পুনম পর্বঃ০৫

0
1744

#পুনম
#আয়েশা_সিদ্দিকা
পর্বঃ০৫

পুনম শিমুদের বাসার সামনে দাঁড়িয়ে কলিং বেল চেপে অপেক্ষা করছে, দরজা খোলার ।পুনম খেয়াল করেছে মানুষ কোথাও দশ মিনিট অপেক্ষা করলে তার মধ্যে সময় দেখে অন্তত তিন চারবার।এই যেমন সে এখন দেখতেছে, তার হাতের চিকন সুরু কালো বেল্টের ঘড়িটাতে জানান দিচ্ছে এখন ছয়টা পাঁচ বাজে।
দরজা খুললো শিমুর আম্মু। এই মহিলা সহজ সরল টাইপ।খুবই আন্তরিক!শিমু এবার ক্লাস এইটে। যেমন মেধাবী তেমনি ভদ্র।এই মেয়েটাকে পড়াতে শিমুর কখনো ঝামেলা পোহাতে হয়না।তাই সারাদিনের ছোটাছুটির পর এতটুকু টাইম পুনম স্বস্তিতে পড়াতে যেমন পারে তেমন রেষ্টও হয় ওর। পুনম শিমুকে পড়াতে বসলে,পুনমের আম্মু এসে বলল,
—–স্যরি পুনম কাল তোমায় ইনফর্ম করতে পারি নি।হুট করে বোনকে ছেলে পক্ষ দেখতে আসলো।তুমি এসে ফেরত গেছো, রাগ করনিতো বোন?
পুনম ছোট্ট করে উত্তর দিলো, —-না ভাবি।
—–তুমি ওকে পড়াও আমি তোমার জন্য চা নিয়ে আসি তোমার ক্লান্তি কেটে যাবে দেখো।

পুনম শিমুকে প্যারাগ্রাফ লিখতে দিয়ে টেবিলের উপর দুইহাত সোজা করে রেখে নিজের মাথা চেপে নিচু হয়ে বিড় বিড় করে বলতে লাগলো,ভাবি দেহের ক্লান্তি না হয় আপনার এক কাপ চায়ে দূর হবে কিন্তু মনের ক্লান্তি দূর করে এমন চা কোথায় পাবো আমি?

গতকাল যখন শিমুকে পড়াতে আসে দরজা খুলে শিমুর বাবা।গত তিন বছর যাবত এ বাসায় পড়ায় পুনম।কখনো এই পরিবারে অসংগত আচরণ দেখেনি ও।মাঝে মাঝে শিমুর বাবাকে বাসায় পায় যখন পুনম পড়াতে আসে। পুনম বাসায় ঢুকে জিজ্ঞেস করে জানতে পায় শিমুরা বাসায় নেই। তখন ও চলে যেতে নিলে শিমুর বাবা খুব ভদ্র সহকারে একটি চাকরির প্রস্তাব দেয় ওকে।তার অফিসে তার স্যারের জন্য একজন পি এ লাগবে। পুনম খুশি হলো। একটা চাকরির ওর দরকার খুব! পুনম যখন বললো,
—–রফিক ভাই আপনি বলেন কখন আমার কাগজ পত্র নিয়ে আপনার অফিসে যেতে হবে?
পুনম খেয়াল করে দেখলো রফিক ভাই মিনমিন করছে। বুঝতে পারলো কোন ঘাপলা আছে।পুনম চেক করলো তার পায়জামার রবাটের কাছে যে ছোট চেইন সিস্টেম পকেট আছে সেখানে পুনম ছোট্ট চাকু রাখে,সেটা আছে কিনা? পুনম সাবধানে চেইনটা খুলে রাখে, কোন এদিক ওদিক দেখলে জাষ্ট জায়গা মত চাকু বসিয়ে দেবে।
কিন্তু অনেকক্ষণ পড়ে রফিক ভাই বললো,
—-পুনম তোমার কোন কাগজপত্র নিয়ে ইন্টারভিউ দিতে হবে না।আমি তোমার ছবি দেখিয়েছি।তাদের তোমায় পছন্দ হয়েছে।তুমি হ্যা বললেই চাকরি কনফার্ম।

