প্রজাপতি আমরা দুজন
১১.
ওরা আরো অনেকটা দূর হেঁটে আসে।চা বাগানের ঠিক মধ্যিখানের সমতল জায়গা জুড়ে ছোট ছোট পাকা ঘর রয়েছে।সাথে ছোট টং দোকান দুই,তিনটে।দোকানের সামনে বাঁশের বেঞ্চি পাতা।নিঝুম তিতলিকে অফার দেয়,
— “চা খাবে তিতলি?”
তিতলি মাথা নাড়িয়ে বললো,
— “অবশ্যই।”
বেঞ্চিতে দুজন পাশাপাশি বসে।নিঝুম একটা বাচ্চা ছেলেকে ডেকে দু’কাপ চা দিতে বললো।তাঁদের সামনেই একটি গ্রুপ বসে আড্ডা দিচ্ছে।সম্ভবত এরা স্কুলের ছেলে-মেয়ে। একসাথে ঘুরতে এসেছে।তিতলি গ্রুপটির দিকে তাকাতেই একটি মেয়ে ইশারায় বোঝায় দুজনকে খুব মানিয়েছে।তিতলি হেসে ফেলে।নিঝুম অবাক হবার ভান করে বললো,
— “হাসছো যে?”
তিতলি অন্যদিকে ফিরে জবাব দেয়,
— “এমনি।”
অন্যদিকে তিতলি মুখ করে থাকলেও নিঝুম বুঝতে পারে তিতলি হাসছে।কেনো হাসছে?অদ্ভুত তো।নিঝুম নিজেকে খুঁটিয়ে দেখে হাস্যকর কিছু আছে নাকি।নাহ,নেই।শ্যাম রংয়ের ছেলেটি দু’কাপ রং চা দিয়ে যায়।অবশ্য কাপ বলা যায়না, স্টিলের ছোট গ্লাস।নিঝুম চায়ে চুমুক দিয়ে বলে,
— “তিতলি ভবিষ্যতে যা হতে চাও এখন থেকেই প্রস্তুতি নেওয়া শুরু করবে।মনে রাখবে,নিজের অস্তিত্ব পৃথিবীর বুকে ধরে রাখা তোমার দায়িত্ব।”
তিতলি অন্যদিকে তাকিয়ে হাসে আর ভাবে,
— “সেই প্রথম দেখা থেকে আমার অস্তিত্ব আপনার দখলে।সেটা কি বুঝেন না?”
নিঝুম তিতলির জবাব না পেয়ে জিজ্ঞাসা করলো,
— “রেজাল্ট কি ছিল তোমার?”
তিতলি চা’য়ে চুমুক দিয়ে জবাব দেয়,
— “জিপিএ৫।”
— “সাবজেক্ট? ”
— “আর্টস।”
— “অনার্স না ডিগ্রি করার ইচ্ছে?”
— “অনার্স, ইংলিশ নিয়ে।পাশাপাশি বিয়েটা হলে বেশি ভালো হয়।”
নিঝুম হাসলো।তিতলির দিকে সরাসরি তাকায়।তিতলিও তাকায়।নিঝুম বলে,
— “বিয়েটা কি সত্যি তোমার ফিউচার প্ল্যান?”
তিতলি চায়ে চুমুক দিয়ে স্বাভাবিকভাবেই বলে,
— “মিথ্যে বলতে যাব কেন?”
নিঝুম অনেকটা জোরেই হাঁফ ছেড়ে বললো,
— “সিলেট না কুমিল্লা বিয়ে করতে চাও?”
— “সিলেট ভালো লেগেছে।”
নিঝুম প্যান্টের পকেট থেকে ফোন বের করে গ্যালারি তে ঢুকলো।এরপর তিতলির হাতে দিয়ে বললো,
— “এখানে আমার অবিবাহিত ফ্রেন্ডদের ছবি আছে।চয়েজ করো।”
তিতলি সরু চোখে তাকায়।এরপর মুখ ফিরিয়ে নিয়ে অভিমানি স্বরে বলে,
— “করলামনা বিয়ে।আজীবন একাই থাকবো।”
নিঝুম ঠোঁট কামড়ে হাসে।গ্রুপটি চলে গেছে।চারপাশ প্রায় খালি।
—- “একটা গান ধরো তো তিতলি।”
— “হাদিয়া কি দিবেন?”
নিঝুম তাকায়।যতটা সহজ সরল ভেবেছিল তিতলিকে ততোটা তিতলি নয় আসলে!
— ” কি চাও?”
