#পুনম
#আয়েশা_সিদ্দিকা
পর্বঃ১০
—তোমার নাম তাহলে মরিচা বানু?
—-জে আফা।বাপে রাখছে মোর নাম….নামটা জব্বর না?….বলে হেসে দেয় মরিচা নামের মেয়েটি।
—-তুমি জানতো তোমার কি কাজ করতে হবে?
—-মুই বেবাক জাইন্না আইছি হাইজা আফা।রান্ধন কন বাড়ন কন সব কামে মুই মরিচা এক নাম্বার।কোন কামে যদি আমনে দুষ পান এই পাহা ঘরে বইয়া কইতে আছি নিজের কান কাটি ফালাম…হুহ!
পুনম মরিচার কথা শুনে হেসে দেয়। গ্রামে পুনমের এক চাচা আছে আপন নয় আবার পরও নয়।তাকে বলে এই মরিচা নামক বিশেষ চিড়িয়াকে আনিয়াছে পুনম।চাচা অবশ্য তখনই বলে দিয়েছিল মরিচা কথা বলে বেশি কিন্তু কাজে খুব পটু।মা তো কাজের লোক রাখার কথা শুনে বললো, এত টাকা পাবি কোথায়? বাদ দে……
কিন্তু পুনম বাদ দিতে পারে নি…দরকার হলে আর একটা টিউশন করাবে তবুও রাত হলে মায়ের কাশির শব্দ শুনতে পারবে না।ইদানিং হাত পাও কেমন যেন ফোলা ফোলা দেখায়।মা কিছুই বলে না।নাপা খেয়ে ব্যথা সাড়ে।বাসায় এতগুলো মানুষ! সব কাজ মায়ের করতে হয়।কেউ তো একটু কুটোও নাড়ে না।মেজ আপার বাচ্চা হবে, একটু পর পর সে বায়না করে এটা ওটা খাওয়ার। বড় আপারা ঈদের পর যাবে, আবার কাল থেকে রোজা…এত কাজ মা একা করবে কি করে এই ভেবে এই মরিচাকে আনানো।
লাবণ্য সোফায় বসে মেকাপ করতে ছিল, তার ক্লাস আছে।কাল থেকে তো রোজার জন্য সব বন্ধ থাকবে তাই আজ ও তারুণের সাথে অনেক ঘুরবে।তারুণ এখন ওর বেষ্ট ফ্রেন্ড! কারণ তারুণ কখনো ওর মেকাপ নিয়ে কথা বলে না।মেকাপের সাথে এতক্ষণ মনোযোগ দিয়ে মরিচার কথাও শুনছিল…এবার প্রশ্ন করলো লাবণ্য,
—–আচ্ছা তোমার নাম মরিচা রাখা হলো কেন?এটা কোন নাম হলো…..
——হায় হায় ছুডু আফা আমনে কেমন কতা কন? মোর নাম লইয়া কোন কথা মুই মানতে পারমু না।মোর বাপে মরিচ বেমেলা পছন্দ করতো তাই মোর নাম রাখছে মরিচা। এই রহমের নাম আমনে কই পাইবেন?আমাগো আশেপাশের দশগ্রামে নাই তারফর তো আফনেগো ঢাহা..
লাবণ্য মরিচার কথা বলার ভঙ্গি দেখে হেসে দেয়।পাশ থেকে মেজো আপা জিজ্ঞেস করে, তোমার বিয়ে হয়েছে মরিচা?
—–হইছিল তো আফা,জানেন আফা হেয় আমারে আদর কইরা বোম্বাই মরিচ ডাকত,কি ভালা পাইতো আমারে…তারফর তো তালাক হইয়া গেল মোগো মধ্যে, বলতে বলতে কেঁদে দেয় মরিচা। তার চোখে পানি দেখে সহজ সরল মেজ আপার চোখও ছলছল করে ওঠে।
—-আরে মাইজা আফা আমনে কানতন কেন? কাইন্দেন না।মানুষটা ভালা আছিল তো তাই মোর কান্দন আয়।
—-তালাক হলো কেন তাহলে?
—-বিয়ার বয়স পাঁচ বছর হইয়া যায় মোর বাচ্চা হয় না, বেবাকে বাজা ডাকে।মাইনষের বাচ্চা দেখলে হেয় চাইয়া থাকতো তাই মুই কইলাম বিয়া করো।হেয় করতে চায় নাই আফা,ভালা পাইতো তো আমারে।মুই জোর কইরা বিয়া দিলাম কইদিন পর হেই বউর বাচ্চা হইবো।হেই বাচ্চা রাকতে হইলে মোরে তালাক দিতে অইবো অই বউ কইলো।তালাকের সময় হের কি কান্দন আফা……
এবার পুনম খুব অবাক হয়,মরিচার চোখ দেখেই বুঝা যায় সে তার স্বামী কে কতটা ভালোবাসে কিন্তু তার সুখের জন্য নিজের অধিকার ছেড়ে দিল, প্রিয়জনের সুখের জন্য এভাবে কত মানুষ যে নিজের সুখ ত্যাগ করে তার হদিস কেইবা রাখে? কতই বা বয়স মরিচার বিশ কি একুশ। এতটুকু মেয়ে এর মধ্যেই কত কিছু না সয়েছে…..