পুনম হা করে তাকিয়ে কথা গুলো শুনলো। সার্টিফিকেট ছাড়া যে চেহারা দেখেই চাকরি হয় এযে কেমন চাকরি তা ওর বুঝা হয়ে গেছে। কিন্তু রফিক ভাই ওর ছবি পেলো কোথায়?
—ইয়ে পুনম আসলে ব্যাপারটা হলো কি তুমি তো পার্সোনাল এসিস্ট্যান্ট হবে তাই তার সব কিছুই তোমার আন্ডারে থাকবে।আর তাছাড়া আজকালের দিনে এতো মানলে হয়,এরপর দেখবে উপরে ওঠার সিড়ি খুবই সহজ হবে তখন।
খুবই ভদ্রতার সহিত কথাগুলো বললো অভদ্র লোকটা।

পুনম উঠে দাঁড়িয়ে মিষ্টি করে হেসে বললো, শুনুন রফিক ভাই আপনার ওয়াইফ কিছুদিন ধরে আমাকে বলছিল, তার বাসায় ভালো লাগে না,আপনি অফিসে চলে যান, আর শিমু স্কুলে। তার শিক্ষাগত যোগ্যতা অল্প বলে চাকরিও করতে পারছেনা। আমি বরংচ এই অফারটা ভাবিকে দেই,তাকে বলি যে আজকাল শিক্ষাগত যোগ্যতা লাগে না চাকরি নিতে ফর্সা আর ফিগার থাকলেই হয়।কি বলেন রফিক ভাই? আমাদের ভাবি তো আবার ঝাক্কাস সুন্দরী! আপনি আর সে একই অফিসে কাজ করলেন কারোই আর একা একা লাগলো না।ঠিকাছে?
পুনম হেসে হেসে কথা গুলো বললেও তার চোখ দিয়ে যেন আগুনের ঝাঁজ বের হচ্ছিলো তখন।মনে মনে বিশ্রী গালি দিয়ে পুনম বের হয়ে আসে।

অন্যকেউ হলে এখানে পড়াতে আসতো না কিন্তু পুনম এসেছে।একে তো মাসের মাঝামাঝি টাইম তারউপর অন্য টিউশনি ঠিক করবে তারপর তো এটা ছাড়তে পারবে।আর চলে যেতে চাইলেও শিমুর আম্মুও ওকে যেতে দিবে না। পুনম ঠিক করেছে টিউশনির টাইমটা ঘুড়িয়ে নিবে অন্য টিউশনির থেকে আর একটু সাবধানে থাকলেই আর সমস্যা হবে না। এই টিউশনিটা থেকেই পুনম বেশি টাকা পায় তাই এই বদলোকের জন্য তো ছাড়বেই না। পুনম মনে করে এগুলো হলো বিষাক্ত পোকা যা প্রতিটি বাগানে থাকবেই তাই বলে কি কেউ বাগান করবে না।

পুনম দেখলো রফিক ভাই এসেছে, সে যে একটা ধাক্কা খেয়েছে পুনমকে দেখে তা নিশ্চিত।সে হয়তো ভেবেছিল পুনম আর আসবেনা। পুনম হেসে বললো, রফিক ভাই অল গুড?
এই কথাটা আগে রফিকের সাথে পুনমের দেখা হলে রফিক বলতো, পুনম অল গুড?
বের হওয়ার সময় পুনম দেখলো রফিক ভাই অনবরত কাশছে, কাশুক বেশি করে,ভালো মানুষের বেশে কতগুলো নোংরা পশু এগুলা!

রাস্তায় হাটতে হাটতে পুনমের মনে হলো মি.তানভীর কে একটা কল দিয়ে কথা বললে হয়তো ওর মন ভালো হবে। কিন্তু পরক্ষণেই মনে হলো, সে কি মন ভালো করার মেশিন? না তো। তবে তার সাথে কথা বললে মন ভালো হবে এই কথাটাই বা মাথায় আসলো কেন? আর মনে হওয়া কথা মনেই রাখতে হয়,সব ইচ্ছা মিটাতে নেই!

