#পূর্ণিমাতিথি
#লেখিকা-তাসনিম জাহান রিয়া
#পর্ব-১৭
হাতে ঠান্ডা কিছুর স্পর্শ পেয়ে ধড়ফড়িয়ে ঘুম থেকে ওঠলাম। আমার সামনে রুদ্র বসে আছে। সন্তপণে আমার হাতে বার্ন ক্রিম লাগিয়ে দিচ্ছেন। আমি লাফিয়ে ওঠায় উনি বিরক্ত বোধ করলেন। মুখ থেকে ‘চ’ এর মতো শব্দ উচ্চারণ করলেন। ক্রিম লাগিয়ে উনি ওঠে দাঁড়ালেন। কাঠ কাঠ গলায় বলেন,
আমার ওপর রাগ করছো ভালো কথা। তাহলে সেই রাগ নিজের ওপর কেনো দেখাচ্ছো? নেক্সট টাইম এমন করলে এর ফল ভালো হবে না।
আমি উনার কথার প্রত্যুত্তর করলাম না। আমি নিঃশব্দে শুয়ে পড়লাম। উনিও আমার কাছ থেকে উত্তরের আশা করলেন নাহ। ধুপধাপ পা ফেলে ওয়াশরুম থেকে চলে গেলেন। মিনিট দশেক পরে উনি ওয়াশরুম থেকে এসে আমার পাশে ধপ করে শুয়ে পড়লেন। আমি উনার দিকেও ফিরেও তাকালাম না। উনার দিকে পিঠ দিয়েই শুয়ে রইলাম। উনি তপ্ত শ্বাস ছেড়ে বললেন,
তুমি অনেক ভাগ্যবান। প্রিয়জন হারানোর ব্যথাটা এখনো অনুভব করোনি। প্রিয়জন হারানোর ব্যথাটা কতোটা ভয়ঙ্কর যে হারায় সেই-ই বুঝে। বুকের ভিতরটা জ্বলে পুড়ে যায়। শুধু দেহটাই অবহেলায় পড়ে থাকে প্রাণটা তো তার সাথেই চলে যায়।
আমি চমকে উনার দিকে তাকালাম। উনি দৃষ্টি উপরের দিকে। উনার কথা শুনেই বুঝা যাচ্ছে উনি অরি আপুকে কতোটা ভালোবাসতেন। বক্ষঃস্থলে চিন চিন ব্যথা হচ্ছে। উনার কথাটা আরেক বার আওড়ে নিলাম। হুট করে উনি প্রিয় জন হারানোর কথা কেনো বললেন? আমাকে হারানোর ভয় পান উনি? আমি কী সত্যিই উনার প্রিয়জন? মন বলে ওঠে, না তুই শুধুই উনার দায়িত্ব।
_________________
আজকে অনেক সকালে ঘুম থেকে ওঠেছি। গতকাল ভালো করে পড়া হয়নি। এখন সব পড়াগুলো ভালো করে পড়তে হবে।
তুমি কী এখন খাবা না?
না।
গতকাল রাতেও কিছু খাওনি। এখনো খাবে না। আমার আগেই বুঝা উচিত ছিল তোমার মতো ত্যাড়া মেয়ে সোজা ভাবে বললে কথা শুনবে না।
উনি আমাকেসহ চেয়ারটা নিজের দিকে ঘুরিয়ে নিলেন। আমি উনার দিকে ঘুরতেই উনি আমার মুখে ডিম ঢুকিয়ে দিলেন। আমি চোখ মুখ কুচকে ফেললাম। ডিমের কুসুম আমার বরাবরই অপ্রিয়। ডিমের সাদা অংশ আমার ভীষণ ভালো লাগে, ডিমের কুসুম খেলেই অস্বস্তি হয়। কেউ যদি আমার অপ্রিয় জিনিস আমাকে জোড় করে খাইয়ে দেয়। তাহলে সেগুলো তো পেটে যায়ই না বরং পেটের ভিতর থেকে সবকিছু উগ্রে আসে।
আজও তার ব্যতিক্রম হলো না। আমি হাত দিয়ে মুখে চেপে ধরে দৌড়ে ওয়াশরুমে চলে এলাম। গড়গড় করে বমি করে দিলাম। উনিও আমার পিছন পিছন আসলেন। উনি এসে আমাকে পিছন থেকে ধরলেন। আমি ক্লান্ত হয়ে নিজের সমস্ত ভার উনার ওপর ছেড়ে দিলাম। হঠাৎই মামুনি রুমে আসে। আমাকে বমি করতে দেখে মামুনি অস্থির হয়ে বলেন,
এই রুদ্র কী হয়েছে রিয়ার? এভাবে বমি কেনো করছে?
