প্রজাপতি উৎসব
#প্রেমের_গল্প #প্রজাপতি_উৎসব
পর্ব ১২
রঞ্জনের মোটর সাইকেল ঢাকায় আসার পর হঠাৎ নষ্ট হয়ে গেছে। কাঁটাবনে ইকবাল মিয়ার মোটর গ্যারেজে রঞ্জন মোটর সাইকেল সারাতে দিয়েছে।
আজ বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে একটা গানের অনুষ্ঠান আছে। আমিই রঞ্জনকে নিয়ে যেতে বলেছি। রঞ্জন সঙ্গে সঙ্গে রাজি হয়েছিল। কিন্তু ঢাকা এসে তো মোটর সাইকেল ফেঁসে গেলো। কাঁটাবনে বাইক রেখে আমরা রিক্সা নিয়েছি। রিক্সায় ওঠার পরপরই আকাশ ভেঙ্গে বৃষ্টি নেমেছে। রিক্সাওয়ালা পর্দা বের করে ভাঁজ খুলে আমাদের হাতে দেয়ার আগে আমরা অর্ধেক ভিজে গেছি। এভাবে রিক্সায় হুড তুলে, পর্দায় গা ঢেকে আমি আর রঞ্জন এত ঘনিষ্ঠভাবে কখনো বসিনি। মোটর সাইকেল নষ্ট না হলে আজও বসার কথা ছিল না।
সাদা টি শার্ট আর নীল জিন্সে রঞ্জনকে খুব হ্যান্ডসাম লাগছে। রঞ্জন বোধহয় গায়ে কোন দামী পারফিউম মেখেছে। সেই উচাটন ঘ্রাণ আর ওর মুহুর্মুহু স্পর্শ আমাকে নাজুক আর ভঙ্গুর করে ফেলছে। খুব ইচ্ছে হচ্ছে রঞ্জনকে জড়িয়ে ধরি। কিন্তু সেটা ঠিক হবে না। রঞ্জন যেমন বন্য, সামান্য ইশারা পেলে গায়ে হামলে পড়বে। মিতির মত ভুল আমি কখনোই করবো না।
রিক্সা আর সাইকেল নিরীহ বাহন। রিক্সা পরিবেশের কোন ক্ষতি করে না। কিন্তু কাজী নজরুল ইসলাম অ্যাভেনিউয়ে রিক্সা চলা নিষেধ। ওখানে শুধু কালো ধোঁয়া ওড়ানো পেট্রোল, ডিজেলের গাড়ি চলে। এ কারণে আমাদের রিক্সা পরিবাগের ভেতর গলি ঘুপচি ঘুরে একটা পেট্রোল পাম্পের কাছে এসে থামলো। বৃষ্টির যেমন হঠাৎ এসেছিল ঠিক তেমনি হঠাৎ মিইয়ে গেছে। রঞ্জন আর আমি দ্রুত পায়ে হেঁটে কেন্দ্রের অডিটোরিয়ামে চলে এলাম। গিয়ে দেখি অর্ণব গান আরম্ভ করে দিয়েছে। ওর মত এত সুন্দর করে রবীন্দ্রসঙ্গীত আর কাউকে গাইতে দেখিনি। আমি রঞ্জনকে বললাম,
-ইস, অর্ণব কী সুন্দর গাইছে।
রঞ্জন মুখ গম্ভীর করে বললো,
-খারাপ না। চলে। রবীন্দ্রসঙ্গীতের চেয়ে ওর নিজের গান ভালো হয়।
আমি অন্য কোন পুরুষের প্রশংসা করছি বলে কি রঞ্জন ঈর্ষা বোধ করছে? আমি আলতো করে রঞ্জনের হাত ছুঁয়ে বললাম,
-অভিমান করলে নাকি?
-নাহ, তোমার ভালো লাগার উপর তো আমার কোন নিয়ন্ত্রণ নেই। আমি অভিমান করবো কেন?
-আহা, তুমিই তো আমার প্রেমিক, রঞ্জন। অর্ণবের কথা ভুলে যাও, ও তো শুধু একজন গায়ক। আমি শিল্পী হিসেবে ওর প্রশংসা করেছি, নাথিং পার্সোনাল।
মনে হলো রঞ্জন একটু আশ্বস্ত হলো। বেশ স্বস্তির সঙ্গে সে এবার গান শুনলো। অর্ণবের গানের পর একটা দশ মিনিটের ব্রেক। তারপর আজকের অনুষ্ঠানের মূল শিল্পী, আমন্ত্রিত অতিথি কৌশিকি চক্রবর্তী গান করবেন। অর্ণবের গান আগেই শুনেছি। কৌশকির জন্যই আজ আসা। ব্রেকের সময় আমি আর রঞ্জন অডিটোরিয়াম থেকে বেরিয়ে ছাদে এলাম। রঞ্জন একটা সিগারেট ধরিয়ে বললো,
-ধুর বৃষ্টি পুরো থেমে গেলো।
-ভালোই তো, ছাদে আসা গেলো।
-বৃষ্টিতে ভিজলে তোমাকে বেশী সুন্দর লাগে।
-কেন? মুখটা স্নিগ্ধ লাগে?
