পূর্ণিমাতিথি পর্ব-২৩

0
2660

#পূর্ণিমাতিথি
#লেখিকা-তাসনিম জাহান রিয়া
#পর্ব-২৩

আমি রুনার মুখের দিতে তাকাতে পারছি না। রুনার দিকে তাকালেই অপরাধবোধে তাড়া করে। ও যখন বলেছিল ইলানকে ফিরিয়ে আনার কথা নিজেকে তখন অক্ষম মনে হচ্ছিল। আমার তো সাধ্য নেই ইলানকে ফিরিয়ে আনার। আমি ওর সামনে দাঁড়াতে পারছিলাম না। অসহ্যকর এক অনুভূতি তাড়া করছিল ইচ্ছে করছিল নিজেকে শেষ করে দেই। দুজন কতো খুশি ছিল বাবা-মা হবে বলে। একটা এক্সিডেন্ট জীবন থেকে সকল সুখ, আনন্দ কেড়ে নিল। ও কতোটা খুশি ছিল। এখনি বাচ্চার জন্য শপিংয়ের প্লেন করে নিয়েছিল।

আমি ইলানের মৃত্যুটা মেনে নিতে পারছি না। সেখানে রুনা কীভাবে মেনে নিবে? এই সময় রুনার হাসিখুসি থাকা দরকার। কিন্তু ইলান চলে গিয়ে যে রুনার সারাজীবনের সাথী করে দিল দুঃখকে। ওর মুখের হাসি চিরতরে মুছে গেলো। ওদের সম্পর্কটা আমার চোখের সামনে গড়ে ওঠেছিল। দুজন দুজনকে কতোটা ভালোবাসতো। হাই স্কুল লাইফ থেকে ওদের ভালোবাসাটা। রাগারাগি হয়েছে, ঝগড়া হয়েছে। কিন্তু কেউ কাউকে কোনোদিন ছেড়ে যায়নি। ইলানের একটু কিছু হলেই রুনা পাগলের মতো বিহেইভ করতো। রুনাকে একেবারে একা করে দিয়ে ইলান চলে গেলো। ওদের দুজনের ভালোবাসা দেখে সবাই হিংসে করতো। স্কুল লাইফ, কলেজ লাইফ সব জায়গায় ওরা বেস্ট কাপল ছিল। ইলানের অনাগত সন্তান যে বাবা হারা হয়ে গেলো। পৃথিবীতে আসার আগেই এতিম হয়ে গেলো। বাবার আদর ভালোবাসা পাবে না।

______________

সকালের সূর্যের আলো চোখে পড়তেই ঘুমটা ভেঙে গেলো। হাত দিয়ে রোদ আটকানোর বৃথা চেষ্টা করলাম কিছুক্ষণ। আড়মোড় ভেঙে সোজা হয়ে বসলাম। রাতে রুদ্রের হালকা জ্বর এসেছিল। আমি উনাকে ধরে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে মেডিসিন খাইয়ে দিয়েছিলাম। রুমের লাইট অফ করে দিয়ে বেলকনির লাইট জ্বালিয়ে পড়তে বসেছিলাম। পড়তে পড়তে বেলকনিতেই ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।

সূর্যের আলোর প্রখরতা জানান দিচ্ছে বেশ বেলা হয়ে গেছে। আমি ঝটপট চেয়ার ছেড়ে ওঠে পড়লাম। রুমে আসতেই নজর পড়ে বিছানার দিকে। বিছানার ওপরে হাত পা ছড়িয়ে শুয়ে আছে রুদ্র। আমি দ্রুত ওয়াশরুমে চলে গেলাম ফ্রেশ হওয়ার জন্য। ফ্রেশ হয়ে রেডি হয়ে নিলাম। উনি এখনো ঘুমাচ্ছেন। আমি আর উনাকে ডাক দিলাম না। খাওয়ার জন্য নিচে চলে এলাম। ব্রেকফাস্ট শেষ করে চেয়ার ছেড়ে ওঠে দাঁড়াতে কারো বুকের সাথে গিয়ে মাথা ঠেকে। মুখ তুলে দেখি রুদ্র।

উনি একেবারে ফ্রেশ হয়ে ড্রেস চেইন্জ করে নিচে আসছেন। স্বাভাবিক ভাবেই আমাকে উদ্দেশ্য করে বলে,

চলো।

চলো মানে কী? কোথায় যাব?

