২+৩+৪
প্রজাপতি আমরা দুজন
২.
একই রকম দুজন মেয়েকে দেখে তিতলি ভারি অবাক হলো।চোখ বুজে আবার খুলে।না ঠিকই দেখছে!এরা জমজ!মৌনতা-মোহনা এগিয়ে আসে তিতলির কাছে।তিতলি অবাক চোখে তাকিয়ে দেখছে জমজ দু’বোনকে।কি ভয়ংকর সুন্দর মেয়ে দু’টি।
তিতলির গাল টেনে মৌনতা বললো,
— “কি মিষ্টি মেয়েরে মোহ।”
আঞ্জুমান হেসে বললেন,
— “একদম মায়ের মতো হইছে দেখতে।”
মোহনা তিতলির দু’হাত নিজের দু’হাতের মুঠোয় নিয়ে বললো,
— “নাম কি তোমার?”
তিতলি মা-মেয়েদের কথায় লজ্জায় মিইয়ে যাচ্ছে।অস্বস্তি লাগছে খুব।কেমন কাঁপাকাপি হচ্ছে শরীরে।নিজের নাম বেমালুম ভুলে গেছে।নতজানু হয়ে কাঁপা স্বরে বললো,
— “তি..তিতলি!মুমতাহিনা তিতলি।”
মৌনতার উৎকন্ঠা,
— “তিতলি তুমি কি ভয় পাচ্ছো?কাঁপছো কেনো?”
খোদা!কি লজ্জা!কাঁপাকাঁপি দেখে ফেললো।কি ভাবছে ওরা কে জানে?তিতলি আরো অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে।লজ্জাজনক অস্বস্তি ভর করে।কখনো বাবাকে ছাড়া কোথাও থাকেনি।তেমন কারোর সাথে মিশেওনি।সবসময় একা থেকেছে।এখানে এসে ভাবনার বাইরে কত কি হচ্ছ।কত অচেনা মানুষ।তিতলি গোপনে দীর্ঘশ্বাস নিয়ে নিজেকে স্বাভাবিক করে।কোমল কন্ঠে বললো,
— “না না আপু। ঠিক আছি।”
মৌনতা একটু জোর দিয়ে বললো,
— “আরে না না।একটু আগেই দেখলাম তোমার হাত কাঁপছে।”
নিঝুম বাড়ি ঢুকেই ক্লান্ত শরীর নিয়ে সোফায় হেলান দিয়ে বসেছিলো।মৌনতার কথা শুনে এগিয়ে আসে।
— “প্রথম প্রথম আসছে।নতুন পরিবেশ।নতুন মানুষ! একটু তো নার্ভাস হবেই।আস্তে আস্তে ঠিক হয়ে যাবে।’ রয়ে সয়ে বলল নিঝুম।
আঞ্জুমান ছেলের সাথে তাল মিলান,
— “হুম সেটা কি তোর বোনেরা বুঝবে।ওদের ইচ্ছে নতুন কেউ এসেই ওদের মতো লাফাতে শুরু করুক।”
মোহনা আর্তনাদের ভান করে বললো,
— “মা…..মৌনর জন্য এখন আমাকেও বকছো।’
— ” তোর নাম কি উল্লেখ করেছি?”
— ” ভাইয়াকে ‘তোর বোনেরা’ বলছো।মানে ভাইয়ার বোনেরা তো আমি আর মৌন।তো বুঝাই যায় আমাকে বকছো।”
আঞ্জুমানের মুখে চাপা হাসি।হাসি লুকিয়ে বলেন,
— “বেশ করেছি।”
মোহনা কান্নার ভান করে নিঝুমের কাছে আসে।
নিঝুম মোহনাকে এক হাতে জড়িয়ে ধরে বললো,
— “কাঁদে না।’
এরপর মা’কে উদ্দেশ্য করে বললো,
— “আম্মু তুমি মৌনের জন্য মোহকে আর বকবেনা!”
আবার মোহনাকে বলে আদুরে গলায়,
— “এবার হ্যাপি ?মা’কে বলে দিয়েছি।আর বকবেনা।”
মোহনা মাথা নাড়িয়ে হাসে।নিখুঁত চিকন ঠোঁটে মোহনা যখন হাসে খুব বেশি মিষ্টি দেখায়।আর নিঝুম সবসময় বোনদের এই হাসিটুকুই দেখতে চায়।মিষ্টি হাসির উত্তরে মোহনার কপালে চুমু এঁকে দেয় নিঝুম।মৌনতা ছলছল চোখে নিঝুমের দিকে তাকিয়ে আছে।নিঝুমের নজরে পড়ে!হাত বাড়িয়ে নিঝুম ডাকে,
— “আয়?”
মৌনতা এগিয়ে আসে।অভিমানী স্বরে বললো,
— “সবসময় প্রথম ওরে ভালবাসো।”
নিঝুম মৌনতার কপালে চুমু দিয়ে বললো,
— “কে বললো সবসময় ওরে আগে ভালবাসা দেই? গতকাল রাতে চকলেট কিন্তু তোকে দিয়েছি আগে।’
মৌনতা হেসে বলল,
— ”কচু!”
নিঝুম হেসে দু’জমজ বোনকে দু’হাতে জড়িয়ে ধরে।
মিসেস আঞ্জুমানের প্রাণ জুড়ায় ভাই-বোনদের এই ভালবাসা দেখে।নিঝুম – নির্জনের কলিজার টুকরা তাদের ছোট বোনগুলো।তিতলির বুকে একরাশ মুগ্ধতা কামড়ে ধরে!তাঁর একটা পোড়া,অল্প বয়সী মন আছে।যে মন বাবার ভালবাসা ছাড়া আর কারো ভালবাসা পায়নি।আঞ্জুমান হুট করে খেয়াল করেন তিতলিকে।ছেলে-মেয়ের কথার মাঝে ওর কথা ভুলে গিয়েছেন।সোফায় রাখা তিতলির ব্যাগটা হাতে নিয়ে বললো,
— “দেখছো কারবারটা!আমরা নিজেদের মতো কথা বলছি।এইখানে একটা মেয়ে কখন থেকে দাঁড়িয়ে আছে।সারাদিন জার্নি করছে কিছু খায়নি।এই মেয়ে চলো আমার সাথে।”
তিতলি মাথা নাড়িয়ে মিসেস আঞ্জুমানের পিছু হাঁটে।একবার নিষিদ্ধ কোনো টানে পিছন ফিরে তাকায়।নিঝুমের দিকে!নিঝুম বোনদের সাথে কথা বলছে সেই সাথে ঠোঁটে সেই চমৎকার হাসি।
তিতলির হৃদপিন্ড ধুকধুক করে উঠে।দ্রুত চোখ সরিয়ে নিজেকে নিজে বুঝায়,
— “এমন করিস না তিতলি।পর পুরুষকে এভাবে দেখতে নেই।কালি লেগে যাবে চরিত্রে।”
_____________________________________________
শুক্রবার হওয়ায় বাড়ির সবাই আজ বাসায়।আলতাফ চৌধুরী ড্রয়িংরুমে বসে পত্রিকা পড়ছেন।মৌনতা,মোহনা,তিতলি, আঞ্জুমান,কাজের মেয়ে টুনি একসাথে আড্ডা দিচ্ছে।আড্ডার টপিক তিতলি এতো গভীর ঘুম কই পেলো?প্রথম প্রথম একটু সঙ্কুচিত বোধ হলেও,মৌনতা, মোহনা,মিসেস আঞ্জুমানের আন্তরিক ব্যবহারে তিতলি অনেকটা সহজ হতে পেরেছে।
— “বাবারে বাবা!তোমাকে এতো ডেকেছি রাতে ডিনারের জন্য!তুমি উঠোই নি।” হাত নাড়িয়ে নাড়িয়ে মুখে সিরিয়াস ভাব নিয়ে বললো মোহনা।
— ”এতো ঘুমাতে পারো তুমি!সন্ধ্যা থেকে এক ঘুমে ভোর।” হেসে বললো মৌনতা।
তিতলির লজ্জায় ইচ্ছে হচ্ছে মাটি খুঁড়ে ঢুকে যেতে।আমতা আমতা করে তিতলি উত্তর দেয়,
— “আ..আসলে খুব ক্লান্ত ছিলাম যে তাই।”
আড্ডার মাঝে এসে ঢুকে নির্জন।
— “হাই?এভ্রিওয়ান!গুড মর্ণিং।”
মৌনতা, মোহনা,হেসে একসাথে বললো,
— “গুড মর্ণিং ভাইয়া।”
মিসেস আঞ্জুমান টুনিকে ইশারায় নির্জনের নাস্তা আনতে বলেন।মুখে ছেলেকে বললো,
— “শুভ সকাল আব্বা।”
তিতলি নির্জনকে দেখে অবাক হয়।টি-শার্ট পরা, প্যান্ট ছেঁড়া।চুলের কাটিং কেমন জানি।কিন্তু গতকাল দেখে মনে হলো উনি অন্যরকম।আর চুলের কাটিংটাও অন্যরকম ছিলো!
