#পুনরায়
#অরিত্রিকা_আহানা
#পর্বঃ৭
সারারাত ধরে ভাবলো মেহরিন। রাগ, অভিমান, অপমান কোনটাই ঠেকিয়ে রাখতে পারছে না সে। মাহমুদ তাকে বিয়ের উপহার দিতে এসেছে? কতবড় সাহস! ছেলের সামনে তাকে এমন অস্বস্তিতে ফেলে? এই রিং যদি মাহমুদের নাক বরাবর না মেরেছে তো তার নামও মেহরিন না। পরেরদিন সকালবেলাই চেইঞ্জ করে রেডি হয়ে নিলো সে। মাহমুদের সাথে আজ এসপারওসপার যাই হোক একটা বোঝাপড়ায় আসতে হবে।
আধঘন্টার ভেতরেই মাহমুদের বাসায় পৌঁছে গেলো সে। দরজায় দাঁড়িয়ে পরপর দুবার কলিংবেল বাজালো।
মাহমুদ ওয়াশরুম। আব্বাস এসে দরজা খুলে দিলো। চারপাশে চোখ বুলিয়ে দেখলো দেখলো মেহরিন। আগামীকাল ফ্লাইট। সুতরাং লাগেজপত্র সব গোছানো শেষ। তারমানে মাহমুদের দেশে ফিরে যাওয়া মোটামুটি ফাইনাল। বেডরুমের পর্দা সরিয়ে ভেতরে ঢুকলো সে। সুজান খাটের ওপর বসে ড্রয়িং করছে। হাত বাড়িয়ে সুজানকে কাছে ডাকলো,
—“সুজান?”
মেহরিনের ডাক শুনে খাতা থেকে মনোযোগ সরালো সুজান। মুখে হাসি ফুটে উঠলো। খাতা রেখে উঠে এলো। দুহাতে গলা জড়িয়ে ধরলো মেহরিনের। ওকে জড়িয়ে ধরতেই অর্ধেক রাগ করে গেলো মেহরিনের নরম মোলায়েম কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো,
—“তোর বাবা কই?”
—“ওয়াশরুমে!”
সুজানের আদুরে মুখখানার হাত বুলিয়ে দিলো মেহরিন। আবারো তার তুলতুলে নরম গালে খুব সাবধানে চুমু খেলো। নিবিড়ভাবে বুকে জড়িয়ে ধরে বললো,
—“তোকে আমি কোথাও যেতে দেবো না। তুই মায়ের কাছে থাকবি!”
সুজান আগাগোড়া কিছুই বুঝলো না। অতএব চুপ করে রইলো সে। মেহরিন পুনরায় তার গালে হাত বুলিয়ে দিয়ে ফিসফিস করে বললো,
—“শোন। মা এখন তোর বাবার সাথে ঝগড়া করবো। তুই কিন্তু একদম ভয় পাবি না কেমন?”
সুজান অবাক হয়ে চেয়ে রইলো তার দিকে। ধীরে ধীরে মাথা দুলিয়ে বললো,
—“তুমি বাবাকে বকবে কেন?”
—“তোর বাবা পঁচা যে! খালি আমাকে কষ্ট দেয়!”
সুজান কথাটা বিশ্বাস করলো না। তার দৃঢ় ধারণা মেহরিনের শুধুশুধুই মাহমুদকে বকবে। এতদিকে সে খানিকটা হলেও বুঝে গেছে তার মায়ের মেজাজ একটু গরম। জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে বললো,
—“কি করেছে বাবা?”
—“তোর বাবা তোকে আমার কাছ থেকে দূরে নিয়ে যেতে চাইছে।”
ওয়াশরুমের দরজা খোলার আওয়াজ পেয়ে মেহরিন আবারো ফিসফিস করে বললো,
—“আমি যাই। তুই কিন্তু একদম ভয় পাবি না।”
মাহমুদ ওয়াশরুম থেকে বেরোনোর আগেই বেডরুম থেকে দ্রুত ড্রয়িংরুমে চলে এলো মেহরিন। মাহমুদ তোয়ালে দিয়ে মাথা মুছতে মুছতে ওয়াশরুম থেকে বেরলো। ছেলের দিকে চোখ পড়তেই হাসিমুখে বললো,
—“কি হলো বাবা? তোমার মুড অফ কেন?”
