পূর্ণিমাতিথি পর্ব-৪৬

0
2469

#পূর্ণিমাতিথি
#লেখিকা-তাসনিম জাহান রিয়া
#পর্ব-৪৬

উনি একটু থামলেন। উনার চোখে অভি চিকচিক করছে। উনি ঠোঁট কামড়ে ধরে অন্যদিকে তাকালেন। আমার বুকের ভিতর ঝড় বয়ে যাচ্ছে। মনের মাঝে একটাই প্রশ্ন জাগছে উনি কী এখনো অরি আপুকে নিজের জীবনে ফিরে পেতে চান? বুকটা কেঁপে ওঠলো। উনি জিহ্বা দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে নিয়ে আবার বলতে শুরু করলেন,

এভাবে কোচিং শেষ হলো। বিভিন্ন মেডিক্যালে ভর্তি পরীক্ষা দেই। ভর্তি পরীক্ষার রেজাল্টের জন্য যখন অপেক্ষা করতে থাকি। তৃষ্ণার্ত চোখ দুটো নিয়ে যখন মরিয়া হয়ে বসে ছিলাম এক্সামের ফলাফল জানার জন্য। ঠিক তখনি খবর পাই অরির বিয়ে ঠিক হয়েছে। আমাকে খবরটা দিয়েছিল অরির এক বান্ধবী। খবরটা বিশ্বাস না করলেও মনের মাঝে একটা ভয় কাজ করছিল। নিজেকে বার বার সান্ত্বনা দিচ্ছিলাম এটা বলে যে, অরি বান্ধবী আমাদের সম্পর্কে মেনে নিতে পারেনি। আমাদের দুজনকে আলাদা করতে চায়। কারণ অরির বান্ধবী আমাকে পছন্দ করতে। নিজেকে যতই সান্ত্বনা দেই অবাধ্য প্রেমিক মন কী আর তা মানতে চায়? প্রেমিকাকে হারানোর ভয় প্রতিটা প্রেমিকের বুক কাঁপে। নিজেকে সামলাতে ব্যর্থ হয়ে আমি অরিকে ফোন দেই। অরি অকপটে সব স্বীকার করে নেয় যে ওর বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে। এটা শোনার পর নিজেকে কেমন কেমন পাগল পাগল লাগছিল। আমি ওর সাথে একবার দেখা করতে চাই ও রাজিও হয়ে যায়। আমি উন্মাদের মতো ছুটে যাই। আব্বু পিছন থেকে বার বার ডেকে বলে আমার ঢাকা মেডিক্যালে চান্স হয়েছে। কিন্তু আমি তা কর্ণগোচর না করেই ছুটে যাই। অরিকে আমি অনেক বুঝায় ও বুঝতে নারাজ ছিল। ওর লাস্ট কথাগুলো এমন ছিল।

আবেগ দিয়ে জীবন চলে না। শুধু ভালোবাসা থাকলেই মানুষ সুখী হয় না। ভালোবাসা ধুয়ে তো আর আমি পানি খাব না। ভালোবাসা মানুষের সাথে কুড়েঁ ঘরেও শান্তি এসব যাস্ট লোক দেখানো কথা। আমি আবেগে ভেসে যাওয়ার মতো মেয়ে না। তুমি কবে না কবে ডক্টর হবে সেই আশায় তো আমি পথ চেয়ে বসে থাকতে পারবো না। আদৌও তুমি ডক্টর হবে কী না তারও তো কোনো নিশ্চয়তা নেই। যদিও ডক্টর হও। আমি যাকে বিয়ে করছি তার সমকক্ষ কোনো দিন হতে পারবে না। ও বিরাট বড় বিজন্যাসম্যান। বিয়ের পর আমাকে নিয়ে কানাডা চলে যাবে। আমি এই আরাম আয়েশের জীবন ছেড়ে তোমার সাথে টিপিক্যাল বাঙালি বউদের মতো সংসার করতে পারব না। যদি বলো তোমার কাছে ক্ষমা চাওয়ার কথা। সরি টু সে সেটা আমি কোনো দিনও চাইবো না। কেউ একজন বলেছিল, যদি ভালো থাকতো চাও তাহলে স্বার্থপর হয়ে যাও। ভালো থাকার জন্য একটু স্বার্থপর হওয়াই যায় কী বলো? একচুয়ালি আমি তোমার টাইপ না। পারলে নিজের টাইপ কাউকে খুঁজে নিও। আসি ভালো থেকো।

