উপন্যাসঃ পাহাড়ে মেঘের ছায়া
পর্ব – ৮
(নূর নাফিসা)
.
.
বৃষ্টি সিমির কাছে গিয়ে বান্ধবীকে কল করার জন্য মোবাইল চাইলো। সিমি তার ফোন বৃষ্টিকে দিলে বৃষ্টি তাবু থেকে কিছুটা দূরে এসে রূপার কাছে কল করলো।
– হ্যালো, রূপা?
– হ্যাঁ বৃষ্টি, বল। কখন আসবি তুই? তোর জন্য কোথাও ঘুরাও হচ্ছে না!
– আমি আসবো না।
– কিইইইই!
– হ্যাঁ, আমি আসবো না। তোরা তোদের মতো করে ঘুরে ঢাকা ফিরে যা। আমি এখানেই আছি কয়েকজন আপু ভাইয়ার সাথে। ওদের সাথেই ঢাকা ফিরে যাবো।
– পাগল হয়ে গেছিস! এমনিতেই বাসায় মিথ্যে বলে এসেছি! আবার তুই বলছিস তোকে রেখে ঢাকা ফিরে যাবো! কাল রাতেও আংকেল তোর ফোনে কল করেছে। আমি রিসিভ করে মিথ্যে বলেছি, যে তুই ঘুমিয়ে আছিস। আবার ফোন দিলে কি বলবো!
– গুড! ভেরি গুড! তুই এক কাজ কর, আমার ফোনটা অফ করে দে। আর বাবাকে যা বলার আমি কল করে বলে দিবো। আর শুন, তোরা নিজেদের মতো ঘুরেফিরে ঢাকায় ফিরে যা। আমার ব্যাগটাও নিয়ে যাবি। আমি ঢাকা ফিরে তোর কাছ থেকে ব্যাগ নিয়ে নিবো। তুই সবার আগে এখন আমার ফোনটা অফ কর। রাখি এখন। আল্লাহ হাফেজ।
বৃষ্টি কল কেটে তার বাবার নম্বরে ডায়াল করলো। রিসিভ হতেই বললো,
– বাবা, কেমন আছো?
– আলহামদুলিল্লাহ। তুমি কেমন আছো?
– আমিও আলহামদুলিল্লাহ। মা ভালো আছে?
– হ্যাঁ। এটা কার নম্বর?
– এটা এক ফ্রেন্ডের কাছ থেকে নিয়ে কল করেছি। আমার ফোনটা নষ্ট হয়ে গেছে। ভাবছি ঢাকা ফিরেই ঠিক করবো। তুমি আবার বারবার কল করো না এটাতে। তাহলে ওরা বিরক্ত হতে পারে।
– তাহলে কথা বলবো কিভাবে? কবে আসবে তুমি?
– আমার ফিরতে দেড়ি হবে। আরো একসপ্তাহের মতো থাকবো। আমাকে নিয়ে কোন চিন্তা করো না। তোমার মেয়ে স্ট্রং! পরিবেশটা ভালো লাগছে তাই আরো কিছুদিন থাকবো। না করবা না প্লিজ। আর আমি মাঝে মাঝে তোমাকে ফ্রেন্ডের ফোন থেকে কল করবো।
– আচ্ছা। ভালো থাকিস।
– ওকে, আল্লাহ হাফেজ।
কল কেটে বৃষ্টি প্রশান্তির হাসি দিলো। যাক, সবটা ম্যানেজ করা হয়ে গেছে। এবার এদিকটা ম্যানেজ করতে হবে। নাস্তা করা শেষে আকাশ বৃষ্টিকে জানালো, আজ তাকে এগিয়ে দিয়ে আসতে পারবে না। আবহাওয়াটা খুব সুন্দর। তাই তার জন্য এখন ফিল্মের কাজটা মিস করতে পারবে না। বৃষ্টি যেন আর একটা দিন কষ্ট করে তাদের সাথে থাকে আর তার ফ্রেন্ডদের যেন কল করে জানিয়ে দেয় কাল ফিরবে তাদের কাছে! বৃষ্টি তো সেই খুশি! সে তো এটাই চাচ্ছিলো কোনভাবে যেন তাদের সাথে থাকতে পারে। যাক, সুযোগটা পেয়েই গেলো! দুপুর পর্যন্ত তাদের সাথে শর্ট ফিল্ম দেখলো। ভালোই অভিনয় করতে পারে এক এক জন। এখন সবাই গোসল করতে যাবে। বাকিটা বিকেলে করবে। সবাই জংলী পোশাকে আছে। বৃষ্টির কাছে দেখতে খুবই ভালো লাগছে। তাবু থেকে একটা বড় পাতিল আর একটা কলস নিয়ে তারা জংগল থেকে বেরিয়ে আসতে লাগলো। কলস দেখে সিমিকে জিজ্ঞেস করলো,
– আপু, এটা নিচ্ছো কেন?
