প্রজাপতি আমরা দুজন পর্ব-৫,৬,৭

৫+৬+৭
প্রজাপতি আমরা দুজন
৫.
তিতলির বুকে হাতুড়ি পেটা বেড়ে চলেছে।এইটুকু পথ যেনো শেষই হচ্ছেনা।নিঝুমের রুমে দ্বিতীয়বারের মতো যাচ্ছে।গত শনিবার দুপুরের পর থেকে নিঝুমকে আর দেখেনি তিতলি।আজ সোমবার।এক্সাম দিয়ে এসে ঘুমিয়েছে।ঘুম থেকে উঠেছে বিকেলে।এমন সময়ে নিঝুম নিজ ঘরে ব্যাস্ত থাকে।তিতলির চোখ দুটো উদগ্রীব হয়ে আছে নিঝুমকে দেখতে। তাই আর দেরি না করে নিঝুমের কাছে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হয়।মনে মনে নিজেকে প্রবল সাহস দেয়।নার্ভাস হওয়া চলবেনা কিছুতেই।দরজা খোলা ছিল।তিতলি হালকা করে দরজায় টোকা দিয়ে বললো,
— “ভাইয়া, আসতে পারি?”
নিঝুম চোখ তুলে তাকায়।ঠোঁটে হাসি ফুটিয়ে বললো,
— “হুম আসো।”
— “বসবো ভাইয়া?”
— “এটাও জিজ্ঞাসা করতে হয়?বসো।”
তিতলি সোফায় বসে।নিঝুমের দিকে তাকায়।নিঝুম ডায়রীতে কিছু লিখছে।তার উপর কোনো আগ্রহই নেই দেখছি।তিতলির মন খারাপ হয় খুব।পরক্ষণে নিজেকে সামলে নিয়ে স্পষ্ট করে বললো,
— “আমি এসে কি বিরক্ত করেছি ভাইয়া?”
— “না।আমি কি বলেছি? ‘
নিঝুম উত্তর আর প্রশ্ন ডায়রীতে তাকিয়েই দিলো।তিতলি অপমানে কটমট করে তাকায়।এরপর এক হাত গালে রেখে ভাবে,
— “এতো অবহেলার কি দরকার? আমার উপর কি নজর পড়েনা আপনার? আমি কি এতোটাই খারাপ দেখতে?এতোটাই কুৎসিত।”
মুখে বিনয়ীর সাথে বলে,
— “আমার তো এক্সাম শেষ।আপনার কাছ থেকে একটা বই নিতে আসছিলাম”
নিঝুম লিখাতে মগ্ন থেকেই জবাব দেয়,
— “নিয়ে নাও যেটা ইচ্ছা।”
তিতলির রাগ উঠে।কিন্তু তা প্রকাশ করেনা।তার ইচ্ছে হচ্ছে নিঝুমের চোখ থেকে চশমাটা খুলে চুরমার করে ভেঙ্গে দিতে।আর….আর ডায়রীটা টেনে নিয়ে কুচি কুচি করে ছিঁড়ে ফেলতে।কিন্তু সে অধিকার তাঁর নেই।আর এরকম বেয়াদবি মনে আসলেও কখনো সে করে না।সে ভেতরে ভেতরে রাগে ফেটে গেলেও উপরে খুব ঠান্ডা ভাব নিয়ে বুকসেলফের দিকে যায়।একটার পর একটা উপন্যাস দেখতে থাকে।একটা ইংলিশ উপন্যাসে চোখ আটকে যায়। নাম ফিফটি শেইডস অফ গ্রে।বইটা হাতে নিয়ে সোফায় এসে বসে।নিঝুম জিজ্ঞাসা করে,
— “কোনটা নিলে?”
তিতলির বই খুলে জবাব দেয়,
— “ফিফটি শেইডস অফ গ্রে।”
নিঝুম ডায়রী বন্ধ করে।চমকে তাকায় তিতলির দিকে।বলে,
— “বইটা দাও!এটা পড়তে হবেনা।”
— “কেনো ভাইয়া?আমার তো এটাই পড়তে ইচ্ছে হচ্ছে।”
নিঝুম বিছানা থেকে নেমে বলে,
— “এটা বড়দের বই।দাও।’
তিতলি অবাক হয়ে তাকায়।বলে,
— “আমিতো বড়ই।আঠারো বছর।বিয়ের বয়স।”
— “আরো বড় হয়ে পইড়ো।এখন দিয়ে দাও।”
— “না দেবনা।”
— “জেদ করোনা দাও।”
— “আপনি জানেন আমি…আমি বড়দের অনেক উপন্যাস পড়েছি।ইংলিশ উপন্যাস।”
— “তুমি কিনে পড়িও।কিন্তু আমার কাছ থেকে বড়দের বই পড়তে পারবেনা।”
— “কেনো?”
— “বুঝবেনা।দাও বইটা।”
তিতলি নিঝুমের সাথে তাল মিলিয়ে নাছোড়বান্দা গলায় বলে,
— “দেব না।”
— “বইটা দিয়ে দাও।যা চাইবে দেব।”
তিতলি সুযোগটা হাত ছাড়া করতে পারেনি।মুহূর্তে দ্বিগুণ সাহস বেড়ে গেছে।যেকোনো মূল্যে নিঝুমকে পাশে পাশে চাই তার।তিতলি নিঝুমের চোখে চোখ রেখে মৃদু হেসে বলে,
— “সত্যি দেবেন?”
