#পূর্ণিমাতিথি
#লেখিকা-তাসনিম জাহান রিয়া
#পর্ব-৫০
হ্যালোসেলুশন হচ্ছে। রুদ্রর দুই বন্ধুর পিছনে অরি আপু ছিল না। কিন্তু আমি স্পষ্ট অরি আপুকে দেখেছিলাম। অরি আপুর ঠোঁটের কোণে ছিল আলতো হাসি। সবটাই হ্যালোসেলুশন। এরকম অদ্ভুত একটা কান্ড আমার সাথে ঘটছে।
মাথা যন্ত্রণায় এক সাইড ছিঁড়ে যাচ্ছে। কী অসহ্যকর অনুভূতি। চুল টেনে ধরে চোখ বন্ধ করে নিলাম। চোখ বন্ধ করতেই চোখের সামনে ভেসে ওঠলো অরি আপুর মুখটা। আমি ঝটফট চোখ খুলে ফেললাম। এসব কী হচ্ছে আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। এমন অদ্ভুত অনুভূতি কেনো হচ্ছে। সব জায়গায় অরি আপুকে দেখতে পাচ্ছি।
রুদ্র হাসতে হাসতে রুমে আসলো। আমার পায়ের কাছটায় উনি বসেন। আমার দিকে ভ্রু কুচকে তাকিয়ে বলেন, তুমি তখন এভাবে চলে এলে কেনো?
আমি উনার প্রশ্নের জবাব না দিয়ে বললাম, আপনি জানেন হাসলে আপনাকে কতোটা সুন্দর লাগে? কিন্তু আপনি তো হাসেন না। যেনো হাসলে আপনাকে টাকা দিতে হবে। আপনি কী জানেন আপনার হাসি মুখটা দেখার জন্য আমি চাতক পাখির ন্যায় অপেক্ষা করি?
এই তুমি এভাবে কথা বলছো কেনো? তোমার কী হয়েছে? শরীর খারাপ লাগছে? জ্বর আসছে নাকি?
আমি মাথা নাড়িয়ে না বললাম। মনে হল না উনি আমার কথা বিশ্বাস করেছেন।
আমাকে একদম মিথ্যা বলার চেষ্টা করবে না। তোমাকে দেখে আমার একদম ঠিক লাগছে না তোমার কী মাথা ব্যথা করছে?
উনার কথা শুনে আমি আলতো হাসলাম। উনার কাছ থেকে আমি কিছু লুকাতে পারি না। আমি মুখ ফুটে না বললেও উনি আমার সব সমস্যার কথা বুঝে যান। আমার মুখ দেখেই বুঝে যান আমার কী প্রয়োজন।
মেডিসিন খেয়োছো?
না।
তা খাবেন কেনো? আপনার তো মেডিসিন খাওয়ার প্রয়োজন নেই। আপনি তো এলিয়েন।
উনি রাগে গজগজ করতে করতে গিয়ে মেডিসিন নিয়ে আসলেন। পানির গ্লাসটা আমার হাতে ধরিয়ে দিলেন।
ম্যাডামের সব দিকেই খেয়াল আছে শুধু নিজের দিকেই খেয়াল নেই।
আমি আলতো হেসে বললাম, আমার খেয়াল রাখার জন্য আপনি আছেন তো।
যখন আমি থাকব না তখন কী করবেন?