– পানি আনবো।
– পানি দিয়ে কি করবে?
– কাল থেকে কি পানি না খেয়ে আছো?
– ওহ! তবে লেকের পানি খেয়েছি?
– বোকা মেয়ে! পাহাড়ি অঞ্চল, ঝর্ণার অভাব! ঝর্ণার বিশুদ্ধ পানি খেয়েছিলে।
বৃষ্টি তাদের সাথে জংগল থেকে বেরিয়ে বিছানাকান্দি ঝর্ণার ধারে এলো। খুব সুন্দর জায়গা! ছোট বড় পাথরে ভরপুর! উঁচু পাহাড় থেকে নেমে আসছে ঝর্ণা! ঝর্ণার পানি পাথরের উপর আছড়ে পড়ছে! ছেলেগুলো ঝাপাঝাপি করে ঝর্ণার ধারে লেকের পানিতে নেমে গেলো। মেয়েরাও কোমড় পানিতে নেমেছে বৃষ্টি খুব সাবধানে পাথরের উপর দাড়িয়ে অল্প পানিতে নেমেই গোসল করেছে। গোসল শেষে পানি থেকে উঠে একদিকে ছেলেরা, একদিকে মেয়েরা গাছের আড়ালে এসে কাপড়চোপড় পাল্টে নিলো। ভেজা কাপড়চোপড় ধুয়ে শুকনো পাথরের উপর মেলে দিলো শুকানোর জন্য। অত:পর আকাশ কলস নিয়ে ঝর্ণার দিকে যেতে লাগলো পানি নেয়ার জন্য। সাথে রওনক আর রিজভী বড় পাতিল হাতে নিয়ে পাতিল বাজাতে বাজাতে আকাশের সাথে যাচ্ছে। অভ্রসহ মেয়েরা দাড়িয়ে আছে একপাশে। বৃষ্টির ইচ্ছে করছে সেই সমান্তরালভাবে নেমে আসা ঝর্ণার ধারে যেতে। যেই ভাবা সেই কাজ! বৃষ্টি প্যান্ট ফোল্ড করে, ওড়না টা গলায় পেচিয়ে ঝুলন্ত মাথা ছোট করে নিলো। তারপর পাথরের উপর দিয়ে হেটে হেটে চলে গেলো তাদের পিছু। অথৈ ডাকছিলো বৃষ্টিকে কিন্তু সেদিকে কান দিলো না বৃষ্টি। ডুবন্ত শ্যাওলাজমা পাথরে খুব সাবধানে পা ফেলে তাদের কাছে চলে গেলো। আকাশ ঝর্ণার নিচে কলস ধরে রেখেছে পানি নেয়ার জন্য আর বড় পাতিলটা নিচে রাখা হয়েছে। কলস ভরে পাতিলে ঢালা হচ্ছে। বৃষ্টি বললো,
– এই পানিতে কোন ময়লা নেই?
রিজভী বললো,
– হ্যাঁ, উড়ন্ত পক্ষীর গু আছে! হা হা হা!
-ছি! কি বাজে লোক!
বৃষ্টিকে দেখে রওনক বললো,
– তুমি এখানে এসেছো কেন শুধু শুধু?
বৃষ্টি উৎফুল্ল হয়ে জবাব দিলো,
– খাড়া ঝর্ণায় হাত ভেজাবো বলে।
বৃষ্টির অদ্ভুত ইচ্ছের কথা শুনে পেছনে ফিরে একবার বৃষ্টির দিকে তাকালো আকাশ। রিজভী হেসে বললো,
– হাত ভেজাতে গিয়ে যদি এই ফাদে পড়ো, তোমার চিহ্নও খুঁজে পাওয়া যাবে না।
পানি নেওয়া শেষ হলে রওনক আর রিজভী পাতিল ধরে নিয়ে আসতে লাগলো। আকাশ কলস হাতে নিতেই বৃষ্টি বললো,
– প্লিজ, এখানে হাত ভেজাবো। ঝর্ণা স্পর্শ করবো একবার।
– করো, না করেছে কে! একবার বাচিয়েছি বলে বারবার বাচাতে যাবো এটা ভেবে ভুল করো না।
কথাটা বলে আকাশ চলে আসছিলো বৃষ্টি তারাহুরো করে আকাশের সামনে লাফ দিয়ে পথ আটকাতে গেলে পানি ছিটে আকাশ আর বৃষ্টি দুজনেই হালকা ভিজে যায়! আকাশ রাগী দৃষ্টিতে তাকালো বৃষ্টির দিকে। বৃষ্টি আহ্লাদী সুরে আবার বললো,
– প্লিজ একটু ধরুন না আমাকে। একটু স্পর্শ করবো ঝর্ণা।
আকাশ কলস পাশে অন্য পাথরের উপর রেখে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বললো,
