#পুনম
#আয়েশা_সিদ্দিকা
পর্বঃ০৮
পুনম ছাদ থেকে নেমে দেখে তার মায়ের মুখ থমথমে। নিশ্চিত পাত্রপক্ষ আপাকে পছন্দ করেনি বা হাই লেভেল যৌতুক চেয়েছে।এ ঘটনা নিয়ে মায়ের দুই তিনদিন মন খারাপ থাকবে,সবার সাথে খিটখিট আচরণ করবে সাথে একটু বিরতিসহ কান্না তো আছেই!
পুনম সোজা রান্নাঘরে চলে গেলো এবং দুকাপ চায়ের পানি চুলায় দিলো।পুনমের মাঝে মাঝে আশ্চর্য লাগে এই যে মায়ের মন খারাপ বা বাবার দুশ্চিন্তা এ নিয়ে বড় আপা বা মেজ আপার কোন হেলদোল হবে না।তারা খুবই স্বাভাবিক থাকবে।সবসময়ের মত একজন স্বামীর অর্থবিত্ত নিয়ে অহম করবে আর একজন স্বামীর আহ্লাদীপনা ভালোবাসার অহম করবে।নিজ আপনজনের সাথে অহংকার করে আদোও কি সুখ পাওয়া যায়?
ইষ্টি মিষ্টি একসাথে দৌড়ে রান্নাঘরে প্রবেশ করলো। এবং একইসাথে তারা খালামণিকে প্রশ্ন করলো,
——খালামণি, খালামণি হাড় হাভাতে কাকে বলে?
পুনম অবাক হলো না ইষ্টি মিষ্টির প্রশ্নে। তার বড় দুলাভাই যে তাদের হাড় হাভাতে বলে আড়ালে সম্বোধন করে তা তার অজানা নয়!
শোন সেজ আপা এরা দু’ভাই কি আমাদের বাড়িটাকে হোটেল মনে করেছে,যার যখন তা অর্ডার করবে আর আমরা তা জি হুজুর বলে পালন করবো…..মুখ ভেচকি দিয়ে বলে ওঠে পুনম।
পাবনী বারান্দায় বেতের মোড়ায় বসে ছিল।পাত্রপক্ষের সামনে যে সাজসজ্জা নিয়ে গেছিল তা এখনো বহাল আছে পাবনীর শরীরে।হালকা আকাশী রঙের শাড়ি, চুল হাতখোপা করা ঠোঁটে লিপস্টিক দেয়া আর কপালে নিল রঙের টিপ।পাবনীকে অপরুপ লাগছে।পুনম মনে মনে মাশাল্লাহ বলে।পুনমের মনে হচ্ছে কোন বিখ্যাত উপন্যাসের নায়িকা তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে।
পাবনী মৃদু হেসে জানতে চায়,
—–কে তোর মত বিচ্ছুকে অর্ডার করলো?
—–কে আবার? সুমন ভাই। বলে কিনা খুব চা খেতে মন চাচ্ছে। চা কি খায়? উজবুকের নানা কোথাকার।
—–এভাবে বলে না পুনম।বড় আপাও তার সাথে বাজে ব্যবহার করে এখন যদি আমরাও করি তবে সুমন ভাই কষ্ট পাবে।
—–তোমার যখন এত দরদ তবে তুমি নিয়েই যাও।আমার বেরোতে হবে এখন।
পুনম বাবার সামনে দাঁড়িয়ে আছে।তার বাবা চোখ বুজে শুয়ে আছে, এ অবেলায় বাবাকে ঘুমাতে দেখে পুনমের মন খারাপ হলো।সে ভাবলো বের হবে না আর। তখনই নিয়াজ উদ্দিন চোখ না খুলেই বলে উঠলো,
—মেয়েটা এত দরদ নিয়ে গান কিভাবে করে রে? ওর কন্ঠে যেন কষ্টের সুর বাজছে….
বাবার এই রুমটা থেকে পরিষ্কার শোনা যাচ্ছে তার সেজ আপা গান গাচ্ছে,
“যখন পড়বে না মোর পায়ের চিহ্ন এই তটে……..
পুনম বাবার কথার জবাব না দিয়ে পাল্টা প্রশ্ন করে,
—-না দেখেই কিভাবে বুঝলে আমি দাঁড়িয়ে আছি।
নিয়াজ উদ্দিন চোখ মেলে তাকান এবং একই সঙ্গে খুবই চমকে যান।তার সামনে দাঁড়ানো তার মেয়েটাকে কোন সাধারণ মানবী মনে হচ্ছে না,যেন পাতালপুরীর রাজকন্যা!
তার মনটা ভালো হয়ে যায়।
—-তুই তো আমার মা, আর মায়ের ঘ্রাণ সব সন্তানেরা বুঝতে পারে।
পুনম বাবার হাতে হাত রাখে,খুবই মৃদুস্বরে কিন্তু দৃঢ়তার সহিত বলে, —বাবা সব ঠিক হয়ে যাবে দেখো।একসময় আমরা খুবই ভালো থাকবো।
পুনম বাসা থেকে বের হওয়ার সময় শুনতে পায় তার বড় আপা মাকে বলছে,
—-যার বিয়ে ভেঙে গেছে সে নির্লজ্জের মত গলা ভেঙে গান গাচ্ছে আর একজন বাসার এরকম পরিস্থিতিতে সঙ সেজে বাহিরে যাচ্ছে। ছি ছি!
