পুনম পর্বঃ৩৫

0
1225

#পুনম
#আয়েশা_সিদ্দিকা
পর্বঃ৩৫

ঝুমার ছেলে হয়েছে।নাদুসনুদুস একটা রাজপুত্র! ধবধবে ফর্সা শরীরের দেবশিশু যেন! পুনম সারা রাত বাচ্চা কোলে নিয়ে বসেছিল।আশ্চর্য হয়ে বাচ্চাটির দিকে তাকিয়ে দেখেছে।এতটুকুন একটা শিশু অথচ কি প্রশান্তিময় মুখ! এত দুঃখের মধ্যেও শিশুটির আগমন যেন এক পশলা সুখের মত! মেজ আপা নিজের ছেলের মুখ দেখেই প্রথম যে কথাটা বললো তা হলো, “দেখ পুনু একদম তোর দুলাভাইয়ের মত দেখতে! মানুষটা নিজের সন্তানকে একবার দেখতে পেলো না!পুনু তাকে এনে দে,তাকে এনে দে।”
পুনম তার উত্তরে কিছুই বলেনি শুধু ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে বোনের কান্নামাখা মুখ দেখেছে।তার এই আপার জগত হলো তার স্বামী!
ঝুমার ভাগ্য ভালো,বাচ্চাটি নরমাল ডেলিভারিতে হয়েছে।ছেলে হয়েছে শুনে মাকে আর হসপিটালে রাখা যায় নি।কান্নাকাটি করে একসার করেছে।শেষে সুমন ভাই রাতেই বাসায় নিয়ে এসেছে।মা পুচকুকে দেখেই বলে উঠলো, ” ওরে পুনম, আমার চাঁদ এসেছে ঘরে।তোর ভাইও এরকম চাঁদের মত হয়েছিলো।”
মা একরাতেই অনেকটা সুস্থ হয়ে গেছে তার নাতিকে দেখে।একটু পরপর কাঁদছে আর বাচ্চাটাকে চুমু দিচ্ছে। লাবণ্য তো মাকে বারবার বলছে, ” মা দেখো বাবু বড় হয়ে নায়ক হবে।যে সুন্দর দেখতে।তোমার এই নাতি হাজার মেয়ের ঘুম হারাম করবে!”
মরিচা সারাঘর ছুটাছুটি করছে আর একটু পরপর লেবুপাতা আর মরিচ পুরছে,পাছে পুচকুর কারো নজর লাগে!
একমাত্র বাবা তার নাতির মুখ দেখে কোন উচ্চ বাচ্চ করলো না,শুধু তপ্ত দীর্ঘ শ্বাস ছাড়লো।
বড় আপা ঘরের দোর আটকে বসে আছে।মধ্যরাত পর্যন্ত কান্নাকাটি করলেও শেষরাতের দিকে ঘুমিয়েছে।
ইষ্টি মিষ্টি তাদের একমাত্র ভাইকে দেখতে পেলো না।পুনম বড় দুলাভাইকে কল করলেও ওপাশ থেকে কেউ রিসিভ করলো না।

********
অনেকক্ষণ বসে গোসল করেছে পুনম। শরীরটা হালকা লাগছে।গোসলের পর যেন পেটের খুদাটা মাথাচার দিয়ে উঠেছে।ফ্যানের বাতাসে নিজের ভেজা চুল মেলে দিয়ে মি.তানভীরকে কল দিলো পুনম।কিন্তু বারবার ফোনটা বন্ধ বলছে।শেষে রাজুকে কল করলো।রাজু একবারই রিসিভ করলো।পুনম ইতস্তত করে জিজ্ঞেস করলো তানভীরের কথা।জানতে পারলো তানভীর ইন্ডিয়া গেছে।রাজু যায় নি।পুনমের সুক্ষ্ম অভিমান হলো।মানুষটা যাওয়ার সময় বলে গেলো না কেন?এই তার ভালোবাসা?

