#পুনম
#আয়েশা_সিদ্দিকা
পর্বঃ৩১
লাবণ্য কান ধরে এক পায়ে দাঁড়িয়ে আছে।লাবণ্যের কান্না পাচ্ছে। চোখ ছলছল করছে।পা ব্যথায় টনটন করছে।লাবণ্য চোখ ঘুরিয়ে ঘড়ির দিকে তাকায়।নাহ এখনো নয়টাই বাজেনি।নয়াপু না আসলে এ শাস্তি থেকে উদ্ধার নেই।বাবা চোখ গরম করে তাকিয়ে আছে।নিয়াজ উদ্দিন ভেবে পায় না, তার এই মেয়েটা পড়ালেখায় এত গাধা কেন? সারাদিন সাজগোজ আর নাচানাচি!
লাবণ্য করুন মুখ করে বাবার দিকে তাকায়, এতে যদি বাবার মন গলে!
শ্যামলাগড়নের মায়াবী মুখ,বড় বড় চোখদুটিতে কাজল দিয়েছিল সম্ভাবত তা লেপ্টে গেছে।এতে মুখটা আরো মায়াবী লাগছে।নিয়াজ উদ্দিন চাপা নিঃশ্বাস ছেড়ে উঠে পড়েন।তার এই মেয়েটা হয়েছে জনম ত্যাদড়!দুঃখী দুঃখী মুখ করে এখন তাকে পটাতে চাইছে।তা হতে দেয়া যাবে না।
লাবণ্য ভালো করেই জানে, বাবা তার মেয়েদের কষ্ট সহ্য করতে পারে না।তাই এই ব্যবস্থা কিন্তু তাতে বিশেষ কাজ হলো না!
বাবা চলে যেতেই মরিচা ফ্যানের পাওয়ার বাড়িয়ে দেয়।মরিচা মনে মনে এই বাড়ির সবাইকে বকে।তার ছুডু আফারে কেউ ভালা পায় না।কেউ না।
লাবণ্য আবার গেটের দিকে তাকায়। নাহ নয়াপু আসছে না।খিদেয় পেটে ইদুর দৌড়াচ্ছে। উফফ! এর থেকে ফেল করলেও ভালো ছিল।বি গ্রেড কি কেউ পায় না নাকি? বি গ্রেড পেয়ে যদি শাস্তি পেতে হয় তবে বি গ্রেড আবিষ্কার করেছে কেন? সোফায় পড়ে থাকা লাবণ্যের মোবাইলটা অনবরত বাজছে।তারুণ কল করছে…এই ছেলের সাথে এখন কথা বলা যাবে না।তাহলে আরো ঝাড়ি খেতে হবে? কিসের জন্য যে ব্রিলিয়ান্ট ছেলের সাথে বন্ধুত্ব করতে গেছিল?এর জন্য নিজেকে নদীতে চুবাইতে মন চাইতাছে!
🌺🌺
সালেহা রান্না করছে আজ অনেক দিনপর।তার মেজাজটা আজ চুলার আগুনের থেকেও গরম!
ইদানীং শরীরটা ভালো থাকে না দেখে পাবনীই রান্না করে কিন্তু মেয়েটা জ্বর বাধিয়ে বিছানায় পড়ে আছে।মেজটার তো এখন উঠতে বসতেই কষ্ট হয়।ভাল্লাগেনা এই সংসার জীবন আর।মরিচাটা মরেছে কোথায় আল্লাহ জানে?তাকে রেখেছে কাজের জন্য আর সে সারাদিন লাবুর সাথে টো টো করে।সালেহা মরিচা বলে চিৎকার করে ডাক দেন…..
—-কি হয়েছে খালাম্মা ডাক পারেনা কেন?
—থাকিস কই?কাজের সময় পাওয়া যায় না।
মরিচার মন এমনিতেই খারাপ…ছুডু আফায় কান ধরি দাঁড়িয়ে আছে আর সে….
—-ক্যান সবই তো গুচাইয়া আমনের হাতের দারে থুইয়া গেলাম….