— “হাই।নাম কি?” প্রশ্ন নির্জনের।
নির্জনের ডাকে তিতলির ভাবনার সুঁতো কাটে।নির্জনের প্রশ্ন শুনে তিতলি বিস্ময়ের চরম পর্যায়ে!এক রাতে নামও ভুলে গেলো?ঢোক গিলে তিতলি বলে,
— “জ্বি!মুমতাহিনা তিতলি।”
মায়ের দিকে নির্জন তাকিয়ে বললো,
— “এই তিতলি? শাহেদ চাচ্চুর মেয়ে?’
— “হুম।ছোট মেয়ে।”
— “ওহ আচ্ছা!আচ্ছা!তো রেজাল্ট কি?”
তিতলি বললো,
— “জিপিএ ৫।”
আঞ্জুমান ছেলের দিকে সরু চোখে তাকান।ঠান্ডা স্বরে বলেন,
— ”রাত কয়টায় ফিরেছিস?গার্লফ্রেন্ডের সাথে এতো রাত অব্দি বাইরে থাকাটা কেমন না?বিয়েটা করে নিলেই পারিস।বয়স তো কম হয় নি।”
গার্লফ্রেন্ডের কথা শুনে তিতলির বড় বড় চোখ দুটি আরো বড় হয়ে যায়। ঈর্ষান্বিত অনুভূতি হয়।মনের বাঁক ফাঁকা ফাঁকা লাগে।কেনো এমন হয় সে জানেনা।শুধু নিশ্চুপ থাকে।
মিসেস আঞ্জুমানের পাশে ঘেঁষে বসে নির্জন।আহ্লাদ করে বলে,
— “আমি কি তোমাদের ছাড়া বিয়ে করতে পারি? রোহি আমি তো রেডি!তোমরা অভিভাবকরা বাকিটা দেখো।”
মৌনতা গাঁ জ্বালা হেসে বললো,
— “নিজের বিয়ের কথা বলতে লজ্জা করে না?”
নির্জন হাত বাড়িয়ে মৌনতার মাথায় গাট্টা দেয়।আর বললো,
— “না করেনি।দেখতেই তো পারছিস।”
মোহনা নির্জনকে ডাকলো,
— “ভাইয়া?”
— “কি?”
খোঁচা দিয়ে মোহনা বললো,
— “আগে বলতা পৃথিবীতে বা সমুদ্রে যত হিংস্র প্রাণী আছে তার মধ্যে সবচেয়ে বৃহত্তম প্রাণী হলো মেয়েরা। এখন সেই হিংস্র প্রাণীকেই বিয়ে করতে চাচ্ছো।ইচ্ছে করে ঘাড়ে টেনে আনছো কিন্তু!”
এবার সবাই হেসে কুটিকুটি হয়ে যায়।নির্জন তেড়ে আসে মোহনার দিকে।মোহনা দৌড়ে আলতাফ চৌধুরীর পিছনে লুকোয়।
টুনি নাস্তা নিয়ে আসে।আঞ্জুমান নির্জনকে বলেন খেয়ে নিতে।নির্জন টেবিলে গিয়ে বসে।তিতলি দু’বোনকে উদ্দেশ্য করে জিজ্ঞাসা করলো,
— “তোমরা কোন ক্লাসে পড়ো।”
মৌনতা বললো,
— “দুজনি অনার্স থার্ড ইয়ারে আছি।সাইন্স থেকে ইংলিশ নিয়ে পড়ছি।”
— “আমিও ইংলিশ নিয়ে পড়তে চাই।তবে আমি আর্টস।কোন ভার্সিটিতে পড়ো?”
— “শাহজালাল ইউনিভার্সিটি অফ সাইন্স এন্ড টেকনোলজি।” বললো মোহনা।
— “ওহ।আর ভাইয়া?”
— “ভাইয়াদের পড়া শেষ।দুজনই ডাক্তার।” হেসে বললো মৌনতা।
তিতলি অবাক স্বরে জিজ্ঞাস করলো,
— “ভাইয়াদের মানে?তোমাদের কয় ভাই আপু?”
মৌনতা দু’আঙ্গুল দেখিয়ে বললো,
— “দুইটা।”
জবাবে তিতলি হাসলো।ভাবে হয়তো আরেকটা ভাই আছে।দেখা হয়নি।কিন্তু বুঝতে পারেনি এই বাড়িতে আরো একজোড়া জমজ আছে।আর দুজনের সাথেই দেখা হয়েছে!
কথার মাঝে তিতলি আড়চোখে নির্জনের দিকে তাকায়।টুনির সাথে কথা বলতে বলতে খাচ্ছে। একসময় কথার ফাঁকে কোনো কারণে হাসে নির্জন। তিতলির নজরে পড়ে নির্জনের গাল।টোল পড়েনি! আপন মনে বিড়বিড় করে তিতলি,
— “আজব তো।গতকাল ভুল দেখলাম।নাকি আজ ভুল দেখছি।”
তিতলির হিঁচকি উঠে।মিসেস আঞ্জুমান দৌড়ে তিতলির কাছে এসে মাথায় হাত বুলান আর চেঁচিয়ে বলেন,
— “টুনি পানি নিয়ে আয় জলদি।”
পানি খেয়ে কিছুক্ষণের মধ্যে শান্ত হয় তিতলি।মিসেস আঞ্জুমান তিতলির মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে জিজ্ঞাসা করলো,
— ”কি এতো ভাবছিলা?হিঁচকি উঠে গেলো যে।”
তিতলি অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে।কেমনে বলবে আপনার ছেলেকে দেখে হিঁচকি উঠেছে!মিথ্যা বলতেও সময় লাগে তিতলির।
— “ফুফি আম্মা আমি রুমে যাই?” ঠান্ডা স্বরে বললো তিতলি।
— “খারাপ লাগছে মা? আচ্ছা যাও রেস্ট নাও।” আঞ্জুমানের আদুরে গলা।
_____________________________________________
দু’ঘন্টা পর তিতলি রুম থেকে বের হয়ে আসে।একা একা বিরক্ত হচ্ছিলো রুমে।বাসায় এতো কিউট জমজ দু’টো আপু থাকতে রুমে বসে থাকতে কার ভালো লাগে!এই বাসার ড্রয়িং আর ডাইনিং রুমটাই আপাতত চিনে তিতলি।দু’তলা থেকে নেমে সরাসরি ড্রয়িং রুমে আসে। মৌনতা তিতলিকে দেখে পাশে এনে বসায়।
মোহনা অপরাধী মুখ করে বললো,
— “আমাদের আজ ফ্রেন্ডের গায়ে হলুদে যেতেই হবে নয়তো তোমাকে একা ফেলে যেতামনা।আজ দিনটা একাই থাকো কেমন?তারপর ফিরে এসে জমিয়ে আড্ডা দেব।”
তিতলি হালকা হেসে বলে,
— ”যাও তোমরা।আন্টি আছেন না।একা কোথায়।”
মৌনতা গুণে গুণে বললো,
— “আন্টি না আরো তিন জন আছে। বাবা বাগানে,নির্জন ভাইয়া গার্লফ্রেন্ডের কাছে গেছে মনে হয়।আর বাসায় আম্মু,টুনি,হামিদ চাচা আর নিঝুম ভাইয়া আছে।”
— “হামিদ চাচা কে?”