অরির কথা শুনে আমি বাকরুদ্ধ হয়ে গিয়েছিলাম। নির্বিকার তাকিয়ে ছিলাম ওর যাওয়ার দিকে। আস্তে আস্তে ও আমার দৃষ্টির অগোচরে চলে যায়। কিন্তু আমি ওকে কিছু বলতে পারি নাই। এই অরি আমার সেই চেনা অরি ছিল না। সম্পূর্ণ অচেনা অরি ছিল। ওর বিয়ের দিনও আমি ওদের বাড়ি গিয়েছিলাম। কিন্তু অরির বাবা আমাকে অরির সাথে দেখা করতে দেয়নি। আংকেল আমাদের সম্পর্কের কথা জানতেন। উনি আমাকে কথাও দিয়েছিলেন অরির সাথে আমার বিয়ে দিবেন। অরির বাবাও হয়তো অরির মতো স্বার্থপরই ছিল। তাই তো বড় লোক মেয়ের জামাই পেয়ে আমাকে দেওয়া কথা বেমালুম ভুলে গিয়েছিল। আমি আংকেলকে অনেক অনুরোধ করি। আমার কাকুতি মিনতি উনার কর্ণগোচর হয়নি। উনি আমাকে অপমান করে বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছিলেন। আমি একটা বার অরির সাথে দেখা করতে চেয়েছিলাম। অনেক কাকুতি মিনতি করেছিলাম। শুধু পায়ে পড়ায় বাকি ছিল। আমার চোখের সামনে দিয়েই অরি বধূ বেসে অন্য একটা ছেলের হাত ধরে চলে যায়। এরপর থেকে আমি প্রচণ্ড ডিপ্রেশড হয়ে পড়ি। নিজেকে ঘর বন্দি করে ফেলি। আগের আমিটা পুরো চেইন্জ হয়ে এই আমিটাই পরিণত হয়। প্রাণবন্ত ছেলেটা হুট করেই চুপ করে গেলো। চরম ডিপ্রেশনে ভুগছিলাম ঠিক তখনি আমার বন্ধুর মতো আমার পাশে দাঁড়িয়ে ছিল আমার মা। আম্মুর একটা কথা আমার আজও মনে পড়ে। আম্মু বলেছিল,

তুমি প্রতিষ্ঠত হও। মানুষের মতো মানুষ হও। যখন তোমাকে সবাই এক নামে চিনবে। তখন অরির মতো হাজারটা মেয়েসহ তার বাপ তোমার পিছনে লাইন লাগিয়ে দাঁড়িয়ে থাকবে।

কথাটা অনেকেই নেগেটিভ মাইন্ডে নিবে। ভাববে মেয়েদের এখানে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করা হচ্ছে। তা কিন্তু মোটেও না। মেয়েদের ক্ষেত্রেও সেইম। একটা মেয়ে যখন প্রতিষ্ঠিত হয় তখন ছেলেরা তো সেই মেয়েকে বিয়ে করতেই চায়, তার সাথে ছেলের বাবা-মা ও ঐ মেয়েটার পিছনে পড়ে নিজের ছেলের সাথে বিয়ে দিতে। আম্মুর কথার মর্ম সেদিন বুঝার ক্ষমতা আমার ছিল না কিন্তু আমি আজ বুঝি।

আপনি এই কথাগুলো আমাকে আগে কেনো বলেননি?

তোমাকে হারানোর ভয়ে। ভয় হতো যদি এসব শুনে তুমি আমাকে ছেড়ে চলে যাও।

আপনি তো অরি আপুকে অনেক ভালোবাসতেন। আজ যদি অরি আপু ফিরে আসে নিশ্চয়ই আপনি নিজের জীবন থেকে আমাকে ছুঁড়ে ফেলে দিবেন?

