প্রজাপতি আমরা দুজন পর্ব-১০

প্রজাপতি আমরা দুজন

১০.
তিতলি খুব ইচ্ছে করছে মনে লুকানো ক্ষতগুলোর কথা নিঝুমকে বলতে।কিন্তু পারছে না।নিঝুম তিতলির পাশ থেকে বুঝতে পারে তিতলি যেন কিছু বলতে চাইছে তাকে।কিন্তু জড়তা কাজ করছে।নিঝুম সাবধানে বললো,
— “কিছু কষ্ট একান্ত নিজের হলেও কারো সাথে শেয়ার করলে বুক হালকা হয়।”
তিতলি দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো।
— ” আপনি কি জানতেন না বাবার দ্বিতীয় বিয়ের কথা?বলেন নি ফুফি আম্মা?”
— “তেমন কিছু শুনেছি বলে মনে হচ্ছে না।”

চা বাগানে হুটহাট চোখে পড়ে বাঁশের বেঞ্চি। তিতলির চেয়ে কিছুটা দূরেই ছিল বাঁশের বেঞ্চি।সে এগিয়ে আসে।বসে বেঞ্চিতে।আবহাওয়া ঠান্ডা, শীতল।পাশে এসে বসে নিঝুম।তিতলি নখ খোঁচাতে খোঁচাতে বলে,
— “আমার বড় বোনের নাম বোধহয় শুনেছেন।তিথিয়া নাম।আমার সৎ বোন।বাচ্চাকালের কথা তো মনে নেই।বোঝ হওয়ার পর দেখতাম আমাকে মা একটুও আদর করেন না।বড় আপুকে খুব আদর করতেন।দাদুনি আগলে রাখতেন।দাদুনি যতদিন ছিলেন একা ছিলাম না।দাদুনি মারা যাওয়ার পর একদম একা হয়ে যাই।স্কুলে যাওয়ার সময় মা টিফিন বক্স হাতে তুলে দেননি।অথচ,আমার সামনে আমার পছন্দের খাবার তিথিয়া আপুকে বক্স ভর্তি করে দিতেন।বাবা যেদিন বাসায় থাকতেন শুধুমাত্র সেদিন টিফিন জুটতো।আমি না খুব অবাক হতাম।আমার মা এমন কেনো?আদর করে বুকে নিয়ে ঘুমায়না।পাশে ঘুমায়না।খাইয়ে দেয়না।সাজিয়ে দেয় না।বাবা তো বেশিরভাগ সময়ই বাইরে থাকতেন।শিক্ষকতা তার উপর গৃহস্থালি।প্রতি বছর আমাদের জমিতে প্রচুর ধান ফলন হয়।ঢাকা চালান করা হতো তাই বাবা ঢাকায়ও যেতেন মাঝে মাঝে।একদিন সারাদিন বাসায় ফিরিনি।যে বাসায় মা মায়ের মতো না সে বাসায় ফিরতে কষ্ট হতো ভীষণ। তাই স্কুল থেকে বাসায় ফিরিনি।তখন আমার বয়স ছিল আট। সন্ধ্যায় আসতেই বাবা মারেন।প্রথমবার বাবা মারেন।আমার এই একটা মানুষই ছিল ভালবাসার সেও মারে। সেদিন কাঁদতে কাঁদতে ভীষণ জ্বর উঠে।জ্বরের ঘোরে বাবাকে বলি মা আমাকে আদর করে না।মারে।তিথিয়া আপুকে নিয়ে থাকে।বাবা রেগে যান।মা’র সাথে তর্ক শুরু হয়।সেদিন আমি প্রথম জানতে পারি আমার মা আমার জন্মের সময় মারা গেছেন।ঘরের মা আমার সৎ মা।ক্লাস থ্রি তে ছিলাম তখন।সৎ মার সংজ্ঞা আমার জানা ছিল।একজন মা’কে ছোট থেকে মা ভাবার পর হুট করে যদি জানতে পারেন সে আপনার সৎ মা কেমন লাগবে আপনার?”

তিতলি থেমে থেমে কাঁদছে।কান্নার দমকে শরীর কাঁপছে।সারা মুখ রক্ত আভা।নিঝুমের বুক ভারী হয়ে আসে।তিতলির পাশ ঘেঁষে বসে।নিঝুম কীভাবে সামলাবে তিতলিকে ঠাওর করতে পারছে না।রুমাল এগিয়ে দেয়।তিতলি নাক, চোখ মুছে আবার বলা শুরু করে,
— “তবুও আমি মেনে নিয়েছিলাম।যদি ভালবাসে সেই আশায়।বাসে নি।তাও মেনে নিয়েছি।মা বলেই ডেকেছি।কিন্তু দু’বছর আগে যা করলো…..”

