পুনম পর্বঃ০৭

0
1706

#পুনম
#আয়েশা_সিদ্দিকা
পর্বঃ০৭

নিয়াজ উদ্দিন খবুই আরামের সাথে সোফায় বসে চা পান করছে।শুক্রবার দিনটা তার জন্য শান্তির। এই দিনটি তার কাছে ঈদের দিনের মত, কেননা পুনম বাসায় থাকে। মেয়েটা চোখের সামনে ঘুরলেই নিজেকে খুবই সুখী মনে হয়।এই যে ড্রয়িং রুমে বসেও পুনমের গলার আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে।মেয়েটা পড়ছে,পুনম ছোটবেলা থেকেই খুবই উচ্চ স্বরে পড়ে।এখন অবশ্য একটু আওয়াজ কম করে পড়ে তাতেই তার বই পড়ার শব্দ ড্রয়িং রুমে বসে শোনা যায়।
সন্তানের জন্য পিতার দোয়া খুবই কার্যকারী,তাই নিয়াজ উদ্দিন বিড়বিড় করে বলতে থাকে,ইয়া আল্লাহ আমার মেয়েটা বড্ড খাটছে,তুমি ওর মনোবাসনা পূরণ করে দাও।

সালেহা বেগমের তাড়ায় নিয়াজ সাহেবের আরামে বসা হলো না,তাকে বাজারে যেতে হবে।আজ পাবনীকে দেখতে আসবে পাত্রপক্ষ।কিছু কেনা কেটা করতে হবে।নিজ অজান্তেই দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে নিয়াজ উদ্দিন।তার এই মেয়েটা এত দুঃখী কেন?
বসা থেকে উঠে নিয়াজ উদ্দিন রান্না ঘরের দিকে হাঁটা ধরেন,এখন সে একটা চমৎকার চা করবেন পুনমের জন্য।তারপর বাজারে যাবেন।সালেহাকে অবশ্য বলা যেত কিন্তু সে এখন মহাব্যস্ত পাত্রপক্ষের আপ্যায়নের সামগ্রী তৈরিতে।যতক্ষন পর্যন্ত পুনম চা পান করবে ততক্ষণ পর্যন্ত তিনি পুনমের সামনে বসে থাকবেন,এক পাও নড়বেন না।তার মেয়েটা কোন সকাল থেকে পড়ছে, নিশ্চয়ই তার মাথা ব্যাথা করছে।তাই এক কাপ চা তার প্রাপ্য। এছাড়া আর একটা কারণ হলো, পুনম চা পান করে বিড়াল ছানাদের মত।খুবই আয়েস করে চোখ দুটি বুজে চুক চুক করে চা পান করে তার পুনম।দেখলেই মনে হয় একটি ছোট্ট বিড়াল ছানা চা পান করছে।তার মনে হয় এত সুন্দর দৃশ্য তার জীবনে সে খুবই কম দেখেছে!
**********************
পুনমের বিরক্তিতে মাথা ধরছে, কপাল কুঁচকে সে বই হাতে নিয়ে ছাদের দিকে রওনা দেয়।কদিন পরপর পাত্রপক্ষের সেজ আপাকে দেখতে আসা তার অসহ্য লাগে।কাজের কাজ কিছু হয় না,কতগুলো টাকার স্রাধ্য হয় আর সেজ আপাকে মানসিক ভাবে দূর্বল করে দিয়ে যায়।কি সুন্দর করে পাত্র পক্ষ আপাকে তার দূর্বলতা নিয়ে বিশ্রী প্রশ্ন গুলো করে।আপা নিচু হয়ে সেগুলো শুনে যায়,তার চোখের টলমলে অশ্রু কেউ দেখে না।তখন বাবার অসহায় চাহনির কথা মনে হলে পুনমের অসহ্য লাগে।আর সবশেষে ইনিয়ে বিনিয়ে কতগুলো যৌতুকের দাবী,যাকে আধুনিক ভাবে বলা হয় উপহার!