— “আমাদের বাসায় কাজ করেন।কিন্তু আমরা আপন চাচার মতোই মনে করি।”
তিতলি জবাবে হাসে।মোহনা বললো,
— “আচ্ছা আমরা যাই।তুমি বাড়িটা ঘুরে দেখো।দু’তলার ডান দিকের কর্ণারের রুমটা নির্জন ভাইয়ার।আর বাম দিকে তিনটা রুমের একটা আমাদের দুজনের আর একটা খালি।অন্যটায় তো তুমিই।আর নিচ’তলায় আম্মু-আব্বুর রুম।টুনি,হামিদ চাচার রুম।আর গেস্ট রুম।আর নিঝুম ভাইয়ার রুম ছাদে।”
তিতলি হেসে বললো,
— “এতো রুম!আচ্ছা আপু দেখবো ঘুরে।”
মোহনা মৌনতাকে বললো, — “সবকিছু ব্যাগে গুছিয়ে রেখেছি।আলমারির ডান পাশের ড্রয়ারে পাবি।নিয়ে আয়।আমি গাড়ি বের করছি।”
তারপর তিতলিকে বললো,
—- “আসি।”
তিতলি হাত নাড়িয়ে বাই দেয়।মোহনাও দেয়।দু’বোন বের হয়ে যায়।তিতলি দু’তলায় উঠে আসে।নিজের রুমে ঢুকতে গিয়ে একটা টান অনুভব করে ছাদের দিকে।তিতলি ভাবে,
— “ছাদের রুমে তো আরেকটা ভাইয়া আছে!একটু দেখে আসবো?গেলে উনি কি ভাববেন?না থাক যাওয়ার দরকার নেই।”
কিন্তু মনটা বড় অস্থির, অবাধ্য হয়ে আছে গতকাল থেকে। কথা শুনে না।যা ইচ্ছে হয় তাই করার টান অঅনুভব করে ভীষণ, ভীষণভাবে!মনের সাথে তাল মিলিয়ে শরীরটাও অবাধ্যতা শুরু করেছে। ঢোক গিলে অবাধ্য মনের অবাধ্য আবদার পূরণ করতে ছাদের দিকে পা বাড়ায় তিতলি।সিঁড়ি ভেঙে ছাদে এসে মুগ্ধ হয়।এতো এতো ফুল গাছের টব।পাশে সুইমিংপুল আর অদ্ভুত সুন্দর একটা ঘর।ছোট বাড়ি বলা যায়।ছোট থেকেই ফুলের প্রতি খুব দূর্বলতা তিতলির।এতো ফুল গাছ থেকে যেনো নতুন প্রাণ পায়।একটা একটা করে ফুল গাছ দেখতে থাকে।সব ফুলের নাম সে জানে।গন্ধরাজ,রজনীগন্ধা, সূর্যমুখী, জিনিয়া,হাজারপুটিয়া, জবা,কামিনী, দোপাটি, জয়তী,অলকানন্দা, সিলোসিয়া, নয়নতারা সব সব আছে।তিতলির মনে হচ্ছে সে নিজের বাগানে আছে।ভাবতেও পারেনি এখানে এসে এতো ফুলের দেখা পাবে।
ধীর পায়ে ঘরটার দরজার সামনে এসে দাঁড়ায়।কাচের দরজা।দরজার দু’পাশে কংকাল। কংকালকে ঘিরে তিনটা ফুলের টব।আশ্চর্য তো!দরজায় হাত রেখে আপন মনে তিতলি ভাবে, টোকা দিবো?নাকি ধাক্কা দেবো?নাকি চলে যাবো?বিরক্ত হয় যদি।
চিন্তায় কপালে ভাঁজ তৈরি হয়।সাত-পাঁচ ভেবে সাহস নিয়ে হালকা আওয়াজ করে টোকা দেয় দরজায়।কোনো সাড়া-শব্দ নেই।আরেকটু জোরে টোকা দিতেই ভেতর থেকে কন্ঠস্বর ভেসে আসে,
— “ভেতরে আসো।ধাক্কা দিলেই খুলবে।”
প্রাপ্তবয়স্ক ভরাট কন্ঠ শুনে তিতলির বুক ধ্বক করে উঠে।এই কন্ঠটাই তো গতকাল বিকেলে শুনেছিল। আঠারো বয়সী উঠতি যুবতীর মনের বাঁকগুলো বেশ জটিল এবং ছন্নছাড়া। না পারে সইতে না পারে পালাতে।দৌড়ে পালাতে গিয়েও থেমে যায় তিতলি।কি যে হচ্ছে!এতো নার্ভাস তো জীবনেও হয়নি ।দরজায় হাত বাড়িয়ে দেয় ধাক্কা দেওয়ার জন্য।কপাল,নাক,গলা ঘামছে খুব!খুব বেশি!ঘেমে একাকার হয়ে যাচ্ছে।বার বার মনে হচ্ছে, ভেতরে যে ভাঙচুর শুরু হয়েছে তা এই ঘরে ঢুকলে আরো দ্বিগুণ বেড়ে যাবে।বা তার চেয়েও বেশি।তিতলি চোখ খিঁচে দরজা ধাক্কা দেয়। বুকের ভেতরে দুটি শব্দ বজ্রপাতের মতো জোরেশোরে যেন বলছে, সর্বনাশা অনুভূতি।
চলবে…..
®ইলমা বেহরোজ
প্রজাপতি আমরা দুজন
৩.
আস্তে করে দরজা ঠেলে তিতলি উঁকি দেয় রুমের ভেতর।প্রথমেই চোখের সামনে ভেসে উঠে মেহগনি উডেন ডাবল সাইড বেড।মানুষ কোথায়?চোখ ঘুরিয়ে ডান পাশে তাকাতেই সাদা এক জোড়া বল সোফা দেখতে পায়।সেখানে আধাশোয়া হয়ে আছে নিঝুম।থ্রী কোয়াটার প্যান্ট আর টি-শার্ট পরা।বুকের উপর ল্যাপটপ।মুখের এক পাশ দরজার দিকে।পুরো মুখ বোঝা যাচ্ছে না।তিতলি ঢোক গিলে ইতস্ততভাবে বলল,
— “ভাইয়া আসবো?”