নিঝুম গভীর মনোযোগ নিয়ে শুনছে।মনোযোগী শ্রোতা সে।তিতলি কথা থামিয়ে নিঝুমের দিকে তাকায়।সেই দৃষ্টিতে প্রচণ্ড ঘৃণা।নিঝুম বাকিটা শোনার জন্য অধীর অপেক্ষায় আছে।তিতলি নিঃশ্বাস ফেলে বলে,
— “পাশের পাড়ার চেয়ারম্যানের লম্পট ছেলের নাম রায়হান।সবাই বখাটে রায়হান বলেই চিনে।ক্লাস সেভে থেকে আমাকে বিরক্ত করে।আমার চেয়ে আট বছরের বড়।স্কুল থেকে ফেরার পথে নির্জন জায়গা পেলেই ওড়না টেনে নিয়েছে।অনেকবার সহ্য করেছি একসময় মা’কে বলি সব।মা পাত্তা দেয় নি।নিজের মা হলে বুক কেঁপে উঠতো।মায়ের কাছে নিরাশ হয়ে বাবাকে বলি।সালিশ বসে।বিচার হয়।কয়দিন ভালো যায় আবার শুরু হয়।আমার জেএসসি খারাপ হয়।পদে পদে বিরক্ত হতে থাকি।দ্বিতীয়বারের মতো আবার সালিশ বসে।বিচার হয়।বাবা রেগে গিয়ে হুমকি দেন,আবার বিরক্ত করলে তিনি পুলিশের কাছে যাবেন।গ্রামে বাবার জমি সবচেয়ে বেশি তাই বাবার দাপট বেশ ভালোই।বাবার হুমকিতে এক বছর বিরক্তের মুখোমুখি হতে হয়নি।কিন্তু আমার দূর্বলতা আমার মা নেই।বাবা ছাড়া পাশে কেউ নেই।এসএসসি পরীক্ষার বেশ কয়েকদিন আগে বাবা ঢাকা যান।হুট করে মা একটা বেনারসি এনে পরতে বলেন।না পরাতে মারধর করেন।জোর করে পরিয়ে দেন।শাড়ি পরার ঘন্টাখানেক পর রায়হান আসে।কাজী নিয়ে।আমি সব হিসেবনিকেশ মিলিয়ে নেই।রায়হানরে সাথে আমার বিয়ে!আর গতকাল রাতে মার কাছে যে এতোগুলো টাকা দেখেছি তাও রায়হানের দেওয়া!জোর করে বিয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা করেছে।আমাকে আমার মা খেলনা ধরে নিয়েছে।যার কোনো মূল্য নেই।একদমই মূল্য নেই।”