আর মি.তানভীর ওরফে নবাবপুত্র সেই বা কেন আজ ওর সামনে আসলো না? চুপে চুপে দূর থেকে ওকে দেখেছে, নবাবপুত্র মনে করেছে আমি জানবো না।কত বড় গাধা এই লোক, সেকি জানে না নবাব চিহ্ন বহন করে যারা তারা যেখানেই যায় তার ছাপ থেকে যায় আশেপাশে!
ঠিক সেই মুহুর্তে পুনমের ফোন বেজে ওঠে।ছোট্ট বাটন সেটটিতে ভেসে ওঠে নবাবপুত্র লেখা নামটি। পুনম কল কেটে দেয় এ লোকের সাথে এখন আর কথা বলতে মন চাচ্ছে না।
পুনম হনহনিয়ে হাটা শুরু করে পরের টিউশনির জন্য, এটা সে নতুনে এ মাসে নিয়েছে।সামনে রোজা, ঈদ। কত খরচ! তার উপর বড় আপারা আছে।বড় আপারা সহজে আসে না, আর একবার আসলে আর এক দুইমাসের নিচে যায় না। পুনম টের পায় ব্যাগের ভিতর তার ফোনটি অনবরত বেজে যাচ্ছে। বাজুক,ধরবে না ও ।হয়ে যাক অদৃশ্য ধৈর্য্য পরিক্ষার খেলা! দেখি কে জিতে? নবাবপুত্র আপনি নাকি
যাকে আপনি পুনমি বলে ডাকেন সে?