সালেহা চোখ গরম করে তাকায়…. পরক্ষণেই আবার চাল কুমড়ার তরকারির মসলা নাড়তে ব্যস্ত হয়ে পড়েন।আসলে এ কথা ঠিক সবই ঘুছাইয়া দিয়ে গেছে মরিচা।রান্নাটা শুধু সে করতাছে। মেজ জামাইটা ঘরে তারে কি আর মরিচার হাতের রান্না খাওয়ান যায়? বড় মেয়েটার জন্য তার কষ্ট হচ্ছে…. জামাইটা নাকি ঝামেলা করতাছে।রুমা একটু আগে ফোন দিয়ে চিল্লা পাল্লা করছে।কি করার আছে তার। পুনমের বাবা সব শুনে চুপ হয়ে আছে।পুনমটা তো সারাটাদিন থাকে দৌড়ের উপর। তার ছেলেটা বেঁচে থাকলে কি আজ বোনের বিপদে দৌড়াতো না? দৌড়াতে অবশ্যই দৌড়াতো।কেন মরে গেল ছেলেটা? এটা ভাবতেই চোখে পানি এসে যায় সালেহার।
রান্না ঘর থেকে বের হতেই লাবণ্য বলে,
—মা খুদা লাগছে।
একেতো মন মেজাজ ভালো নেই সব ঝাল যেয়ে পড়ে লাবণ্যের উপর।
—-এত বড় দামড়ি ছেড়ি…সারাদিন শুধু খাওয়া আর সাজগোজ। এই রেজাল্টের পর তোর খুদা লাগে কেমনে? কথা কস না কে?
লাবণ্য ফুঁসে ওঠে,
—ফেল তো আর করিনি।এর থেকে ভালো আমি আর পারবো না।আমার পড়া লেখা করতে ভালো লাগেনা।
সালেহার মাথায় যেন রক্ত চড়ে….রান্না ঘর থেকে কাঠের চেড়া এনে এলোপাতাড়ি মারতে শুরু করে লাবণ্যকে।লাবণ্য মায়ের মার দেখে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে।বড় হওয়ার পরতো কখনো মা মারে নি। লাবণ্যকে মারতে দেখে মরিচা জোরে জোরে কাঁদতে শুরু করে। খালুজান খালুজান করে চিল্লাতে থাকে….
🌺🌺🌺
পুনম যখন বাসায় ফিরে তখন বাসার পরিবেশ ঠান্ডা। হাত মুখ ধুয়ে প্রথমে বাবার রুমে যায় পুনম। মাকে শুয়ে থাকতে দেখে মায়ের পাশে বসে।মায়ের মাথায় হাত রাখতেই ধরফর করে উঠে বসে মা। মায়ের চোখে পানি দেখে পুনম ব্যস্ত কন্ঠে বলে,
—মা শরীর খারাপ লাগছে?কাঁদছো কেন? কি হয়েছে মা?
—পুনু রে আমি আজ লাবুকে মেরেছি।রাগের মাথায় মনে হয় বেশি মার দিয়ে ফেলেছি।মেয়েটা মনে হয় বেশি ব্যথা পাইছে।
—সে কি! ওকে মেরেছো কেন?
—মাথা ঠিক ছিল না।কি একটা রেজাল্ট করেছে তার উপর রুমার চিন্তায় আমি কি করে ফেলেছি নিজেও জানি না।
—ঠিক আছে চিন্তা করো না।ওকে আমি বুঝাবো।আর বড় আপাকে তো আমি কল করতেছি সে তো রাগ করে আমার কল রিসিভ করে না। সুমন ভাই বললো, তোমার বড় জামাই নাকি আবার বিয়ে করবে।
সালেহা হাউমাউ করে কেঁদে ওঠেন,
—-আমার মেয়েটার কি হবে পুনু?তুই কিছু কর মা?সুমন কেন এমন করলো?