তার বাবাকে মা শুধুশুধু বকবে এটা সুজানের সহ্য হলো না। দৌঁড়ে বাবার কাছে গিয়ে কানের সাথে মুখ লাগিয়ে ফিসফিস করে বললো,
—“বাবা, মা এসেছে। তোমাকে বকবে বলেছে।”
মাহমুদ অবাক হয়ে ছেলের মুখের দিকে তাকালো। সুজানের মুখ থমথমে। তার সিরিয়াস ভাব দেখে হেসে ফেললো মাহমুদ। সুজান অবশ্য হাসলো না। বরং বাবার হাসিতে বিরক্ত হয়েছে সে। মাহমুদ ছেলের মনোভাব বুঝতে পেরে বললো,
—“চলো তোমার মায়ের কাছে যাই।”
সুজানকে কোলে নিয়েই ড্রয়িংরুমে এসে ঢুকলো মাহমুদ। মেহরিন সোফায় বসে একটা ম্যাগাজিন নিয়ে ঘাটাঘাটি করছে। স্থির দৃষ্টিতে কিছুক্ষন তার দিকে চেয়ে রইলো মাহমুদ। বড় নিশ্বাস বেরিয়ে এলো বুক চিরে। গলা খাঁকারি দিলো। তার উপস্থিতি টের পেয়ে সোজা হয়ে বসলো মেহরিন। মুখের হাসির রেখা টেনে জিজ্ঞেস করলো,
—“কখন এলে?”
মেহরিন ঝগড়ার প্রস্তুতি নিয়ে রেডি হয়ে ছিলো। মাহমুদ কিছু বললেই ঝাপিয়ে পড়বে তার ওপর। কিন্তু অকস্মাৎ বাপ ছেলের হাসি হাসি মুখ থেকে নিমিষেই সব রাগ পানি হয়ে গেলো।
—“হয়েছে দশমিনিটের মত!”
মাহমুদ সুজানকে উদ্দেশ্য করে বললো,
—“মাকে তোমার ড্রয়িং দেখিয়েছো?”
—“না। এখনো শেষ হয় নি।”
—“ঠিক আছে তুমি ড্রয়িং শেষ করে এসো। বাবা তোমার মায়ের সাথে একটু কথা বলি কেমন?”
মেহরিন যেন এই সুযোগেই ছিলো। এবার আচ্ছামত ঝাড়া যাবে মাহমুদকে। সুজান ভেতরে চলে গেলে মেহরিনের মুখটা আবার আগের মত থমথমে হয়ে গেলো। মাহমুদ তার চেহারার পরিবর্তন লক্ষ্য করে বললো,
—“তোমাকে এমন দেখাচ্ছে কেন? কোন সমস্যা?”
শক্ত, রিনরিনে গলায় বললো,
—“হ্যাঁ। অনেক বড় সমস্যা!”
স্পষ্ট রাগ তার চোখেমুখে। প্রতিউত্তরে মাহমুদ বলল,
—“আমি কি কোনভাবে হেল্প করতে পারি!”
রাগে মেহরিনের গা জ্বলে যাচ্ছে। মাহমুদ এত নরমাল বিহেভ করছে কি করে? ঝগড়ার মুহূর্তে অপরপক্ষের নির্লিপ্ত মনোভাব বড়ই পীড়াদায়ক! কোন ভনিতা না করে সরাসরি কঠিন গলায় বললো,
—“আমি সুজানকে নিয়ে যেতে দেবো না।”
—“তার কারণ?”
—“সুজানের মায়ের প্রয়োজন!”
—“তবে কি আমাকে আবার বিয়ে করতে বলছো?”
