#পুনরায়
#অরিত্রিকা_আহানা
#পর্বঃ৪
আজকে অফ ডে। মাহমুদ বাসায়ই ছিলো। এই সপ্তাহের মেইল গুলো চেক করছিলো সে। এমন সময় ডোরবেল বেজে উঠলো। পর পর দুবার বাজলো। মাহমুদ তাড়াহুড়ো করে ল্যাপটপ বন্ধ করে দরজা খুলতে গেলো। দরজার ওপাশের মানুষটাকে দেখে যারপরনাই অবাক হলো সে। মেহরিন! হ্যাঁ মেহরিন দাঁড়িয়ে আছে তার সামনে। হাসিমুখে দাঁড়িয়ে আছে! মাহমুদ কয়েক সেকেন্ড চুপ করে রইলো পাছে তার উত্তেজনাটুকু মেহরিনের কাছে ধরা পড়ে যায়। উত্তপ্ত নিশ্বাস চেপে রেখে বললো,
—“তুমি!”
—“হ্যাঁ। তোমার বাসা দেখতে এলাম।”
দরজা থেকে সরে ভেতরে তাকে ঢুকার জায়গা করে দিলো মাহমুদ। মেহরিন নিঃসংকোচে সোফায় গিয়ে বসলো। তার মুখোমুখি বসলো মাহমুদ। তার চোখে হতবম্ভ ভাব! চারপাশে চোখ বুলিয়ে দেখলো মেহরিন। বেশ বড়সড় ফ্ল্যাট। খোলামেলা, শান্ত! ইতোমধ্যে নিজেকে সামলে নিয়ে মাহমুদ। শান্ত গলায় জিজ্ঞেস করলো,
—“বাসার ঠিকানা পেলে কার কাছ থেকে?”
—“জেনে লাভ কি?”
—“কোন লাভ নেই। তবুও তোমাকে দেখে অবাক হয়েছি। একা এসেছো?”
মেহরিন ইঙ্গিতটা বুঝলো। তবে সূক্ষ্মভাবেই পাশ কাটিয়ে গেলো সে। বললো,
—“সুজান বাসায় নেই?”
—“সুইমিং এ গেছে।”
—“এনা?”
সরাসরি মাহমুদের মুখের দিকে তাকালো মেহরিন। মাহমুদের চেহারার অবশ্য কোন পরিবর্তন হলো না। এই প্রশ্নটার জন্য সে প্রস্তুত হয়েই ছিলো। সংক্ষিপ্ত জবাব দিলো,
—“না।”
—“এখানে কতদিন থাকবে?”
—“আগামী মাসেই ফিরে যাচ্ছি। তুমি চা কফি কিছু নেবে?”
—“বানাবে কে?”
মাহমুদের স্মিত হাসলো। মেহরিন মুগ্ধ দৃষ্টিতে চেয়ে রইলো। ঠাট্টার সুরে বললো,
—“এনা শিখিয়েছে বুঝি?”
মাহমুদ জবাব না দিয়ে উঠে কিচেনে চলে গেলো। মেহরিন পিছু পিছু এলো। মাহমুদের পরনে ছাইরঙা একটা টি-শার্ট আর সাদা ট্রাওজার। মুখভর্তি খোঁচা দাড়িগুলো বেশ বড় হয়েছে। চোখজোড়া আরেকটু গভীর হয়েছে কেবল। তবে এখনো আগেই মতই সুস্বাস্থ্যবান। মেহরিন একটু হাসার চেষ্টা করে বললো,
—“আগের মতই হ্যান্ডসাম আছো দেখছি!”
মাহমুদ হাসলো। মেহরিনের হাতে কফির মগ তুলে দিয়ে বললো,
—“থ্যাংকস!”
দুজনে একসঙ্গে বেরিয়ে এলো কিচেন থেকে। বেডরুমে গিয়ে কাকে যেন ফোন করলো মাহমুদ। পুনরায় সোফায় বসে বললো,
—“কফি কেমন হয়েছে?”
