্চাদের পাহাড় থেকে নামতে দেখলো, তখন মেঘ দৌড়ে পাহাড়ে উঠে এলো। নাফিসার পথ আটকে দাড়াতেই নাফিসা বললো,
– আপনি এখনো যাননি?
– না।
– আমার সামনে দাড়িয়ে আছেন কেন? সরে দাড়ান।
– সরে দাড়ালে পথ আটকাবো কিভাবে?
– কি চাইছেন আপনি?
– তোমাকে।
– মানে!
– মানে, তোমার সাথে একটু সময় কাটাতে চাইছি। ওদিকটায় চলো, দুজন বসে একটু গল্প করি।
– গল্প করার মতো সময় আমার হাতে নেই। আমি আপনার মতো বসে বসে খাই না। উপার্জন করলেই হাড়িতে ভাত আসে।
– এজন্যই তো তোমাকে এতো পছন্দ করি। তবে এটা তোমাকে কে বললো যে আমি বসে বসে খাই!
– কাউকে বলতে হবে কেন! আমি কি নিজ চোখে দেখছি না। কাজকর্ম থাকলে কি আর এখানে থেকে থেকে অন্যের কাজে ব্যাঘাত সৃষ্টি করতেন?
– একটু সময় নিয়ে গল্প করতে চাচ্ছি, তার জন্য কতো কথা শুনিয়ে যাচ্ছো!
নাফিসা মেঘকে ধাক্কা দিয়ে একপাশে সরিয়ে নেমে এলো। মেঘ পাহাড়ের উপর থেকেই বললো,
– গল্প করার সময় আমি ঠিক খুঁজে নিবো, মেঘা। দেখে নিও তুমি….
পথের ধারে চায়ের দোকানে ঢুকে এক কাপ চা নিলো মেঘ। সিলেটে আসার পর এই মাটির কাপে চা মেঘের মাঝে নতুন অনুভূতি সৃষ্টি করেছে। জ্বিভে স্বাদ স্পর্শ করতেই সর্বাঙ্গে এক অজানা শিহরণ বয়ে যায় এবং ফুরফুরে করে দেয় মন! তাই সুযোগ পেলেই এক কাপ চা নিয়ে মুহূর্তটা উপভোগ করে মেঘ। চায়ের দোকান থেকে বেরিয়ে রিসোর্টের দিকে যাওয়ার পথে দেখলো চা পাতা তোলার জন্য দলবেঁধে মেয়েগুলো চা বাগানে নামছে। হঠাৎ মনে হলো, নাফিসাও তো সকাল বিকাল দুবার চা পাতা তুলতে আসে! মেঘ পথ চলা থামিয়ে অপেক্ষা করতে লাগলো তার মেঘার জন্য। একটু পর অন্য এক দলে নাফিসাকে দেখতে পেল। নাফিসা বাগানে চা পাতা তুলতে লাগলে মেঘও নেমে এলো তাদের সাথে। মেয়েগুলো ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে আছে মেঘের দিকে, আর নাফিসার প্রচুর রাগ হচ্ছে এভাবে পিছু নিচ্ছে বলে। মেয়েগুলো না থাকলে এখন দু’চারটা কথা শুনিয়ে দিতো। তাদের সামনে কিছু বলতে গেলে সমস্যায় পড়তে হবে তাই চুপচাপ চা পাতা তুলে যাচ্ছে। মেঘ নাফিসার লাইনে এসে কয়েকটি পাতা ছিড়ে নাফিসার পিঠের ঝুড়িতে রাখলো। নাফিসা বিরক্তি নিয়ে বললো,
– এসব কি হচ্ছে! পাতাগুলো এভাবে নষ্ট করছেন কেন?
– কেন, নষ্ট হয়ে গেছে? তোমাদের দেখে আমারও ইচ্ছে হলো তুলতে, তাই তুলছিলাম।
– হ্যাঁ নষ্ট হয়ে গেছে। বের হন এখান থেকে!
– আশ্চর্য! আমি পাতা তুলতে এসেছি। কোথায় শিখিয়ে দিবে, তা না করে তাড়িয়ে দিচ্ছো!
– হ্যাঁ তাড়িয়ে দিচ্ছি। আপনি থাকায় আমার অসুবিধা হচ্ছে।
মেঘ চলে এলো সেখান থেকে। এই মেয়ের মন যে পাথরের মতো শক্ত, তা অনেক আগেই বুঝে গেছে!
.