পাবনী পেপে ভর্তা দিয়ে একপ্লেট ভাত নিয়ে এসেছে। সাথে মরিচ পোড়া।পুনম প্লেটের দিকে তাকিয়ে গোপনে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো।তার মানে ঘরের বাজার শেষ হয়েছে।এতদিনের অশান্তিতে বাজার করা হয়নি।আর বাবাও থম মেরে সারাদিন রুমে শুয়ে থাকে তাকে কিছু বলে লাভ নেই।
পুনম শান্ত ভঙ্গিতে ভাত মেখে খাওয়া শুরু করে।পাবনীর বুকের ভিতর মোচর দিয়ে ওঠে।পুনমের জন্য তার কষ্ট হয়।এত কিছু মেয়েটা একা সামলাবে কি করে?
পাবনীকে চিন্তিত মুখে চেয়ে থাকতে দেখে পুনম বলে,
” এত কি চিন্তা করছো সেজ আপা? ”
“আমার বড় ভয় করছে পুনম।বাবা ভীষণ নিশ্চুপ হয়ে গেছে।তোর চিন্তা হচ্ছে না?”
“কাল পর্যন্ত খুব টেনশনে ছিলাম পরে ভাবলাম চিন্তা করে তো কোন লাভ নেই।যে বিপদ দিয়েছে সেই উদ্ধার করবে শুধু আমাকে লড়তে হবে। বুঝেছো আপা?”
” তোর মত সবাই কেন হয় না, বলতো? ”
পুনম চুপচাপ শুনলো পড়ে বললো,” আপা এইযে খাবার খাচ্ছি, খুদার তাড়নায়! কোন শান্তি নিয়ে না।দিনশেষে আমারও ভয় হয় কিন্তু তোমরা ভেঙে পড়লেও আমি ভেঙে পড়তে পারি না।আমি শুধু এতটুকু জানি আমাকে লড়ে বাঁচতে হবে নতুবা মরতে হবে কিন্তু ভেঙে পড়া যাবেনা!”

পাবনী পুনমের কথা শুনে কেঁদে দেয়।একটুকুন একটা মেয়ে। কি করে সবদিক সামলাবে?
“সেজ আপা শুধু শুধু কেঁদো না তো।টিউশনে যাওয়ার আগে বাজার দিয়ে যাবো,তা রান্না করে রেখো।এসব ভর্তা দিয়ে ভাত খাওয়া যায় না।”
পাবনী হালকা পায়ে উঠে যায়। পুনম তাকিয়ে দেখে সেজ আপা বেশিই খুড়িয়ে হাঁটছে।তারমানে পায়ের ব্যথা বেড়েছে।পুনম দেখেও কিছু জিজ্ঞেস করলো না।

***********
তারুণ লন্ডন যাওয়া নিয়ে ভীষণ ব্যস্ত।কাগজপত্র ঠিক করছে।কোন ভার্সিটিতে পড়বে তার ডকুমেন্টস ঠিক করছে।সবকিছু মিলিয়ে ভীষণ ব্যস্ত!লাবণ্যের সাথে রাগ করে গত কয়েকদিন কথা বলেনি তারুণ।আজ মনে হচ্ছে দুষ্টু মেয়েটার সাথে রাগ করে লাভ নেই।রাগের কিছুই বোঝে না।এই যে এতদিন একটা কল করলো না তারুণ কই সে তো একটাবার খবর নেই নি।এই তার বন্ধুত্ব? মোবাইলে ঠিকই নাচানাচি করতে পারে অথচ…..
ঠিক সেই মুহুর্তে লাবণ্য মেসেজ করে, “তারু বেবি, আমি তৃতীয় বার খালামণি হয়েছি।খুব সুন্দর একটা রাজপুত্রের খালামাণি!আজ কিন্তু আমি অনেক প্লেট ফুচকা খাবো আর বিল তুই দিবি।রাজপুত্রের খালামণি হওয়ার ট্রিট!”
তারুণ মেসেজ পড়ে হেসে দেয়।লন্ডনে যাওয়ার পর এই মেয়েটাকে ও ভীষণ মিস করবে!
আর কাকে মিস করবে ভাবতেই মায়ের মুখটা ভেসে ওঠে।অবাক হয় তারুণ!বাবাকে ভীষণ ভালোবাসে সে আর বাবার সাথে সখ্যতাও বেশি অথচ মায়ের মুখটা কেন ভেসে উঠলো?তবে কি মাকে বেশি ভালোবাসে?মায়ের কথা ভাবতেই প্রচন্ড খারাপ লাগছে তারুণের অথচ বাবার জন্য একটুও খারাপ লাগছে না। কেন? তবে কি কোথাও কোন ভুল হলো?