অন্যদিকে পুনম দেখলো তার মেজ দুলাভাই মেজ আপার চুলে তেল দিয়ে দিচ্ছে আর মেজ আপা খিলখিলিয়ে হাসছে।
পুনমের ভয় হয়,এই ভালোবাসা লোক দেখানো ভালোবাসা নয়তো?
পুনম রেডি হয়ে বাসার সামনে খোলা জায়গায় দাঁড়িয়ে ছাদের দিকে তাকিয়ে দেখতে পায়,তার সেজ আপা গান গাচ্ছে একমনে আকাশের দিকে তাকিয়ে আর তার পাশে সুমন ভাই দাঁড়িয়ে চায়ের কাপে চুমক দিচ্ছে আর ফ্যাঁচফ্যাঁচিয়ে কাঁদছে।পুনমের ঠোঁটে হাসি রেখা ফুটে ওঠে, সুমন ভাইয়ের চা পুনম লবন দিয়ে বানিয়েছে আর সেই চা এই উজবুক পান করতেছে সেজ আপা বানিয়েছে তাই ভেবে! ভালোবাসা কি সত্যিই মানুষকে এতটা অবুঝ আর পাগল বানিয়ে দেয়?
তানভীর হন্তদন্ত হয়ে পার্কের গেটে রিকশা থেকে নামে ,অনেক দেরি করে ফেলেছে এখন বাজে সাড়ে পাঁচটা।পুনম টেক্সট পাঠিয়েছে সারে তিনটায়। পুনমকে পাবে তো? টেনশনে তানভীরের মাথা হ্যাং হয়ে রয়েছে। সেদিন বুবুর বাসায় যাওয়ার কারণে তানভীর এই দুদিন ঘরবন্দী ছিল।হিসেব মত আরো একদিন থাকার কথা। পুনম যখন টেক্সট করেছে তখন তানভীর ঘুমে ছিল।ঘুম থেকে উঠে এই মেসেজ দেখে তানভীর খুব অবাক হয়, দেড় বছর ধরে একে অপরের সাথে পরিচয় কখনোই পুনম ওর সাথে সরাসরি এভাবে দেখা করতে চায়নি।কোন রকম রেডি হয়ে, বারান্দা থেকে দড়ি বেয়ে ও নিচে নেমেছে।রাজু বা ওর বাবার কথা তখন ওর মাথায় আসেনি।ওর শুধু মনে হয়েছে যে করে হোক ওকে পৌঁছাতে হবে পুনমের কাছে। কেন এত জরুরী তলব? ওর মুখদর্শন কেনই করতে চায় ওই নিষ্ঠুর মেয়েটা? কই কতবার তো সামনে গেছে ও পুনমের তখন তো মুখ অন্য দিকে ঘুরিয়ে রাখতো না হয় কপাল কুঁচকে থাকতো।তবে আজ কেন?
পুনম পার্কের বেন্ঞ্চে বসে বাদাম চিবোচ্ছে,ওর অপেক্ষা করতে খারাপ লাগছে না বরং ভালোই লাগছে।অপেক্ষায় থাকার মধ্যেও একটা ইতিবাচক আনন্দ আছে, কোন কিছু ঘটার বা না ঘটার সমান সম্ভাবনা থাকে অপেক্ষা শব্দটিতে।
পুনমের মুখে নষ্ট বাদাম পড়ায় মুডটা নষ্ট হযে যায়,মুখের স্বাদ যেমন এখন তিতকুটে লাগছে তেমন সামনে থেকে আসতে থাকা আগুন্তক মানুষটাকেও ওর তিতকুটে মনে হচ্ছে।
ক্যাটক্যাটে লাল একটা শার্ট পড়ে হন্তদন্ত হয়ে হেটে আসছে।পুনমের মনে হচ্ছে যে কোন সময় এই ব্যাক্তি উষ্ঠা খেয়ে পড়ে যেতে পারে। তারউপর শার্টটা পড়েছে উল্টো, বোতাম গুলো এলোমেলো ভাবে লাগানোর কারণে ডানপাশ থেকে কোমড় ও পেটের এককোণা দেখা যাচ্ছে।
নাকি ইচ্ছা করে পড়েছে?ভেবেছে পুনম আহ্লাদে গদগদ হয়ে শার্টের বোতাম ঠিক করে দিবে।হুহ! কখনোই না।
তানভীর যখন কাছে এসে দাঁড়ালো তখন পুনমের সত্যি মনে হলো এই ব্যক্তি আসলেই বিরক্তিকর! ঘুমথেকে উঠে মনে হয় মুখ ধোয়নি।কেমন আহাম্মকের মত লাগছে, চুলগুলোও অপরিপাটি। পুনম বিরক্তে কপাল কুঁচকে তাকিয়ে থাকলো তানভীরের দিকে।
কেমন হা করে তাকিয়ে আছে মনে হয় আগে ওকে দেখেনি।
সদ্য ঘুম থেকে ওঠা ফোলা ফোলা চোখ দুটি দিয়ে তানভীর তাকিয়ে আছে পুনমের দিকে।আর বিড় বিড় করে বলছে,
ওহ গড! আই’ম ফিনিশ! আই’ম ডায়িং!
চলবে