*********************
পাবনী ছাদের রেলিং এ হেলান দিয়ে রাতের আকাশ দেখছে, ও অনুভব করে ওর দু চোখ ভিজে উঠছে। পাবনী দেখতে সুন্দর তবে পুনমের মত ধারালো সৌন্দর্য তার নেই। পাবনী মাঝে মাঝে উপরওয়ালাকে জিজ্ঞেস করে, একই মায়ের গর্ভে দুজনের বসবাস ছিল কিন্তু তাকেই কেন ত্রুটি নিয়ে জন্মাতে হলো? কিন্তু উপরওয়ালা জবাব দেয় না। পাবনীর সৌন্দর্য গুন সব ঢাকা পড়ে যায় একটি কথায়, পাবনীর পায়ে ত্রুটি আছে । ছোটবেলা থেকে সবাই ওকে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করে এসেছে।ওকে কত সহজে সবাই লেংড়া বলে সম্বোধন করতো। সবাই দেখে ও চুপচাপ, গম্ভীর স্বভাবের কিন্তু কেউ কখনোই দেখতে পায়নি ও যখন ওর সমবয়সী বাচ্চাদের সাথে খেলতে যেত তাড়া দূর দূর করে তাড়িয়ে দিত।অন্যান্য বাচ্চাদের প্যারেন্টসরা তো বলেই ফেলতো খুব সুন্দর করে, পাবনী তুমি কাছে এসো না ওরা তোমাকে দেখলে ভয় পায়। কি সহজ কথা কিন্তু একটা বাচ্চার জন্য তা কতটা সহনশীল তা তারা বুঝতে চাইতো না। পাবনীর একটা পা অন্য পায়ের থেকে খাটো এবং কিছুটা বাঁকানো। তাই পাবনী খুঁড়িয়ে হাঁটতো। স্কুলে পড়ার সময় অনেকই বলতো আম্মুকে,
–ভাবি আপনার মেয়ে তো প্রতিবন্ধী। তাকে প্রতিবন্ধী স্কুলে দিলেই তো পারেন।
কি সহজ ভাবেই না তারা বলতো।অথচ শিশুদের মন কাঁচের পাত্রের মত হয়,অল্পতেই যা ভঙুর।ওকে ভিতর থেকে প্রতিবন্ধী করে দিতো মানুষ গুলো।নিজেদের আত্মীয় স্বজন কেউ বাদ থাকতো না।কেউ করুণা করত,কেউ তাচ্ছিল্য করতো, কেউ ঘৃণা করতো।অনেকে তো অপয়া বলতো।এত এত মানসিক আঘাত পাবনীকে ভিতর থেকে নাড়িয়ে দিয়েছে।পাবনী ছোট বেলা থেকে দেখেছে ওর আম্মুকে যখন সবাই ওর সম্পর্কে বলতো তখন ওর বোকা মা নিজের মুখ লুকাতো,মিন মিনিয়ে জবাব দিত তাদের। কখনো শক্ত গলায় তার মা বলেনি, —আমার মেয়ে ল্যাংড়া হোক খোঁড়া হোক সে আমার মেয়ে।আমি তাকে নিয়ে কি করবো তা আপনারা বলার কেউ না।
কিন্তু এই কাজ টা সবসময় পুনম করে এসেছে ছোটবেলা থেকে যেভাবে পারতো পাবনীকে সাহায্য করতো।ও তো ছোট ছিল তখন।একটু যখন বুঝতে শরু করলো তখন সবার কাছে বেয়াদব বলে পরিচিত হল পুনম।কেননা সে সেজো আপার হয়ে প্রতিবাদ করে কথা বলতো।
পাবনীর এখনো মনে আছে, তখন ওরা এইটে পড়ে। পুনম ওয়াশরুমে গেছিলো সেই সুযোগে ক্লাসের একটা দল ওকে নিয়ে অনেক উপহাস করছিল,পাবনীকে নিয়ে মজায় তারা এতটা ব্যস্ত ছিল তারা ওর কষ্ট কেউ দেখেনি বরং একজনে ওর অচল পায়ে স্যারের চেয়ার ফেলে দিয়েছিল। ছেলেটা বার বার চেয়ারটা পাবনীর পায়ের সামনে এনে একটু ফেলছিল আর ধরছিল ভয় দেখাবার জন্য ।অনেকবার পাবনী মানা করে, সরে যেতে চায় কিন্তু পারেনি। শেষে তো চেয়ারটা পায়ে পড়েই গেলো। পুনম এসে দেখে যখন তার সেজো আপা কান্না করছে আর সবাই দৌড়ে চলে যাচ্ছে। পাবনী যখন আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল কে মেরেছে সারা স্কুল মাঠ দৌড়ে সেই ছেলেকে ধরে একই চেয়ার দিয়ে সেই ছেলের পায়ে মেরেছে পুনম।
প্রিন্সিপাল রুমে নোটিশ দিল সব অভিবাকরা।সবার এক কথা পুনম বেয়াদব।পুরো স্কুলে গুন্জন, পুনম বখাটেদের মত একটা ছেলের পা ভেঙে দিয়েছে।
প্রিন্সিপাল যখন পুনমকে জিজ্ঞাসাবাদ করলো, পুনম প্রিন্সিপালের চোখের দিকে তাকিয়ে সাহসীর মত উত্তর দিলো,
— আমার বোনের ব্যাথা পায়ে যে আঘাত করেছে তার পা ভেঙে দিয়ে আমি কোন ভুল করিনি। বরং ও এখন আমার বোনের কষ্ট বুঝতে পারবে।
প্রিন্সিপাল স্যার অনেক্ক্ষণ পুনমের দিকে তাকিয়ে থেকে হেসে বলেছিল,যেহুতো সব অভিবাবক নোটিশ দিয়েছে তাই রুলস অনুযায়ী তোমাকে স্কুলে রাখা আমার সম্ভব নয়।তবে আমি এতটুকু তো বলতেই পারি, ওয়েল ডান ব্রেভো গার্ল!
এই হলো পুনম।সবাই ছি ছি করলো স্কুল থেকে বহিষ্কারের জন্য পুনমকে।শক্ত ভাবে উপস্থাপন হলো পুনম বেয়াদব। কিন্তু তাতে পুনমের কি। আমরা দুবোন যখন স্কুল থেকে টিসি নিয়ে বের হলাম বাবা তখন আমাদের আইসক্রিম কিনে খাওয়ালো,কাচ্চি খাওয়ালো।রিকশায় করে বাবার সাথে আমরা খুব ঘুরলাম।বাবার হাসি মুখ দেখে বুঝেছিলাম বাবা সেদিন খুব খুশি হয়েছিল!

পাবনীর এই জীবনে কষ্টের পরিমিতি অনেক বেশি,কিন্তু সকল কষ্টকে ছাপিয় যায় একটা প্রাপ্তি।পুনম! তার বোন। তার জীবনের বড় প্রাপ্তি। সকল তাচ্ছিল্যপূর্ণ অশ্রাব্য কথা ঢেকে যায় একটি ডাকে, সেজো আপা!

চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here