পুনম ব্যাগ নিয়ে উঠে দাঁড়ায় তাকে টিউশনিতে যেতে হবে সেখান থেকে আবার হসপিটাল যেতে হবে।যেতে যেতে সে শুনতে পায় মরিচা লাবুকে জিজ্ঞেস করতেছে,
এই গুলা আফনে কি ঘষেন মুখে ছুডু আফা?
মেকাপ করি মরিচা বু।তুমি একটু লিপস্টিক দিবে?
মরিচার হাসির শব্দ শুনতে পাওয়া যায়।মোর সাজতে খুউব ভালা লাগে ছুডু আফা।
পুনম দরজার কাছ থেকে ফিরে তাকায়, দেখে লাবু খুব যত্ন করে মরিচার ঠোঁটে লিপস্টিক দিয়ে দিচ্ছে আর মরিচা বড় করে হা করে আছে…..
************************************
তানভীর হসপিটালের কেবিনে শুয়ে সিলিং এর দিকে তাকিয়ে আছে।তার শরীর জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে কিন্তু তাও সে একটু পর পর রাজুকে জিজ্ঞেস করতাছে,
—–রাজু তুমি পুনমি কে ঠিকঠাক খবর দিয়েছিলে তো, বলেছো তো আমি খুবই অসুস্থ। সে আসবে তো রাজু?
রাজু পারে না তো এখন কেঁদে দেয়, ওর পুনমের পা ধরা বাকি আছে কেবল।এখন পর্যন্ত যতবার পুনমকে সে আসতে বলছে ততবার পুনম উত্তর দিয়েছে, আমি এসে কি করবো রাজু ভাই?আমি কি ডাক্তার না কবিরাজ? নাকি আমি কোন মহামানবী যে আমি আসলেই আপনার স্যারের অসুখ ভালো হয়ে যাবে? আমি আসতে পারবো না রাজু ভাই, আমার অনেক কাজ!
রাজু ভেবে পায়না এই নিষ্ঠুর মেয়েটিকে কেন তার স্যার এত পছন্দ করে….
সেদিন পুনমের সাথে দেখা করে আসার পথে বৃষ্টি নামে, সেই বৃষ্টিতে ভিজে জ্বর বাধে। রাজু বিড়বিড় করে বলতে থাকে, মেয়ে মানেই ঝামেলা!
প্রচুর জ্বরে তানভীরের চোখ মুখ লাল হয়ে আসে। চোখ জোরা ক্লান্তিতে বুজে আসতে চায় তবু তানভীর জোর করে মেলে রাখে যদি পুনম আসে?জ্বরের আগুন তানভীর কে পুড়াতে পারে না যতটা পুনম নামের মেয়েটি ওকে পোঁড়ায়।বুকের ভিতর যন্ত্রণা হয়, ওই শান্ত অথচ দৃঢ়তায় ভরপুর মেয়েটিকে দেখার জন্য। তানভীর জানে পুনম আসলেই ও সুস্থ যাবে। এ অসুখ সুখের অসুখ!পুনম নামের অসুখ!
সেদিন রিকশায় বসে পুনম তানভীরকে বলে,
—-নবাবপুত্র এই যে আমাকে দেখতে পাচ্ছেন এটাই আমি,খুবই সাধারণ। যে বাজার করে, পায়ে হেটে রোজ পাঁচটা ছয়টা টিউশন করায়।ঘামে ভিজে বাসের ভিরে ঘন্টার পর ঘন্টা দাঁড়িয়ে গন্তব্যে পৌছায়।আমাদের জীবনে কোন বিলাসিতা চাই না,আমরা একটু সচ্ছলতার খোঁজ করি রোজ!মাসের শেষে আমার বাবার হাতটান থাকে। আমদের বাসায় রোজ মাছ মাংস রান্না হয়না। একটা ডিম ভাজাও আমাদের জন্য মাঝে মাঝে বিলাসিতা। আপনারা বেলা বারটায় উঠে রোজ হেভি হেভি নাস্তা করেন আর এই আমায় খুব সকালে উঠে ছুটতে হয় কাজের জন্য। আমার আর আপনার কোন মিল নেই নবাবপুত্র! আমার কাছে ভালোবাসার আগে দায়িত্ব বড়।যদি কেউ আমার কাছে সুখ দুঃখ এই দুটোর মধ্যে একটা বেচতে চায়।আমি কোনটা কিনবো জানেন? দুঃখ! কারণ সুখ কখনো কেউ কিনতে পারে না।দুঃখ কেনা যায়। আপনাকে গ্রহণ করা মানে আমার সুখের লোভ করা হবে।
আমি সাধারণ মেয়ে,আমার জীবনে আমি সাধারণ একজন মানুষ চাই। ভাই না থাকায় বাবার অনেক কাজের দায়িত্ব এখন আমার। “ভালোবাসা এড়ানো যায় কিন্তু দায়িত্ব এড়ানো অসম্ভব।” আমি একজন সাধারন মানুষ চাই যে আমার দায়িত্ব নিবে।এত এত দায়িত্বের বোঝায় ভরপুর আমার কাঁধটাকে নিঃসঙ্কোচে জরিয়ে ধরবে। যার কোন ভয় থাকবে না আমায় গ্রহণ করতে।
নবাবপুত্র অনেক দায়িত্ব আমার ভিতর আশ্রয় নিয়েছে সেখানে নতুন কোন দায়িত্ব আর আমি নিতে পারবো না। আমি একজন হিরো চাই, যে লড়বে আমার জন্য, কিন্তু অসহায় হয়ে কোন আশ্রয় চাইবে না। আমি এমন কোন অসহায় মানুষকে আমার জীবনে চাইনা যে আমার কাছে আশ্রয় চায়।আমার দায়িত্বের ঝুলি কানায় কানায় পূর্ন!