নিঝুম মাথা ঘুরিয়ে তাকায়।তিতলিকে দেখে সোফা থেকে পা নামিয়ে হেসে বললো,
— “আরে তিতলি!ভেতরে আসো।”
তিতলি নিঝুমকে দেখে যতটা না অবাক হয় তার চেয়েও বেশি বিস্মিত হয় নিঝুমের গালে গর্ত হওয়া দেখে!মাথা চক্কর দিয়ে উঠে।এখানে তো আরেকটা ভাইয়ের থাকার কথা ছিল।আর মোহনা বললো,নির্জন ভাইয়া গার্লফ্রেন্ডের কাছে গেছে আর নিঝুম ভাইয়া রুমে।কিন্তু গার্লফ্রেন্ড তো এই ভাইয়ার আছে শুনছিল।তিতলি ভাবে,আমি ভুল শুনলাম নাকি মোহনা আপু বলতে চেয়েছিল নিঝুম ভাইয়া গার্লফ্রেন্ডের কাছে গেছে আর নির্জন ভাইয়া রুমে।দুই ভাইয়েরই হয়তো গার্লফ্রেন্ড আছে।
তিতলি কি হলো কে জানে, হিঁচকি উঠার আগেই দ্রুত হেঁটে এগিয়ে আসে।নিঝুমের সামনে থাকা গ্লাস থেকে ঢকঢক করে পানি খেয়ে প্রাণভরে শ্বাস নেয়।নিঝুম শান্তভাবে ব্যাপারটা খেয়াল করে।তার মধ্যে কোনো ভাবভঙ্গী নেই।নিঝুম যেনো সব কিছু শান্ত ভাবে নেওয়ার অসীম ক্ষমতা নিয়ে দুনিয়াতে এসেছে।
তিতলি যখন বুঝতে পারে সে অভদ্রতা করে ফেলেছে।নিজেকে মনে মনে প্রচুর গালি দেয়।এরপর মাথা নামিয়ে থেমে থেমে বললো,
— “স-রি ভা-ইয়া!”
নিঝুম হাসলো।বললো,
— “ইটস ওকে!বসো।” নিঝুম সোফা থেকে উঠে তিতলিকে বসতে বলে।
তিতলি উত্তেজিত হয়ে বললো,
— “না না ভাইয়া।কি করছেন? বসেন আপনি।”
— “তুমি আমার ঘরে অতিথি হয়ে এসেছো।এভাবে দাঁড়িয়ে আছো কেমন না ব্যাপারটা?আমি কিন্তু অতিথির ব্যাপারে খুব সিরিয়াস!”
— “সোফা তো দুটো।আপনি যেখানে ছিলেন সেখানেই বসেন।আমি পাশেরটাই বসছি।”
সোফায় বসতে বসতে বললো নিঝুম,
— “খুব জেদী তো তুমি!বসিয়েই ছাড়লে।”
চুল কানে গুঁজে উত্তরে হাসলো তিতলি।নিঝুম বললো,
— “তো কী মনে করে?’
তিতলি অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে নিঝুমের প্রশ্নে!বড় বড় চোখ করে তাকায়।কি বলবে এখন?এতো নার্ভাস ফিল হচ্ছে যে মিথ্যা কথাও সাজানো যাচ্ছেনা।তিতলি দু’তিনবার ঢোক গিলে।নিঝুম উৎসাহ নিয়ে তাকায়।প্রশ্ন করে,
— “তুমি সবসময় এতো ঢোক গিলো কেনো?ভয় পাচ্ছো আমাকে?”
তিতলি নিশ্চুপ। নিঝুমের দিকে তাকালেই চোখে চোখ পড়ছে। যতবার চোখ পড়ছে কথা হারিয়ে যাচ্ছে।কথাই যখন মজুদ নেই।কি বলবে সে?কি উত্তর দিবে?
তিতলিকে চুপ থাকতে দেখে নিঝুম মাথা নামিয়ে এক দফা নিঃশব্দে হেসে নেয়।এমন অদ্ভুত মেয়ে প্রথম দেখছে সে।দেখে মনে হয় সারাক্ষণ কোনো আতঙ্কে আছে।নিঝুমকে হাসতে দেখে তিতলির ঠোঁট দু’টো মৃদু হাসিতে মাতে।এই নিয়ে দু’বার দেখা হলেও সে নিঝুমের হাসি দেখে খুন হয়েছে বার বার।এইযে বার বার চশমাটা ঠিক করে এতেও ছন্দ খুঁজে পায় তিতলি।
তিতলি তখনো থ’ মেরে বসে আছে।নিঝুম অভিজ্ঞ চোখে তিতলির ভয়ার্ত মুখটা দেখে কিছু একটা ভাবে।এরপর বলে,
— “কিছু বলবেনা?আচ্ছা বসে থাকো। আমার রুম দেখো।আমি আমার কাজ করি।”
রুমের এক পাশের পুরো দেয়াল জুড়ে বুকশেলফ।নিঝুম বুকসেলফের সামনে এসে দাঁড়ায়।একবার ঘুরে তিতলিকে দেখে, মেয়েটা হাত চুলকাচ্ছে।উশখুস করছে।অল্প বয়সীদের মন কখন কি চায় নিজেও জানে না। ছন্নছাড়া।এই বয়সটা নিঝুম পার করে এসেছে।তাই আর এদিক তাকায়নি।বুকশেলফের উপরের কর্ণের বইগুলা অগোছালো। নিঝুম সেগুলো ঠিক করতে থাকে।
তিতলির নিজেকে ছোট মনে হতে থাকে।এভাবে চুপ থাকার কি কোনো মানে আছে? কি ভাবছেন উনি?কিন্তু মুখও তো খুলছেনা।জড়তা এসে ভর করেছে মুখে, শরীরে।মুখ নড়ছেনা, শরীরও চাইছেনা নিঝুমের রুম থেকে বের হয়ে যেতে।তাহলে কি একটা পর পুরুষের রুমে সারাক্ষণ বসে থাকা যাবে?কোনোভাবেই না।কিন্তু নিজের আত্মসম্মান বলে একটা কথা আছে।তিতলি সোফা থেকে উঠে দাঁড়ায়।নিঝুমকে ডাকে,
— “ভাইয়া?আমি তাহলে যাই।”
নিঝুম এগিয়ে এসে বলে,
— “এখুনি চলে যাবে?কেনো আসছিলে বললেই তো না।”
— “এমনি ভাইয়া।আপুরা বাড়ি নেই।ভালো লাগছিলোনা।তাই বাড়িটা ঘুরে দেখছিলাম।”
— “আচ্ছা।কিন্তু বসো।কিছু খেয়ে তো যাও।চা নাকি কফি”
— “না ভাইয়া।ওসব লাগবেনা।আপনার কষ্ট করে নিচ’তলায় যেতে হবেনা।আমার ইচ্ছে হলে গিয়ে খেয়ে নিবো।”
— “নিচ’তলায় কে যাবে?আর নিচ’তলার রান্নাঘর থেকে খাবে নাকি খাবেনা ওটা তোমার ব্যাপার।আমার রুমে আসছো।আমার বানানো কফি খেয়ে যাও।”
— “নিচ’তলায় না গেলে কফি কই থেকে আনবেন?”
