#পূর্ণিমাতিথি
#লেখিকা-তাসনিম জাহান রিয়া
#পর্ব-১৫
আমি বাইরের দিকে অনিমেষ তাকিয়ে আছি। প্রথমে ভেবেছিলাম উনি আমাকে সরি বলছেন। আমি তো এমন কেউ না যে উনি আমাকে সরি বলবেন। আমি উনার জীবনের গুরুত্বপূর্ণ কেউ না তো। উনার তো আমার মন খারাপে কিছু যায় আসে না। আমার জীবনে আমার অবস্থান একটা আগাছার মতো। আগাছা যেমন মানুষ উপড়ে ফেলে, তেমনি একদিন উনিও আমাকে উনার জীবন থেকে ছুঁড়ে ফেলে দিবেন। কিন্তু আমি তো সেই সুযোগ দিব না। তার আগেই আমি উনার জীবন থেকে অনেক দুরে চলে যাব। এতোটাই দূরে যাব উনি আমাকে আর কখনো খোঁজে পাবেন নাহ।
সবাই হাসি ঠাট্টা করছে। কিন্তু আমি নিশ্চুপ।
রুনা আসুক তারপর আমি তোর হাসি বের করবো। আমি বলবো তুই অন্য মেয়েদের দিকে তাকিয়ে থাকিস। তাদের প্রশংসায় পঞ্চমুখ। মাঝে মাঝে চোখও মারিস।
ছিঃ রুদ্র। তোকে তো আমি ভালো ভাবতাম, আর তুই আমার সংসার ভাঙতে চাইছিস।
তোর ড্রামা অফ কর।
_____________
সবাই মিলে আজ অনেক ঘুরাঘুরি করলাম। একসাথে সবাই হাওয়াই মিঠাই খেলাম। উনি প্রথমে খেতে না চাইলেও ইলান ভাইয়া জোড় করে মুখে ঢুকিয়ে দিয়েছেন। বর্তমানে আমি রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে আছি। গাড়িতে বসে থাকতে থাকতে বিরক্ত লাগছিল। রুদ্র আর ইলান ভাইয়া কী যেনো একটা জরুরি কাজে গিয়েছে। যাওয়ার আগে অবশ্য আমাকে গাড়িতে বসে থাকার কথা বলে গিয়েছিল। রিদি আপুরা নিজেদের বাসায় চলে গেছে।
হুট করেই কেউ একজন আমার হাত ধরে রাস্তার পাশ থেকে সরিয়ে নিলো। সাথে সাথেই তীব্র বেগে একটা গাড়ি আমার পাশ ঘেষে চলে গেলো। আচমকা এমন হওয়াতে আমি অনেকটাই ভয় পেয়ে গেলাম।
আর ইউ অকে?
পুরুষালি কন্ঠ কর্ণকুহর হতেই আমি মাথা তুলে থাকালাম। চোখের সামনে স্বল্প পরিচিত একটা মুখ। এই লোকটা আগের বারও আমাকে বাঁচিয়েছিল। এবারও আমাকে বাঁচালো। আমি মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানালাম। আমি ঠিক আছি।
ধন্যবাদ আপনাকে। আবারও আপনি আমার জীবন বাঁচালেন। আপনি আমার জীবন বাঁচিয়েছেন এর তুলনায় ধন্যবাদটা অতি সামান্য। আমি সারাজীবন আপনার কাছে কৃতজ্ঞ থাকবো।
কৃতজ্ঞ থাকার দরকার নেই এটা আমার কর্তব্য ছিল। চোখের সামনে একজনকে তো আর মরতে দেখতে পারি না। আমার জায়গায় আপনি হলেও হয়তো এই একই কাজ করতেন। বাই দা ওয়ে দুই দুবার দেখা হলো কিন্তু আপনার নামটা জানা হলো না। আমি ইফাদ আপনি?