পুনম মায়ের চোখের পানি মুছে দিয়ে বলে,
—মা সুমন ভাই তো ভুল কাজ করছে না।সুমন ভাই যদি তার পাওনা অংশ চায় এর সাথে বড় দুলাভাইর বিয়ের কি সম্পর্ক? যে তার মেয়েদের মুখের দিকে তাকাচ্ছে না…. তাকে আমি কি বলবো? তবুও দেখি বাবাকে কাল একবার ওদিকে যেতে বলবো।
—পুনুরে আমার রুমা বদমেজাজি। নিজের স্বার্থ ছাড়া কিছু বুঝেনি কোনদিন তারপরও সে তো আমাদের মেয়ে। তোর বাবা কেন চুপ হয়ে আছে বলতো?
পুনম কোন কথার জবাব না দিয়ে চুপ হয়ে থাকে।কি বলবে মাকে? বড় আপা যেমনই হোক নিজের বোন তো। কষ্ট কি ওর কম হচ্ছে? মায়ের চোখের নিচ ফোলা।শরীরের রঙ ফ্যাকসে।মা কে একবার ভালো একটা ডাক্তার দেখানো দরকার।সামনে মেজ আপার ডেলিভারি। এত এত চিন্তা কার ভালো লাগে।
—-মা তুমি বেশি ব্যথার ঔষধ খেয়েও নাতো।
—কি করবো? কোমড়ে আর পা ব্যথা যখন উঠে আর পারি না সহ্য করতে।
মাকে বিশ্রাম নিতে বলে পুনম ঘর থেকে বের হয়ে যায়। লাবণ্যের কি অবস্থা দেখা দরকার একবার!
🌺🌺🌺
হায়দার হোসেন তার নিজস্ব উকিলের সাথে কথা বলছিল। তার কপালে চিন্তার রেখা।আর কিছুটা দিন এরপর সব ঠিক হয়ে যাবে। এত দিনের পরিশ্রম বিফলে যেতে দিবেন না হায়দার হোসেন। তার কাছে টাকার থেকে বড় কিচ্ছু না।
উকিলের কথার বিপরীতে হায়দার হোসেন বলে ওঠে,
—দরকার হলে কাজ শেষে দুনিয়া ছাড়া করবো ওকে।
ঠিক সেই মুহুর্তে তারুণ রুমে প্রবেশ করে।তারুণকে রুমে দেখে উকিল আর বাবা দুজনেই হকচকিয়ে যায়।সর্বনাশ!তারুণ সব শুনে ফেলেনিতো?
—-স্যরি বাবা।তুমি কি বিজি?আমি পরে আসবো?
হায়দার হোসেন একগাল হেসে না বলে।উকিলকে চলে যেতে বলে তারুণে উদ্দেশ্যে বলে,
—-কি ব্যাপার মাই সান?এনি প্রবলেম?
—-বাবা তুমি ভাইকে ফিরে আসতে বলো।
—আমি তোমার ভাইকে যেতে বলিনি তারুণ। সে একটা মেয়ের জন্য আমাদের ছেড়ে গেছে।আমি কি এতে কষ্ট পাইনি।আফটার অল সে আমার একমাত্র ছেলে!
—তাহলে বাবা আমি কি?
—না না আসলে বলছিলাম সে আমার একমাত্র বড় ছেলে।তুমি তো এখনো ছোট। এত কিছু কি বোঝো আর?
—-বাবা আমি এতটাও ছোট নই।ভাই যাকে চায় তাকে কেন তুমি মানতে পারছো না?
—আমি আমার বন্ধুর মেয়েকে তানভীরের জন্য আনবো। ওই সব থার্ডক্লাস হাড় হাভাতের আমার ম্যানশনে কোন জায়গা নেই। তোমার এতকিছু না জানলেও চলবে। তুমি এত ভালো রেজাল্ট করেছো বাসায় একটা পার্টি দিবো আগামীকাল। কি খুশি তো?
—-আমি কোন পার্টি ফার্টি করবো না।ভাইকে ছাড়া তো একদমই না।
—-তোমার এত ভালো রেজাল্টে সেলিব্রেট করবো না।তা তো হয় না মাই সান।তোমার বন্ধুটিকেও নিয়ে এসো।কেমন?