— “হুম দেব।বই দাও।”
— “আমাকে চা বাগান দেখাতে নিয়ে যাবেন?প্লীজজজ।”
নিঝুম তিতলির হাত থেকে চট করে বইটা কেড়ে নেয়।এরপর হেসে বললো,
— “তুমি আসলেই একটা বাচ্চা।এভাবে জব্দ করে বাচ্চারাই আবদার করে।আচ্ছা কাল দুপুরে হস্পিটাল থেকে এসে নিয়ে যাবো।”
নিঝুম বইটা জায়গা রেখে বলে,
— “কি খাবে?অবশ্যই কফি?’
— “হুম।”
— “অন্য বই খুঁজে নাও।আসছি।”
তিতলি মাথা ঝাঁকায়।নিঝুম চলে যেতেই শেলফের দিকে আসে।বাবলি নামের একটা বই বেছে নেয়।বইটা নিয়ে ব্যালকনিতে আসে।ভয়ংকর সুন্দর ব্যালকনি।লতা-পাতার টব ঝুলানো।দু’ কর্ণারে বেতের বল সোফা।মাঝে সেন্টার টেবিল সেটাও বেতের।বিকেলের স্নিগ্ধ বাতাস সাঁ সাঁ করে আসছে।টবের পাতা মৃদু দুলছে।সেই সাথে তিতলির চুল।ডান পাশের সোফায় বসে তিতলি বই খুলে।তখন নিঝুম আসে।তিতলির দিকে কফি এগিয়ে দিয়ে বলে,
— “তুমি এখানে আর আমি রুমে এসে ভাবি মেয়েটা গেলো কই।”
তিতলি নিঝুম একসাথে হাসলো।নিঝুম নিজের কফিতে এক চুমুক দিয়ে জিজ্ঞাসা করে,
— “এখন কোন বইটা নিলে?”
— “বাবলি।”
নিঝুম চুলে হাত বুলিয়ে ঠোঁট কামড়ে হালকা হাসে। আর বললো,
— “শুধু লাভ স্টোরি পড়তে ইচ্ছে করে কেনো?”
— “এটা প্রেমের গল্প জানতামনা।”
— “এখন তো জানলে।বইটা রেখে কাঁটাসিরিজ বা মিসির আলী এনে পড়ো।”
তিতলির বলতে দ্বিধা লাগলেও সাহস নিয়ে প্রশ্ন করে,
— “প্রেমের গল্পতে এতো অনীহা কেনো আপনার?”
— “একসময় তোমারও ভালো লাগবেনা। কম বয়সে আমারো অনেক ভালো লাগতো। এখন আর ইন্টারেস্ট পাইনা।”
— “মানে?অল্প বয়সে পড়েছেন।আমারো তো অল্প বয়স।তাহলে আমি পড়ি।”
নিঝুম হেসে উত্তর দেয়,
— “আচ্ছা পড়ো।”
— “কই যাচ্ছেন?”
— “রুমে যাই।তুমি পড়ো।”
— “আমার একা থাকতে ভালো লাগেনা।দু’কর্ণারে তো দুটো সোফা।আপনি ওই কর্ণারে এসে বসেন। আর আপনার কাজ করেন।আমি উপন্যাস পড়ি।”
নিঝুম বাইরের পরিবেশ দেখে বলে,
— “আজকের দিনটা সুন্দর।এখানে বসে কবিতা লিখলে ভালোই লাগবে।আচ্ছা আসছি।”
নিঝুম কবিতা লিখে শুনে তিতলি মুগ্ধ হয়ে থ মেরে থাকে।নিঝুম আসতেই বইয়ে নজর দেয়।নিঝুম তিতলির উদ্দেশ্যে বললো,
— “বইটা রুমে নিয়ে পড়িও।আমার সামনে পড়তে তোমারই অস্বস্তি হবে।লজ্জা পাবে।”
— “আপনার কোনো কথা শুনছিনা।আমি এখানেই পড়বো।’
নিঝুম বুঝে যায় তিতলি আর কথা শুনবেনা।মেয়েটা লাজুক হলে ঘাড়ত্যাড়া।অনেক্ষণ পার হয়ে যায়।বইটা আর পড়তে পারছেনা তিতলি।দু’টি প্রধান চরিত্রের খোলামেলা অনুভূতি বইটায়।তিতলি আড়চোখে নিঝুমের দিকে তাকায়।নিঝুম মনোযোগ সহকারে লিখছে।তিতলির গাল লাল টুকটুকে হয়ে আসে।কান দিয়ে যেন ধোঁয়া বের হচ্ছে।কানের লতি গরম হয়ে আসে।শরীরটাও অবশ মনে হচ্ছে লজ্জায়।বইটা চট করে বন্ধ করে দেয়।এতোটা লজ্জা হয়তো পেতোনা যদি নিঝুম পাশে না থাকতো।আবার নিঝুম শুরুতেই না করেছিল বইটা পড়তে।নিঝুম তিতলির দিকে না তাকালেও বুঝতে পারে তিতলি অনেকটা পড়ে ফেলছে এবং লজ্জা পাচ্ছে।এখন সে তাকালে তিতলি হার্ট এ্যটাক করতে পারে।তবুও নিঝুমের মাথায় দুষ্টুমি আসে।ইচ্ছে হয় একবার তাকিয়ে দেখি কি হয়।নিঝুম তাকায় তিতলি চোখ সরিয়ে নেয়।সে কি করবে বুঝে উঠতে পারছেনা।লজ্জাটা স্পষ্ট হয়ে গেছে চোখে,মুখে।লুকানো আর সম্ভব না।মেরুদণ্ড সোজা রেখে দাঁড়িয়ে পড়ে।নিঝুম ইনোসেন্ট ভাব নিয়ে প্রশ্ন করে,
— “কি হলো তিতলি?”
