#পুনম
#আয়েশা_সিদ্দিকা
পর্বঃ০১
সময় রাত সাড়ে আটটা। নিয়াজ উদ্দিন সাহেব বারান্দায় পাতা বেতের চেয়ারে বসে বার বার ঘড়ি দেখছেন। তার চতুর্থ কন্যা এখনো বাড়ি আসেনি।সাতটা কি সাড়ে সাতটায় তার মেয়ে বাসায় এসে উপস্থিত হয় কিন্তু আজ এখনো আসে নি। মেয়েরা বাহিরে থাকলে পৃথিবীর কোন মেয়ের বাবাই শান্তিতে নিঃশ্বাস পর্যন্ত ফেলতে পারে না।
নিয়াজ সাহেব পুনরায় আবার ঘড়ি দেখছে,মনে হচ্ছে তার ঘড়ি আজ ফাস্ট চলছে। তার ঘাম হচ্ছে, পুনম বাড়ি ফেরা না পর্যন্ত সে এভাবেই ঘড়ি দেখবেন আর অস্থিরতায় ঘামতে থাকবেন।
ঢাকার মোহাম্মদপুরে দু কাঠা জমির উপর একতলা একটি পৈত্রিক বাড়ি নিয়াজ সাহেবের। পাঁচ রুম, দুটি বারান্দা আর বাড়ির সামনে ছোট্ট একটি উঠোন নিয়ে নিয়ে বাড়িটি।
নিয়াজ উদ্দিন ভূমি অফিসের খুবই ছোট একটি পদে কর্মরত রয়েছে।যা বেতন পান তা দিয়ে কোন রকম সংসার চালানো যায় কিন্তু স্বচ্ছলতা আসে না তাতে।নিয়াজ সাহেব আবার ঘড়ি দেখলো, এখন বাজে নয়টা, এখনো মেয়েটা এলো না।আজ এত দেরি কেন হচ্ছে? তার গলা শুকিয়ে আসছে, কোন বিপদ হলো না তো মেয়েটার? তার পাঁচ কন্যার মধ্যে তার এই চতুর্থ কন্যা পুনম তার সবচেয়ে প্রিয়।
—“পুনমের মা আমায় এক গ্লাস পানি দাও তো, ও পুনমের মা….।”দেখা যায় স্বামী-স্ত্রী সব সময় বড় সন্তানের নামে ডাকে একে অপরকে কিন্তু নিয়াজ সাহেব পুনমের নামে ডাকে….তিনি মনে করেন যতবার পুনম নামটি সে বলে ততবার তার বুকে শান্তির বাতাস বহে।
সালেহা বেগম শাড়ির আঁচলে হাত মুছে স্বামীর জন্য এক গ্লাস শরবত নিয়ে আসেন। পানির বদলে শরবত দেখে নিয়াজ সাহেবের মেজাজ খারাপ হয়ে যায়। তিনি রাগী কন্ঠে বলে ওঠে,
“আমি পানি চেয়েছি,শরবত কিসের জন্য?”
—“মনে হলো শরবত খেলে আপনার ভালো লাগবে তাই।”
— “গর্দভ মহিলা কোথাকার।এত ভালো লাগা দিয়ে কি হবে? আমার মেয়েটা এখনো বাসায় আসলো না। আর তাদের আছে ভালো লাগা,হুহ!”
স্বামীর রাগ দেখে সালেহার চোখ পানি চলে আসে,সে মুখে আঁচল চেপে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কাঁদতে শুরু করে।
—–“একদম ফ্যাঁচফ্যাঁচ করে কাঁদবে না।একটু কিছুতে কাঁদা হলো বোকার লক্ষণ।আর তোমার বাবা তোমার মত এক বোকা মহিলাকে আমাকে ধরিয়ে দিয়েছে।যত্তসব!”