আমার কথা শুনে উনি আলতো হাসলেন। তবে কিছু বললেন না। ঠোঁট দিয়ে ঠোঁট চেপে ধরে বাইরের দিকে অনিমেষ তাকিয়ে রইলেন। অতঃপর আমার আমার দিকে তাকালেন। মৃদু কন্ঠে বলে ওঠলেন,

সেটা কখনোই সম্ভব না। অরি আর কখনোই ফিরে আসবে না। আজ থেকে দুই বছর আগে অরি মারা গেছে। মারা গেছে বললে ভুল হবে। ওকে খুন করা হয়েছিল। খুনটা তার হাজবেন্ডই করেছিল। কানাডা গিয়ে অরির হাজবেন্ডের থেকেও বড় বিজন্যাসম্যানের সাথে অরির পরিচয় হয়। অরি জড়িয়ে যায় পরকীয়া নামক অবৈধ রিলেশনে। এটা জানার পর অরির হাজবেন্ড মেনে নিতে পারেনি। অরির হাজবেন্ড অরিকে ভীষণ ভালোবাসতো। তাই উনি মেনে নিতে পারেননি তার স্ত্রী তাকে ছাড়া অন্য কাউকে ভালোবাসে। ঐ ভদ্রলোক তাই নিজের হাতে অরিকে খুন করে। এখন অবশ্য ঐ ভদ্রলোক মেন্টাল এ্যাসাইলামে আছেন। প্রকৃতপক্ষে অরি কাউকেই ভালোবাসেনি। অরি সবার টাকাকে ভালোবেসেছে। তিন তিনটা ছেলের জীবন নিয়ে খেললো। আর রইলো তোমাকে নিজের জীবন থেকে ছুঁড়ে ফেলে দেওয়ার কথা সেটা আমি কোনোদিনও পারবো না। কারণ তোমাকে নিজের জীবন থেকে ছুঁড়ে ফেলে দিতে হলে যে আমাকে নিজের শরীর থেকে যে নিজের আত্নাটা ছুঁড়ে ফেলে দিতে হবে।

আমার চাহনি নির্বিকার। এই লোকটা ভালোবাসি না বলেও কতো সুন্দর করে বুঝিয়ে দেন উনি আমাকে কতোটা ভালোবাসেন। আমি নিঃশব্দে ঐ স্থান ত্যাগ করলাম।

________________

দিনটা শুক্রবার। চারদিকে সূর্যের আলো ঝলমল করছে। আর মৃদু মন্দ বাতাস বইছে। সকাল সকালই মনটা ফুরফুরে হয়ে গেলো। আজকে আমি আর রুদ্র দুজনেই বাসায়। মাঝে আর একটা দিন বাকি রমজান মাস শুরু হওয়ার। ছোটবেলায় রমজান মাস নামটা শুনলেই কেমন যেনো একটা এক্সাইটমেন্ট কাজ করতো। রমজান মাসের পরই আসবে ঈদ। ঈদে নতুন জামা কিনবো। সবার কাছ থেকে সালামি নেওয়া। ঈদের আগের দিনে রাতে তো এক্সাইটমেন্টে আমার ঘুমই হতো না। কাজিনদের মাঝে প্রতিযোগিতা হতো ঈদের দিন সকালে কে সবার আগে ঘুম থেকে ওঠতে পারে তার। ছোটবেলার পাগলামিগুলো মনে পড়লে এখন হাসি পায়।

নিজের কোমড়ের দুই পাশে বলিষ্ঠ হাত জোড়ার স্পর্শ পেয়ে আমি কেঁপে ওঠলাম। নিঃশব্দের উনি আমাকে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে আমার কাধে থুতনি রাখলেন। উনার নিঃশ্বাস আমার কান, গাড় ছুঁয়ে যাচ্ছে। আমার নিশ্বাস দ্রুততর হয়ে আসছে। শরীর অসাড় হয়ে আসছে।

চলবে……..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here