প্রজাপতি আমরা দুজন
১২.
চোখের চশমা চোখ থেকে সরে এসেছে।নিঝুম যত্ন করে চশমা চোখে নিয়ে আসে।এরপর তিতলিকে ডাকে,
— “তিতলি?”
ন্যাড়া মাথার একটা বাচ্চাকে তিতলি কাতুকুতু দিচ্ছিল। নিঝুমের ডাকে ফিরে তাকায়।
— “কিছু বলবেন?”
— “এখানে তো অনেক্ষণ হলো।সামনে চলো।”
তিতলি বাচ্চাগুলো’কে টাটা দিয়ে নিঝুমের পাশে এসে দাঁড়ায়।দুজন পাশাপাশি হাঁটতে থাকে।কিছু সময় পর পর তিতলি হোঁচট খাচ্ছে।নিঝুম একবারও ধরার জন্য হাত বাড়ায়নি। সে মনোযোগ দিয়ে ছবি তোলাতে মগ্ন।তিতলি ডাকে,
— “এইযে…”
নিঝুম তাকাতেই তিতলি বলে,
— “ছয় বার হোঁচট খেয়েছি।একবারো ধরেন নি কেনো?”
— “পড়ে তো যাওনি।”
— “যদি যেতাম?”
— “পড়ে যাওয়ার মতো হোঁচট খেলে অবশ্যই ধরার চেষ্টা করবো।এইযে ছয় বার হোঁচট খেয়েছো বললে এইটা তো তোমার শাড়ির জন্যই।আর তুমিও নিজেকে সামলে নিয়েছো।”
তিতলি চোখ ছোট ছোট করে দাঁড়িয়ে পড়ে।নিঝুম প্রশ্ন করে,
— “দাঁড়ালে কেনো?”
তিতলি অভিযোগ করে,
— “আপনি মেয়েদের মতো এতো কথা বলেন কেনো?”
নিঝুম হাসে।দীর্ঘ সেই হাসি।তিতলির ঘোর লাগে।নিঝুম চমৎকার করে বলে,
— “যাক,কেউ তো বললো আমি এতো কথা বলি।”
কথা আর বাড়েনি।দুজন আবারো পাশাপাশি হাঁটতে থাকে।নিঝুম যেন হুট করেই অনুভব করে তাঁর ভেতরে উষ্ণ, কোমল, পেলব অনুভূতির সৃষ্টি হচ্ছে ক্রমান্বয়ে।প্রকৃতির জন্য নাকি অন্য কিছু?বা অন্য কেউ!জানা নেই।নিঝুম কিছুটা এগিয়ে যায়।তিতলি ব্যাকুল চোখে তাকিয়ে থাকে নিঝুম পানে।ব্লু শার্ট সাথে জিন্স পরা।পায়ে লেদার লোফার।গলায় ঝুলানো ক্যামেরা আর চোখে সবসময় চশমা।কয়দিনে নিঝুমের প্রতিটি পছন্দ মুখস্থ হয়ে গেছে তিতলির।নিঝুম ঘুরে তাকায়।দেখে তিতলি নিষকম্প স্থির চোখে তাকিয়ে আছে তাঁর দিকে।
— “তিতলি?”
তিতলি যেন চমকে উঠলো।নিঝুম বললো,
— “কি হয়েছে?”
তিতলি নিজেকে ধাতস্থ করে বললো,
— “কিছুনা।”
বেশ কিছুক্ষণ পর তিতলি বললো,
— “চলুন না টিলার উপর উঠি।”
— “শাড়ি পরেছো উঠতে পারবে না।”
— “পারবো।”
— “তিতলি ত্যাড়ামি করো না।”
তিতলি অনুরোধ করে বললো,
— “প্লীজ ডাক্তার….প্লীজ।”
নিঝুম তিতলির ‘ডাক্তার’ ডাকটায় কিছু একটা পায়।কি সেটা জানে না সে।তবে কিছু একটা যেন আছে।টিলার দিকে পা বাড়িয়ে নিঝুম প্রশ্ন করলো,
— “ভাইয়া ডাক ছেড়ে ডাক্তার ডাকা শুরু করলে কেনো?”