নিঝুম হেসে বলে,
— “ম্যাজিক।বসো।আসছি।”
নিঝুম দেয়ালে ঝুলানো জর্জেট ডাবল পার্ট পর্দা দু’হাতে সরিয়ে হারিয়ে যায়।তিতলি এতক্ষণ এটাকে দেয়াল ভেবেছে।যখন নিঝুম পর্দা সরালো কাচের আরেকটা দরজা চোখে পড়ে।তিতলি রুমটা দেখতে থাকে চোখ ঘুরিয়ে।বেডের ডান পাশে ছোট রাউন্ড শেলফ।বাম পাশে কনসোল টেবিল।যার উপর মাটির টব।টবের ফুলটা জীবন্ত মনে হচ্ছে।প্রতিদিন হয়তো ফুল চেঞ্জ করা হয়।কি শৌখিন একটা মানুষ।এছাড়া রুমে আছে মেহগনি উডেন স্লাইডিং ডোর আলমারি, ফোল্ডিং হ্যাঙ্গার, শু র্যাক। সবকিছুই সুন্দর।রুম ভর্তি আসবাবপত্রে। তবুও রুমটা বড় মনে হচ্ছে।চারদিকে জর্জেট ডাবল পার্ট পর্দা।পর্দাগুলো মৃদু দুলছে।একটা ব্যলকনি চোখে পড়ে। আগ্রহ জমলেও সেদিকে যায় না।বিছানার উপর চোখ পড়ে।বিছানায় কালো একটা ডায়রি, খুব ছোট।কারো ব্যক্তিগত কিছু তিতলি কখনো ধরেনি।একবার ভুলে চোখ পড়লেও আরেকবার তাকায়না।কিন্তু এখন তীব্র ইচ্ছা হচ্ছে ডায়রীটা খুলে দেখতে।তিতলি হাত বাড়িয়ে আবার সরিয়ে নেয়।
নিঝুম কফি নিয়ে আসে।তিতলির হাতে দেয়।তিতলি প্রশ্ন করে,
— “রান্নাঘর আছে?”
— “হুম।”
— “আপনি রেঁধে খান কেনো?আলাদা থাকেন পরিবার থেকে?”
— “না একসাথেই।তবে আমার রুমে কেউ আসলে তাকে রেঁধে খাওয়াই।অতিথি আসলে তাকে বাড়ির অতিথি বলা হয়।আর আমার রুমে আসলে তাকে রুমের অতিথি হতে হয়।”
তিতলি হাসে।নিঝুম বলে,
— “আছোই তো।একদিন সারাদিনের জন্য এসো সময় করে।বিরিয়ানি রেঁধে খাওয়াবো।”
তিতলি উৎসাহ নিয়ে বলে,
— “বাবাহ,বিরিয়ানি রাঁধতেও জানেন!আর কি পারেন রাঁধতে?”
— “সবই পারি।মাছ কাটা ছাড়া!”
— “আচ্ছা আসবো একদিন সারাদিনের জন্য।”
— ”হুম এসো।”
তিতলি কফিতে চুমুক দিয়ে বুঝতে পারে স্বাদটা অসাধারণ।সে অনেকবারই কফি খেয়েছে তবে এটার আলাদা স্বাদ মনে হচ্ছে।তিতলি প্রশ্ন করার আগে নিঝুম প্রশ্ন করে,
— “কফির স্বাদটা কেমন তিতলি?অন্যরকম মনে হচ্ছে না?”
— ”জ্বি ভাইয়া।আর অসাধারণ!”
— “আমার এক ফ্রেন্ড কানাডা থাকে।ও পাঠিয়েছে আমার জন্য।আমার ফেভারিট খুব এটা।কয়েক মাস পর পরই পাঠায়।”
— “এজন্যই এতো ইউনিক একটা স্বাদ।ভালো লাগছে খুব।”
— “যখন ইচ্ছে হয় চলে এসো।কানাডার কফির স্বাদ নিতে।”
— “আচ্ছা ভাইয়া।”
তিতলি মনে মনে ভাবছে,ছেলে মানুষ এতো কিছু পারে।খাওয়ার প্রতি ঝোঁক আছে বোধহয়।এরিমধ্যে নিঝুম বললো,
— ”বুঝলে তিতলি, আমি খুবই পেটুক।তাই রান্নাটা শিখে নিয়েছি।বউ কখনো রাগ করে বাপের বাড়ি চলে গেলে বা রাগ করে না রাঁধলে যাতে নিজে রেঁধে খেতে পারি।”
তিতলি খিলখিল করে হেসে উঠলো।তাল মিলিয়ে নিঝুমও হাসে।তবে সে হাসির শব্দ নেই।অন্যদিকে তিতলির হাসি ঘর কাঁপানো।
— “আপনার রুমে অনেক বই দেখছি।সবই ডাক্তারি বই?”
— ”না! ডাক্তার হলে কি ডাক্তারি বইই থাকবে?বেশিরভাগই উপন্যাস।”
— “আমি খুব ভালবাসি উপন্যাস পড়তে।তবে সুযোগের অভাবে খুব কম পড়া হয়েছে ।”
— “কার কার উপন্যাস পড়া হয়েছে?”
— “হূমায়েন, জহির আর জাফর ইকবালের সব বই পড়া শেষ।”
— ”বাহ! অনেকেই তো পড়েছো।তোমার ভর্তি এক্সাম তো পরের সপ্তাহের শেষ দিকে। এক্সামের পর আমার শেলফ থেকে উপন্যাস নিয়ে পড়তে পারো।”
— “থ্যাংকস ভাইয়া।আমি অবশ্যই নিয়ে পড়বো।এতো বই দেখে রীতিমতো নেশা ধরে যাচ্ছে।”
নিঝুম হেসে বললো,
— ” বই পড়ুয়ারা এমনই। এরা অনেক বই একসাথে দেখলে আত্মহারা হয়ে পড়ে।”
কফি শেষ।তিতলি বিরক্ত হয় খুব।এতো জলদি শেষ হতে হলো!
না চাইতেও তিতলির বলতে হয়,
— “আজ আসি ভাইয়া।”
— “চলে যাবে? আচ্ছা যাও।”
তিতলি কফির মগটা সেন্টার টেবিলে রেখে উঠে দাঁড়ায়।নিঝুম হাতের ইশারায় থামতে বলে।তিতলি কৌতূহল নিয়ে দাঁড়ায়।তিন ইঞ্চি পিছনে দেয়াল।নিঝুম বিছানায় বসা ছিল।বিছানা থেকে নেমে তিতলির দিকে আসতে থাকে।তিতলি কথা বলতে নিলে নিঝুম আঙ্গুলের ইশারায় ‘শিসসসস’ বলে।তিতলি থতমত খেয়ে যায়।নিঝুমের চোখের দিকে তাকায়।নিঝুমের দৃষ্টি পেছনের দেয়ালে মনে হলো।তিতলি ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনে তাকাতে নিলে নিঝুম তিতলির মাথা দু’হাতে ধরে ইঙ্গিতে চুপ থাকতে বলে।এরপর তিতলির উপর দিয়ে নিঝুম সাবধানে দেয়ালে হাত বাড়ায় প্রজাপতিটা ধরতে।নিঝুমের বুকে তিতলির মাথা ঠেকে।এতোটা কাছে!তিতলির আবেগী মন নিতে পারেনি।অন্তরের গভীর অন্তরস্থল থেকে নিঃশ্বাস বেরিয়ে আসে।নিঝুম সরতেই তিতলি হন্তদন্ত হয়ে ‘আসি’ বলে ব্যস্ত পায়ে রুম থেকে বেরিয়ে পড়ে।নিঝুম আকস্মিক তিতলি চলে যাওয়াটা দেখে কিছু একটা ভাবে।এরপর আলমারি থেকে ক্যামেরা নিয়ে সুইমিংপুল আসে।প্রজাপতির সাথে সুইমিংপুলের ফটোগ্রাফি করার জন্য,বিগত কয়দিন ধরেই প্রজাপতি খুঁজছিল।
রুমে এসে দরজা লাগিয়ে ঝিম মেরে কতক্ষণ বসে থাকে তিতলি।বুকে যেনো হাতুড়ি পেটাচ্ছে কেউ।হৃদপিন্ড লাফাচ্ছে দ্রুত গতিতে।সে নিজেকে সামাল দিতে হিমশিম খাচ্ছে।হাঁপড়ের মতো উঠা-নামা করছে বুক।ঠোঁট শুকিয়ে কাঠ।দরজায় কড়াঘাত করে টুনি।তিতলি ঢোক গিলে দরজা খুলে।টুনি বলে,
— “খালাম্মায় ডাকে।”
— “আসছি।”
টুনি চলে যেতে চাইলে তিতলি ডাকে,
— “শুনো?”