তিতলি ঢোক গিলে।দৃষ্টি অস্থির রেখে জবাব দেয়,
— “ফুফি আম্মা ডাকছিলেন।ভুলেই গিয়েছি।আসি…আমি আসি।”
কথা শেষ করেই দ্রুত পায়ে বেরিয়ে পড়ে।নিঝুম দরজার দিকে তাকিয়ে ঠোঁট কামড়ে হাসতে থাকে।অদ্ভুত মেয়ে।আসে শান্তভাবে।ফিরে যায় ঝড়ের গতিতে।তিতলি রুম থেকে বেরিয়ে সিঁড়ি পার হয় দৌড়ে।তিতলিকে লজ্জামাখা মুখ নিয়ে দৌড়ে রুমে ঢুকতে দেখে মিসেস আঞ্জুমান সিঁড়িতে থমকে দাঁড়ান।
চলবে…..
@ইলমা বেহরোজ
প্রজাপতি আমরা দুজন
৬.
নির্জনের রুম সামনে এসে আঞ্জুমান ভাবনায় ডুবেন।ছেলের অনুমতি নিয়ে ঘরে ঢুকবেন নাকি অনুমতি ছাড়া।অনুমতি ছাড়া ঢুকলে কি সাংঘাতিক কাজ কর্ম দেখতে হয়।সেদিন ঢুকে দেখেন নির্জন ভিডিও কলে রোহিকে উড়ন্ত চুমু দিচ্ছে!আঞ্জুমান দরজায় টোকা দিয়েই ডাকেন,
— “নির্জন, আব্বু আছোস?”
একটু থেমে আবার ডাকে,
— “নির্জন?”
গলার স্বর দ্বিগুণ করেন,
— “নির্জন?”
নির্জন ভিডিও কলে ব্যস্ত ছিলো রোহির সঙ্গে।মায়ের কন্ঠ কানে আসেনি।তৃতীয় ডাকটা কানে আসে।মা জোরে চেঁচিয়ে ডাকছেন।তাড়াতাড়ি কল কাটে নির্জন।এরপর দরজা খুলে টান টান করে জোরপূর্বক হাসে।আঞ্জুমান ছেলের হাসির স্টাইল দেখে কপালের ভুরু হালকা কুঞ্চিত করে বললেন,
— “হাঁদারামের মতোন হাসবিনা আমার সামনে।হাঁদারাম আছিস হাঁদারাম থাক!প্রকাশ করার কি দরকার?”
নির্জন বাধ্য ছেলের মতো হাসি বন্ধ করে স্ট্যাচু হয়ে দাঁড়ায়।আঞ্জুমান বলেন,
— “এখন স্ট্যাচু হইছোস কেন?ঢং করবিনা।”
নির্জন তখনো স্ট্যাচু!ইচ্ছে করে এমন করছে মা কে রাগানোর জন্য।সোজা হয়ে থাকবে কথা বলবেনা, হাসবেনা।আঞ্জুমান ছেলের দিকে সরু চোখে তাকান।নির্জনো হুবুহু কপি করে তাকায়।আঞ্জুমান চোখ দিয়ে ভয় দেখান।নির্জনও তাই করে।আঞ্জুমান নাক দিয়ে জোরে জোরে শ্বাস নেন,জিহ্বা বের করেন।নির্জন মায়ের পাগলামি দেখে জোরে হেসে উঠে।সাথে হাসেন আঞ্জুমান।নির্জনের পিঠ চাপড়ে বলেন,
— “সুখবর আছে।”
নির্জন আগ্রহ নিয়ে তাকায়।আঞ্জুমান রুমে ঢুকতে ঢুকতে বলেন,
— “রোহিরে কল দিয়ে বল আমরা আগামী বৃহস্পতিবার বিয়ে পাকা করতে ওদের বাড়ি যাচ্ছি।আংটি পরিয়ে আসবি সেদিনই।বয়স তো কম না,আঠাশ হলো।”
নির্জন সেকেন্ড দুয়েক হা হয়ে তাকিয়ে থাকে।এরপর মা’কে কোলে তুলে নেয় খুশিতে।আঞ্জুমান চিৎকার করে উঠেন,
— “পড়ে যাবো,পড়ে যাবো।নামা!”
নির্জন মা কে নামিয়ে উত্তেজিত হয়ে বললো,
— “থ্যাংকিউ সো মাচ আম্মু।সারপ্রাইজ ছিল আমার জন্য।”
আঞ্জুমান ছেলের এতো আনন্দ দেখে বুক ভরে শ্বাস নেন।এরপর ছেলের কপালে চুমু এঁকে বলেন,
— “তোদের খুশিই আমাদের খুশিরে বাবা।”
____________________________________________________
আঞ্জুমান নিঝুমের রুমে এসে দেখেন রুমে নেই নিঝুম।তিনি ব্যালকনিতে আসেন।নিঝুমকে পান।মগ্ন হয়ে লিখছে।তিনি ডাকেন,
— “নিঝুম? আব্বা।”
নিঝুম ঘুরে তাকায়।মা’কে দেখে হাসলো।বললো,
— “আম্মু।বসো।”
আঞ্জুমান বসতে গিয়ে দেখতে পান সেন্টার টেবিলে আরেকটা কফির মগ।তিতলির জন্য ছিল হয়তো।বুঝেও সাবধানে প্রশ্ন করেন,
— “কেউ এসেছিল?কফির মগ দেখছি।”
— “তিতলি এসেছিল।”
— “গল্প করতে আসছিলো?”
