প্রজাপতি উৎসব
#প্রেমের_গল্প #প্রজাপতি_উৎসব
পর্ব ২৪
আম্মুর লাল কাতান শড়ি পরে আমি ধীরে ধীরে বিয়ের মঞ্চের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি।
আমার মাথার উপরে গাদা ফুলের ঝালর, চারদিক থেকে চারজন ঝালর ধরে আমার সঙ্গে সঙ্গে এগোচ্ছে। এখন আর আগের মত উঁচু করে মঞ্চ বানানো হয় না। হলের শেষ মাথায় পারস্যের গালিচা আর নকশা করা পার্টিশন দিয়ে মোঘল রাজদরবারের ভাব আনা হয়েছে। সিলিং থেকে একটা ক্রিস্টালের ঝাড়বাতি নেমে এসেছে। সেই আলোয় ঝলমল করছে একটা কারুকার্যখচিত রাজসিক সোফা। সোফার বাঁ পাশে মোহন বসে আছে। রূপোলী জরির কাজ করা সাদা শেরওয়ানি আর লাল পাগড়িতে মোহনকে আগের দিনের ভারতীয় প্রিন্সদের মত লাগছে। মোহন আমার দিকে তাকিয়ে মিষ্টি করে হাসি দিতেই ওর গালে জলতরঙ্গের মত হাল্কা টোল পড়লো। ভিডিও ক্যামেরম্যান মুহূর্তটিকে বন্দী করবার জন্য একবার আমার দিকে, আরেকবার মোহনের দিকে ক্যামেরা তাক করলো। উপস্থিত অতিথিদের মাঝে মিষ্টি একটা উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়লো।
আমাদের সোফার দুপাশে দুটো টাব চেয়ার। একটু পরপর দু পক্ষের আত্মীয়স্বজনরা এসে চেয়ারে বসছে। আমাদের সঙ্গে হেসে হেসে ছবি তুলছে। ছবির জন্য বাধ্যতামূলক রংঢং করতে করতে আমার কাহিল হবার দশা। এর মাঝে কাজী সাহেব এক ফাঁকে এসে বিয়ে পড়িয়ে রেজিস্ট্রি করলেন। কাজী সাহেব ওখান থেকে সরে যেতেই দুপক্ষের সব আত্মীয়স্বজন আমাদের ঘিরে ধরলো। এসব নিশ্চয় আগে থেকে পরিকল্পনা করা। একটা দশবারো বছরেরে মেয়ে ট্রে করে বর কণের আংটি নিয়ে এসেছে, এটাও একটা নতুন কায়দা। আমি বরের আংটি নিয়ে মোহনের অনামিকায় পরিয়ে দিলাম। সঙ্গে সঙ্গে অনেকগুলো ক্যামেরার ফ্ল্যাশ জ্বলে উঠলো। এবার মোহন আমার অনামিকায় কণের আংটি পরিয়ে দিলো। আমার পুরো শরীরটা কেঁপে উঠলো। তাহলে কী চিরবন্ধনে আবদ্ধ হলাম? আমার এত দিনের স্বাধীন জীবনের সমাপ্তি ঘটলো? একদিকে ভালো লাগলো আবার অন্যদিকে মনের ভেতর কেমন একটা চিনচিনে কষ্টও হলো।
একজন হিলপরা খালাম্মা টাইপের মহিলা গটগট করে এসে বললেন, এবার বর কণের শুভ দৃষ্টি বিনিময় হবে। আমার লাল চেলিটা কয়েকটা মেয়ে তখন আমাদের দুজনের মাথায় সামিয়ানার মত করে টেনে ধরলো। পরীর মত আরেকটা মেয়ে বড় একটা গোল আয়না নিয়ে এলো। আয়নার ফ্রেমে পিতলের কারুকাজ করা। দেখে মনে হয় কোন রাজার বাড়ি থেকে এনেছে। আয়নাটা সে আমাদের হাঁটুর কাছে এমনভাবে ধরলো যেন আমি আর মোহন দুজন দুজনকে সেই আয়নায় দেখতে পারি। খালাম্মা টাইপের মহিলাটা বলেলন, মনে করো তোমরা দুজন পুকুর পাড়ে বসে আছো, পানিতে তোমাদের প্রতিবম্ব, এবার একজন আরেকজনকে মনভরে দ্যাখো। আমি গভীর দৃষ্টিতে মোহনের দিকে তাকালাম। মোহনও আয়না দিয়ে আমার দিকে তাকালো। কিন্তু মোহনের দৃষ্টি কেমন এদিক ওদিক নড়ছিল। হঠাৎ মনে হলো, মোহনের সঙ্গে আমার যতবারই দেখা হয়েছে, ও অনেক বিনীতভাবে আমার সঙ্গে কথা বলেছে, কিন্তু কখনো চোখে চোখ রেখে গভীরভাবে তাকায়নি। মোহন কি কোন কারণে আমার দিকে সহজভাবে তাকাতে সংকোচ বোধ করে?