আমি রিয়া।
নাইস নেইম।
ধন্যবাদ।
আচ্ছা তাহলে আমি আসি, আর একটু সাবধানে চলাফেরা করবেন। আই থিংক আপনাকে কেউ মারার চেষ্টা করেছিল। আপনাকে বাঁচানোর জন্য তো সবসময় আর আমি থাকবো না।
উনি আমাকে বাই বলে চলে গেলেন। আমিও সৌজন্য মূলক হাসি দিয়ে বাই বললাম। কিন্তু আমার মাথায় ঘুরছে অন্য চিন্তা। কে আমাকে মারতে চাইছিল? এটা পরিষ্কার কেউ একজন আমাকে মারতে চাইছিল। কারণ আমি মেইন রোড থেকে বেশ খানিকটা দূরে দাঁড়িয়ে ছিলাম। কেউ একজন ইচ্ছাকৃত ভাবে আমাকে গাড়ি চাপা দিতে চাইছিল। কিন্তু কে?
আমি গিয়ে আবার গাড়িতে ওঠে বসলাম। একটু পর উনিও আসলেন। সিটবেল্ট বাধতে বাধতে উনি বলেন,
বাহ আজকে এতো শান্ত শিষ্ট। এমনিতে তো তোমাকে ধমকিয়ে এক জায়গায় বসিয়ে রাখা যায় না। আর আজকে নিজে থেকেই এতক্ষণ ধরে শান্তভাবে গাড়িতে বসে আছো।
আমি উনার কথার কোনো প্রতিত্তর করলাম না। উনি গাড়ি স্টার্ট দিতে দিতে বলেন,
তখনকার জন্য রেগে আছো? বকাটা তোমার প্রাপ্য ছিল। এর জন্য আমি তোমাকে সরি বলবো না। ভুলটা তোমার ছিল। জিজু তোমাকে না ধরলে এতক্ষণে তুমি হসপিটালে থাকতে।
আমি এবারও কিছু বললাম না। উনিও আর কিছু বললেন না। উনি চুপচাপ গাড়ি চালাচ্ছেন। আমি উনাকে তখনকার ঘটনাটাও বললাম না। বললেই বকাবকি শুরু করে দিবেন। তাই চুপ থাকাই ভালো। হুট করেই উনি আশ্চর্যজনক একটা প্রশ্ন করে বসেন,
ফুচকা খাবে তুমি?
মানে?
ঐ যে দেখো ফুচকা আর চটপটির দোকান। খাবে? মেয়েদের মন খারাপ থাকলেও নাকি ফুচকা দেখলে মন ভালো হয়ে যায়।
আমি একবার দোকানের দিকে তাকিয়ে মুখ ঘুরিয়ে নিলাম। ফুচকা কখনোই আমার প্রিয় খাবারের মাঝে ছিল না।
না খাব না। আপনি বাসায় চলুন।
সিরিয়াসলি তুমি মেয়ে হয়ে ফুচকাকে না বলছো।
মেয়ে হওয়ার পিছনে শর্ত জুড়ে দেওয়া হয়েছে। মেয়ে হলে ফুচকা খেতেই হবে। প্রিয় খাবারের মাঝে ফুচকা থাকতেই হবে। আমি ফুচকা এতো পছন্দ করি না। এখানের ফুচকাগুলো নোংরা পরিবেশে তৈরি করে। একজন খেয়ে যাওয়ার পর আরেক জনকে এই প্লেটেই দিচ্ছে। দেখুন প্লেটগুলো বার বার এক পানিতেই ধুয়ে দিচ্ছে।
তুমি মেয়ে তো? কলেজ লাইফে থাকতে দেখতাম কলেজ ছুটি হওয়ার পর মেয়েরা হামলে পড়তো ফুচকার দোকানের ওপর। অ….