— “জ্বে?”
তিতলি চোখের দৃষ্টি অস্থির রেখে প্রশ্ন করে,
— “সকালে যে দেখা হলো একটা ভাইয়ার সাথে। ওই যে ড্রয়িংরুমে।নাম কি উনার?”
টুনি সরু চোখে তাকায়।এরপর কাঠ কাঠ গলায় প্রশ্ন করে,
— ” ক্যান কিতা করবাইন?”
তিতলি ভয় পেয়ে যায়।এভাবে একটা প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষের নাম জানার জন্য প্রশ্ন করা কি ঠিক হলো? টুনি খারাপ কিছু ভাবছে না তো।তিতলি আমতা আমতা করে বলে,
— “এমনি।”
— “নির্জন ভাইজান আছিলো।”
তিতলি জোরপূর্বক হেসে ধন্যবাদ জানায়।টুনি চলে যায়।তিতলি দ্রুত দরজা লাগিয়ে সানজুকে কল করে।তাঁর কলেজ ফ্রেন্ড।
দু’বার কলের সময় ওপাশ থেকে সানজুর গলা পাওয়া যায়,
— “হ্যালো, তিতলি?’
— “হুম আমি।কেমন আছিস?”
— “ভালো না।তোদের খুব মিস করি।সবাই কেমন আলাদা হয়ে গেছি।”
— “আমিও রে।”
— “কই আছিস এখন?”
— “সিলেট আছি।তোদের বলছিলামনা সিলেট আমার এক ফুফি আছে? উনার কাছে।”
— “ওইখানেই ভর্তি হবি?”
— “হুম,আচ্ছা শোন?”
— “ইম্পোরটেন্ট কিছু বলবি মনে হচ্ছে।”
তিতলির কণ্ঠনালি স্তব্ধ হয়ে যায়।লজ্জায় গাল হয় লাল। খ্যাক করে গলা পরিষ্কার করে। সাহস নিয়ে চোখ বুজে প্রশ্ন করে,
— “প্রথম দেখাতে কারো প্রেমে পড়া যায় দোস্ত?”
ওপাশ থেকে বিকট চিৎকার ভেসে আসে,
— “তুইইইই প্রেমে পড়েছিসস!! ইয়া আল্লাহ।”
তিতলি দ্রুত ফোন কানের চেয়ে দূরত্বে নেয়।এরপর ধমকে বলে,
— “কান ফাটিয়ে দিছিস তো।”
সানজু ফিক করে হেসে দেয়। এরপর বলে,
— “অবশ্যই হয়।কান্দিপাড়ার মিলি আপুরে প্রথম দেখাতেই না আজম ভাই প্রেমে পড়ছিল।এরপরদিনই বিয়ের প্রপোজাল।বিয়েডাও হয়ে গেলো।”
তিতলি নখ কামড়ে ছোট করে বলে,
— “ওহ।”
— “দোস্ত আমার তোরে সামনে থেকে দেখতে ইচ্ছে হচ্ছে।তুই কোন সৌভাগ্যবানের প্রেমে পড়ছস!আল্লাহ!আমার খুশিতে দম ফেটে যাচ্ছে।”
সানজু হেসেই চলেছে।তিতলি বলে,
— “ফাজিল ফোন রাখ।”
— “এই না,না। নামটা তো বল? আর পিক সেন্ড কর মেসেঞ্জারে প্লীজ!”
— “পিক নাই।নাম নির্জন।ডাক্তার নির্জন।”
চলবে……
@ইলমা বেহরোজ
প্রজাপতি আমরা দুজন
৪.
দু’দিন পর ভর্তি এক্সাম অথচ তিতলির মন বসে না পড়ায়।এমনটা কখনো হয়নি।জ্বর,মাথা ব্যাথাসহ কত রকম রোগে ভুগেছে। কিন্তু কখনো পড়া থেকে মন উঠেনি।প্রেম রোগ বোধহয় এমনই।মনটা চুরি হয়েই গেলো।ডাক্তার মানুষকে সুস্থ করে আর এই ডাক্তার অসুস্থ বানিয়ে দিলো!তিতলি রুমে অনেক্ষণ পায়চারি করে।মনে হাজারটা ভাবনা।উসখুস লাগছে।মানুষটাকে দেখতে ইচ্ছে হচ্ছে খুব!সাংঘাতিক অস্বস্তি মনে,শরীরে।মাথার কাপড়টা টেনে রুম থেকে বের হয় তিতলি।সিঁড়ি তিনটা উঠে আর এগোয়নি।বেশ খানিকক্ষণ ছাদের দরজার দিকে তাকিয়ে থাকে।এরপর নেমে আসে।হালকা হলুদ আলোয় পুরো বাড়িটাকে রহস্যময় মনে হচ্ছে।সবার ঘরের দরজা বন্ধ।রাত একটা বাজে, হয়তো ঘুমাচ্ছে সবাই।শুধু তিতলির ঘুমটাই হারাম হয়ে গেলো।
— “তিতলি নাকি?”
মৌনতার ডাক শুনে কেঁপে উঠে তিতলি।ফিরে তাকায়।মৌনতাকে দেখে মৃদু হাসে।তবে চিনতে পারেনি এটা মোহনা নাকি মৌনতা। তাই শুধু আপু বলে সম্বোধন করে।
— “হ্যাঁ আপু আমি।ঘুম আসছিলো না তাই হাঁটছিলাম।”
— “তুমি তো ১০ টায় ডিনার করে রুমে আসছিলে।তিন ঘন্টা শুয়ে থেকেও ঘুমে ধরেনি!আল্লাহ!”