সকালে ঘুম থেকে উঠে মেঘ হোটেলে নাস্তা করে নিয়েছে। তারপর চা বাগানের দিকে হাটতে লাগলো। নাফিসা চা পাতা তুলতে এলে আজও তার সাথে নেমে গেলো বাগানে। পাতা তুলে নাফিসার ঝুড়িতে রাখতেই নাফিসা চোখ রাঙিয়ে মেঘের দিকে তাকালো। মেঘ এভাবে তাকাতে দেখে বললো,
– হচ্ছে না যখন শিখিয়ে দাও না! বেড়াতে এসেছি যখন কিছু না শিখলে কি সার্থক হবে!
নাফিসার দলের মেয়েগুলো একটু পর পর তাকাচ্ছে আর হাসছে। তারাও বুঝে গেছে ছেলেটি নাফিসার পেছনে পড়েছে! তাদের মধ্যে একজন বললো,
– নাফিসা, দে না শিখিয়ে।
এবার নাফিসা দেখিয়ে দিলো, কিভাবে তুলতে হয়। মেঘ চুপচাপ তাকে অনুসরণ করে কিছু পাতা তুলে নাফিসার ঝুড়ি ভর্তি করে দিলো। চলে যাওয়ার সময় মেঘ পেছন থেকে বললো,
– মেঘা, পাহাড়ে আজ একটু আগে আসবে?
মেয়েগুলো সবাই হা করে আছে। নাফিসা পেছনে ফিরে মেঘের কাছে এসে বললো,
– এই নামটা কালও পাহাড় থেকে নামার সময় শুনেছি। কে মেঘা?
– তুমি মেঘা।
– আমি মেঘা না। আমি নাফিসা। নূর নাফিসা।
– হ্যাঁ, সবার কাছে তুমি নূর নাফিসা হতে পারো। কিন্তু শুধু আমার জন্য মেঘা। তুমি এই মেঘের মেঘা।
– আর কখনো মেঘা বলে ডাকবেন না। আর আমি পাহাড়ে আগে আসবো না, আপনাকে যেন পাহাড়ে না দেখি।
নাফিসা আবার সামনে এগিয়ে গেলো। এক মেয়ে নাফিসাকে বললো,
– অন্নেক হ্যান্ডসাম রে নাফিসা! মানাইছে তোর ধারে! তুই মাইনা যা!
বাকি মেয়েগুলো মিটিমিটি হাসছে আর নাফিসা রাগী দৃষ্টিতে মেয়েটির দিকে তাকিয়েছে! মেঘও মেয়েটির কথা শুনে মুচকি হেসে পেছন থেকে বললো,
– মেঘা, ওর মতো সবাই বলবে তুমি আমি একে অপরের জন্য পারফেক্ট!
দুপুরে মেঘ হামহাম ঝর্ণাতে এলো। সেদিন পাহাড় থেকে বুঝা যাচ্ছিলো খুব কাছে ঝর্ণাটি। হয়তো তিন চার মিনিটের পথ হবে। আজ এসে দেখলো বিশ মিনিটেরও অধিক সময় লেগেছে! অনেক লোক আছে এখানে। চাকমাসহ, ঢাকাইয়াও দেখা যাচ্ছে। বেড়াতে এসেছে বোধহয়! তাদের সাথে নেমে মেঘও অনেক্ক্ষণ ঝাপাঝাপি করলো ঝর্ণার পানিতে। তবে এটা বুঝতে পারছে বন্ধুরা এলে গোসলে আরও বেশি মজা হতো! বিকেলে নাফিসার আগেই পাহাড়ে এসে খোলা আকাশের নিচে সবুজ ঘাসের উপর শুয়ে আছে মেঘ। একটু পর দু একজন করে বাচ্চারা আসতে লাগলো। সবার কাছে বসার জন্য আলাদা আলাদা ছোট মাদুর আছে। মাদুর পেতে বাচ্চারা বসে পড়লো। কয়েকজন এসে গতকালের মতো খেলার জন্য মেঘকে টানতে লাগলো। মেঘ উঠে একজনের কাছ থেকে খাতা নিয়ে যোগবিয়োগ খেলা খেলে তাদের কৌশলে যোগ আর বিয়োগ শিখিয়ে দিলো। তারপর জাতীয় সংগীতের তৃতীয় ও চতুর্থ লাইন গেয়ে শেখাল। গতকাল প্রথম দুই লাইন শিখিয়েছিলো। এবার চার লাইন একসাথে বাচ্চাদের গাইতে বললে বাচ্চারা শিখিয়ে দেওয়া সুর টেনে গাইতে লাগলো। নাফিসা পাহাড়ে উঠার সময় বাচ্চাদের সুরেলা কন্ঠ শুনে অবাক হলো। দ্রুত গতিতে পাহাড়ে উঠে এসে দেখলো মেঘ দাড়িয়ে আছে আর বাচ্চারা সংগীত গাইছে! দেখে নাফিসা খুব খুশি হলেও তা বাইরে প্রকাশ করলো না। মেঘ নাফিসাকে দাড়িয়ে থাকতে দেখে বাচ্চাদের থামতে বললো। নাফিসার কাছে এসে বললো,
– মেঘা, কথা দিচ্ছি বিরক্ত করবো না। থাকতে পারবো তো এখানে কিছুক্ষণ ?