নিঝুম ডায়রি বন্ধ করে মায়ের সোজাসুজি বসে বললো,
— “সেদিন আসছিল বুঝছো।আমার এতো বই দেখে খুশি হয় খুব।তাই আমি বলেছি এক্সাম শেষে বই নিয়ে পড়তে।আজ বই নিতে আসে।বার বার বড়দের উপন্যাস নিচ্ছিলো পড়তে।আমি মানা করেছি।কিন্তু ও বড়দের উপন্যাসই পড়বে।কথা শুনলো না পড়তে বসলো।আমি জানতাম প্রেমের উপন্যাস ও কারোর সামনে পড়তে পারবেনা।লজ্জা পাবে।মেয়েটা খুব লাজুক।তবুও পড়েছে কিন্তু শেষে কি হলো জানো?ঠিকই লজ্জা পেয়েছে।আমি তাকাতেই উঠে ভোঁ দৌড়।”
নিঝুম হেসে উঠলো।কিন্তু শব্দ নেই নিঃশব্দ সেই হাসি।আঞ্জুমান মুগ্ধ নয়নে ছেলেকে দেখেন।আর অবাক হন খুব।নিঝুম সাধারণত বেশি কথা বলে না।বিস্তারিত কিছু বলে না। আঞ্জমান ঠোঁটে হাসি ফুটিয়ে বললেন,
— “মেয়েটা খুব সরল আর ভালো।”
— “সেটা ঠিক তবে মেয়েটা বয়স কম আবেগ বেশি!আর ঘাড়ত্যাড়া।”
আঞ্জুমান মুখ ফসকে জিজ্ঞাসা করেন,
— “তিতলিকে কেমন লাগে তোর?”
নিঝুম শান্ত চোখে মায়ের চোখের দিকে তাকায়।এরপর প্রশ্ন এড়িয়ে বলে,
— “আব্বু বাসায় ফিরেছে?”
আঞ্জুমান ছোট করে উত্তর দেন,
— “হুম।”
নিঝুম আবার ডায়রি খুলে।আঞ্জুমান ভেবেছিলেন নিঝুমের হয়তো দূর্বলতা আছে তিতলির প্রতি।কিন্তু নিঝুমের কথায় বুঝে যান ছেলের কোনো আগ্রহ নেই তিতলির উপর।তবে,উনার বেশ মনে ধরেছে তিতলিকে হুট করেই।মিনিট কয়েক আগেও যা ভাবেন নি তাই এখন ভাবনায় ঘুরপাক খাচ্ছে। আঞ্জুমান বলেন,
— “আচ্ছা আসি আব্বা!’
— “আচ্ছা।”
নিঝুম পিছন থেকে আবার ডেকে উঠলো,
— “শুনো আম্মু?”
মিসেস আঞ্জুমান ঘুরে দাঁড়ান।নিঝুম বলে,
— “ডিনার করতে নিচে যাবনা।পাঠিয়ে দিও প্লীজ।”
— “আচ্ছা আব্বা।”
____________________________________________________
দরজার ওপাশে কেউ এসে দাঁড়ায়।টোকা দেয়।কন্ঠস্বর ভেসে আসে,
— “তিতলি?”
তিতলি মাথায় কাপড় দিয়ে দরজা খুলে।অবাক হয়ে বললো,
— “নির্জন ভাইয়া আপনি?”
নির্জন আরো বেশি অবাক হয়।তিতলি তাকে আর নিঝুমকে গুলিয়ে ফেলেনি দেখে।নির্জন হেসে বলে,
— “চিনে গেছো দেখি।”
তিতলি মাথা নামিয়ে ভাবে,
— “আমি আমার ডাক্তারকে কখনো কারো সাথে গুলিয়ে ফেলবোনা ভাইয়া।”
নির্জন বলে,
— “রুমে ঢুকবো?’
তিতলি সামনে থেকে সরে গিয়ে বলে,
— “জ্বি ভাইয়া!’
নির্জন রুমে ঢুকে বললো,
— ” তুমি জানো তুমি আমার জন্য লাকি গার্ল।”
তিতলি অবাক হয়ে তাকায়।নির্জন বলে,
— “আসছো পাঁচদিন।এর মধ্যে আমার বিয়ে পাকা হয়ে যাচ্ছে।”
— “এ ক্রেডিট তো আমার না।আল্লাহ চাইছেন বলেই হয়েছে।”
নির্জন এক হাতে সামনের চুল ঠিক করে এরপর বলে,
— “সেটা ঠিক।তবে, তুমি আসার পর আমার এতদিনের অপেক্ষা শেষ হয়েছে।তাই তোমাকে ট্রিট দেব।বলো কি চাও?”
তিতলি লজ্জা পেয়ে বললো,
— “আপনাদের বাড়িতে এক-দু মাসের জন্য থাকতে দিয়েছেন এটাই অনেক।”
নির্জন দু’হাত প্যান্টের পকেটে ঢুকিয়ে বললো,
— ” আব্বু দিয়েছে আমি না।আমার কাছে আলাদা করে কিছু চাও।”
— “একদিন চেয়ে নেব ভাইয়া।আজ মনে পড়ছেনা।”
— “আচ্ছা।কিন্তু আমি মরার আগে চেয়ো কিন্তু।”
তিতলি জোরে হেসে বললো,
— “হ্যাঁ ভাইয়া চাইবো।”
— “আচ্ছা আসি।”
— “জ্বি ভাইয়া আসুন!”