—–“আজ যদি আমার ছেলেটা বেঁচে থাকতো আমার এত কিছু সহ্য করতে হতো না।আজ শবে বরাত, জামাই দুজন হাশের গোসত রুটি পিঠা খেতে চাইলো। তোমার মেয়েকে বললাম সে কথা।সে আমায় রুটি পিঠা বানিয়ে রাখতে বলে হাওয়া। সে হাঁস না আনতে পারলে বললো কেন একথা? আজ আমার ছেলেটা বেঁচে নেই বলে……” একথা বলে কাঁদতে কাঁদতে রান্না ঘরে চলে গেলো। বড় জামাই বলছিল পায়েসের কথা। রাঁধতে হবে, ঘরে দুধ আছে কিনা কে জানে?
নিয়াজ উদ্দিন বোকার মত কতক্ষণ স্ত্রী যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইলো।একটা মানুষ এতটা বোকা কি করে হয়? তার মেয়ে এখনো বাড়ি ফেরেনি আর সে হাঁসের চিন্তা করছে। এখন বুঝা গেলো পুনমের এত দেরি কেন হচ্ছে? তিনি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বারান্দায় জায়নামাজ বিছিয়ে আবার নামাজে দাঁড়ালেন।মেয়ের চিন্তায় মসজিদে পর্যন্ত যেতে পারেনি নিয়াজ উদ্দিন। সে আজ আল্লাহর কাছে দু হাত তুলে এই একটা কথাই বলবে, তার অভাব দূর হয়ে যাক,তার পুনম একটু শান্তি পাক! আল্লাহ নিশ্চয়ই এই ব্যর্থ পিতাকে ফিরিয়ে দিবে না।
বাজারে দোকান গুলির সামনে ষাট পাওয়ারের লাইট জ্বলছে, কোন দোকানে আবার এইচ ডি লাইটও জ্বলছে। পুনম কাঁধের ব্যাগটা ডান হাত দিয়ে শক্ত করে চেপে বাম হাত দিয়ে সালোয়ার টা সামান্য উচু করলো। বাজারের অবস্থা জঘন্য। এই রাতের বেলায়ও এত ভির! বাজার জায়গাটা সবসময় এড়িয়ে চলতে চায় পুনম।কিন্তু বাবার বয়স হয়েছে সবসময় আসতে পারে না। আর মাসের শেষদিন গুলোতে বাবার হাত ধরতে গেলে শূন্যই থাকে তখন পুনম কে আসতে হয়।পুনম মাথায় ওরনা দিয়ে প্যাচ দিয়ে নিলো, আশেপাশের লোকের চাহনী দেখে মনে হচ্ছে পুনম এলিয়েন।
অবশেষে হাঁসের সন্ধান পাওয়া গেলো। দুটো হাঁস চাচ্ছে ১৬০০টাকা।এতো রাত দুপুরে ডাকাতি। অবশেষে অনেক দরদামের পর ১১০০ টাকা দিয়ে হাঁস কিনলো।
পুনম হাঁস বিক্রেতাকে টাকা দিচ্ছিল ঠিক সেই মুহুর্তে কে যেন পুনমের কোমরে বিশ্রী ভাবে হাত দিয়ে চাপ দিলো। তার সর্বশরীর ঘৃণায় রি রি করে উঠলো।দু চোখ কান্না রাগে লাল হয়ে গেলো।পুনম চট করে সেই লোকের হাত নিজের হাত দিয়ে শক্ত করে ধরে পিছনে ফিরে থাপ্পড় বসিয়ে দিল।লোকটি হয়তো বলতে চাচ্ছিল কেন মারছে….. তা তাকে আর বলার সুযোগ দেয়া হয়নি। পুনমের দুটো থাপ্পড়ের পর বাজারের আরো কিছু লোক লোকটাকে গণ ধোলাই দিল। মেয়ে মানুষ বাজারে গেলেই কিছু পুরুষের ধারণা মেয়েরা বাজারী! তাদের শরীর যেন বাজারের পন্য, যেখানে খুশি হাত দিয়ে মেয়েদের হ্যারেস করা যেন নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে।
পুনম একটা রিকশা ডেকে তাতে উঠে পড়লো, রাত অনেক হয়েছে বাবা চিন্তা করবে।লোকটির স্পর্শ যতবার মনে পড়ছে ততবার পুনমের বমি পাচ্ছে।পুনম মনে মনে গালি দিল,হারামজাদা!