তানভীর বিড়বিড় করে বলতে থাকে, আমি তোমার হিরো হবো পুনমি।আমিই তোমায় ভালোবাসার দায়িত্ব নিবো!
পুনম যখন হসপিটালে পৌঁছালো তখন তানভীর আধো ঘুমে আধো জাগরণে।পুনমের দেখে মায়া হয়। কি সুন্দর দেখতে মানুষটা এই কদিনের জ্বরে কেমন হয়ে গেলো।পুনম জানে তানভীর তার উপর রাগ করেই বৃষ্টিতে ভিজেছে।এত রাগ! পুনম আসতে চায়নি।অনেক বার ইগনোর করেছে রাজুর কল।কিন্তু হটাৎ করে পুনমের খুব খারাপ লাগতে শুরু করলো।মনে হলো কে যেন ওকে বার বার ডাকছে,তাই আসা।
রাজু রাগ দেখিয়ে কেবিনের বাহিরে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে।
বেডের পাশে রাখা টুলটাতে বসে পুনম তানভীররে কপালে হাত রাখে।পুনম শিউরে ওঠে,ইশ! এত জ্বর! পুনমের চোখ ছলছল করে।কেন পাগলামি করে এই মানুষটা? উনি যা চায় তা কি আদোও সম্ভব! আনমনেই পুনম তানভীরের চুলে হাত বুলায়…..
তানভীর চোখ মেলে পুনমকে দেখে বিশ্বজয়ের হাসি দেয়। পুনম আশ্চর্য হয়।এত জ্বর নিয়ে কিভাবে হাসা সম্ভব? জ্বরের ক্লান্ত মুখ, ঘুমঘুম শান্ত দুটি চোখ, খোঁচা খোঁচা দাড়ি আর এলোমেলো চুলে তানভীরকে বড্ড আদুরে লাগে পুনমের কাছে। এত পবিত্র মুখ কি পুরুষের হয়? নিজেকে নিজে প্রশ্ন করে,কিন্তু উত্তর পায়না।
পরক্ষণেই তানভীররে কথায় চমকে ওঠে।
ঘোরলাগা কন্ঠে তানভীর তাকে বলে,
—-আমায় একটা চুমু দাও না পুনমি। আমার না খু….ব জ্বর!
কি ভয়ংকর কথা!পুনমে বুকের ভিতর ধক্ করে ওঠে।কি মায়া কন্ঠে আদুরে আবদার! যেন জ্বর হলেই চুমু দিতে হয়।পুনমের বুকের ভিতর তোলপাড় হয়!নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হয়। এই দুটো বাক্যই যথেষ্ট কোন নারীর হৃদয় কে খুন করার জন্য।
তানভীর তখনও চোখ পিটপিট করে তাকিয়ে আছে পুনমের দিকে।ওই চোখ যেন পুনমের কাছে আবদার করে বলছে, আমায় একটা চুমু দাও না পুনমি,আমার না খু…ব জ্বর!
পুনমের দিশেহারা লাগে,তেষ্টা পায় ভীষণ! টেবিলের উপর রাখা পানির গ্লাস নিয়ে ঢকঢক করে পানি পান করে পুনম।এতে ওর তেষ্টা কমে না বরং বাড়ে! ও জানে তানভীর জ্বরের ঘোরে এই কথাটা বলেছে, তারপরও পুনমের এই জীবনে শোনা এই কথাটাই চরম ভয়ংকর সুন্দর কথা! হ্যা ভয়ংকর সুন্দর!
চলবে,