কিছু একটা বলতে গিয়েও উনি থেমে গেলেন। কিন্তু আমি বুঝতে পারছি উনি অরির কথায় বলতে চেয়েছিলেন। উনার মনটাও খারাপ হয়ে গেছে। আমি হাসি মুখে বললাম,
আমি কোনো ট্রিট মিস করি না। আপনি আমাকে ফুচকা ট্রিট দিতে চেয়েছিলেন। যেহেতু আমি ফুচকা পছন্দ করি না। তাই আপনি আমাকে চকলেট ট্রিট দিবেন। না বলতে পারবেন নাহ। যান এখনি চকলেট নিয়ে আসুন।
উনি চলে গেলেন চকলেট নিয়ে আসতে।
_________________
এর মাঝে কেটে গেলো দুইদিন। বিহান আমার সাথে অনেক চেষ্টা করেছে কথা বলার জন্য। কিন্তু রুদ্রর জন্য সুযোগ পায়নি। বিহান হঠাৎ কেনো আমার সাথে দেখা করতে চাইছে। সেই কারণটা সবার কাছে অজানা হলেও আমি জানি।
আগামীকাল কোচিংয়ে পরিক্ষা। তাই পড়াশোনা নিয়ে প্রচুর ব্যস্ত। রুদ্র আমাকে একজন টিউটরের মতো গাইড করছে। পড়া না বুঝলে বুঝিয়ে দিচ্ছেন। নোটস করে দিচ্ছেন। যাতে আমার সময় নষ্ট না হয়। যখন যা লাগে সব এনে দিচ্ছেন। এক কথায় উনি উনার দায়িত্ব পালনে কোনো রূপ ত্রুটি রাখছেন নাহ।
নিজেকে একজনের দায়িত্ব মনে হতেই হাসি পায়। সত্যিই আমি উনার কাছে দায়িত্ব ছাড়া আর কিছুই না। এসব ভাবনা চিন্তার মাঝেই চুলে টান পড়লো। আমি চোখ মুখ কুঁচকে সামনে তাকাতেই রুদ্রকে দেখতে পেলাম। উনি কিছুক্ষণ আগেই হসপিটাল থেকে এসেছেন। হসপিটাল থেকে এসেই শাওয়ার নিয়েছেন। এখনো চুল থেকে টুপ টাপ পানি পড়ছে। শাওয়ার নেওয়ার পর উনাকে অনেক স্নিগ্ধ লাগছে।
একে তো আমার আদেশ অমান্য করে বিছানায় পড়তে বসেছো। এখন আবার পড়াশোনা বাদ দিয়ে স্বপ্ন দেখতে ব্যস্ত হয়ে গেছো।
উনার কর্কশ গলা শুনে ঘোর কেটে গেলো। এই লোকটা অলয়েজ তেতো তেতো কথা বলে। জন্মের পর থেকে মনে হয় শুধু করলাই খেয়েছে।
বইটা দাও দেখি। এতক্ষণে কী পড়ছো? শুধু স্বপ্নই দেখেছ নাকি ফাঁকে ফাঁকে একটু পড়াশোনাও করছো।
মাথায় হাত দিয়ে আমি উনার দিকে চোখ মুখ কুঁচকে তাকাই। বেয়াদব লোক এতো জুড়ে চুল টান দিয়েছে যে এখনো ব্যথা পাচ্ছি।
______________
পরীক্ষার দিন আমার এতো টেনশন হয় কি বলবো। টেনশনে পড়ায় ভুলে যায়, আর প্রশ্ন কমন পড়লে এক্সাইটমেন্টে লিখতে ভুলে যায় বা কোনটা রেখে কোনটা দিব সেটাই ডিসাইড করতে পারি না।
আজকে সকাল থেকেই প্রচুর টেনশন করছি। টেনশনে রাতে ভালো করে ঘুমাতে পারি নাই।
এতো টেনশন করো না। তোমার প্রিপারেশন অনেক ভালো। ইনশাল্লাহ পরীক্ষা ভালোই হবে।
গাড়িতে ওঠে বসলাম। কিন্তু কিছুতেই সিটবেল্ট লাগাতে পারছি না। নিজের হাতের ওপর আরেকটা হাতের ছোঁয়া পেয়ে চমকে পাশে তাকাতেই ঘটে গেলো অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা।
চলবে……