___________________________________________________
এরপরদিন দুপুর এগারোটায় তিতলি ছাদে আসে।বাগান দেখছিল ঘুরে ঘুরে।মৌনতা, মোহনা দুজন ভার্সিটিতে।নিঝুম নির্জন হস্পিটাল।বাড়ি প্রায় খালি।সুইমিংপুলের পাশ দিয়ে হাঁটার সময় আচমকা পা ফসকে পানিতে পড়ে তিতলি।পানি থেকে মুখ তুলে তিতলি হতবাক।মুহুর্তে কি হয়ে গেলো।নিজে নিজে হেসে ফেললো।স্বচ্ছ নীল পানি।পায়ের তালু অব্দি দেখা যাচ্ছে।বেশ লাগছে তার।আরেকটা ডুব দেয়।সাঁতার কাটতে থাকে।সেই মুহূর্তে নিঝুমের পা পড়ে ছাদে।সাদা শার্ট গায়ে, চোখে চশমা।নিঝুমের চোখ যায় সুইমিংপুলে।একটা মেয়ে নিশ্চিন্তে সাঁতার কাটছে।স্বচ্চ নীল জলে ধবধবে ফর্সা এক কন্যা।জলে ভাসছে কালো লম্বা চুল।নিঝুম চিত্রশিল্পী হলে তখনি এই দৃশ্য এঁকে নিতো।সে এক পা এক পা করে সুইমিংপুলের পাশে এসে দাঁড়ায়।তিতলি থমকে যায়।কারো পায়ের শব্দ শুনেছে যেমন।ঘুরে তাকায়।নিঝুমকে দেখে কেঁপে উঠলো। সাথে সাথে ডুব দেয়।বেশ কয়েক সেকেন্ড পর ভেসে উঠে।নিঝুম তখনো দাঁড়িয়ে।ঠোঁটে হাসি।তিতলি আবার ডুব দেয়।যখন শ্বাস বন্ধের উপক্রম তখন ভেসে উঠে।তখনো নিঝুম দাঁড়িয়ে আছে।তিতলি আবার ডুব নিতে গেলে সাথে সাথে নিঝুম বলে,
— “এই আর ডুব দিওনা।একটা কথা ছিল তোমার সাথে।উঠে আসো।”
তিতলির ভেজা গায়ে উপরে উঠতে লজ্জা করছিল ভীষণ। তাই মাথা নাড়িয়ে না করে।নিঝুম বুঝতে পেরে বললো,
— “আচ্ছা শুনো।আজ বের হতে পারব না।বিকেলে আমাকে একটা অপারেশন করতে হবে।ইট’স আর্জেন্ট।আগামীকাল বের হবো আমরা।”
তিতলি নিঝুমের চোখের দিকে তাকিয়ে বলে,
— “এইটা বলতে এসেছেন?”
নিঝুম রুমে যাওয়ার জন্য পা বাড়ায় আর বলে,
— “না।ফোন নিতে মনে নেই।নিতে এসেছি।আরো দরকারি কাজ আছে।”
নিঝুম রুমে চলে যায়।তিতলি থ মেরে দাঁড়িয়ে থাকে।ভেবেছিল আজ একসাথে পাশাপাশি থাকা হবে।অথচ হলোনা।নিঝুম ফোন নিয়ে বেরিয়ে আসে।সিঁড়ি বেয়ে নামতে গিয়ে আবার উপরে উঠে আসে।রুমে যায়।একটা বড় তোয়ালে তিতলির হাতে দিয়ে নেমে যায়।তিতলি এতে ভীষণ রকম খুশি হয়….ভীষণ।নিঝুমের দেওয়া তোয়ালে অঙ্গে জড়িয়ে খুশিতে চোখ খিঁচে হাসে।
চলবে…..
®ইলমা বেহরোজ
প্রজাপতি আমরা দুজন
৭.
নিঝুম তিতলির রুমের সামনে এসে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে কয়েক সেকেন্ড। তাকে বিচলিত দেখাচ্ছে।দরজায় টোকা দিতে চাইছে কিন্তু পারছে না।নিঝুম এরকম বেকায়দা অবস্থায় কখনো পড়েনি।একটা মেয়ের রুমের দরজায় কড়াঘাত করতে গিয়ে তার এতো অস্থিরতা হওয়ার কথা নয়।নিঝুম বড় নিঃশ্বাস নিল।এরপর হালকা কেশে দরজায় টোকা দেয়।সাথে ক্ষীণ স্বরে ডাকলো,
— “তিতলি?”
তিতলি জানালার পাশে বসে সন্ধ্যার আকাশ দেখছিল।আকাশ কালো করেছে।ঠান্ডা একটা হাওয়া চারপাশে। নিঝুমের গলার স্বর তিতলির অস্তিত্বসহ সর্বাঙ্গ কাঁপিয়ে তুলে।তিতলি বিড়বিড় করে ‘কার গলা শুনলাম।’ওড়না নিয়ে তড়িঘড়ি করে বিছানা থেকে নামে।দ্রুত দরজা খুলে।নিঝুম তখন দ্বিতীয়বারের মতো ডাকতে নিচ্ছিলো, তার আগেই তিতলি দরজা খুলে।দুজনের চোখাচোখি হতেই নিঝুম হালকা করে হাসে।তিতলি গলা টেনে বললো,
— “আ-প-নি?’
নিঝুম তিতলিকে ব্যঙ্গ করে গলা টেনে বললো,
— “কে-নো আ-স-তে পা-রি-না?”
তিতকি খিলখিল করে হেসে উঠলো নিঝুমের দুষ্টুমি দেখে।নিঝুম চোখের চশমাটা ঠিক করে বললো,
— “হাসবেই নাকি রুমে আসতে বলবে?”