ধক করে জ্বলে উঠলো মেহরিনের চোখজোড়া। রক্তবর্ণ হয়ে গেলো চেহারা। মাহমুদ তার সাথে ঠাট্টা করছে? কাঁটা কাঁটা গলায় বললো,
—“তা যদি বুঝেই থাকো। তাহলে এতদিন করো নি কেন?”
—“কি করে করবো বলো। এনার পর কাকে বিয়ে করতে হবে তা তো তুমি বলে যাও নি?”
মাহমুদের কন্ঠে খানিকটা ঠাট্টা, রাগ বিষন্নতা মিশ্রণ। মেহরিন ক্ষুব্ধ কন্ঠে বললো,
—“আমি বললে করতে?”
—“আগের বার তো করেছিলাম।”
মেহরিন অনেক কিছু বলতে পারতো। কিন্তু রাগে অভিমানে সব গুলিয়ে ফেললো। একটা শব্দও উচ্চারণ করতে পারলো না। চুপচাপ বসে রইলো।
— “তোমার কি আর কিছু বলার আছে?”
—“বললাম তো আমি সুজানকে নিয়ে যেতে দেবো না। সুজান আমার কাছে থাকবে!”
মাহমুদ চুপ করে রইলো। তার জবাবের অপেক্ষা না করেই মেহরিন হুড়মুড়িয়ে বেডরুমে ঢুকে সুজানকে কোলে নিয়ে বেরিয়ে এলো। তারপর সদর দরজা খুলে বেরোতে বেরোতে বললো,
—“সুজানকে আমি নিয়ে যাচ্ছি। তোমার যদি ক্ষমতা থাকে তো ঠেকাও।”
সুজান অবাক হয়ে চেয়ে আছে। কি ঘটছে না ঘটছে সে কিছুই বুঝতে পারছে না। মায়ের মুখের দিকে তাকালো। বাবার ওপর কি রেগে আছে? তাকে প্রতিবাদ করার কোন সুযোগ না দিয়ে কোলে নিয়ে বেরিয়ে গেলো মেহরিন। মাহমুদ কিছুক্ষন অবাক হয়ে চেয়ে রইলো তাদের যাওয়ার দিকে। পরোক্ষনেই একটা লম্বা দীর্ঘশ্বাস ফেলে সোফায় বসে পড়লো সে। মুখে মিটমিটে হাসি। পকেট থেকে ফোন বের করে সোহাগের নাম্বারে ডায়াল করলো।
★
খবর পেয়ে সোহাগ তাড়াহুড়ো করে চলে এসেছে। আবার কি ভেজাল লেগেছে কে জানে? হন্তদন্ত হয়ে ভেতরে ঢুকে দেখলো মাহমুদ সোফায় গা এলিয়ে দিয়ে চুপচাপ বসে আছে। সোহাগ আতঙ্কিত কন্ঠে বললো,
—“কি ব্যাপার মাহমুদ ভাই? কোন সমস্যা?”
মাহমুদ খুব স্বাভাবিক ধীরস্থির কন্ঠে জবাব দিলো,
—“মেহরিন এসেছিলো কিছুক্ষন আগে।”
—“তাই নাকি?…চলে গেছে?”
—“হুম। সুজানকে সাথে নিয়ে গেছে।”
সোহাগ পলকহীন ভাবে কিছুক্ষন চেয়ে রইলো মাহমুদের দিকে। তার চোখেমুখে বিস্ময়। তারপর আচমকাই হেসে ফেললো। মাহমুদও হাসছে। হাসিমুখেই বললো,
—“আজও সেই মাথামোটাই রয়ে গেলো। আমাকে একবার বললেই তো আমি ফ্লাইট ক্যান্সেল করে দিই। তা না করে, পাগল হয়ে সুজানকে নিয়ে বেরিয়ে গেলো।”
—“আপনি চলে যাবেন শুনে দিশেহারা হয়ে গেছিলো বোধহয়!”
মাহমুদের মুখে লেগে থাকা হাসিটা আরেকটু গাঢ় হলো। তার হাসিহাসি মুখটার দিকে চেয়ে সোহাগের ভীষণ ভালো লাগছে। বললো,
—“আমি কি একটা ফোন করবো?”
