#পূর্ণময়ীর_বিসর্জন
#পর্ব:১০
#মৌমি_দত্ত
সময়টা বিকেল ৪ টা। কিন্তু দেখলেই মনে হবে হয় ভোর হচ্ছে নাহয় গোধুলির আগমন হবে এমন সময়। শীতের এই অসময়ে বৃষ্টি হচ্ছে। আর পূর্ণ ছাদের মেঝেতে শুয়ে হু হু করে কাঁদছে। মোবাইলটা তার পাশেই মেঝেতে পানিতে ভিজে জবুথবু। চোখ বুজে বলে দেওয়া যায় এই মোবাইল আর কাজ করবে না কোনো ভাবেই। হিচকি তুলতে তুলতে পূর্ণ বলে উঠলো,
– আমি আর রায়ানের কাছে যাবো না। কখনো যাবো না।
ঘন্টাকয়েক আগে,
পূর্ণ চোখের জল মুছে রেডি হয়ে নিলো। অনুবিকা আর তার বান্ধবীদের সাথে বসেছিলো গাড়িতে বাইরে যাবার উদ্দেশ্যে। এরপরেই শুরু হয় জঘণ্য পরিকল্পনা অনুবিকার। অনুবিকার এক মেয়ে ফ্রেন্ড বলে উঠে,
– তোহ অনু, এই গ্যাঁয়ো মেয়েটা কে রে?
অনুবিকা হো হো করে হেসে উঠলো। ঔষধ ও কাউন্সেলিংয়ের প্রভাবে আস্তে আস্তে স্বাভাবিক হচ্ছে পূর্ণ৷ গ্যাঁয়ো অর্থ না বাংলা জানেনা বলে না বুঝলেও মানুষ হিসেবে অঙ্গভঙ্গি তো বুঝে। তাই ভ্রু কুঁচকে ফেললো পূর্ণ। অনুবিকা পূর্ণর দিকে তাচ্ছিল্য হেসে বললো,
– ও আমাদের আশ্রিতা। ওকে আমরা দয়া দেখিয়ে থাকতে দিয়েছি।
আশ্রিতা কথাটির অর্থ না বুঝলেও পরের লাইনের জন্য পূর্ণ চমকে তাকালো অনুবিকার দিকে। যদিও কোনো ভুল সে ধরতে পারলো না বাক্যটিতে। কিন্তু বাক্যটি খারাপ লাগলো তার। আসলেই কি আশ্রিতা? তাহলে রায়ান কেন ওভাবে আগলে রাখে? দয়া দেখিয়ে? পূর্ণ্র চোখ চুলকোচ্ছে। নিশ্চয় খারাপ লাগা গুলো জল হয়ে ঝড়ে পড়ে মুক্তি পেতে চায় চোখের আবরণ থেকে। তখনই অনুবিকার আরেকটা মেয়ে ফ্রেন্ড বলে উঠলো,
– আশ্রিতা এতো ভালো কাপড় দিস তোদের বাসায়? ছেড়া ফাকটা কাপড়ই যথেষ্ট এদের জন্য।
গাড়িতে সবাই হেসে উঠলো আবারও পূর্ণ ছাড়া। অনুবিকাকে আরেক ফ্রেন্ড বললো,
– এমন মেয়ে কে শপিংয়ে নিস নাকি? ইয়াক!
পূর্ণ এবার কেঁদে ফেললো। মনে মনে সে খুব করে চাইলো রায়ান এক্ষুনি কোনো যাদুবলে তার পাশে এসে তাকে বুকে চেপে নিক, লুকিয়ে ফেলুক যাবতীয় সমাজ ও মানুষ নামের জঞ্জাল গুলোর থেকে আড়ালে। কিন্তু অবুঝ হলেও পূর্ণ ঠিকই জানে রায়ান আসবে না। কেন আসবে না জেনেও তার মন খারাপ ক্রমশ গাঢ়ো হতে লাগলো। তখনই অনুবিকা হলে উঠলো উত্তরে,
– আরেহ! ঘরের কাজের লোকেদেরও তো একটা না একটা কাজ থাকে। পূর্ণ তো বেকার। তাই ভাবলাম ওকেই নিয়ে যাই শপিংয়ের ব্যাগ তুলতে।
পূর্ণ মৃদুস্বরে ” আপু ” বলে ডেকে উঠলো প্রতিবাদে। কিন্তু যথেষ্ট জোড়ালো না হওয়াতে কেও শুনলো না। সবাই হাসতে ব্যস্ত। তখনই অনুবিকা রাগে লাল হয়ে পূর্ণর গাল চেপে মাথা ঠেসে ধরলো সিটে পাশে বসেই।
– কি ভেবেছিস তুই? তোর এই ন্যাকামো আর নাটক দিয়ে আমার ভাইকে বশ করবি? কোথায় আমার ভাইয়া আর কোথায় তুই? কি যোগ্যতা আছে তোর আমার ভাইয়ের পাশে দাঁড়াবার। থার্ড ক্লাস মেয়ে, আর কয়দিন পড়ে থাকবি এখানে? চলে যেতে পারস না কোথাও?