তিতলি সরে দাঁড়িয়ে বিনয়ীর সাথে বললো,
— “আমার রুম আর কই! আপনারই বাসা।অনুমতি লাগে নাকি।”
— “এটা ঠিক না।তুমি থাকো। এখন এইটা তোমার রুম।আর কারো রুমে অনুমতি নিয়া ঢুকা ভদ্রতা।”
তিতলি হেসে বলে,
— “আচ্ছা আসুন।অনুমতি দিলাম।”
নিঝুম চোখ ঘুরিয়ে রুমটা দেখতে থাকে।পরিপাটি,গোছানো। বিছানার পাশে কনসোল টেবিলে ফুলের টব।তাতে তাজা ফুল।তিতলি বললো,
— “আমার রুমে সোফা নেই বিছানায় বসুন।নয়তো চেয়ারে।আর আপনার মতো আমার রুমে রান্নাঘর নাই তাই কফি বা চা অফার করতেও পারবনা।”
তিতলির কথা শুনে নিঝুম হাসলো।তারপর উত্তর দেয়,
— “না আমার চা-কফি লাগবেনা।আর বিছানায় বসতে পারি কিন্তু এখন বসবনা একটা কথা বলতে আসছি বলেই চলে যাবো।”
তিতলি প্রশ্নবোধক চিহ্ন চোখে-মুখে ফুটিয়ে তাকায়।
নিঝুম রুমটা আরেকবার দেখে বললো,
— “ফুল দেখছি।পছন্দ করো নাকি?”
তিতলি নতজানু হয়ে মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ বললো।নিঝুম হঠাৎ মনে পড়ার মতো ভাব করে বললো,
— “ওহ,যা বলতে এসেছিলাম।বলেছিলামনা কাল চা বাগানে নিয়ে যাবো তোমাকে?”
তিতলির কান্না চলে আসে গলা পর্যন্ত।নিঝুম কি বলবে? কালকে যেতে পারবেনা বলবে?কিন্তু তিতলি যে অনেক কল্পনা, জল্পনা করে বসে আছে কালকের দিনটাকে নিয়ে।নিঝুম শান্ত গলায় বললো,
— “আমরা কাল বিকেলে যাচ্ছিনা।সকালে যাবো।”
তিতলি জোরে টেনে নিঃশ্বাস নেয়!প্রশান্তির নিশ্বাস.এরপর প্রশ্ন করে,
— “কিন্তু কেনো ভাইয়া?”
নিঝুম নিজ হাতে ঘাড় ম্যাস্যাজ করে বললো,
— “বিকেলে কাপলদের ভীর থাকে।আমরা সকালেই যাব।”
তিতলি চোখ অস্থির রেখে জবাব দেয়,
— “আচ্ছা ভাইয়া।আমার সমস্যা নাই।আপনি পাশে থাকলেই হবে।”
তিতলির শেষ কথাটা অস্পষ্ট ছিল। নিঝুম বুঝতে না পেরে বললো,
— “কী?”
তিতলি বড় বড় চোখ করে তাকায়।গোপনে ঢোক গিলে বললো,
— “না মানে,ঘুরতে পারলেই হলো।”
— “ওহ,আচ্ছা আসি।”
তিতলি পিছন ডাকে,
— “শুনুন?”
নিঝুম ঘুরে তাকায়।চার চোখ এক হয়।নিঝুমের চোখের দিকে একবার নিজের দৃষ্টি গেঁথে গেলে তিতলি হিতাহিত জ্ঞান শূন্য হয়ে পড়ে।তাই হলো।আবিষ্টভাবে চেয়ে থাকে তিতলি।তিতলি জানে এই মানুষটার মনে তাকে নিয়ে কোনো ভাবনা নেই, আগ্রহ নেই,অনুভূতি নেই, ভালবাসা নেই।তবুও মানুষটার উপস্থিতি ভেতরে বাহিরে অবিরাম আন্দোলিত করছে।নিঝুম তিতলির চাহনি দেখে হাসে।
— “তিতলি?”
তিতলি কেঁপে উঠে চোখ সরিয়ে নেয়।নিঝুম বললো,
— “ডাকলে কেনো?”
তিতলি নিজেকে সামলিয়ে বললো,
— “আমি কাল শাড়ি পরি?”
নিঝুম ভ্রু উঁচিয়ে বললো,
— “ট্রাভেল করতে গেলে কেউ শাড়ি পরে?”
তিতলির হাসিখুশি মুখটা চুপসে যায়।নিঝুম ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটিয়েই বললো,
— “আচ্ছা শাড়ি পরিও।মন খারাপ করতে হবেনা।চা বাগানে যখন উঁচ উঁচু ছোট বড় পাহাড়গুলোতে উঠবে তখন পা ভেঙ্গে আমাকে ফাঁসিয়োনা শুধু।”
তিতলি কিছুটা আর্তনাদের মতো করে বললো,
— “এমা!পা ভেঙ্গে যাবে?আমি কাঁদবো তো।”
— “আমি আছিনা? বড় ভাই।সামলাবো চিন্তা করোনা।”
বড় ভাই কথাটি শুনে তিতলি ভেতরে ভেতরে ফুঁসফুঁস করে উঠলো।দাঁতে দাঁত চেপে মনে মনে গালি দেয়,
— “গবেটের ঘরে গবেট।হাবলার হাবলা আপনি আমার বড় ভাই,না?আমি যদি কোনোদিন বাগে পাই আপনারে আমার একদিন কি আপনার একদিন।”
নিঝুম তিতলির ভাবনাগ্রস্ত মুখ দেখে ভুরু কুঁচকায়।
— “কি? কি ভাবো?”
— “হে না না কিছুনা।”
— “আচ্ছা আসি।”
—- “আসুন।”
নিঝুম বেরিয়ে যায়।তিতলি ঠাস করে দরজা লাগায়।ওড়না বিছানার রাখে।নিঝুম দরজার আওয়াজ শুনতে পেয়ে আবার আসে।দরজা ধাক্কা দিয়ে উঁকি দেয়।
— “আওয়াজ করে দরজা লাগালে কেনো? আমার উপর কোনো কারণে ক্ষেপেছো?”