– এসো।
বৃষ্টি খুশি হয়ে আকাশের হাত ধরে সামনে গেলো। অসমতল জায়গায় আকাশ খুব সাবধানে দাড়িয়ে বৃষ্টিকে ধরে রইলো। বৃষ্টি উৎফুল্ল হয়ে এক হাতে আকাশকে ধরে রেখে অন্য হাতে ঝর্ণা স্পর্শ করলো। অন্যরকম এক ভালো লাগা! আকাশ বৃষ্টির আনন্দ দেখে বৃষ্টির দিকে তাকিয়ে রইলো। বৃষ্টি আকাশকে তার দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে ঝর্ণা হতে হাত নামিয়ে আকশেরও একটা হাত টেনে নিয়ে আবার ঝর্ণা স্পর্শ করলো! আকাশ আরো গভীরভাবে বৃষ্টির দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো। বৃষ্টি আকাশের চোখে পলকহীন তাকিয়ে আছে! এ দৃষ্টি স্বাভাবিক নয়! দুজনের দৃষ্টি নিরবে কথা বলে যাচ্ছে! বৃষ্টি মুহুর্তটা গভীরভাবে অনুভব করছিলো! আকাশ আচমকা হাত সরিয়ে নিয়ে অন্যদিকে তাকালো। এ কোথায় ভেসে যাচ্ছিলো সে! এ মেয়েটা তার মাঝে কেমন যেন অনুভূতি সৃষ্টি করে দিচ্ছিলো! সে বৃষ্টিকে সরিয়ে এনে কলস হাতে নিয়ে চলে এলো। বৃষ্টিও তার পিছু পিছু চলে এলো আর বন্ধুবান্ধব তো আছেই তাদের নিয়ে ঠাট্টা করার জন্য! বিকেলটাও খুব মজা করে তাদের সাথে কাটালো বৃষ্টি! যখনই সুযোগ পাচ্ছে আকাশের সাথে কথা বলছে, অভ্র আর রিজভীর সাথে মিলে একটু একটু দুষ্টুমি করছে! মানুষগুলো সত্যিই অন্যরকম!
১১.
মেঘা পাহাড় থেকে চলে যাওয়ার পর মেঘ আবার ঘাসের উপর শুয়ে আকাশ পানে তাকিয়ে রইলো। সন্ধ্যা পর্যন্ত আকাশে ভেসে বেড়ানো মেঘ আর উড়ন্ত ঘাস ফড়িংয়ের সাথে খেলা করেই সময়টা পার করে দিলো। সূর্য ডুবে অন্ধকার হয়ে আসছে, মেঘ উঠে পাহাড় থেকে নেমে গেলো। রিসোর্টের পথের ধারে হাটতে লাগলো। চা বাগানে কাউকে দেখা যাচ্ছে না। চলে গেছে হয়তো সবাই। টংয়ের উপর বসানো মুদি দোকানে এলো মেঘ। মাটির কাপে এক কাপ চা না খেলেই নয়। এখানে আসার পর এটা রোজকার অভ্যাস হয়ে গেছে। বড়দের আড্ডায় কিছুক্ষণ বসে ছিলো। তাদের কথাবার্তা, হাসিঠাট্টা সম্পূর্ণ ভিন্ন! এক এক বিষয় নিয়ে এক একজন, এক এক কথা বলে যাচ্ছে। হঠাৎ কোন দূর মসজিদ থেকে আযানের শব্দ ভেসে এলো। এখানে আসার পর মেঘ মসজিদ দেখেনি কিন্তু নাফিসার বাসায় থাকাকালেও কয়েকবার দূর থেকে আযানের শব্দ শুনতে পেয়েছিলো। মোবাইলটা হাতে নিয়ে দেখলো সাড়ে সাতটা বাজে। ইশার আযান দিয়েছে। বাসায় থাকলে নামাজ তেমন মিস হয় না। কিন্তু সিলেট আসার পর সেই যে হবিগঞ্জে নামাজ পড়েছিলো আর পড়া হয়নি। তারপর তো এক্সিডেন্টই হলো। যাক আজ নামাজ পড়বে তাই দোকান থেকে বেরিয়ে রিসোর্টে ফিরে এলো। সেখানেই নামাজ আদায় করে নিলো। রেস্টুরেন্টে ডিনার করে বাবা মায়ের সাথে কিছুক্ষণ কথা বললো। বৃষ্টির খবর নিয়ে জানতে পারলো তারা কুমিল্লা গেছে বেড়াতে। বেশি রাত জেগে না থেকে ঘুমিয়ে পড়লো মেঘ।