—বাবা সেও তো থার্ডক্লাস পরিবারের মেয়ে। মানো তোমার মতে মধ্যবিত্ত পরিবার মানেই তো থার্ড ক্লাস তাই না?
হায়দার হোসেন হটাৎই মুখটা গম্ভীর করে ফেলেন। হাতের কাছে রাখা ফাইলটা টেনে নিয়ে বলেন,
—-তুমি আর তানভীর কখনোই এক নও।এখন তুমি আসো..আমার কাজ আছে।
তারুণের মনটা খারাপ হয়ে যায়।সে আর ভাই এক নয় কেন?
🌺🌺🌺🌺🌺
তানভীর দম ফেলার সময় পাচ্ছেনা।নিজে কিছু করার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা চালাচ্ছে। রেস্টুরেন্ট বিজনেস করার ইচ্ছা। টুকটাক পড়াশোনা করে নিজের মগজ ধোলাই করছে। বিজনেসের জন্য এদিক সেদিক দৌড়াতো হচ্ছে। যেখানেই বিজনেসের কাজ করতে যাচ্ছে সেখানেই সবাই অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে।যার বাবার কোটি কোটি সম্পত্তি, যাদের কয়েকটা কোম্পানি তার ছেলে কেনো বিজনেসের জন্য স্ট্রাগল করছে? সবারই এক প্রশ্ন।কিন্তু তানভীরের উত্তর দিতে মন চায় না। তানভীর আর ফিরে যাবে না ঐ বিষ ম্যনশনে…মাঝে মাঝে তো মনে চায় বাবার পরিচয় যদি মুছে ফেলা যেতো।কিন্তু তা আদৌ সম্ভব?
রাজু চাকরি ছাড়ার পর ইদানীং আর একটা লোক ওকে ফলো করছে।তানভীর সবই খেয়াল করে কিন্তু সবই না দেখার ভান করে থাকে।দেখা যাক না কি করে হায়দার হোসেন?
রাজ কপাল কুঁচকে বলে,
—-স্যার আর কতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকবো?
ফর্সা গায়ে কালো গেঞ্জি, ঘামে ভিজে আছে। কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম।খোঁচা খোঁচা দাঁড়িতে রোদ পড়ে ঘাম গুলো স্বর্ণ বিন্দুর মত চিককিক করছে।তানভীর চায়ের কাপে পুনরায় ঠোঁট ছোঁয়ায়। রাজু বিরক্ত মুখে চায়ের দোকানের বেঞ্চিতে বসে পড়ে।রাজু ভেবে পায় না কি লাভ প্রতিদিন এমন লুকিয়ে লুকিয়ে পুনম ম্যামকে দেখে? সামনেও যাবে না। শুধু দেখবে….রাজুর মাঝে মাঝে মনে হয়,স্যার প্রেমের পড়ে আহাম্মক হয়ে গেছে।
তানভীরের চোখ দুটো স্থির হয়ে যায় সামনের রাস্তা থেকে হেঁটে আসা ঐ নিষ্ঠুর তরুণীর দিকে।চোখে পলক ফেলতেও যেন ভুলে যায়।নিঃশ্বাস আটকে আসে এক মুহুর্তের জন্য। তার পুনমি এত সুন্দর কেন?কেন?
কি সুন্দর করে হেঁটে আসছে।চোখ দুটো কুঁচকানো কেন? রোদের জন্য।উফফ!এক মুহুর্তের জন্য তানভীর ঐ রোদগুলোকেও হিংসা করে ফেলে।ওরা কত সহজেই না তার পুনমিকে ছুঁয়ে ফেলে!