তিতলি অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে।কি আজব!ওড়নাটা রাখতেই লোকটা চলে আসছে।নিঝুম তিতলির জবাব না পেয়ে,
— “স্ট্যাচু হয়ে আছো কেনো? এদিক ফিরো।প্রশ্ন করেছি একটা।”
তিতলি পড়ে বেকায়দায়। তাড়াতাড়ি উত্তর দেয়,
— “না, না কারোর উপর ক্ষেপে নেই আমি।আপনি আসুন।”
নিঝুম আরো কিছু বলতে যাচ্ছিলো।হুট করে খেয়াল হয় তিতলির গায়ে ওড়না নেই মনে হচ্ছে।নিঝুম অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে।দ্রুত ‘আসি’ বলে জায়গা ছাড়ে।নিঝুমের সাড়া না পেয়ে তিতলি ঘুরে দাঁড়ায়।দৌড়ে গিয়ে দরজা ভেতর থেকে লক করে।বুকে হাত রেখে জোরে নিঃশ্বাস ফেলে।ওড়নাটা মাথায় দিয়ে একা একা কতক্ষণ হাসে।ভাবতেই পারছেনা নিঝুমের সাথে এতো কথা হয়।তিতলি শুয়ে পড়ে বিছানায়।নতুন প্রেমে পড়া মেয়েরা কারণে-অকারণে বিছানায় শুয়ে ভাবনায় ডুবে।তিতলি এখন সেই পথের যাত্রী।সন্ধ্যার বাতাসটা জানালা দিয়ে হো হো করে আসছে রুমে।তিতলির শরীর জুড়িয়ে যাচ্ছে।বাতাসের সাথে মিশে যেন আসছে সহস্র ভালবাসার অনুভূতি।
____________________________________________________
ডিনারে।আঞ্জুমান মৌনতার উপর ক্ষেপেন।
— “মৌ?চেহারার কি ছিরি!হে?”
মৌনতা মায়ের উত্তর না দিয়ে খেয়েই যাচ্ছে।
— “কথা বলস না কেন?রাত জেগে প্রেম করতে হয়? ওই ছেলেরে বলবি বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে আসতে।আমার বাড়িতে এতো রাত জেগে চোখের নিচে কালি করবিনা।মনেই হচ্ছে না আমার মেয়ে।”
আঞ্জুমানের কথা শুনে আলতাফ চৌধুরী হা হা করে হাসেন।আঞ্জুমান তীক্ষ্ণ চোখে তাকান।বলেন,
— “তুমি হাসতাছো কেনো?”
আলতাফ চৌধুরী হাসি থামিয়ে খাবারে মন দেন।আঞ্জুমান তেজ বাড়িয়ে বলেন,
— “মেয়েগুলা বাপের মতো হইছে।কিছু জিজ্ঞাসা করলে মুখ দিয়ে কিছু বের হয় না।মুখে কিছু ঠাসা মেরে রাখে।
মোহনা খাবার রেখে বললো,
— “মৌনতা আর বাবার জন্য আমাকে বকলে।”
আঞ্জুমান মোহনার দিকে তাকিয়ে বলেন,
— “তুই তো তোর বাপেরই মেয়ে।”
মৌনতা মায়ের দিকে তাকিয়ে বলে,
— “কেন আব্বু কি করছে?আব্বুকে নিয়ে কিছু বলবানা।”
— “তুই আমারে শিখাবি? কেমনে কথা কমু?”
মিসেস আঞ্জুমান রেগে ফেটে চৌচির।
আলতাফ চৌধুরী ইশারায় মেয়েদের চুপ হতে বলেন।ইশারায় বুঝান, ‘তোদের মা তো এমনি।থাকুক বলুক।একসময় চুপ হয়ে যাবে।’মৌনতা,মোহনা চুপচাপ খেয়ে চলে যায়।আলতাফ চৌধুরী হালকা কেশে মিসেস আঞ্জুমানের দৃস্টি আকর্ষণ করেন।মিসেস আঞ্জুমান তাকালে উনি বলেন,
— “ছেলেরা কই?তিতলি কই?’
— “রুমে।নির্জন আসবে খেতে।নিঝুম গতকাল থেকে কোনো কাজে ব্যস্ত খুব।আজও রুমে খাবে।আর তিতলি বই পড়তেছে।চলে আসবে এখুনি।”
— “আচ্ছা পাঠিয়ে দাও নিঝুমের খাবার।আর নির্জন, তিতলিকে ডেকে আনো।অনেক রাত হইছে।”
আঞ্জুমান রান্নাঘরের দিকে যেতে যেতে বলেন,
— “পাঠাবো একটু পর।তোমার তো খাওয়া শেষ যাও রুমে আমি আসছি।”
তিতলি নেমে আসে।ড্রয়িংরুম দেকে প্রশ্ন করে,
— “ফুফি আম্মা সবার খাওয়া শেষ?”
— “হ্যাঁ মা।”
— “সরি, ফুফি আম্মা।দেরি হয়ে গেল।”
আঞ্জুমান বলেন,
— “সমস্যা নাই।নিঝুমও খায় নাই।টুনি মনে হয় ঘুমিয়ে পড়ছে।একটু দিয়ে আসবা খাবারটা নিঝুমের রুমে?”
তিতলি যেনো আকাশের চাঁদ হাতে পেলো।মনে মনে নেচে উঠে।উপরে মিষ্টি হেসে বিনয়ীর সাথে বললো,
— “জ্বি পারবো। দিয়ে আসছি।”
আঞ্জুমান একটা প্লেট এনে তিতলির হাতে দেন।বলেন,
— “নিঝুম তো রাতে রুটি খায়।বলিও একটা রুটিও যেন না থাকে।পাঁচটাই যেন শেষ করে।আর গরু মাংস শেষ। আজ মুরগি খেয়ে নিতে।আর সিদ্ধ ডিম দুইটা আছে।”
— “আচ্ছা আন্টি।”
তিতলি প্লেট নিয়ে সিঁড়িতে উঠে।আঞ্জুমান ডাকেন,
— “তিতলি?”