— “আপনার তো দুইটা বোন আছে।ভাইয়া ডাকার জন্য।তবুও আরো বোন বানানোর শখ?”
— “আমি একবারো সেটা বলেছি?”
— “বোঝা যায়।”
— “মেয়েরা এক লাইন বেশি সবসময় বুঝে।”
— “আপনি খুব ঝগড়াটে।”
— “কোন যুক্তিতে মনে হলো?”
— “আমি আপনার সাথে আর কথাই বলব না।”
নিঝুম হাসে।বেশ কিছুক্ষণ হেসেই গেল।দুজন অনেক উপরে উঠে আসে।নিঝুম তিতলির চেয়ে অনেকটা দূরে। তিতলির শাড়ি একবার লজ্জাবতী গাছে লাগে তো আরেকবার কাঁটাযুক্ত গুল্মলতায়।
— “এই যে…দাঁড়ান।”
নিঝুম হাঁটা থামিয়ে তিতলির জন্য অপেক্ষা করে।নিঝুম তিন হাত উঁচু জায়গায়।তিতলি নিচে এসে দাঁড়াতেই নিঝুম বললো,
— “বলেছিলাম শাড়ি পরে উপরে উঠতে পারবে না।শুনোনি তো।”
— “এতো বকাবকি কেনো করেন আপনি।একটু হাতটা বাড়ান নয়তো আমি উঠতে পারবো না।”
নিঝুম হাত বাড়িয়ে বলে,
— “মেয়েরা সবসময় ছেলেদের উপর নির্ভরশীল।নাও হাত ধরো।”
তিতলি নিঝুমের হাত ধরার জন্য হাত বাড়িয়ে আবার গুটিয়ে নেয়।ঝাঁঝালো কন্ঠে বলে,
— “ধরলামনা আপনার হাত।আমি একাই উঠতে পারি।”
নিঝুম কিঞ্চিৎ ভ্রু বাঁকায়।বললো,
— “শাড়ি পরে এই জায়গাটা উঠা সম্ভব নয়।জেদ করোনা।হাতটা ধরো।”
তিতলি দৃঢ়কণ্ঠে বললো,
— “আমি পারবো।আপনি সরুন।”
নিঝুম দীর্ঘশ্বাস ফেলে সরে দাঁড়ায়।তিতলি চুল হাত খোঁপা করে।শাড়ির আঁচল কোমরে গুঁজে নেয়।এরপর,
দু’হাতে শাড়ি ধরে পায়ের গোড়ালির উপরে তুলে কোমরে গুঁজে। নিঝুম চোখ অস্থির রেখে অন্যদিকে ফিরে।তিতলি মাটিতে দু’হাত রাখে,এরপর দু’হাতে ভর দিয়ে উপরে উঠে আসে।হাত থেকে বালু ঝাড়তে ঝাড়তে গর্ব করে নিঝুমকে বললো,
— “মেয়েরা কখনোই ছেলেদের উপর নির্ভরশীল না।”
নিঝুম তিতলির দিকে তাকায়।ওর পুরো শাড়িতে মাটি লেগে একাকার।তার উপর ভেজা মাটি।ময়লা হাতে কপালের ঘাম মুছে তিতলি।ফলে মুখেও লেগে যায়।নিঝুম জোরে হেসে উঠে।এই হাসি নিঃশব্দ নয়।চারপাশ কেঁপে কেঁপে উঠছে হাসির দমকে।তিতলি বিস্ময় নিয়ে চেয়ে থাকে।ও ভাবতেই পারেনি নিঝুম জোরে হাসতে পারে। নিঝুম হাসি থামিয়ে তিতলির কাছে এসে বললো,
— “মেয়েরা কখনোই ছেলেদের ছাড়া সম্পূর্ণ নয়!”
তিতলি মনে মনে আওড়ায়,
— “সত্যি…..সত্যি আমি আপনি ছাড়া অসম্পূর্ণ !”
তিতলির সাড়া না পেয়ে নিঝুম হাতে তুড়ি বাজিয়ে বললো,
— “কি?”