আমি উনার ঠোঁটের ওপর আঙ্গুল রেখে চুপ করিয়ে দিলাম। হুশশশ। এমন কথা আর বলবেন না। আপনিহীনা আমি নিজেকে কল্পনা করতে পারি না। সেই দিন যেনো কখনো না আসে। আল্লাহ যেনো আপনার আগে আমার মৃত্যু দেন।
রাগে উনার চোখ মুখ লাল হয়ে গেছে। উনি পেইন কিলারটা আমার মুখে ঠুসে দিলেন। হাত থেকে টান দিয়ে গ্লাসটা নিয়ে নিলেন। গাল চেপে ধরে আমাকে পানি খাইয়ে দিলেন। আমি অবাক নয়নে উনার কার্যকলাপ দেখে যাচ্ছি। উনি হঠাৎ এতো রেগে গেলেন কেনো সেটা আমার বোধগম্য হচ্ছে না। পরক্ষণেই মনে পড়লো আমি একটু আগে মৃত্যুর কথা বলেছিলাম। এটার জন্যই কী উনি রেগে গেছেন? আমার ঠোঁটের কোণে প্রাপ্তির হাসি ফুটে ওঠলো।
উনি চলে যেতে নিলে আমি উনার হাত টেনে ধরে বিছানায় বসিয়ে দিলাম। উনি বিছানায় বসতেই আমি উনার বুকে মাথা রাখলাম। উনার হাতটা আমার মাথার ওপর রাখলাম।
একটু মাথায় হাত বুলিয়ে দিবেন। মাথা প্রচণ্ড ব্যথা করছে। দিন না একটু বিলি কেটে।
উনি এক হাতে আমাকে জড়িয়ে ধরে আরেক হাতে মাথায় বিলি কেটে দিচ্ছেন। আমি আবেশে উনাকে দুই হাতে জড়িয়ে ধরলাম। উনি কপালে পর পর তিনটা চুমু খেলেন। গালে আলতো করে ছুঁয়ে দিতে দিতে বলেন,
আমি নিজের অনুভূতি প্রকাশে বরাবরই ব্যর্থ। নিজের অনুভূতিগুলো আমি কখনোই গুছিয়ে অন্য কারো সামনে প্রকাশ করতে পারি না। তাই কেউ আমার অনুভূতি বুঝতেও পারে না। তুমিও আমার অনুভূতি বুঝতে ব্যর্থ। তোমার মুখ থেকে মৃত্যুর কথা শুনলে আমার বক্ষঃস্থলে চিন চিন ব্যথা হয়। মনে অদ্ভুত ভয়ের অনুভূতি হয়। আমি তোমাকে হারাতে পারবো না। তোমার থেকে একটুখানি দূরত্বও যে আমার সহ্য হয় না।
উনার কথাগুলো শুনে আমার বুকের ভিতরে মুচর দিয়ে ওঠে। আমি কী সত্যিই উনার অনুভূতি বুঝতে ব্যর্থ। উনাকে বুঝতে দিলাম না যে আমি সজাগ। এসব ভাবতে ভাবতেই এক সময় উনার বুকে মাথা রেখে ঘুমিয়ে গেলাম।
_________________
ঘুম থেকে ওঠে আর উনাকে পেলাম না। এলোমেলো চুলগুলো খোপা করতে করতে ওয়াশরুমে ঢুকে গেলাম। হাত মুখ ধুয়ে ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে এলাম। রিসেপশন উপলক্ষ্যে আমাদের এবং রুদ্রর অনেক রিলেটিভসই বাসায় এসেছে। তাই নিজেকে একটু ঠিক ঠাক করে রুম থেকে বের হলাম।
রুম থেকে বের হয়ে ড্রয়িংরুমে আসতেই কেউ একজন ফটাফট মুখে মিষ্টি ঢুকিয়ে দিল। মুখের মিষ্টিটুকু গিলে চোখ তুলে তাকাতে না তাকাতেই আরেকটা মিষ্টি ঢুকিয়ে দিল আমার সামনে থাকা ব্যক্তিটা। আমার সামনে হাসিমুখে দাঁড়িয়ে আছে ইলান ভাইয়া। আমাকে উনার দিকে চোখ বড় বড় করে তাকাতেই বলে ওঠলেন,
নিজের বিয়ের মিষ্টি খাও। তুমি বিয়ের কনে তুমি মিষ্টিমুখ না করলে তো মিষ্টিমুখের অনুষ্ঠানটাই ইনকম্পলিট থেকে যাবে।
ইলান ভাইয়ার কথা শুনে আমার গলায় মিষ্টি আটকে গেলো। আমি কাশতে কাশতে শুরু করলাম। ইলান ভাইয়ার আম্মু আমার দিকে দ্রুত এক গ্লাস পানি বাড়িয়ে দিলেন। পানি দিয়ে উনি আমার পিঠে হাত বুলিয়ে দিতে লাগলেন। আমার কাশি থামতেই আন্টি ইলান ভাইয়ার কান টেনে ধরেন।
তোর বাদরের মতো স্বভাব কোনো দিন যাবে না। না? এভাবে কেউ মিষ্টি খাওয়ায়? হুট হাট এভাবে কাউকে খাওয়াতে নেই জানিস না?