কী বলবো তোমাকে? এই মেয়েকে নিয়ে পারছি না। না খেয়ে খেয়ে দিন দিন অসুস্থ হয়ে পড়ছে। দুই দিন আগে বললো মাথা কেমন ঘুরছে। আর আজকে একটু ডিম খেতে না খেতেই বমি করে ওয়াশরুম ভাসিয়ে দিল। কোনদিন না জানি রাস্তা-ঘাটে অঙ্গান হয়ে পড়ে থাকে। এই মেয়েকে নিয়ে টেনশন করতে করতে নিশ্চিত আমি একদিন হার্ট এ্যাটাক করবো।
উনি আমাকে ধরতে নিয়ে এসে বিছানায় শুইয়ে দিলেন। অদ্ভুত ব্যাপার আমি মামুনির চোখে মুখে চিন্তার চাপের পরিবর্তে খুশির ঝিলিক দেখতে পাচ্ছি। যে ব্যক্তি আমি একটু ব্যথা পেলেই টেনশন করে প্রেসার হাই করে ফেলে। আজকে এতকিছু শোনার পরও খুশি হচ্ছে।
বমি করা মাথা ঘুরানো এসব তো প্রেগনন্সির লক্ষণ। এতো তাড়াতাড়ি তোরা যে বাচ্চা নিয়ে নিবি সেটা আমার কল্পনারও বাইরে ছিল। রুদ্র তুই তো আর অবুঝ না রিয়া বাচ্চা একটা মেয়ে। মেডিকেলে ভর্তি হওয়া, পড়াশোনা সবকিছুই এখনো বাকি। রুদ্র তুই এমন কেয়ারলেসের মতো কাজ করলি। যাই হোক আমি ভীষণ খুশি।
মামুনির কথা শুনে আমি চমকে ওঠলাম। মামুনি এসব কী বলছে? কিছুই মাথায় ঢুকছে না। এর মাঝেই ঘটে ইলান ভাইয়ের আগমন। উনি এসেই সোফায় আয়েশ ভঙ্গিতে সোফায় গা এলিয়ে দিলেন।
তোমার এতো খুশির কারণ কী আন্টি?
দারুণ খুশির খবর ইলান। আমাদের বাসায় নতুন অতিথি আসতে চলেছে।
ইলান ভাইয়া ভ্রু কুচকে প্রশ্ন করে, মানে?
রিয়া প্রেগনেন্ট। রিয়া মা হতে চলেছে। আমি দাদি হতে চলেছি।
মামুনির কথা শেষ হওয়ার আগেই ইলান ভাইয়া এক লাফে সোফা ছেড়ে বিছানায় চলে এলেন। আমি হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে আছি। আমি প্রেগনেন্ট আর আমিই জানি না। ইলান ভাইয়া রুদ্র পাশে বসে রুদ্রকে আলতো ধাক্কা দিয়ে বলে,
তুই তো আমার থেকেও ফাস্ট। আমি বিয়ে করলাম এতোদিন হয়ে গেলো এখনো বাবা হতে পারলাম না। আর তুই আমার পরে বিয়ে করে আমার আগে বাবা হয়ে যাচ্ছিস। সেদিন তো খুব আমাকে বলছিলি, আর আজ…
স্টপ ইলান।
ইলান কেনো থামবে। কোনো থামা থামি নেই। আজকে এতো বড় একটা খুশির খবর বাড়িতে এসেছে। আজকে আমাদের আনন্দের দিন। আমি তোর বাবাকে, তোর খালামনিকে, রিদিদের সবাইকে জানিয়ে আসি। আমার কতো কাজ। আমি দাদি হতে যাচ্ছি। বেবির জন্য শপিং করতে হবে কাথা শেলাই করতে হবে। তার আগে আজকে বাসায় একটা পার্টির আয়োজন করতে হবে। ইলান আমার সাথে আয়। আজকে তোর ওপর অনেক দায়িত্ব। প্রথম বার চাচ্চু হতে যাচ্ছিস।
উনি অসহায় মুখ করে মামুনির দিকে তাকিয়ে আছেন। উনার অসহায় মুখটা দেখলেই আমার হাসি পাচ্ছে। মামুনি কথাগুলো বলে চলে যেতে নিলেই রুদ্র ডাক শুনে থেমে যায়।
স্টপ আম্মু।
কী হয়ছে?