– থাকুন।
মেঘ খুশি হয়ে এক পাশে এসে ঘাসের উপর শুয়ে আকাশ পানে তাকিয়ে উড়ন্ত ঘাষ ফড়িং এর সাথে দৃষ্টিতে খেলতে লাগলো আর রঙিন স্বপ্ন গুলো সাজাতে লাগলো। যদি থাকতো শত রঙের প্রজাপতির ডানা, তাহলে আজ ভুবনে থেকে দৃষ্টিতে নয়! উড়ে উড়ে সঙ্গ দিতো তাদের আর জমিয়ে দিতো রঙিন খেলামেলা! দৃষ্টির সম্মুখে আকাশে ভেসে যাচ্ছে সাদাকালো মেঘ। অন্যদিকে কানে তার মধুর সুর হয়ে ভেসে আসছে বাচ্চাদের পড়া। জমিনে শুয়ে থাকা মেঘ খুব গভীর ভাবে অনুভব করছে মুহুর্তটাকে! একটু পর বাচ্চাদের সুর বন্ধ হয়ে গেল। মেঘ ঘাড় ঘুরিয়ে তাকিয়ে দেখলো বাচ্চারা লাইন ধরে নেমে যাচ্ছে আর তার মেঘা তার দিকে অগ্রসর হচ্ছে! নাফিসা এসে মেঘের কাছে বসে দূরে থাকা উচ্চ পাহাড়ের দিকে তাকিয়ে রইলো। এদিকে মেঘ স্বপ্ন দেখছে নাকি বুঝতে পারছে না! চোখের পাতা কয়েকবার বন্ধ করলো আর খুললো। তারপর উঠে বসলো, এ তো সত্যিই তার মেঘা তার পাশে বসে আছে! মেঘ জিজ্ঞেস করলো,
– চা পাতা তুলতে যাবে না আজ?
নাফিসা পাহাড়ের দিকে দৃষ্টি রেখেই জবাব দিলো,
– হ্যাঁ, যাবো। বেড়াতে এসেছেন, আর কত থাকবেন? ঢাকা ফিরে যাচ্ছেন না কেন?
– পাহাড়ি কন্যার মায়া যে ছাড়ে না আমায়!
– এভাবে পিছু নিচ্ছেন কেন আমার?
– ভালোবাসি, তাই।
নাফিসা এবার মেঘের দিকে তাকিয়ে বললো,
– ভালোবাসার জন্য আর কাউকে চোখে পড়লো না? আমাকে কেন এভাবে বিরক্ত করে যাচ্ছেন?
– প্রথম দেখেই তোমাকে ভালো লেগেছে। আর সেবাযত্ন করে তো আমার হৃদ মাঝারেই বসে গেছো যেটা অন্যকারো পক্ষে সম্ভব হয়নি! তাছাড়া আগেই তো বলেছি, আমাকে আশ্রয় দিয়ে তুমি সবচেয়ে বড় ভুল করেছো। এখন যে আমি তোমার ভালোবাসার জন্যই পাগল হয়ে আছি!
– ভালোবাসা পাথর চাপা দিয়ে ঢাকা ফিরে যান।
– ঢাকা ফিরতে হলে মেঘাকে সাথে নিয়েই ফিরবো।
– এসব পাগলামি পাহাড়ে মানায় না।
– তুমি চাইলেই মেনে যাবে।
– তাহলে জেনে রাখুন আমি চাইবো না কখনো সেটা।
নাফিসা উঠে চলে গেলো। মেঘ শুধু মেঘার যাওয়ার পানে চেয়ে মুচকি হাসলো।