পুনমের চোখে পানি এসে গেল, পৃথিবীটা এমন কেন।মেয়েদের রাস্তায় চলাচল যেন হারাম হয়ে গিয়েছে। পুনমের পরিচিত সবাই জানে পুনম শক্ত মেয়ে, পুনমকে কেউ কাঁদতে দেখেনি। কিন্তু পুনম জানে এই দুনিয়ায় নরম হয়ে বেঁচে থাকা যায় না। বুকের ভিতর হু হু করে ওঠে পুনমের।
মায়ের মত পুনমেরও মনে হচ্ছে আজ যদি তার একটা ভাই থাকতো! এত কষ্ট তাদের হতো না।
ঠিক তখনি পুনমের সিমফোনির বাটন সেট টা বেজে উঠল।পুনম চোখ মুছে কলটা রিসিভ করে ভেজা কন্ঠে বলে উঠলো, হ্যালো! হ্যালো!
—“তুমি কি কাঁদছিলে পুনম?” পুরুষালী ভারি কন্ঠে অপর পাশ থেকে উত্তর এলো।
পুনমের মনে হলো কেউ কবিতা পড়ছে। কি ভরাট কন্ঠ! একটু চুপ থেকে পুনম উত্তর দিল,
—–“পুনম কখনো কাঁদে না, জানেন না?”
—–“আমার মনে হলো তুমি কাঁদছিলে। পুনম কেমন আছো?” ঠান্ডা গলায় অপর পাশ থেকে জিজ্ঞেস করলো।
—–“পুনম সবসময় ভালো থাকে।”
——“পুনম তুমি আমায় এখন জিজ্ঞেস করো, আমি কি করছি? আমি তার উত্তর দিবো।” আদুরে আবদারে বলে উঠলো অপর পাশ থেকে।
——“কি করছেন আপনি?” পুনম ক্লান্ত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করে,তার এই হেয়ালী বিরক্ত লাগছে।
—-“পুনম দেখছি আমি,এই মেয়ে শুনতে পাচ্ছো? আমি পুনমকে দেখছি।”
পুনম এতক্ষণে খেয়াল করে সে হুডখোলা রিকশায় আর আকাশে মস্ত বড় এক চাঁদ দেখা যাচ্ছে। তার মানে আজ পূর্নিমা রাত। তার ভালো লাগতে শুরু করে, একটু আগের বিশ্রী রকম মনখারাপ ভাব কমে যাচ্ছে।
—–পুনমি,তুমি এখনো বাসায় যাওনি তাই না? এতটা ব্যস্ত থেকো না যে, নিজেকে, আর নিজের অনুভূতিকে এক সময় হারিয়ে ফেলবে।”
পুনমের মেজাজ খারাপ হয়ে যায়, তাকে জ্ঞান দিচ্ছে এই লোক। পুনম তেজের সহিত উত্তর দেয়,
—–“একদম জ্ঞান দিবেন না আমায়।পুনম কখনো কারো জ্ঞানের কথা শুনে না।জ্ঞান দিয়ে কখনো কারো পেট ভরে না।বাবার ওষধ ,মায়ের কাপড় , সেজো আপার বিয়ে ,লাবুর ইচ্ছে পূরন এসব আপনাদের জ্ঞান এসে দিয়ে যাবে না।”
—–“পুনম তুমি বড্ড বেয়াদব!” বলে কল কেটে দেয় অপর পাশের ব্যক্তি।
পুনম বিড়বিড় করে বলতে থাকে,সত্য কথা সবসময় বেয়াদবি মনে হয়। পুনম রিকশাওয়ালাকে তাড়া দিতে থাকে দ্রুত যাওয়ার জন্য। মা যে অপেক্ষা করছে, সে দ্রুত না গেলে হাঁসের গোশত রান্না হবে কিভাবে?
চলবে,
—–