পুনমি যেখানে জব করে। সেখানে ইউনিফর্ম হলো পাতলা জর্জেটের গোলাপি শাড়ি।
লতানো দেহে ফিনফিনে পাতলা শাড়ি,ফর্সা শরীরে গোলাপি রং মিশে যেন আলাদা আভা তৈরি করেছে।পুনমকে দেখতর পুরোই হাওয়াই মিঠাই লাগছে। পুনমের এরুপ রুপে তানভীরের চোখ ঝলসে যায়!বুকের ভিতর ধুকপুক করে!ইশ! এই মেয়েটাকে সে ভালোবাসে ভাবতেই মুখে হাসি ফুটে ওঠে।
পুনম রিকশার জন্য দাঁড়িয়ে পড়ে।।পুনম দোকানের দিকে পিঠ রেখে দাঁড়িয়ে আছে।চুলে খোপা করার দরুন ফর্সা পিঠ দেখা যাচ্ছে। তানভীরের মেজাজ গরম হয়।ব্লাউজের গলা কেন এতো বড়ো হতে হবে? কেন?
সবাইকে নিজের রুপ না দেখালেই নয়! তানভীর চায়ের কাপ রেখে দোকান থেকে বেড়িয়ে পড়ে।রাগে নিজেকে শেষ করে দিতে মনে চায়। দুনিয়ায় এত মেয়ে থাকতে তার মন কেন বেছে বেছে এই নিষ্ঠুর মেয়েটার কাছে গিয়ে মরলো?
রাজু ধীরে সুস্থে চা খেয়ে বের হয়।তার এখন আর ব্যস্ত হওয়ার কিছু নেই।রোজকার ঘটনা এটা।তার স্যার পুনম ম্যামের জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করবে।পুনম আসবে তার স্যার পাগল প্রেমিকের মত তাকিয়ে দেখবে কিছুক্ষণ পর রাগ নিয়ে বেড়িয়ে যাবে। না কথা বলবে না দেখা করবে।সে নাকি পুনম ম্যামকে শাস্তি দিচ্ছে। এ কিরকম শাস্তি?যে শাস্তিতে নিজেই জ্বলে পুড়ে মরতে হয়!
🌺🌺🌺🌺
এলোমেলো দুই বেণি করা।চোখ মুখ ফুলে আছে।জামা কুঁচকে আছে।লাল একটা ওড়না পেচিয়ে বাসা থেকে বের হয় লাবণ্য।
লাবণ্যের এরকম সজ্জা দেখে তারুণ অবাক হয়।এই মেয়ে রেজাল্ট খারাপের জন্য নিশ্চয় কাঁদেনি।তবে কি হয়েছে?
মেকাপ রাণীর এরকম লুক কেন?
লাবণ্য মেজাজ দেখিয়ে বলে,
—কি হয়েছে?এত ফোন দিচ্ছিস কেন?আর আমার বাসার সামনে কি?
তারুণ ঠোঁট টিপে হাসে।রেগে আছে মেয়েটা।তারুণ কিছু না বলে লাবণ্যর এক হাত নিজের হাতে মুঠোয় নিয়ে হাটা ধরে।লাবণ্যও কিছু বলে না।পাশাপাশি দুজনে হাঁটে।
একটা পার্কে এসে দুজনে বসে।লাবণ্য এখনো চুপ।যে মেয়ে কথা ছাড়া থাকতে পারে না।তার চুপ থাকা তারুণের ভালো লাগলো না।
তারুণ লাবণ্যের চোখের দিকে তাকিয়ে বলে,
—-কি হয়েছে আমাকে বল?
লাবণ্য ছলছল চোখে তাকায়। বড় বড় চোখদুটি ছাপিয়ে মুহুর্তেই জল গড়িয়ে পড়ে।ফুপিয়ে কেঁদে ওঠে।
হাতে চোট দেখে তারুণ ফের বলে,
—-ব্যথা পেলি কি করে?চুপ না থেকে বল।
—-মা মেরেছে।
—কেন?
—বি গ্রেড কেন পেলাম তাই।আমি কি করবো? পড়াশোনা আমার মাথায় থাকে না।
—এই এতটুকুতেই মারতে হয় নাকি।কাঁদিস না।সবাই কি ভালো স্টুডেন্ট হয়?
—নয়াপুও তাই বলেছে। তুইও কি রাগ করেছিস?