—“ভালো।”
—“থ্যাংকস!”
তারপর কিছুক্ষন নিরবতা। মাহমুদ কফিতে চুমুক দিয়ে বললো,
—“তারপর?…বিয়ে করছো কবে?”
—“কেন? আসবে তুমি?”
—“এই মাসে হলে, অবশ্যই চেষ্টা করবো।”
ভাংচুর দুদিক থেকেই হচ্ছে। নিঃশব্দ ভাংচুর! হৃদয় ভাংচুর! তবুও দুপক্ষই শান্ত! যেন কিছুই হয় নি। মেহরিনের নিঃশব্দে কিছুক্ষন চেয়ে রইলো মাহমুদের দিকে। বিয়ের প্রসঙ্গে কথা বলতে তার ভালো লাগছে না। ইচ্ছে করেই এনার কথা জিজ্ঞেস করলো। এনাকে দেখতে না পেয়ে ভেতরে ভেতরে খানিকটা কৌতূহল অনুভব করছে সে। জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে বললো,
—“এনাকে নিয়ে আসো নি যে?”
—“সুজানকেও আনার প্ল্যান ছিলো না। বাধ্য হয়ে নিয়ে আসতে হয়েছে।”
—“এনা জোর করে নি?”
—“না।”
—“তোমাকে একা ছেড়ে দিলো?”
—“মানে?”
মাহমুদ কফির মগ সেন্টার টেবিলে ওপর রাখলো। তারপর ফিরে তাকালো মেহরিনের দিকে। এমন সরাসরি চাহনি মেহরিনকে অস্বস্তিতে ফেলে দিলো। অস্বস্তিকর অবস্থা থেকে বেরোনোর জন্য বললো,
—“সুজানের সাথে দেখা করতে এসেছিলাম। ওকে বলো আমি এসেছি। আজ তাহলে আমি উঠি।”
—“লাঞ্চ করে যাও? আমি সুজানকে নিয়ে আসার কথা বলেছি।”
—“অন্যদিন।”
—“অন্যদিন কি আবার আসবে?”
—“বারণ করছো?”
—“বারন করবো কেন? তবে না এলেই বোধহয় ভালো। তোমার জন্যেও, আমার জন্যেও!”
অপমানে মেহরিনের মুখ থমথমে হয়ে গেলো। নিদারুণ ক্ষোভ জমা হলো সুন্দর মুখটাকে। তড়িৎগতিতে ব্যাগ নিয়ে উঠে দাঁড়ালো সে। সদর দরজা খুলে ঝড়ের বেগে বেরিয়ে যাচ্ছিলো, তবে ত্বরিতে তার ডানহাতটা চেপে ধরলো মাহমুদ। ছাড়ানোর চেষ্টা করে গর্জে উঠলো মেহরিন,
—“ছাড়ো আমাকে।”
—“রিলাক্স মেহরিন! এত রেগে যাচ্ছো কেন? রাগার মত কিছু হয় নি।”
মেহরিন কোনরকম ভদ্রতার ধারে কাছে দিয়েও গেলো না। ঝাড়া মেরে হাত সরিয়ে নিয়ে চেঁচিয়ে উঠে বললো,
—“তুমি আমাকে কি ভাবো? আমি ভিখিরি? আমি তোমার আর এনার মাঝখানে ঢুকতে এসেছি? তবে শুনে রাখো, যে জায়গা আমি স্বেচ্ছায় ছেড়ে দিয়েছে সেই জায়গা পুনরায় দখল করবার কোন অভিলাষ আমার নেই।”
—“শুনে খুশি হলাম।”
ক্রোধে জ্বলে উঠলো মেহরিন। মাহমুদ শান্তস্বরে বললো,
—“যাইহোক সেই সব প্রসঙ্গ থাক!”