-অন্য কারণে, বলবো না, রেগে যাবে।
কে যেন হঠাৎ ডাক দিলো,
-রঞ্জন।
আমি আর রঞ্জন একসঙ্গে পেছন ফিরে তাকালাম। নীল শাড়ি পরা একটা মেয়ে আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে। মেয়েটা একহাড়া গড়নের, অতিরিক্ত ফর্সা, মোনালিসার মত সুশ্রী চেহারা। মেয়েটা চেয়ার ছেড়ে উঠে আমাদের দিক এগিয়ে এলো। রঞ্জন একটু অপ্রস্তুত হলো নাকি? কিন্তু পরক্ষণেই ও নিজেকে সামলে নিয়ে বললো,
-আরে সপ্তর্ষি,? কবে এসেছো?
সপ্তর্ষি নামের মেয়েটি এবার আমাদের কাছে এগিয়ে এসে বললো,
-এসেছি তো দু সপ্তাহ হতে চললো।
-টু উইকস? জানাওনি কেন আমাকে?
-তোমাকে তো কোনভাবেই খুঁজে পাচ্ছি না।
-তাই? খুঁজে পাচ্ছো না কেন?
-বোকা সেজো না রঞ্জন, তুমি ভালো করেই জানো কেন। তুমি তোমার মোবাইল নম্বর, ফেসবুক প্রোফাইল, সবই বদলেছো। গা ঢাকা দিয়ে আছো।
-আর বলো না, মোবাইল নেট ওয়ার্ক চেঞ্জ করতে বাধ্য হয়েছি। আগের নেটওয়ার্কে বেশী চার্জ করছিল। ওদিকে ফেসবুকের আগের আইডি হ্যাক হয়ে গেছে। ঝামেলার উপর ঝামেলা।
-হুম, কেউ অ্যাভয়েড করতে চাইলে একশটা ঝক্কি ঝামেলা দেখাতে পারবে। তাই না? কী আর করার।
-কেন অ্যাভয়েড করবো? আমার খেয়েদেয়ে আর কাজ নেই।
-হা হা হা, এই ঠাট্টাটা করো না প্লিজ। ব্রেকাপের পর আর দেখা করবে না সেটাই এক্সপেক্টেড ছিল।
রঞ্জন কথা ঘুরিয়ে বললো,
-এখন তোমার কথা বলো সপ্তর্ষি। ইন্ডিয়ায় পড়ালেখা কেমন হচ্ছে?
-ভালো। ওখানে তো কেউ মেন্টাল টেনশন দেয় না, এক মনে লেখাপড়া করতে পারি।
-হুম, কবে ফিরে যাচ্ছো?
-মনে হয় আমি গেলেই তুমি বাঁচো। আমি আরো দু সপ্তাহ আছি। জানো তো আব্বুর কোভিড হয়েছিল?
-না, জানি না।
-আব্বু তোমার কথা জিগেস করেছিল। বললাম, রঞ্জন তো হাওয়া হয়ে গেছে। বললো, বাড়ি থেকে? আমাই বললাম, না, প্রথমত ফেইসবুক থেকে, দ্বিতীয়ত মোবাইল থেকে, তৃতীয়ত আমার জীবন থেকেই সে হাওয়া হয়ে গেছে। বাবা বিশ্বাস করে না। তুমি বোধহয় বাবাকে একদম পটিয়ে ফেলেছিলে?
রঞ্জনকে দেখে মনে হচ্ছে সে এখান থেকে যেতে পারলেই বাঁচে। সপ্তর্ষি আমার দিকে তাকিয়ে বললো,
-স্যরি, আপনার সামনেই রঞ্জনের সঙ্গে ব্যক্তিগত আলাপ জুড়ে দিয়েছি। আপনার সঙ্গে আগে পরিচয় হয়নি মনে হয়।
রঞ্জন তাড়াহুড়া করে বললো,
-ওর নাম রূপা। আমাদের জাহাঙ্গীর নগরের ইয়ারমেট। আমরা অর্ণব আর কৌশিকির গান শুনতে এসেছিলাম।
সপ্তর্ষি আবার আমার দিকে তাকিয়ে বললো
-আমরাও তো একই প্রোগ্রামে এসেছি। আগে কিন্তু এসব সিরিয়াস গান শুনতো না রঞ্জন। ওর রুচির তো বেশ উন্নতি ঘটেছে ।
-রঞ্জন বোধহয় আপনার খুব ক্লোজ ফ্রেন্ড ছিল?