তিতলি খুব সরল গলায় বললো,
— “কিছুনা।”
নিঝুম তিতলির শাড়ির দিকে চোখ রেখে বললো,
— “শাড়িতে তো কাদা লাগিয়েছ।”
তিতলি নিজের দিকে তাকায়।আসলেইতো…সে এক পায়ে পিছু হটে….নিঝুম মৃদু চিৎকার করে উঠলো,
— “পরে যা….”
বলতে বলতে তিতলি পরে নিচ্ছিলো।নিঝুম ডান হাত ধরে ফেলে শক্ত করে।তিতলি ভেবেছিলো পড়ে গেছে সে।চোখ খিঁচে রাখে।যখন মনে হলো সে ঝুলে আছে।চোখ খুলে।নিঝুম এক হাতে ধরে রেখেছে দেখে ঠোঁটে হাসি ফুটে। নিঝুম টেনে তুলতে গেলেই তিতলি আর্তনাদ করে উঠলো।নিঝুম তিতলির পায়ের দিকে তাকিয়ে দেখে, তিতলির এক পা ছোট একটা গর্তে অস্বাভাবিকভাবে পড়েছে।নিঝুম তিতলির পা গর্ত থেকে বের করে।তিতলি আর্তনাদ করে মাটিতে বসে পড়ে।নিঝুম তিতলির পা হাতে নিয়ে দেখে,পা লাল হয়ে গেছে।মচকে গিয়েছে হয়তো।নিঝুম বললো,
— “হাঁটার শক্তিটুকু আছে?”
তিতলি কাঁদছে।চোখ বেয়ে পানি পড়ছে।সেনসিটিভ ত্বক হওয়াতে ব্যাথা করছে খুব।নিঝুম আবারো বলে,
— “তিতলি এখন নামা সম্ভব নয়।আমরা হাঁটতে হাঁটতে অনেক উপরে চলে এসেছি।আর একটু পথ বাকি।তাহলে চূড়ায় চলে যাবো।একটু কষ্ট করে আসতে পারবে?”
তিতলি মাথা নাড়িয়ে না করে।নিঝুম কয়েক সেকেন্ড ভাবে।এরপর তিতলিকে পাঁজা কোলে তুলে নিতে নিতে বললো,
— “আমি আমার আটাশ বছরের জীবনে একদিনে এতো সমস্যার মুখোমুখি হইনি।”
তিতলির ব্যাপারটা বুঝতে অনেক সময় লাগে।যখন বুঝে তখন সে অবাকের চরম পর্যায়ে!পিল উঠলো চমকে।নিঝুমের বিরক্তি নিয়ে বলা কথাটি কানে অব্দি আসেনি।তাঁর দৃষ্টি নিঝুমের উপর থমকে গেল।নাকের পাটা লজ্জায় লাল হয়ে যায়।সেই সাথে বুকে ঝির ঝির কাঁপন।নিঝুম বুঝতে পারে তিতলি তাঁর দিকে তাকিয়ে আছে পলকহীন ভাবে।বুঝেও,নিঝুমের এতোটুকুও অস্বস্তি হচ্ছেনা!বরং মোহময় অনুভূতি অনুভব হচ্ছে।
তিতলি চোখ বুজে মনে মনে আওড়ায়,
— “স্বর্গের সুখ এর চেয়েও কি বেশি!”
— “তোমার ওজন কত?”
নিঝুমের কণ্ঠ শুনে তিতলি চোখ খুলে।কপাল কুঁচকে জিজ্ঞাসা করে,
— “কেনো?কি দরকার?”
তিতলির প্রশ্ন অগ্রাহ্য করে নিঝুম বললো,
— “পঞ্চাশ না বায়ান্ন?”
তিতলি অন্যদিকে ফিরে বলে,
— “চুয়ান্ন।”
নিঝুম মৃদু হেসে বলে,
— “আমি আরেকটু বেশি ভেবেছিলাম।”
— “বললেন তো কম।”
— “মেয়েদের বয়স আর ওজন কম করে বললে খুশি হয় সেজন্য।”
— “আপনি খুব খারাপ।কষ্ট হলে নামিয়ে দিন।”
নিঝুম ঠোঁট কামড়ে হাসে।মেয়েটা আসলেই এক লাইন বেশি বুঝে।
চলবে….
®ইলমা বেহরোজ