তিতলি ঘাড় ঘুরে তাকায়।
— “তোমার খাবারটাও নিয়ে যাও একসাথে খেয়ে নিও।”
তিতলি সৌজন্যতার সাথে হেসে বললো,
— “আমি পরে এসে খেয়ে নেব।”
____________________________________________________
— “আসব ভাইয়া?”
নিঝুম শার্ট খুলছিল।তিতলির কণ্ঠ শুনে তাড়াতাড়ি বোতাম লাগিয়ে নেয়।এরপর বলে,
— “হুম আসো।”
তিতলি দরজা ঠেলে রুমে ঢুকে।নিঝুমকে বলে,
— “আপনার খাবার।”
— “টুনি কই? তুমি কেনো?”
— “ঘুমিয়ে পড়েছে।ফুফি আম্মা আমাকে পাঠালো।”
নিঝুম বিছানা থেকে বইপত্র তুলে জবাব দেয়,
— “আম্মু ও না বাচ্চা হয়ে যায়।অতিথিকে কেউ ফরমায়েশ দেয়!”
— “আমার কিন্তু ভালোই লাগে বড়রা যখন কিছু করতে বলে।”
— “এই প্রথম কেউ এমন কথা বললো।”
— “সত্যি বলছি আমি।”
— “আচ্ছা।আমার ফরমায়েশ খাটো একটু।”
তিতলি মাথা উচিয়ে থাকায়।খুশি হয় খুব!
— “কি করতে হবে?”
— “বাবাহ!কাজ করতে একদম প্রস্তুত।না বাবা! লাগবেনা।আমি নিজের কাজ নিজেই করি।”
— “খাবারটা তো নেন।”
— “রাখো।আমি আসছি।”
তিতলি সেন্টার টেবিলে খাবার রাখে।নিঝুম ওয়াশরুমে ঢুকে।ব্যালকনির পর্দা গুলো উড়াউড়ি করছিল খুব।তিতলি আগ্রহ নিয়ে ব্যালকনিতে আসে। গুড়িগুড়ি বৃষ্টি হচ্ছে।ছিটে এসে জল পড়ছে ব্যালকনিতে।বারান্দায় জ্বলছে লাল ড্রিম লাইট।আরেকটু এগিয়ে দাঁড়ায় তিতলি।দমকা বাতাস আসছে।তিতলি খোঁপা থেকে মুক্ত করে দেয় চুল।শরীরে এসে জল পড়ছে।সে ভুলে যাচ্ছে অন্যকারো রুমে এটা।অন্যকারো ব্যালকনি।হঠাৎ কারো ঠোঁটের ছোঁয়া পায় ঘাড়ে।কেঁপে উঠে।ঘুরে দাঁড়ায়।দেখে, নিঝুম এক হাতে তার কোমর ধরে টেনে রেখেছে নিজের কাছে। তিতলি আমতা আমতা করে বললো,
— “আ,আপনি?”
নিঝুম তিতলির উত্তর না দিয়ে ওর চোখের পাতায় চুমু এঁকে দেয়।তিতলির শরীরে ঠান্ডা শিরশির অনুভব হয়। নিঝুমের সাদা শার্ট খামচে ধরে।নিঝুম ফিসফিসিয়ে বলে,
— “ভালবাসি, ভালবাসি, ভালবাসি।”
তিতলির পায়ের তালু থেকে চুল অব্দি কেঁপে উঠে।নিঝুমকে জড়িয়ে ধরে শক্ত করে।চোখ বুজে আবেশে।তখনি কেউ একজন ধমকের স্বরে ডাকে,
— “এই তিতলি?”
তিতলি চমকে উঠে।চোখ খুলে পিছন ঘুরে।নিঝুম দাঁড়িয়ে আছে।তার চেয়ে কয়েক হাত দূরে।নিঝুম গলার স্বর চড়া করে বলে,
— “তুমি কি পাগল?বৃষ্টিতে তো ভিজে টুইম্বুর হয়ে যাচ্ছো।তবুও ঠায় দাঁড়িয়ে আছো।”
তিতলি নিজের দিকে আবিষ্টমনে তাকায়।এরপর আবার নিঝুমের দিকে তাকায়।চেয়েই থাকে।বুকের মন নামক যন্ত্রণাটা থেমে থেমে কাঁপছে।ড্রিম লাইটের লাল আলোয় নিঝুমকে অদ্ভুত মনে হচ্ছে।নাকি তাঁর ভুল? কিন্তু এখানে বেশিক্ষণ থাকলে কেলেঙ্কারি হয়ে যাবে।তিতলির নিজেকে মাতাল মনে হচ্ছে।ছটফটানি হচ্ছে ভেতরটা।ইচ্ছে হচ্ছে একবার মানুষটাকে জড়িয়ে ধরে বলতে, ‘আমি আপনাকে ভালবাসি।প্লীজ আপনিও আমাকে ভালবাসুন।’ নিঝুম তিতলির ব্যবহার দেখে ভড়কে যায়।উদ্বেগ হয়ে বলে,
— “কি হইছে তিতলি?এমন করছো কেনো?কোনো সমস্যা?”
তিতলির সত্যি সত্যি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে।নিঝুমের বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠে।নিঝুম টাল সামলাতে না পেরে দু’কদম পিছিয়ে যায়।দেয়ালে হাত রাখে।এমন কিছু হবে নিঝুম ভাবেনি,কক্ষনো ভাবেনি!মুহূর্তে সর্বাঙ্গে উষ্ণতা ছড়িয়ে পড়ে।
চলবে….
®ইলমা বেহরোজ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here