অনুবিকা বলা শেষ করতে না করতেই অনুবিকার এক ফ্রেন্ড বলে উঠলো,
– এই মেয়ে, নিজেকে কি ভেবেছো? অমন একটা সুন্দর, যোগ্য পুরুষের জীবনে তোমার মতো অসুস্থ মেয়ে একটা আপদ, বোঝা আর বিরক্তি ছাড়া কিছুই না। সেখানে ঐ মানুষটাকে বেঁধে রাখার ইচ্ছা পোষণ করো কিভাবে মনে? জঘন্য।
আরেক ফ্রেন্ড বলে উঠলো,
– এই গাঁইয়াটাকে এক্ষুনি নামা গাড়ি থেকে। নাইলে আমি যাবো না আর।
অনুবিকার দিকে ভয় ভয় চোখে তাকালো পূর্ণ। সে যে রাস্তা ঘাট চিনে না তা জেনেও নিশ্চয় অনুবিকা তাকে ফেলে দেবে না মাঝ রাস্তায়। এই আশায় জল ঢেলে অনুবিকা পৈশাচিক হেসে গাড়ির দরজা খুলে ধাক্কা মেরে ফেলে দিলো পূর্ণকে। অনুবিকাদের গাড়ি অপেক্ষা না করেই চলে গেলো। কিছুদূর যাওয়ার পর অনুবিকা চিন্তিত মুখে বললো,
– এটা বাড়াবাড়ি হয়নি তো? মেয়েটা বাসায় যাবে কিভাবে? কিছুই তো চিনেনা। আর বাসায় না গেলে তো আমাকে জবাব্দিহি করতে হবে সবাইকে। ধ্যাত!
অনুবিকার এক ফ্রেন্ড অনুবিকার কাঁধে হাত রেখে বললো,
– চিন্তা নিস না। মেয়েটা অসুস্থ তা তো সবাই জানেই। বলবি হারিয়ে গেছে। তোর কথা না মেনে হাত ছেড়ে কোথাও চলে গেছে।
এমন একটা বাহানা পেয়ে কিছুটা হলেও শান্ত হলো অনুবিকা।
.
.
মাঝরাস্তা থেকে উঠে জামা ঝেড়ে নিলো পূর্ণ। নীরবেই গড়িয়ে পড়ছে তার মনের দুঃখ গুলো চোখের জল হয়ে। ঠোঁট ফুলিয়ে বারবার সে নাক টানছে কান্না বন্ধ করতে। কিন্তু দ্বিগুন হারে কান্না পাচ্ছে। হাতে থাকা ছোট্ট ব্যাগটা থেকে মোবাইল বের করলো সে। মোবাইলের কনট্যাক্টস এ ঢুকে আয়ন সাহেবের নাম্বার পেলো ” আব্বি ” নামে সেইভ করা। তাতেই কল করলো পূর্ণ। তিনবার রিং হবার পর রিসিভ করলে৷ আয়ান সাহেব।
– হ্যাঁ বল পূর্ণ মা, কোথায় তুই?
পূর্ণ কাঁদো কাঁদো স্বরে বললো,
– আব্বু, আমি হারিয়ে গেছি।
নিজের কেবিনে বসে ফাইলস চেক করছিলেন আয়ান সাহেব। পূর্ণর এমন একটা কথা শুনে তিনি চমকে সিট ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন।
– কি বলছিস এসব মা? কিভাবে হারিয়ে গেছিস? কোথায় তুই এখন? অনুবিকা আর রেহানা কোথায়?
পূর্ণ বললো,
– আমি জানিনা, আমি কিচ্ছু জানিনা। আমাকে এসে নিয়ে যাও আব্বু প্লিজ।
আয়ান সাহেব অস্থির হয়ে গেলেন। এই মেয়েটাও তার কলিজার এক অংশ অতি সাবধানে দখল করে ফেলেছে যে। তিনি দ্রুত গায়ে কোট চাপাতে চাপাতে এক হাতে মোবাইল কানে ধরে বললেন,
– মোবাইলের লোকেশনটা অন করে নে মা। আমি এক্ষুনি আসছি। বাপি দুই মিনিটে আসছি।
আয়ান সাহেব কলটা কেটে দ্রুত গাড়ির চাবি নিয়ে বের হয়ে পড়লেন। মোবাইলে দেখলেন শপিং মলে যাওয়ার সময় একটা জঙ্গলের শর্ট কাট রাস্তায় লোকেশন দেখাচ্ছে পূর্ণর। সেদিকেই গাড়ি ধাওয়া করলেন তিনি। কিন্তু কোনোমতেই বুঝে উঠতে পারছেন না মেয়েটা ওখআনে গেলো কিভাবে?
.
.
পূর্ণকে নিয়ে অসময়ে আয়ান সাহেবকে বাড়িতে ফিরতে দেখে অবাক হলেন রেহানা। সদর দরজা দিয়ে দু’জনকে ঢুকতে দেখে ছুটে গেলেন তিনি। কিন্তু অনুবিকাকে কোথাও দেখলেন না। তিনি অবাক হয়েই বললেন,
– এটা কেমন হলো? পূর্ণকে নিয়ে গেলো অনুবিকা। দিয়ে যাচ্ছো তুমি? অনু কোথায়? এই অসময়ে তুমি অফিসের বাইরে ওদের সাথে কি করছিলে?
আয়ান সাহেব এতোক্ষনে বুঝতে পারলেন পূর্ণ ওখানে পৌছালো কিভাবে। সারা রাস্তা পূর্ণকে তিনি অনেক প্রশ্ন করেছেন। পূর্ণ শুধু কেঁদেছে। কোনো উত্তর দেয়নি। আয়ান সাহেবের এখন রাগ হচ্ছে। তার মেয়ে হয়ে অনুবিকা এতোটা কেয়ারলেস কিভাবে হতে পারে। পূর্ণ এতোক্ষন ধরে তার সাথে নেই এটা কি তার এখনো অজানা?
চলবে….