পুনমের সবচেয়ে কষ্ট হয় তখনই যখন পাত্রপক্ষ আসে তখন মা পুনমকে আড়ালে রাখে আর লাবণ্যকে বান্ধবীর বাসায় পাঠিয়ে দেয়।নিজেকে আপার প্রতিদ্বন্দ্বী মনে হয় তখন। এতে যে সেজ আপার অপমান হয় তা মা কেন বুঝে না?তার আপা কি ফেলনা?
প্রথম প্রথম প্রতিবাদ করতো পুনম।তার আপাকে যে গ্রহণ করবে সে আপাকে দেখেই গ্রহণ করবে।কোন হুরপরী তার সামনে থাকলেও কিচ্ছু আসবে যাবে না। কিন্তু মা তা বুঝে না।চেচামেচি করবে ফিঁচফিচ করে কাঁদবে তার কথা না মানা পর্যন্ত।তার উপর তো সোনায় সোহাগা তার দুই দুলাভাই বাড়িতে। তারা সস্তা রসিকতায় বলবে, পুনমের মত সুন্দরী থাকতে মা, কেউ কি পাবনীকে বাছাই করবে? আর মা তা শুনেই হায় হায় করবে। এটা কি গরুর বাজার যে বাছাইয়ের প্রশ্ন আসছে।
তাছাড়া পুনম বুঝতে পারছেনা দুপুর বেলা কি কেউ মেয়ে দেখতে আসে?

পুনম ঠিক করেছে বিকালের আগে সে আর নিচে নামবে না।গোল্লায় যাক সব!
ছাদে এসে দেখে আর এক উজবুক ছাদের রেলিং-এ বসে আছে।পুনম মনে মনে গালি দেয়,সবথেকে বিশ্রী গালি!
—–এখানে কি করছেন সুমন ভাই?
সুমন চমকে ওঠে ফিরে তাকায়। পুনম দেখতে পায় সুমনের শান্ত চোখদুটি আজ আরো বেশি শান্ত দেখাচ্ছে। পুনমের মায়া লাগে।
—–তোমাদের গাছের ফুল গুলি খুবই সুন্দর পুনম।আমার খুবই পছন্দ।
—–তাই বুঝি।শুধুই ফুল পছন্দ হলো,আর ফুলের মালীকে বুঝি অপছন্দ আপনার?
সুমনরে দৃষ্টি এলোমেলো হয়ে আসে।এই মেয়েটার সামনে সুমনের নিজেকে অসহায় মনে হয়।এত তীক্ষ্ণদৃষ্টি! সুমনের ভয় লাগে কখন না যেন তার ভিতরটা পড়ে ফেলে পুনম।
—–নিচে কেন যাচ্ছেন না সুমন ভাই।সেজ আপাকে দেখতে আসবে।আপনার সেখানে থাকা উচিত।
সুমন উত্তর দেয় না।ফুল গাছগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকে।
—–সুমন ভাই আমরা সকল মানুষই কিছুনা কিছু অপূর্ণতা নিয়ে পৃথিবীতে বসবাস করছি।কোন মানুষই সবকিছু পায়না।তাই বলে কি কেউ চায় না?এই অপূর্নতা গুলো যদি না থাকতো মানুষের, তবে মানুষ সৃষ্টিকর্তাকে ভুলে যেত!