তারুণ হাসে মিষ্টি করে।লাবণ্যের চোখের জল মুছিয়ে দিয়ে বলে,
—-সবাই সব কিছু পারে না লাবণ্য। আমি তোর সাথে কেন রাগ করবো।আমি যে মেয়েটির সাথে বন্ধুত্ব করেছি সে মেয়েটা দুই তিন সাবজেক্টে ফেল করে।আজ সেই মেয়ে পাস করেছে এটাই অনেক!ফেলতো আর মারিস নি।
—এটাই তো মা বুঝে না,যদি ফেল করতাম।
—-একটা কথা মনে রাখবি লাবণ্য আমি কলেজে টপার কিন্তু আমি বন্ধু বানিয়েছি পড়াশোনায় অমনোযোগী একটা মেয়েকে।কারণ মেয়েটার অনেক গুন। সে অনেক ভালো সাজতে পারে,নাচতে পারে,অভিনয় পারে।এবং বড় কথা সে মানুষটি ভালো।তার পাশে থাকলে গোমড়া মুখো মানুষও হাসে! তাই কষ্ট পাবি না।তুই ফেল করলেও আমি তোকে ছাড়তাম না।কিন্তু তুই একটু চেষ্টা করলে আরো ভালো করবি।তাই নো কান্না। এখন হাস…আর সবসময় সেজেগুজে থাকবি।মেকাপ ছাড়া তোকে পেতনি লাগে।
লাবণ্য হেসে দেয়।তারুণ আর নয়াপু ছাড়া তাকে আর কেউ বুঝে না।এরা এতো ভালো কেন?
🌺🌺🌺🌺
পাবনীকে মেডিসিনের ডক্টর দেখিয়ে পুনম রিকশা নেয়।সেজ আপার জ্বরে শরীর পুড়ে যাচ্ছে। চোখগুলো রক্তজবার মত লাল।তারপরও আপা কি স্বাভাবিক! এত চাপা কেন তার সেজ আপা?
—তুই শুধু শুধু ডাক্তারের কাছে আনলি পুনম।কতগুলো টাকা খরচ হলো।এ জ্বর এমনিতেই সেরে যেতো।
—হ্যা তোকে বলেছে।এ জ্বর কি ভোগায় দেখো?
—-আমি তো এমনিতেই ছোটবেলা থেকেই ভুক্তভোগী আর কি ভোগাবে বল?
পুনম রিকশা নেয়।রিকশায় সেজ আপাকে শক্ত করে ধরে বলে,
—এত তত্ত্ব কথা বলো না।কিছু খাবে বলো?
পাবনী কথা বলেনা।ওর আসলে ঝাল ঝাল কিছু খেতে মন চাইছে।কিন্তু বলতে ইচ্ছে করলো না।এমনিতেই পুনমের কত গুলো টাকা খরচ হলো।
—-আপা জানিস পৃথিবীতে আল্লাহ সবাইকে কোন না কোন খুঁত দিয়ে পাঠিয়েছে। কারো খুঁত বড় কারো খুঁত হয় ছোট। তাই বলে কি কেউ নিজের জীবন নিয়ে হেলাফেলা করে?
পাবনী রিকশার পাশের হাতল শক্ত করে ধরে। তার মাথা ঘুরাচ্ছে।নিজেকে ধাতস্থ করে বলে,
—মিথ্যে কথা।তুই তো নিখুঁত। তুই সবদিক দিয়ে পারফেক্ট। তবে?
পুনম কিছুসময় চুপ থাকে।আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখে চাঁদ উঠেছে। ঠিক সেই সময়েই মনে পড়ে, তানভীর নামের অর্থ আলোকিত।পুনম মনে মনে বলে, নবাবপুত্র আপনি কার জীবন আলোকিত করতে এসেছেন?কে সে?
নিজির ভাবনা একপাশে রেখে পুনম বলে,
–সেজ আপা আমি ভালোবাসতে পারি না।কারো অনুভুতির মূল্য দিতে পারি না।নিষ্ঠুর আমি!বেয়াদব আমি! কঠিন আমি! এটা কি খুঁত নয়?