তিতলি রাগে হাঁপাতে থাকে।নিঝুমের শান্ত মুখোশ ভেদ করে উত্তেজনা ফুটে উঠেছে।সে প্রশ্ন করে,
— “পরে বিয়ে হয়েছিলো?”
— “না হয়নি।আমি পালিয়েছিলাম।”
— “কীভাবে?কই গিয়েছিলে?”
— ” বাথরুমে যাব বলে বাড়ির পিছন দিয়ে বের হয়ে দুনিয়াবি ভুলে শুধু দৌড়িয়েছি।আমার এক বন্ধু ছিল।সানজু নাম।ওর বাসায় গিয়ে সানজুর পরিবারকে সব বলি।ওরা আমাকে মামার বাড়ি পৌঁছে দেয়।”
কপালের দু’পাশের রগ টনটন করছে।নিঝুম বাম হাতে নিজের কপাল ম্যাসেজ করে।বলে,
— “তারপর তোমার বাবা জানতে পেরেছেন?”
— “পেরেছে।সেদিন নিজেকে বিয়ের হাত থেকে বাঁচাতে পালিয়েছি।আর মহিলা গ্রামে ছড়িয়েছে আমি নাকি ছেলে ধরে পালিয়েছি।বাবা যখন ফিরে আসে আমিও ফিরে আসি মামার সাথে।বাবা সেদিন আমাকে বিশ্বাস করলেও সমাজ করেনি।প্রতিবেশীরা দু’মুখো সাপ হয় শুনেছি কিন্তু কখনো বুঝিনি।সেদিন বুঝেছিলাম তাদের মুখে কত বিষ।লাঞ্চনা-বঞ্চনা সহ্য করে দু’টো বছর কাটিয়েছি।আমি রাস্তায় হাঁটতে পারিনি।কেউ না কেউ খুঁচিয়ে বাজে কথা বলতোই।কোনো মেয়ে আমার সাথে মিশতোনা।ওদের পরিবার থেকে কঠোর নিষেধ থাকতো, তিতলির সাথে মেশা যাবে না।
সেদিনের পর থেকে রায়হানের উত্তক্ত্য অনেক গুণ বেড়ে যায়।কলেজ যাওয়ার পথে রাস্তায় আটকে জড়িয়ে ধরতো।কেউ বাধা দিতোনা।সবাই ভাবতো, কোন ছেলের সাথে শুয়ে আসছি!আমি এগুলারই যোগ্য!”
শেষ কথাটা বলে তিতলি ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠে।নির্জন গহীন অরণ্যের মতো এই চা বাগানে তাঁর চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে হচ্ছে।যেনো পিছনের সব ক্ষত ধুয়ে মুছে যায়।নিঝুম নিজের বড় গুণটি হারিয়ে ফেলে যেন।শান্তভাবে সব সামলানো!ও কথা বলতে গিয়ে দেখে স্বান্তনাবাণী তার গলার জোরে নেই।তিতলি কেঁদেই চলেছে।পিছনের প্রতিটি সময় জীবন্ত হয়ে চোখের সামনে ভাসছে।নিঝুম কি করবে না করবে বুঝে উঠতে পারছে না।কিছু না ভেবেই তিতলির এক হাত চেপে ধরে।তিতলি কিঞ্চিৎ কেঁপে উঠে। কান্নাটা থেমে যায় রেশ রয়ে যায়।ছলছল চোখে তাকায়।নিঝুম বলে,
— “শক্ত হও। ”
তিতলি অন্য হাতে চোখের জল মুছে দূরে…দূরে তাকায়।যত দূর চোখ যায়।নিঝুমের মনে হলো তার বুক পুড়ছে।খুব করে পুড়ছে।তিতলির এলোমেলো চুল উড়ে এসে নিঝুমের চোখে মুখে ধাক্কা খাচ্ছে।পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে নিঝুম বললো,
— “আমরা এখন টিলার উপর আছি।আর টিলা থেকে নীচে দৌড়ে নামার মধ্যে আলাদা আনন্দ আছে।এখনতো তুমি সেই আনন্দটা পাবে না।বলেছিলাম শাড়ি না পরতে।পরে এসেছো।এখন মজা বুঝো।”
তিতলি উঠে দাঁড়ায়।নবাবি চালে বলে,
— “তিতলি শাড়ি পরেও দৌড়াতে জানে।”
নিঝুম ডান পাশের ভ্রু উঁচিয়ে বলে,
— “শিওর?”
— “হান্ড্রেট পার্সেন্ট। দাঁড়ান দেখাচ্ছি।”
তিতলি চুল খোঁপা করে শাড়ির আঁচল কোমরে গুঁজতেই পেটের কিছু অংশ উন্মুক্ত হয়ে যায়।নিঝুম দ্রুত চোখ সরিয়ে নেয়।তিতলি দু’হাত প্রজাপতির ডানার মতো মেলে টিলার উপর থেকে নিচে নামার জন্য দৌড় দেয়।পিছনে নিঝুম আসে।সেকেন্ড দুয়েক পার হতেই তিতলি চেঁচিয়ে উঠে,
— “ডাক্তার! আমি থামতে পারছিনা।”
নিঝুম ভয় পেয়ে যায়।তিতলি উল্টে যেতে পারে যেভাবে দৌড়াচ্ছে।আবার কন্ট্রোল হারিয়ে ফেলেছে।নিঝুম দ্রুত দৌড়ে নিচের দিকে আসে।তিতলি কিছুতেই নিজেকে নিয়ন্ত্রন করতে পারছে না।উপর থেকে নিচে দৌড়ে আসলে দৌড়ের গতি মাঝে মাঝে কন্ট্রোলের বাইরে চলে যায়।তিতলির যখনি মনে হলো সে এখনি উল্টে যাবে তখনি ঝড়ের গতিতে নিঝুম তিতলির সামনে এসে দাঁড়ায়।তিতলি দৌড়ে নিঝুমের বুকে পড়ে।নিঝুম দু’হাতে জড়িয়ে ধরে ঘুরে দাঁড়ায়।আরেকটু হলে নিঝুম তিতলিকে নিয়ে উল্টে যেত।তিতলির যখন হুঁশ আসে টের পায় কারো বুকের সাথে মিশে আছে সে।এবং তার পায়ের নিচে মাটি নেই।হৃদস্পন্দন বেড়ে যায়।সম্মোহিতের মতো মুখ তুলে তাকায়।নিঝুমের থুতনিতে তিতলির ঠোঁট লাগতেই নিঝুমের হৃদপিণ্ড একটিবারের জন্য থমকে যায়।তিতলির হৃদপিণ্ড তীরের বেগে ছুটতে থাকে। কোনো কথা নেই।শুধু হৃদয়ের ধুকপুক। আর এলোমেলো নিঃশ্বাস।

নিঝুমই পরিস্থিতি প্রতিকূলে আনতে বলে,
— “তোমার মতো পাগলি আর একটাও দেখিনি।এখনি কি হতে পারতো?”

চলবে….
®ইলমা বেহরোজ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here