-জি, অনেক ক্লোজ। তারপর আমি ইন্ডিয়া চলে গেলাম। আর রঞ্জনও বেমালুম গায়েব। রঞ্জনের ব্যাপারে সাবধান থাকবেন। প্রথমে খুব খাতির করে নিজেরটুকু বুঝে নেবে। তারপর হঠাৎ দেখবেন ফোন, মোবাইল নম্বর সব চেঞ্জ হয়ে গেছে। আর পাওয়া যাচ্ছে না। এটা কিন্তু ওর স্বভাব। কয়লা ধুলে ময়লা যায় না।
রঞ্জন খুব জোরে হো হো করে হেসে উঠলো যেন সপ্তর্ষি ভারী মজার একটা ঠাট্টা করেছে। সপ্তর্ষি রঞ্জনের দিকে তাকিয়ে বললো,
-পলা, ঊর্মি, জাভেদ সবাই এসেছে, ভেতরে আছে। আমি এখন নীচে যাচ্ছি। অনুষ্ঠানের পর আড্ডা হবে। চাইলে থাকতে পারো। আমি ওদের জানিয়ে দিচ্ছি প্লেবয়কে খুঁজে পাওয়া গেছে।
সপ্তর্ষি চলে যেতেই আমি বললাম,
-সপ্তর্ষি কী বললেন বুঝলাম না। তোমাকে উনি অত খুঁজছেন কেন? ও্নার বাবা তোমার কথা বলেন কেন? সপ্তর্ষি যাবার সময় তোমাকে প্লেবয় বললেন কেন? আর ব্রেকাপের কথা আগে কী বললেন?
-সপ্তর্ষি সব সময় এসব আজব আজব ঠাট্টা করে। ও একটা হাফ পাগল। কী বলে না বলে নিজেই জানে না।
-আসলেই, কনফিউজিং কথাবার্তা। নীচে চলো, গান শুরু হয়ে যাবে। গান শেষে তোমার বন্ধুদের সাথে পরিচয় করিয়ে দেবে।
রঞ্জন হঠাত মাথায় হাত দিয়ে এক দিকে ঝুঁকে বললো,
-আমার না খুব মাথা ব্যথা করছে রূপা। উহ, কী যে কষ্ট।
আমি উৎকণ্ঠিত হয়ে বললাম,
-কী হলো হঠাৎ?
-খুব খারাপ লাগছে। বমি আসছে। মাইগ্রেনের ব্যথা মনে হয়। এখন আর এখানে থাকতে চাচ্ছি না।
-তোমার মাইগ্রেন আছে?
-মনে হয়, শিওর না। মাঝে মাঝে প্রচন্ড মাথা ব্যথা করে। ডাক্তার দেখাতে হবে।
-আগে বলোনি তো।
-তোমাকে চিন্তায় ফেলতে চাইনি। এমনিতেই তোমার কত টেনশন।
-তাহলে চলো ইউনিভার্সিটি ফিরে যাই। কিন্তু মাথা ব্যথা নিয়ে মোটর সাইকেল চালাবে কীভাবে?
-মোটর সাইকেল তো মনে হয় না আজ ঠিক করে ফেরত দেবে। মাথা ব্যথা নিয়ে চালাতেও পারবো না । আমি বরং আজ ঢাকায় থেকে যাই আমাদের বাসায়। তুমি বাস নিয়ে জাহাঙ্গীরনগর চলে যাও।
-ঠিক আছে, সেটাই ভালো। তাহলে তুমি বাড়ি চলে যাও এখন। আমি গান শোনা শেষ করে তোমার বন্ধুদের সাথে গল্প করবো। তারপর এখান থেকে খালার বাসায় যাবো। কাল দুজন একসাথে ফিরবো।
-আমি মাথা ব্যথা নিয়ে এখন একা কীভাবে যাবো, তুমি আমার সাথে আসবে না?
-ওহ, স্যরি, ঠিকই তো। আচ্ছা চলো তোমাকে বাসা পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে আসি। তোমার বাসায় আমার সম্পর্কে জানে?
-না, আর কদিন পর জানাবো।
আমরা কেন্দ্র থেকে সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে শুনলাম কৌশিকি চক্রবর্তী গান আরম্ভ করে দিয়েছেন। আবছা আবছা শুনলাম উনি জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষের একটা ধ্রপদী ঘরানার গান গাইছেন,
ভালোবাসা সে তো বেসাতি নয়,
প্রাণের বিনিময়ে তো প্রাণ,
প্রীতি দিয়ে তার দেয়া নেয়ায়,
আমি ভুলের ঘোরে কী যে হারালাম…
আমার কেন যে মনটা খারাপ হয়ে গেলো নিজেও ঠিক বুঝলাম না।
(চলবে)
পর্ব ১১ https://www.facebook.com/groups/Anyaprokash/permalink/1352170248631332/
পর্ব ১৩ https://www.facebook.com/groups/Anyaprokash/permalink/1355451131636577/