—–বাবা মার মৃত্যুর পর পুনম আমি সব থেকে অসহায় হয়ে গিয়েছি,তোমার ভাষায় যাকে বলে মেরুদণ্ডহীন মানুষ।খুব কাছ থেকে আপনজনদের বিশ্বাসঘাতকতা দেখেছি।আমার সব থেকে পছন্দের জিনিস অন্যের হতে দেখেছি।আমি বড় ভীতু মানুষ পুনম।আমি চাইতে পারি না।আমার আবদারের স্থান যেদিন শূন্য হলো সেদিন থেকে আমিই নিজেই শূন্যে পরিনত হয়েছি।আমার মত মানুষের কোন চাওয়া-পাওয়া থাকতে নেই।অবজ্ঞা, অবহেলা যেখানে আমার জন্য বরাদ্দ সেখানে স্থান দিয়ে অন্য কাউকে ছোট করতে চাইনা।
পুনম মনে মনে বলতে থাকে,খুব শিগ্রয়ই আপনার শূন্য স্থান পূর্ণ হবে সুমন ভাই।একজন চমৎকার মানবী আপনার জীবনে আসবে যে আপনাকে আগলে রাখবে। তারপর খুব মিষ্টি করে হেসে পুনম বলে ওঠে,
—–সুমন ভাই আপনি কি আমাকে গাধী ভাবছেন? মনে মনে যে প্রতিদিন আপনি অন্তত শত বার এই ফুলগাছের মালিনীকে চান তা বুঝি আমি জানি না।
সুমন খুকখুক করে কাশতে শুরু করে।
—-সুমন ভাই বলেন তো এই ফুল গাছগুলো কে লাগিয়েছে?
সুমন প্রচন্ড হতাশ হয়,এই মেয়েটা এত বিচ্ছু! এর কাছে কোন বিষয় লুকানো অসম্ভব!
—–আমি জানি না,জানি নাহ!
—-আপনি কি জানেন সুমন ভাই সেজ আপার কখনোই ভালো থাকা হয়নি?সবাই তাকে অবজ্ঞার চোখে দেখে।একমাত্র আমিই আপনার চোখে আপার জন্য এক ঝাঁক মুগ্ধতা দেখেছি!তার কষ্টে আপনাকে কষ্ট পেতে দেখেছি।তার প্রতি আপনার ভালোবাসার দৃষ্টি দেখেছি।
আপনাদের দুজনের প্রতি সকলের অবজ্ঞাকে সৃষ্টিকর্তা কাটাকাটি করে দিয়েছে অংকের মত।এখন থেকে শুধুই আপনারা ভালো থাকবেন সুমন ভাই।শুধু আপনি একটু শক্ত হোন।আমার আপার ভালো থাকা আজ থেকে আপনার উপর সুমন ভাই। আপনাকে পারতে হবে,আমি তো সাথে আছি আপনার।

সুমন কিছু বলতে নেয় পুনমকে কিন্তু বলতে পারেনা।তার চোখ থেকে পানির ফোয়ারা নামতে শুরু করেছে। তার মনের গোপন কথা এই মেয়েটা কিভাবে বুঝলো?সামনে দাঁড়ানো মেয়েটিকে সুমনের মায়ারাজ্যের জাদুর কাঠি মনে হয়।যে ছুঁয়ে দিলেই সব পবিত্র আর সুন্দর হয়ে যায়!

পুনম কপট বিরক্তি নিয়ে বলে ওঠে,
—–একদম মেয়েদের মত কাঁদবেন না তো সুমন ভাই।আপনি কি মেয়ে? এরকম কাঁদলে কিন্তু আমি আপনার আধি ঘরওয়ালী হবো না। বলে দিলাম।
তাতে সুমনের কান্না বন্ধ হয়না।বরং বাড়তে থাকে……

বিকেল বেলা পুনম ছাদের সিড়ি দিয়ে নামতে গিয়ে উপলব্ধি করে তার মনটা খুব ভালো হয়ে গিয়েছে। সকালের সেই অশান্তিটা আর নেই। পুনম বিশ্বাস করে আস্তে আস্তে সব ভালো হবে তাদের জীবনে।সবাই ভালো থাকবে,সবাই….

পুনম মোবাইলটা হাতে নিয়ে ছোট্ট একটা টেক্সট করে একজনের কাছে,
“নবাবপুত্র আপনার মুখদর্শন করতে চাই। আজ,এখুনি।”
কারণ আজ পুনমের মনটা বড্ড ভালো!একদল রঙিন প্রজাপতির উড়ার মত তার মনটা আজ ফুড় ফুঁড়ে!
প্রজাপতির মত তারও উড়তে মন চাচ্ছে।
আচ্ছা, উড়ে উড়ে কোথায় যাবে ও? নবাবপুরে?

চলবে,
আগের পর্ব
https://www.facebook.com/groups/497262353809219/permalink/1676819782520131/?app=fbl

আশা করি ভালো লাগলে বা ভুল করলেও একটা মন্তব্য করে আমার লেখার পরিধি জানাবেন সকলে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here