—“কেন থাকবে কেন? বলো আমি শুনতে চাই!”
—“তুমি শুনতে চাইলেই যে আমি বলবো তেমন তো কোন কথা নেই?”
—“ভয় পাচ্ছো? সত্যিটা বেরিয়ে আসার ভয়?”
—“কোন সত্যি?”
—“তুমি এনাকে ভালোবাসো! স্বীকার করে নিলেই তো হয়!”
আশ্চর্য জনক ভাবে এবারেও হাসলো মাহমুদ। শান্ত স্বরেই বললো,
—“সেটা তো তোমার জন্য খুশির খবর। তুমি তো তাই চেয়েছিলে?”
আত্মসংবরণ করতে পারলো না মেহরিন। দুপ করে সোফায় বসে পড়লো সে। টলমল করতে থাকা চোখের পানি বৃষ্টির ধারার ন্যায় গড়িয়ে পড়তে শুরু করলো। নিজের বোকামি লজ্জায় নুইয়ে দিলো তাকে। কেন সে নিজেকে সামলাতে পারলো না। কেন এলো এখানে? কেন?
আগের মত হলে হয়ত মাহমুদ বলতো, “শোন মেহরিন! আমার হৃদয়টা কোন দানের বস্তু নয় যে যখন খুশি, যাকে খুশি দান করবে। আমার হৃদয় একান্তই তার। আমার হৃদয় নিংড়ানো ভালোবাসাটাও একান্তই আমার। তবে যেই জায়গার কথা তুমি বললে তা বরাবরই তোমার দখলে ছিলো, আছে এবং থাকবে। এনা সেই চরম সত্যিটা জেনেই আমাকে ভালোবেসেছিলো কিন্তু আফসোস তুমিই জানতে পারলে না।”
কিন্তু এখন বললো না। এসব কথা এখন ভিত্তিহীন। এসব কথা বলে মেহরিনকে দ্বিধায় ফেলে দেওয়ার কোন মানে হয় না। মেহরিন যখন স্বেচ্ছায় বিয়েতে রাজী হয়েছে তখন মাহমুদ তাকে কোন রকম অস্বস্তিতে ফেলতে চায় না। চুপচাপ মেহরিনের পাশে বসে রইল সে।মেহরিন চোখ মুছে শান্ত স্বরে বললো,
—“আমি আসি মাহমুদ!”
★
তারপর দুটো দিন নিজেকে পুরোপুরি ঘরবন্দি করে রাখলো মেহরিন। নিজেকে সময় দিলো। মাথা ঠান্ডা করে ভাবলো। নাহ! আর কোনভাবেই মাহমুদের সাথে জড়াবে না সে। মাহমুদ এনাকে বিয়ে করে সুখি হয়েছে। মেহরিন শুধুশুধু তাদের মাঝে ঢুকে ঝামেলা সৃষ্টি করতে চায় না। এতকাল যাবত যা করে এসেছে আজও তাই করে করবে। নিজেকে সম্পূর্ণ আড়াল করে ফেলবে মাহমুদের কাছ থেকে। মাহমুদকে সামনে এলে সব কিছু এলোমেলো হয়ে যায়। আর তা হতে দেওয়া যাবে না। নিজেকে আটকাতে হবে। তারজন্য রায়হানের সাথে বিয়েটা হওয়া জরুরী! কারো বিবাহিতা স্ত্রী নিশ্চই চাইলেই অন্য কোন পুরুষের চিন্তা মাথায় আনতে পারবে না। তখন বিবেকবোধ, দায়িত্ব, কর্তব্যের অদৃশ্য দেওয়াল তার সামনে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। হ্যাঁ ঠিক সিদ্ধান্তই নিয়েছে মেহরিন। যত দ্রুত সম্ভব নিজেকে ভালোবাসার এই টানাপোড়ন থেকে বের করে আনতে হবে। পুনরায় নিজেকে সামলে নিতে হবে।