কোচিংয়ে যাবা না?

আমি নাহয় কোচিংয়ে যাব আপনি কোথায় যাবেন?

তুমি একা যেতে চাইছো নাকি? এটা কল্পনাও করো না। আমি তোমাকে আমি একা কিছুতেই ছাড়ব না।

আপনি সব সময় নিজের মতামত আমার ওপর চাপিয়ে দেন। আপনার সব কথা আমাকে শুনতে বাধ্য করান। কিন্তু আপনি আমার একটা কথাও শুনেন না। আজকে আপনাকে আমার কথা শুনতেই হবে। আপনি এখন কোথাও যাবেন না। আপনি অসুস্থ। এখন ব্রেকফাস্ট করে মেডিসিন নিয়ে রেস্ট নিবেন।

একদম না। তোমাকে আমিই দিয়ে আসবো। তোমাকে আমি একা এই বাসার বাইরে এক পাও রাখতে দিব না। জেদ করবা না একদম। তোমাকে আমি কিছুতেই একা ছাড়ব না। একজনকে হারিয়েছি আমি আরেকজনকে হারাতে পারবো না।

লাস্টের কথাগুলো উনি বিড়বিড় করে বলতে বলতে চলে গেলেন। উনার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে আমি দীর্ঘশ্বাস ছাড়লাম। উনি যে আমার কথা শুনবেন না সেটা আমার আগেই বুঝা উচিত ছিল উনাকে উনার ডিসিশন থেকে সরানো আর ঘোড়ার ডিম দেখা এক বিষয়। আমার বুঝা হয়ে গেছে উনি আমাকে একা ছাড়বেন না। অগ্যতা উনার পিছু পিছু আসলাম।

________________

কোচিংয়ের সামনে উনি গাড়ি দাঁড় করিয়ে আমার হাত চেপে ধরে বলেন,

আমি তোমার কথা শুনবো। এখান থেকে গিয়ে ব্রেকফাস্ট করে মেডিসিন নিয়ে রেস্ট নিব। তুমি প্লিজ একা একা কোথাও যেয়ো না। কোচিং শেষে তুমি একদম বাইরে বের হবা না। আমি এসে তোমাকে নিয়ে যাব। তুমি আমার কথা শুনবা না?

আমি মাথা নেড়ে সম্মতি জানাই যে আমি উনার কথা শুনবো। আমি গাড়ি থেকে নেমে পড়লাম। আমি যতক্ষণ না কোচিংয়ে ঢুকলাম ততক্ষণ উনি দাঁড়িয়ে ছিলেন।

_____________

কোচিং শেষ উনি আমাকে নিয়ে ইলান ভাইয়াদের বাসায় এসেছেন। দুই দিন ধরে রুনা আপু কারো সাথে একটা কথাও বলেননি। টু শব্দও করেননি। সারাদিন মূর্তির মতো বসে থাকেন। আমি উনার সামনে বসে বকবক করেই যাচ্ছি কিন্তু উনি ইলান ভাইয়ার ছবির দিকে তাকিয়ে আছেন। রুদ্র ইলান ভাইয়ার আম্মুকে বলেন,

আন্টি আমি তোমাদের এখানে একা থাকতে দিব না। আজকেই তোমাদের দুজনকে আমাদের বাসায় নিয়ে যাব।

আন্টি মলিন গলায় বলে, এটা হয় না রুদ্র। আমি তোর সাথে যেতে পারবো না।

কেনো হয় না আন্টি? তুমি না বলো আমি তোমার আরেক ছেলে। তাহলে আমার সাথে যেতে তোমার কী অসুবিধা?