উফ আম্মু ছাড় তো। রিয়া তো অবাক হয়ে গিয়েছিল। তাই গলায় মিষ্টি আটকে গিয়েছিল। এখন তো রিয়ার অবাক হওয়ার দিন। রিয়া মিনিটে মিনিটে ঝটকা খাবে।
রুনা আপু সোফা বসেছিলেন। উনি চিৎকার দিয়ে বলে ওঠলেন, আম্মু জুড়ে টেনে ধরো কান। পারলে কান টেনে ছিঁড়ে ফেলো। এই গরিলাটা খাবার নিয়ে আমার ওপর কী অত্যাচারটায় না করে।
________________
পড়ার টেবিলে বসে কলম ঘুরাচ্ছি আর ভাবছি। এট লাস্ট নিজের মনস্থির করে ফেললাম। এখন থেকে আমিও উনার ছোট ছোট ইচ্ছেগুলো পুরণ করার চেষ্টা করবো। উনার ভালো লাগা খারাপ লাগা সব অনুভূতি বুঝার চেষ্টা করবো।
উনার ডায়েরীর ছিঁড়া এক অংশ পাতায় পড়েছিলাম। উনার প্রেয়সী লাল পাড়ের সাদা শাড়ি পড়ে এসে উনার সামনে দাঁড়াবে। হাতে থাকবে এক মুঠো লাল রঙের কাঁচের চুড়ি। এলোমেলো চুলে উনার সামনে এসে দাঁড়াবে। উনি নিজ হাতে খোপা করে দিয়ে খোপায় বেলি ফুলের মালা জড়িয়ে দিবে। উনি নিজ হাতে আলতা পড়িয়ে দিবেন। উনার প্রেয়সীর রক্তিম গাল জোড়ায় চুমু এঁকে দিবেন।
উনি কখনো উনার এই ইচ্ছেগুলো আমাকে বলেননি। কারণ উনি জানেন আমার শাড়ী পড়তে ভালো লাগে না। বিয়ের পর় থেকে তেমন একটা শাড়ী পড়া হয়নি। আলতা পড়তে আমার বেশ লাগে। উনি আমার প্রিয় অপ্রিয় জিনিসের এতো খেয়াল রাখেন আমারও উচিত উনার অনুভূতিগুলোর খেয়াল রাখা। উনার খুশির জন্য একদিন না হয় নিজের খারাপ লাগা সরিয়ে এক সাইডে রেখে দিলাম।
বাগান থেকে এক মুঠো বেলি ফুল নিয়ে এলাম। বেলি ফুলগুলো দিয়ে খুব সুন্দর করে মালা গেথে নিলাম। কাবার্ড থেকে লাল পাড়ের সাদা শাড়ী বের করে নিলাম। এই শাড়ীটা ত্রয়ী আমাকে গিফট করেছিল। উনার মনের মতো করে আজকে নিজেকে সজ্জিত করে নিলাম। এখন অপেক্ষা উনার আসার।
উনার আসার শব্দ শুনেই বেলকনিতে চলে এলাম। আমি জানি উনি ফ্রেশ হয়ে আমার খোঁজে এই বেলকনিতেই আসবেন। অল্প কিছুক্ষণ পরেই নিজের কাধে রুদ্রর ছোঁয়া পেলাম। হুট করে লজ্জায় আমায় ঘিরে ধরলো। লজ্জায় উনার দিকে তাকাতে পারছি না। লজ্জায় মাথা নিচু করে উনার দিকে ফিরলাম। উনার দিকে আলতা বাড়িয়ে দিলাম।
উনি আমাকে দেখে অবাক হয়েছেন ঠিকই। হয়তো বুঝতে পেরেছেন আমি উনার ডায়েরীর অংশ বিশেষ পড়ে নিয়েছি। উনি ফ্লোরে বসে পড়লেন উনার সাথে সাথে আমিও বসে পড়লাম। উনি মনোযোগ দিয়ে আলতা পড়িয়ে দিচ্ছেন। মৃদু বাতাস বইছে। বাতাসে উনার চুলগুলো কপালে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ছে। উনি খুব সুন্দর করে হাতে পায়ে আলতা পড়িয়ে দিলেন। আমি উনার দিকে বেলি ফুলের মালাটা এগিয়ে দিলাম। কিন্তু উনি নিলেন না বরং উনি আমার খুব কাছে চলে এলেন। পর পর দুটো চুমু খেলেন কপালে। উনি সরে গেলেন না আমাকে দুই হাতে আগলে নিলেন। কানের কাছে ফিসফিস করে বললেন,
তোমাকে যদি একটু ভালোবাসি তাহলে কী খুব বেশি অন্যায় হয়ে যাবে? আমার আলতো স্পর্শ যদি তোমার সর্বাঙ্গে ছড়িয়ে পড়ে তাহলে কী খুব বেশি ক্ষতি হয়ে যাবে?
আমি উনার কথার প্রতিত্তর করলাম না বরং লজ্জাবতী গাছের ন্যায় উনার বুকে মুখ গুঁজে দিলাম। উনি আলতো হেসে আমাকে কোলে তুলে নিলেন। আমাকে বিছানায় শুইয়ে দিলেন। লাইট অফ করে দিয়ে আমার কানে ফিযফিস করে বার কয়েক বার বললেন, ভালোবাসি। আমি আবেশে চোখ বন্ধ করে নিলাম। দু হাতে খামছে ধরলাম উনার টি-শার্ট।
চলবে…….