— ” আপনার গার্লফ্রেন্ডের সাথে পরিচয় করিয়ে দিন।”
তিতলি নিঝুমকে জব্দ করে নিঞ্জা টেকনিকে জানতে চাইছে নিঝুমের সাথে কারো প্রেম আছে নাকি!নিঝুম ভারী অবাক হয়ে বললো,
— “বড় ভাইকে বলছো গার্লফ্রেন্ডের সাথে পরিচয় করিয়ে দিতে?সাহস তো কম না।”
— “আপনি আমার কোন জন্মের ভাই?”
তিতলির জবাব না দিয়ে নিঝুম প্রশ্ন করে,
— “তুমি জানো আমি তোমার কত বড়?তোমার আঠারো হলে আমি তোমার দশ বছর সিনিয়র।”
তিতলি লুকিয়ে চাপা হাসে।এরপর নিঝুমের দিকে তাকিয়ে বলে,
— ” বাঘ তো আর না।”
নিঝুম ভারী অবাক হয়।মেয়ের মুখে একদম খই ফুটেছে যেন।
— “আমার গার্লফ্রেন্ড নেই।”
তিতলি চমকে তাকায়।পাঁজরে পাঁজরে কাঁপন ধরে।খুশিতে অন্য দিকে ফিরে হাসে।চোখে জল চিকচিক করে উঠে।সে ভাবে, তাহলে আপনি শুধু আমারই ডাক্তার।
তিতলি উঠে দাঁড়ায়।মৃদু হাওয়া বইছে।নিঝুম চশমটা ঠিক করে নেয়।কান খাড়া করে রাখে তিতলির গান শোনার জন্য।তিতলি গায়-
” আমার ও পরান ও যাহা চায়
তুমি তাই , তুমি তাই গো
আমার ও পরান ও যাহা চায়
তোমা ছাড়া আর এ জগতে
মোর কেহ নাই কিছু নাই গো
আমার ও পরান ও যাহা চায়
তুমি সুখ ও যদি নাহি পাও
যাও সুখের ও সন্ধানে যাও
আমি তোমারে পেয়েছি হৃদয় ও মাঝে
আর ও কিছু নাহি চায় গো ও
আমার ও পরান ও যাহা চায়
তুমি তাই তুমি তাই গো
আমার ও পরান ও যাহা চায়
আমি তোমার ও বিরহে
রহিব বিলীন ও
তোমাতে করিব বাস…….”
তিতলির গান শেষ হতেই হাতের তালির আওয়াজ শোনা যায়।সে চোখ খুলে পিছন ফিরে তাকায়।নিঝুম সহ ছোট ছোট বাচ্চারা হাতের তালি দিচ্ছে।কখন এরা এসে ভীর করেছে তিতলি বুঝেনি একদম!প্রায় সবগুলো বাচ্চার রং কালো।তিতলি বাচ্চাদের সাথে ভাব জমায়।নিঝুম ক্যামেরা তাক করে তিতলি সহ বাচ্চাদের ক্লিক করতে থাকে বিরামহীন ভাবে।ফোন বেজে উঠে।আঞ্জুমান কল করেছেন।নিঝুম রিসিভ করে,
— “বলো আম্মু।”
— “তোরা এখন কই?”
— “চা-বাগান।”
— “বাসায় ফিরবি কেমনে আব্বা?আম্বরখানায় অনেক ভেজাল চলছে বিএনপি,আওয়ামীলীগের।দুইজন মারাও গেছে।টিভিতে দেখাচ্ছে।”
— “দিন অনেক বাকি।থেমে যাবে।”
ফোন নির্জন কেড়ে নেয়।নিঝুমকে বলে,
— “বিকেলে তোকে কল করব।আমি বললে এমুখো হবি।নয়তো রাতটা কাটিয়ে দিবি কোথাও।রিস্ক খুব এদিক দিয়ে আসা।মেজর সিরাজ খুন হয়েছে।”
নিঝুম উদ্বেগ হয়ে বললো,
— “কি সাংঘাতিক!”
— “ওদিকের অবস্থা ভালো না।তিতলির জন্যই আম্মু চিন্তা করছে বেশি।”
— “হবেই।একা হলে রিস্ক নিতাম।আচ্চা কল দিয়ে দিয়ে আপডেট জানাস।”
— “আচ্ছা।সাবধানে থাকবি।”
ফোন রেখে নিঝুম বিরক্তিতে চোখ ছোট করে ফেলে।নিজের রুম ছাড়া কোথাও থাকা তাঁর জন্য অনেক বড় ত্যাগ।বাড়ি হলেও মানা যেতো!
চলবে…..
®ইলমা বেহরোজ