এই বাসা ছেড়ে আমি কোথাও যেতে পারবো না।

হঠাৎ করে বাসায় পুলিশ আসায় রুনা আপু একটু ভয় পেয়ে যান। ভয়ে আমার হাতটা জুড়ে চেপে ধরেন।

পুলিশ এসেই বলে, বাহ মিস্টার রুদ্র ভালোই তো এক্টিং করতে পারেন। মিস্টার ইলানকে হত্যা করে এখন তারই পরিবারকে দয়া দেখাতে আসছেন।

রুদ্র অবাক হয়ে বলে, আপনি এসব কী বলছেন? আমি ইলানকে মেরে ফেলছি?

আমাদের তো তাই ধারণা। মিস্টার ইলান শেষ বারের মতো আপনাকে ফোন করেছিল। আপনি যদি মিস্টার ইলানকে খুন না করতেন তাহলে এক্সিডেন্টের পর পরই এক্সিডেন্ট স্পটে পৌছালেন কী করে?

রুদ্র চুপ চাপ দাঁড়িয়ে আছে। হয়তো কিছু বলার মতো ভাষা খুঁজে পাচ্ছে না। ইলান ভাইয়ার মৃত্যুর জন্য উনাকে দায়ী করা হবে সেটা হয়তো উনি কল্পনাও করতে পারেননি। উনি ধপ করে ফ্লোরে বসে পড়েন। এর মাঝে বাসার উপস্থিত অন্যরা কানা ঘুষা শুরু করে দিয়েছেন। অনেকে অনেক কথা বলছেন। অনেকই বলছে রুদ্রই খুন করেছে। তাই তো এতো নাটক করে কান্না-কাটি করেছে।

আপনি যদি খুন করে না থাকেন তবে এমন করছেন কেনো? আমরা তো এটাও জানতে পেরেছি আপনি এক্সিডেন্টের দুই দিন আগে মিস্টার ইলানকে হত্যার হুমকি দিয়েছিলেন।
ইলান সাহেবের এক্সিডেন্টের পরে আপনি কর্পূরের মতো উদাও হয়ে গেলেন। দুই দিন আপনার কোনো খোঁজ খবর নেই।

রুদ্র চুপ করে থাকলেও রুনা আপু চুপ করে থাকতে পারলেন না। আজ দুই দিন পর রুনা আপু মুখ খুললেন। উনার হয়ে প্রতিবাদ করার জন্য রুনা আপু কথা বললেন। রুনা আপু চিৎকার করে বলেন,

আপনারা কী মানুষ? আপনাদের মাঝে কী কোনো মনুষ্যত্ব নেই? আপনারা নিজের চোখেই দেখেছিলেন রুদ্রের অবস্থা। সেদিন রুদ্রকে শান্ত্বনা দিচ্ছিলেন আর আজকেই রং রং বদল করে ফেলেছেন। আপনারা তো গিরগিটির থেকেও বেশি রং পাল্টান। আপনাদের মতো আত্নীয়দের কোনো দরকার নেই। বেরিয়ে যান এই বাসা থেকে।

রুনা আপু একটা লম্বা শ্বাস নিয়ে পুলিশকে উদ্দেশ্য করে বলেন,

আপনার চাকরিটা কী ঘুষ দিয়ে পেয়েছিলেন? ফোনের লাস্ট কল দিয়ে আপনি বিচার করছেন খুনি কে? এখন যদি প্রমাণিত হয় রুদ্র নির্দোষ তখনি কী আমাকে খুনি বলবে? কারণ রুদ্রের আগে তো আমাকেই কল করেছিল ইলান। আপনি হয়তে ভাবতেও পারছেন না রুদ্র কতোটা ইলানকে ভালোবাসে। রুদ্র ইলানকে নিজের ভাইয়ের মতো দেখতো। আপনি তাকেই ইলানের খুনি প্রমাণ করতে চাইছেন।

চলবে…………

[আপনাদের কথায় আর আমি গল্পের প্লট চেইন্জ করবো না। অনেকেই বলছেন পাঠকদের কথার কি কোনো দাম নেই? এখন যদি আমি পাঠকদের কথায় ইলানকে ফিরিয়ে নিয়ে আসি। তখন আপনাদের মনে হবে আমি সিরিয়াল লেখছি। ]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here