— “না আপু।আসলে দু’দিন পর এক্সামতো।পড়ছিলাম।”
— “বাব্বাহ!একদম আমার ভাইদের মতো দেখি।শুধু পড়া আর পড়া।’
উত্তরে তিতলি হাসলো সাথে মৌনতাও।
— “আচ্ছা, যাও ঘুমাও।গুড নাইট।”
— “গুড নাইট।”
তিতলি রুমে এসে বিছানায় শুয়ে চোখ বন্ধ করে।চোখের পর্দায় ভেসে উঠে নিঝুমের হাসি।সে চট করে চোখ খুলে।স্বস্তি পাচ্ছেনা একটুও।প্রেমে শান্তি থাকলেও স্বস্তি নেই! এ যেনো এক টক-জ্বাল-মিষ্টির মিশ্রণে তৈরি অনুভূতি।একটা বালিশ বুকে জড়িয়ে তিতলি আবার চোখ বুজে।দুপুরে যতক্ষণ নিঝুমের রুমে ছিল তার প্রতিটা সেকেন্ড আবার রিপিট করে কল্পনায় টেনে আনে।তিতলির মুখে লাজুকতা।সে ছোট থেকেই প্রচণ্ড লাজুক।প্রেমে পড়ে যেনো লাজুকতা দ্বিগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে।সারাক্ষন মুখে ফুটে থাকে লজ্জা।লজ্জাবতীরা যখন প্রেমে পড়ে তখন খুব বেশিই মুগ্ধকর দেখায়। তিতলির বেলায় তার ব্যাতিক্রম হচ্ছেনা।
__________________________________________________
সকাল।তিতলিকে নিচে নামতে দেখে আঞ্জুমান হাত বাড়িয়ে খাবার টেবিলে ডাকেন।
— “তিতলি আসো।”
তিতলি অনেকটা অবাক হওয়ার ভান করে বললো,
— “ফুফি আম্মা আপুরা, ভাইয়ারা কই?এখনও উঠেনি?”
— “কয়টা বাজে দেখেছো ?৯টা ২০ বাজে। এখন কি ওরা বাসায় থাকবে ?”
— “ইয়া আল্লাহ! এতো বেলা!”
— “সকালে ডাকতে নিছিলাম তোমাকে কিন্তু মৌন বলল অনেক রাত অব্দি পড়ছো।তাই আর ডাকিনি।”
— ”সরি ফুফি আম্মা এতো বেলা হয়ে গেল….”
মিসেস আঞ্জুমান বাধা দিয়ে বললো,
— “এসবের জন্য সরি বলতে হবেনা।”
— “আপুরা ভার্সিটিতে?আর ভাইয়ারা হসপিটালে না?”
— “হুম সবাই বাইরে।নিঝুম এখনো বের হয়নি।রেডি হতে গেছে।চলে যাবে এখনি।এতো কথা না বলে জলদি খাও।অনেক বেলা হইছে।শরীর খারাপ করবে।”
— ” আন্টি একটা কথা বলি?”
— “হুম বলো।”
— “আপনি আমাকে তুমি করে না বলে তুই বলতে পারেন।ভালো লাগবে অনেক।”
মিসেস আঞ্জুমানের খুশিতে গদগদ হয়ে বলেন,
— “আমারো তুমি তুমি বলতে কেমন লাগছিলো রে মা।বাঁচালি!কি সুন্দর করে ফুফি আম্মা ডাকিস। আর আমাকে তুমি করে সম্বোধন করতে হয়।ভালো লাগছিল না।”
উত্তরে তিতলি মিষ্টি হাসলো।বললো,
— “বাবা বলেছে আপনাকে ফুফি আম্মা ডাকতে।”
— “তাই।কিন্তু মাঝে মাঝে তো আন্টি ডাকতেছিস।”
তিতলি অপরাধীর মতো হেসে বলে,
— “আসলে সবাইকে আন্টি ডাকি তো তাই।চলে আসে মুখে অটোমেটিক। ”
— “কয়দিন ডাকলেই অভ্যাস হয়ে যাবে।”
কিছুক্ষণ পর নিঝুম নেমে আসে।আঞ্জুমান রান্নাঘর থেকে হাত মুছে ছেলেকে আদর করতে এগিয়ে আসেন।তিতলি নিঝুমটা যে কে এখনো দেখেনি তাই পিছনে ফিরে দেখার জন্য।নিঝুমকে দেখে তিতলি বিস্ফোরিত হয়।মাথা ঘুরিয়ে নেয়।চোখ মার্বেলের মতো গোল হয়ে যায়।এখুনি চোখ কোটর থেকে বেরিয়ে আসবে এমন অবস্থা।সে বিড়বিড় করে,
— “নিঝুম এটা?তাহলে নির্জন কে? কারে দেখলাম? নির্জন কে? আর নিঝুমই কে?”
হিঁচকি উঠার আগে সামনে রাখা পানি খেয়ে ঢোক গিলে তিতলি।নিজেকে সামলায়।নিজের সাথে নিজে কথা বলে,
— “তিতলি এতো উত্তেজিত হোস না।ফুফি আম্মাকে জিজ্ঞাসা করে তোর প্রশ্নের উত্তর বের করে দেব।শান্ত হ,কুল কুল!”
তিতলি আবার ঘুরে তাকায়।নিঝুম হাসছে গালে টোল!খাবার রেখে এক হাতে মাথা ভর দিয়ে নিষ্পলকভাবে নিঝুমের দিকে তাকিয়ে থাকে সে।ঠোঁটে তার ভালবাসার হাসি।চোখের দৃষ্টিতে নিঝুমের জন্য অজস্র ভালবাসা।
জিন্সের সাথে ইন করা ব্ল্যাক শার্ট,হাতে এপ্রোন।বডি সুগঠিত,সবল।চুল গুলো ছোট তবে খাড়া খাড়া।চোখে চশমা।গোল ফ্রেমের।তিতলি বেহায়ার মতো হা করে তাকিয়ে থাকে।এক সেকেন্ডের জন্যও চোখের পলক পড়েনা।ফলে, চোখ ঝাপসা হয়ে আসে।
— “তিতলি?”
আঞ্জুমানের ডাকে তিতলি হকচকিয়ে উঠে।হুঁশ আসে।খেয়াল করে নিঝুম নেই।আঞ্জুমান আবারো প্রশ্ন করেন,
— “তিতলি শরীর খারাপ?”
— ” ভাবছি।”
— “কি ভাবছিস?”
তিতলি খ্যাঁক করে গলা পরিষ্কার করে টান টান হয়ে বসে।এরপর বললো,
— “গতকাল বললেন উনার নাম নির্জন আজ বলছেন নিঝুম।কিন্তু শুনছি আপনার দু’ছেলের নাম নিঝুম আর নির্জন।আমার নিজেরে পাগল পাগল মনে হচ্ছে ফুফি আম্মা।”
কথার মাঝে সেখানে টুনি উপস্থিত হয়।মিসেস আঞ্জুমান আর টুনি একসাথে হেসে উঠে।তিতলি নির্লিপ্ত ভাবে তাকিয়ে থাকে।প্রশ্ন জাগে মনে, এরা হাসছে কেনো?হাসার মতো কি বললো? টুনি টেবিল মুছতে মুছতে বলে,
— “আফামণি হেগোরাও জমজ!”
তিতলির চোখগুলো আরো বড় আকার ধারণ করে।কন্ঠে আকাশচুম্বী বিস্ময়তা নিয়ে প্রশ্ন করে,
— “মানে?”
— “নিঝুম ভাইজান আর নির্জন ভাইজান জমজ।”
তিতলির দু’ঠোঁট নিজেদের শক্তিতে আলাদা হয়ে যায়।আঞ্জুমান হাসেন।তিতলির হিঁচকি উঠে।আঞ্জুমান হাসি থামিয়ে পানি এগিয়ে দেন।তিতলি পানি খেয়ে শান্ত হয়।অনেকটা জোরেই হাঁফ ছেড়ে বললো,
— “এ কি জমজের কারখানায় এসেছি!যেদিকে তাকাই সব দুটো।”
আঞ্জুমান, টুনি আবারো হাসে।তিতলি সামনে দাঁড়িয়ে থাকা দুজনের দিকে তাকিয়ে বলে,
— “এখানে কি ফুফি আম্মাও দুইটা আছে? টুনিও কি দুইটা?