পাবনী হাসে,যে মেয়েটা সবাইকে আগলে রাখছে।সবার দায়িত্ব বইছে।সেই মেয়েটা নাকি ভালোবাসতে জানে না। নিজের জামা পুরানো হলেও যার চিন্তা হয় না। সেই পুরানো জামা হাসি মুখে পড়ে।নতুন জামার টাকা দিয়ে পরিবারের অন্য কারো চাহিদা পূরণ করে।যার জ্বর হলেও কেউ জানতে পারে না।যে কাঁদে সবার আড়ালে মুখ লুকিয়ে।সেই মেয়েটা নাকি অনুভুতি শূন্য?
পাবনী কিছু বলতে নেয় ঠিক সে সময় পুনমের ফোন বেজে ওঠে। পুনম মোবাইলের দিকে তাকিয়ে বলে,
—সেজ আপা এই উজবুক আমায় কেন কল করছে? তার আমার কাছে কি?
পাবনী বুঝতে পারে সুমন কল দিয়েছে।এই লোক আজ একশো কল দিয়েছে, পাবনী রিসিভ করেনি।পাবনী মৃদুস্বরে বলে,আমি কি জানি?
পুনম বিরক্তের ঢঙ ধরে বলে,
—হ্যালো!হ্যালো!
—পুনম তুমি কোথায়?…. সুমনের কন্ঠে অস্থিরতা।
—তা দিয়ে আপনার কি দরকার সুমন ভাই?
—ইয়ে পুনম..পাবনীর কি হয়েছে? আমার কল রিসিভ করে না কেন?
—আপনার পাবনী গোস্বা করছে। আপনি এসে গোস্বা ভাঙান।
সুমন ফোনের ওপাশে চুপ হয়ে থাকে কি বলবে ভেবে পায় না।পুনম ফোনের লাউড বাড়িয়ে দেয়।ঠোঁটে মৃদুহাসি নিয়ে বলে,
—-সুমনভাই আপার তো ভীষণ জ্বর এসেছে।
—সে কি!কখন? কিভাবে? এই মেয়েটা নিজের খেয়ার কেন রাখে না বলতো পুনম? আমি পাগল হয়ে না যাই।…সুমন চিৎকার করে বলে।
—-আপা তো এমনই।আপনি একবার আসবেন।এসে না হয় আপাকে একটু বকে গেলেন।
পাবনী ওদের কথা শুনে চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছে।
—-আমি আসলে যদি পাবনী রাগ করে?
—করুক…আদর টাদর করে রাগ ভাঙাবেন।এটাও আপনাকে বলতে হবে সুমন ভাই।
—আস্তাগফিরুল্লাহ! কি বলো এসব পুনম।
—-একটা সত্যি কথা বলেন তো সুমন ভাই।আপাকে কি ভালোবাসেন?
সুমন চুপ থাকে কয়েক মুহূর্ত। তারপর ফিসফিসিয়ে বলে,
—তোমার আপাকে আমি ভীষণ ভালোবাসি পুনম!।ভীষণ ভালোবাসি!এটা শুনে কি তোমার আপা রাগ করবে?
সুমনের ফিসফিস করা কন্ঠ যেন পাবনীর হৃদয়ে সুক্ষ্ম আঘাত হানে।কি বলে মানুষটা?ওর মত খোড়াকে কেন ভালোবাসতে যাবে।মানুষটা কি পাগল?সুমনের কথা শুনে পাবনীর ঘাম দিয়ে জ্বর ছেড়ে যায়!
পুনম হেসে দেয়।সুমনের সেজ আপার জন্য এই অস্থিরতা ওর খুব ভালো লাগে। কল কেটে দেয় পুনম।পাবনী ধীর কন্ঠে বলে,
—-পুনম আমার কেমন জানি লাগছে।মাথা ঘোরাচ্ছে!
—কেমন লাগছে আপা?সু-মন লাগছে নাকি কু-মন লাগছে?…..পুনম ভুরু নাচায়। পুনমের ভালো লাগছে ভীষণ ভালো লাগছে।হুট করে আপার অসুস্থতাও যেন ভালো লাগছে!
চলবে,
আপনারা কৃপণ কিন্তু আমি কৃপণ না। হুহ!