—“আমার মনে হয় না এখন তার সিগন্যাল পাওয়া যাবে। আমার ফ্লাইটের আগে সে আর দেখা দেবে না।”
—“তারমানে আবার উধাও?”
মাহমুদ একটু শব্দ করে হাসলো। বললো,
—“ইয়েস, উইথ মাই সান!”
—“সুজান গেলো?”
—“মুখ থেকে মনে হলো নার্ভাস! কিছু বুঝতে পারে নি বোধহয়! হতবম্ভ হয়ে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে ছিলো। মাকে বোধহয় একটু ভয় পায় !”
সোহাগ কৌতুকমিশ্রিত কন্ঠে মাথা নেড়ে বলল,
—“সি ইজ রিয়েলি ইম্পসিবল!
—“বাদ দাও। রায়হান সাহেবের কি খবর? নক আউট?”
—” ইয়েস!”
মাহমুদ চিন্তিত মুখে বললো,
—“কেন যে এমন পাগলামি করে মেহরিন!”
তারপর একসঙ্গেই হেসে ফেললো দুজন।
★
সোহাগ মেহরিনের সাথে তার দেখা হওয়ার ঘটনা রায়হানের কাছে যাওয়ার ঘটনা একে একে সব খুলে বললো মাহমুদকে। সবশুনে মাহমুদ শুধু হাসলো। আর মনে মনে কৃতজ্ঞতা জানালো রায়হানের প্রতি! হঠাৎ করেই অচেনা নম্বর থেকে সোহাগের নাম্বারে কল এলো। অবাক হয়ে মাহমুদের দিকে তাকাকেই ইশারায় তাকে স্পিকার অন করতে বললো মাহমুদ। তার কথামতই ফোন রিসিভ করে স্পিকার অন করে দিলো সোহাগ। সাথে সাথেই ওপাশ থেকে ভেসে এলো,
—“হ্যালো সোহাগ। আমি মেহরিন।”
সোহাগ কন্ঠস্বর যথাসম্ভব স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করলো। বলা যায় না টের পেলে মেহরিন হয়ত সোহাগের কাছে কিছু বলতে চাইবে না। কিংবা অন্য জায়গায় উধাও হয়ে যেতে পারে।
—“কি ব্যাপার হঠাৎ অচেনা নাম্বার থেকে ফোন করলে যে? কোন সমস্যা?”
—“তোমাকে পরে সব খুলে বলবো। আপাতত দারূণ একটা গুড নিউজ আছে!
—“তাই নাকি?”
—“ইয়েস। সুজান আমার কাছে। ওকে নিয়ে এসেছি। এবার দেখি অসভ্যটা কি করে ওকে নিয়ে দেশে ফিরে যায়?”
সোহাগ এবং মাহমুদ একে অপরের দিকে তাকিয়ে নিঃশব্দে হাসলো। মাহমুদ ইশারায় কথা চালিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দিলো। সোহাগ বললো,
—“তুমি কি বাসায়?”
—“মাথা খারাপ? পরশুর আগে আমি বাসার ফিরছি না।”
—“ঠিক আছে তোমরা কোথায় আছো? আমাকে বলো, আমি আসছি।”
—“আমি তোমাকে মেসেজ করে পাঠিয়ে দিচ্ছি!”
—“রাখছি তাহলে? সাবধানে থেকো।”
—“ওকে!”
ফোন রেখে আরেকদফা হাসলো সোহাগ আর মাহমুদ। মাহমুদ মাথা নাড়িয়ে হাসিহাসি গলায় বললো,
—“পাগল! আস্ত পাগল!
—“আমি ভাবছি আমার সঙ্গে আপনাকে দেখলে ওর রিয়েকশনটা কি হবে?”
—“তোমার অবস্থা যে খুব ভালো থাকবে তার নিশ্চয়তা দেওয়া যায় না।”
আবারো হাসির বন্যা বইয়ে দিলো দুজনে।তারপর একসঙ্গে মেহরিনের দেওয়া এড্রেস এর উদ্দেশ্যে বেরোলো।