তুমি এতো ফাস্ট না দৌড়ে একটু স্লো হাঁটো। তুমি যা ভাবছো তেমন কিছুই না। রিয়া কোনো প্রেগনেন্ট টেগনেন্ট না। আমি ও ভুলে গিয়েছিলাম রিয়া ডিমের কুসুম খেতে পারে না। আমি জোড় করে খাইয়ে দেওয়ায় বমি করে দিয়েছে। ঠিক মতো খাওয়া দাওয়া না করলে তো মাথা ঘুরবেই। আমি বলছি একটা তুমি বুঝছো আরেকটা। এজন্যই মানুষ বলে মেয়েরা ‘ক’ বলতেই কলকাতা বুঝে।
মামুনি কপাল চাপড়াতে চাপড়াতে চলে গেলেন। ইলান ভাইয়া বিছানা থেকে ওঠতে ওঠতে বললেন,
আমার আগেই বোঝা উচিত ছিল তোর মতো নিরামিষকে দিয়ে কিচ্ছু হবে না রোমান্সও না।
ইলান ভাইয়া একটা তপ্ত শ্বাস ছেড়ে চলে গেলেন। ইলান ভাইয়া চলে যেতেই আমি শব্দ করে হেসে ফেললাম। অনেক উনি বিরক্ত হয়ে বলেন,
হাসছো কেনো?
আমার ইচ্ছা আপনার কী?
আমারই তো সবকিছু। তোমার জন্য আমাকে কেমন একটা পরিস্থিতি পড়তে হলো।
আমি উনার দিকে তাকিয়ে একটা ভেংচি দিই।
____________
আজকে দুই দিন পর কোচিংয়ে আসলাম। আজকে কোচিংয়ে অনেক সকালে আসছি। দুই দিন ধরে কোচিংয়ে আসি না। ত্রয়ীর কাছ থেকে নোট নেওয়ার জন্যই আগে আসা। দুই দিন মামুনির জন্যই কোচিংয়ে আসতে পারিনি। মামুনির ভাষ্যমতে আমি ভীষণ অসুস্থ। তাই এখানে বাসা থেকে বের হওয়া যাবে না।
ত্রয়ী আর আমি দুজন দুজনেই সাথে কথা বলতে বলতে গেইটের দিকে এগিয়ে আসলাম। কোচিং থেকে বের হতেই ত্রয়ী আমার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে যায়। আমি এসে কোচিংয়ের সামনে দাঁড়াই। উনি সাফ সাফ বলে দিয়েছেন, নেক্সট টাইম একা একা আসার ভুলটা করলে আমার খবর আছে। আমাকে কোচিংয়ের সামনে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকতে বলেছেন।
হুট করেই পিছন থেকে কেউ আমার মাথায় স্বজুড়ে আঘাত করে। আঘাত এতোটাই তীব্র ছিল যে মুহুর্তেই মাঝেই চোখের সামনে সবকিছু অন্ধকার হয়ে আসলো। আমি মাথায় হাত দিয়েই ঢলে পড়ে যায়ে নিচে।
চলবে…..