টুনি হা হয়ে ভ্রু-জোড়া কুঁচকে ফেলে।আঞ্জুমানকে বলে,
— “খালাম্মা, আফারে ভূতে ধরছে।দেখেন কেমনে তাকাইছে।”
— “তোর সবকিছুতে ভূত না টানলে হয় না?”
— “শরি খালাম্মা।”
— “শরি না সরি হবে।না মা, আর জমজ নেই এখানে।খাওয়া শেষ করে রুমে গিয়ে বিশ্রাম নাও।আর আমার ছেলে মেয়েরা জমজ।মেয়েগুলার মধ্যে যার চুল লম্বা সে মৌনতা আরেকজন মোহনা।আর ছেলেদের মধ্যে যার গালে টোল পড়ে,দেখতে স্বাস্থ্যবান,আর ঠান্ডা স্বভাবের তার নাম নিঝুম আর ফাজিলটা নির্জন।মনে থাকবে?”
তিতলি বাধ্যর মতো মাথা ঝাঁকায়।টুনি ফোড়ন কাটে,
— “খালাম্মা নিঝুম ভাই প্রাকৃতিক বটকা না হে তো বিয়াম কইরা বটকা হইছে।”
— ” কি ভাষা!বটকা কি?ওর কি ভূরি আছে?যে বটকা বলবি!”
টুনি মাথা নামিয়ে বলে,
— “শরি। ”
— “বটকা যদি আরেকদিন শুনি তোর চাকরি ক্যান্সেল।” মিসেস আঞ্জুমান হনহন করে রুমে চলে যান।টুনি মুখ বাঁকিয়ে ব্যঙ্গ করে বলে,
— “মাইনষের বাড়িত বান্দিগিরি করি এইডা নাকি চাকরি!”
__________________________________________________
তিতলি রুমে এসেই সানজুকে কল করে।সানজুকে মনের সব কথা না বললে শান্তি লাগে না।সানজু কল রিসিভ করতেই তিতলি বলে,
— “সানজু মিস্টেক হয়ে গেছে একটা?”
— “মারাত্মক কিছু?”
— “তেমন না।”
— “তো?”
— “উনার নাম নির্জন না নিঝুম।”
সানজু সেকেন্ড কয়েক থ মেরে বসে থাকে।এরপর হো হো করে হেসে উঠে।তিতলির মেজাজ খিঁচড়ে গেল।হাসতে হাসতে সানজু বললো,
— “যার প্রেমে পড়লি তার নাম কেমনে ভুল বললি!”
কথা শেষ করে সানজু আবার হাসে।তিতলির প্রচন্ড রাগ উঠে।
— “আমি কেমনে জানবো।নিঝুম, নির্জন জমজ দুই ভাই।দুজনেই দেখতে একরকম।”
— “কিহ?একরকম দেখতে!কার প্রেমে পড়েছিস জানিস তো?”
— “হ জানি।উনার গালে টোল পড়ে।”
— “তাহলে টোলই প্রেমের কারণ?”
— “কি জানি।”
— “এই আমি না ভাবছি ভুলে ভুলে বাসর ঘরে যদি আরেকটা ভাই ঢুকে পড়ে তো তুইতো ওইটার সাথে বাসর করে ফেলবি!কি সাংঘাতিক দোস্ত!”
— “ছিঃ তোর এই ফিউচার গণনা আমার ভাল্লাগেনা।”
— “আচ্ছা মা মাফ কর।সরি আমি!”
— “ঢং।”
— “প্রপোজ করবি কবে?”
— “খাইয়া আমার আর কাম নাই?জীবনে বলবনা।
মাত্র দু’দিন হলো আসছি।”
— “তাইলে যখন অন্য মেয়ে চুরি করে নিয়া যাবে তখন বুঝবি।”
— “এতোদিনে হয়তো নিয়েও নিছে।”
— “এসব ভেবেও ভালবাসতে গেলি?এক পাক্ষিক ভালবেসে যাবি নাকি?”
তিতলি কন্ঠে অসহায়ত্ব নিয়ে বলে,
— “নির্জন ভাইয়া প্রেম করে গতকাল শুনছি।নিঝুম ভাইয়াকে নির্জন ভাবতাম।মানে ভাবতাম নিঝুম ভাই প্রেম করে।তবুও তো মনকে আটকাতে পারিনি।”
— “মরবি তুই মরবি!”
তিতলি লম্বা করে দীর্ঘশ্বাস ফেলে!
_________________________________________________
দুপুরের নামাযের পর ড্রয়িং রুমে বসে সবাই। নিঝুম, নির্জনের জন্য অপেক্ষা করে।তারা আসলে একসাথে দুপুরের খাবার খাবে। মোহনা তিতলিকে প্রশ্ন করে,
— “তিতলি গান গাইতে পারো?”
তিতলি বিনয়ের সাথে বলে,
— “একটু আধটু পারি।”
মৌনতা উচ্ছাসিত কন্ঠে বললো,
— “সিরিয়েসলি!আমার লাইভ গান শুনতে এতো ভালো লাগে। প্লীজ একটা গাও।”
তিতলি একবার নাচক করলেও পরে রাজি হয়ে যায়।মৌসুমি ভৌমিকের সেদিন গানটির সুর তুলে।মুগ্ধ হয়ে উপস্থিত সবাই শুনে।তিতলির অনেক প্রশংসা করে।তখন আগমন ঘটে নিঝুম-নির্জনের।টুনি বলে উঠে,
— “ভাইজানরা আইয়া পড়ছে।”
বাকিরা মেইন ডোরের দিকে তাকায়।এক জোড়া একরকম মানুষ দাঁড়িয়ে আছে।তবে কেন জানি এখন নিঝুমকে চিনতে একটুও অসুবিধে হচ্ছেনা তিতলির।নিঝুমের চোখের দিকে তাকায় সে।চোখাচোখি হয় দুজনের।তিতলির ভেতরটা শিরশির করে কেঁপে উঠে।মানুষটার দৃষ্টিতে সাংঘাতিক কিছু আছে!লজ্জায় চোখ সরিয়ে নেয়।নিঝুম – নির্জন হালকা পাতলা কথা বলে পা বাড়ায় উপরে যেতে।আঞ্জুমান রান্নাঘরে ঢুকেন।মৌনতা তিতলির কাছে আবদার করে রোমান্টিক একটা গান গাইতে।বলার সাথে সাথে তিতলি সুর তুলে।
” তুমি আমার এমনি একজন
যারে এক জনমে ভালোবেসে
ভরবে না এ মন
এক জনমের ভালোবাসা
এক জনমের কাছে আসা
একটু চোখের পলক পড়তে
লাগে যতক্ষণ….. ”
গানের সুর গলায় চোখের দৃষ্টি নিঝুমে।নিঝুম এক পা এক পা করে সিঁড়ির প্রতিটি ধাপ পার হচ্ছে তা তিতলির কাছে গানের সুরের মতো মনে হচ্ছে।এইযে, এখুনি হাতের ঘড়ি টা খুললো তাতেও ছন্দের গতি।নিঝুম হুট করে সিঁড়িতে থমকে দাঁড়ায়।মনে হচ্ছে কেউ একজন তাকিয়ে আছে তার দিকে।গভীর দৃষ্টি নিয়ে।পিছন ফিরে তাকায়।সাথে সাথে তিতলি চোখ সরিয়ে ফেলে।সারা মুখে ছড়িয়ে পড়ে লজ্জার আভা।তখন কন্ঠে লাইন দু’টি –
” ভালবাসা সাগর তুমি
বুকে অথৈ জল ”
চলবে……
®ইলমা বেহরোজ