*********
পুনম অনেকক্ষণ থানায় বসে থাকার পর মেজ দুলাভাইয়ের সাথে দেখা করার অনুমতি পেলো।মানুষটাকে দেখেই পুনমের ভীষণ খারাপ লাগলো আর পুচকুর মুখটা ভেসে উঠলো।জামাল একয়দিনেই অনেক শুকিয়ে গেছে।চোখমুখ কেমন বসে গেছে।পুনমকে দেখেই জামাল হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো।বারবার বলতে লাগলো, ” আমি কাউকে মারি নি পুনম,আমি কাউকে মারিনি।”
পুনম অনেকবলে তাকে শান্ত করলো।পরক্ষণেই আবার ঝুমা ঝুমা বলে কেঁদে উঠলো।পুনম মোবাইলে তোলা পুচকুর ছবি দেখালো।জামাল সেই ছবি দেখে আবার কতক্ষন কাঁদলো।ছবিতে হাত বুলালো,চুমু দিলো।শেষে বললো,” পুনম বাবুর গা থেকে কি নেফতানির গন্ধ আসে? ঝুমা তো সারাদিন তার গন্ধ শুঁকতো!”
কি অদ্ভুত প্রশ্ন!পুনম মাথা নাড়িয়ে না বললো।জামাল আবার কাঁদলো।তাকে ছাড়িয়ে নিয়ে যাওয়ার অনুরোধ করলো।পুনম তাকে কি স্বান্তনা দিবে ভেবে পেলো না।খুনের দায়ে জেলে গেলে কি এত সহজে ছাড়ানো যায়? তারউপর তো এ দেশে সত্য মামলার থেকে মিথ্যে মামলায় শাস্তি হয় বেশি! পুনম একরাশ চিন্তা নিয়ে থানা থেকে বের হলো।অবশ্য আসার আগে জামাল বলে দিলো তার ছেলের নাম রাখতে মুক্ত!পুনম তাকে আসস্ত করে এসেছে পুনম যেকোন উপায়েই তাকে ছাড়াবে।কিন্তু আদৌ সেই উপায়টা পুনমের জানা নেই!

***********
রাতে বাসায় ফিরবার আগে পুনমের নম্বরে একটা কল এলো।আনএক্সপেক্টেড কল যাকে বলে।তানভীরের বাবা কল করেছে তাকে।পুনম ভীষণ আশ্চর্য হলো।এই লোক তার কাছে কি চায় আবার?
পুনম কল রিসিভ করলো না।পরক্ষণেই একটা মেসেজ এলো সে নম্বর থেকে। ” অফারটা কিন্তু এখনো আছে।আই এম ওয়েটিং ফর ইউ!”
মেসেজটা পড়ে পুনমের কাছে সব জলের মত পরিষ্কার হয়ে গেলো।রাগমিশ্রিত ঘৃণায় শরীর রি রি করে উঠলো।একটা মানুষ কতটা জঘন্য হলে এরকম কিছু করতে পারে।কোন অজানা কারণে তানভীরের উপরও রাগ হলো।সকালে যে মন তানভীরের চিন্তায় আচ্ছন্ন ছিল এখন সেই মন তানভীরের উপর বিষিয়ে উঠলো।বারবার মনে হতে লাগলো, এই ছেলেটা তার জীবনে না এলে আজ এরকম কিছুই হতো না!
তানভীরের চৌদ্দ গুষ্টিকে বিশ্রী সব গালি দিতে মন চাইলো! পুনমের সমস্ত স্বত্বটা বিষিয়ে উঠলো!

চলবে,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here