একটু দূরে দেয়াল ঘেঁষে একটা টাব চেয়ারে আম্মু বসে আছে। লাল সাদা জামদানিতে আম্মুকে মিষ্টি একটা পুতুলের মত লাগছে। শুধু মাথার কাচাপাকা চুলগুলো আম্মুর হঠাৎ বেড়ে যাওয়া বয়সের কথা মনে করিয়ে দেয়। আম্মুর পাশে আব্বু বসেছে। খদ্দরের পাঞ্জাবিতে আব্বুকে নিভন্ত আগ্নেয়গিরির মত শান্ত সমাহিত লাগছে। কেয়ার-গিভার আয়েশা আপাও আছেন, হঠাৎ কোন প্রয়োজন হয় যদি। আম্মুকে দেখে মনে হচ্ছে এখানে এসে অনেক আনন্দ পাচ্ছে। নিশ্চয় একমাত্র মেয়ের বিয়ে উপভোগ করছে। আবার এমন হতে পারে আম্মু ভাবছে অন্য কারও বিয়ে খেতে এসেছে। আব্বুর দিকে তাকিয়ে কষ্ট পেলাম। বেচারা একদিকে মেয়েকে নিয়ে, অন্যদিকে মাকে নিয়ে বেদনায় জর্জরিত। মোহনের ছোট বোন মিনু অনেকক্ষণ ধরে দূর থেকে আমাকে দেখছিল, এখন কাছে এসে বললো, ভাবী আমি মিনু, মোহনের ছোট বোন। পরিচয় হবার আগেই এত তাড়াতাড়ি বিয়ে হয়ে যাবে বুঝিনি। আজ তো বাসায় চলে আসবেন, অনেক কথা হবে।
হঠাৎ পিঠে কে চিমটি কাটলো, ঘুরে তাকিয়ে দেখি দিলশাদ মিষ্টি করে হাসছে। দিলশাদের পাশে অতন্দ্রিলা, অতন্দ্রিলা বললো,
– ইস, তোকে চাঁদের কণার মত লাগছে। বরটাও মন্দ না। আর দ্যাখ, কে এসেছে।
অতন্দ্রিলার পাশে বেঢপ মোটা পেট নিয়ে মিলি চলে এসেছে, মিলির সঙ্গে কুদ্দুস স্যার। কুদ্দুস স্যার বললেন,
-প্লেটো বলেছিলেন, অবশ্যই বিয়ে করো, কারণ বিয়েতে কোন ক্ষতি নেই। যদি তোমার সঙ্গী ভালো হয়, তুমি সুখী হবে, আর তোমার সঙ্গে খারাপ হলে তুমি দার্শনিক হবে।
মিলি কুদ্দুস স্যারের পিঠে হাল্কা চাপড় দিয়ে বললো,
-ইস, তোমার মার খাওয়ার সময় হয়েছে, এখানে ফিলোসফি শুরু করেছো।
নিজের অজান্তেই জাহাঙ্গিরনগরের এরা আমার পরিবার হয়ে গেছে। হঠাৎ কেন যেন খুব কান্না পেলো। অনেক কষ্টে নিজেকে সামলালাম। অতন্দ্রিলা আমার কানের কাছে মুখ এনে বললো,
-রঞ্জনকে নিয়ে ভাবিস না, রঞ্জন কোন ঝামেলা করতে পারবে না। ইন্সপেক্টর লাবণি ওকে এখনো ছাড়েনি, হি হি হি।
রঞ্জনের সাথে মেশা আসলে আমার উচিত হয়নি। আমি কোন অ্যাডভেঞ্চারাস মেয়ে না। আমি সব সময় স্থির, স্বাভাবিক একটা সংসার চেয়েছি, এখন রঞ্জন একটা কাঁটা হয়ে মনের ভেতর গেঁথে থাকবে।
হৈ হট্টগোলের ভেতর কখন যে বিয়ে অনুষ্ঠান ফুরিয়ে গেলো টেরই পেলাম না। যাবার সময় আব্বু আমাকে জড়িয়ে শিশুর মত কেঁদে ফেললো, আমিও অনেক কাঁদলাম। আম্মু অনেকক্ষণ ধরে কী হচ্ছে বোঝার চেষ্টা করলো, বোধহয় ভুলে গেছে কার বিয়েতে এসেছে। কিন্তু একটু পরই আম্মুর স্মৃতি ফিরে এলো, তারপর আমাকে জড়িয়ে ধরে সেই কী কান্না। দিলশাদ আর অতন্দ্রিলা আম্মুকে কোন মতে সামলালো।
আমাদের ফুলে ছাওয়া গাড়িটা যখন বেইলি রোডের দিকে রওনা হলো, মোহন ওর হাতটা আমার হাতের উপর রাখলো। এই প্রথম কারো স্পর্শ ভালো কী মন্দ তা নিয়ে আমার দুবার ভাবতে হলো না। মোহন কীভাবে কীভাবে পাঁচদিনের ভেতর বিয়ের আয়োজন করে ফেললো, সবচেয়ে বড় কথা আম্মু আনন্দ নিয়ে আমার বিয়েটা দেখে যেতে পারলো। মোহনের প্রতি কৃতজ্ঞতায় মন ভরে গেলো। আমি মোহনের দিকে তাকিয়ে বললাম,
-থ্যাংক ইউ, মোহন।
মোহন উত্তর দেবার আগেই কোত্থেকে ওর মোবাইলে একটা ফোন এলো । নিশ্চয় গুরুত্বপূর্ণ ফোন, তা না হলে এ সময় কে ফোন করবে? ও কথা বলতে বলতে গাড়ি ওদের বাড়ির গেটে চলে এলো। বাড়িতে ঢুকে মোহন আমাকে ওর বাবার ঘরে নিয়ে গেলো। মোহনের বাবা পক্ষাঘাতে শয্যাশায়ী। বিয়েতে আসতে পারেননি। ভেতরে ঢুকে দেখলাম উনি বিছানায় কাত শুয়ে আছেন, চোখ বোজা, বোধহয় ঘুমোচ্ছেন। মোহন হাল্কা করে ওনার কাঁধ ছুঁয়ে বললো, বাবা।
শ্বশুর সাহেব প্রায় সঙ্গে সঙ্গে চোখ মেললেন। প্রথমে মোহনের দিকে দিকে চাইলেন, তারপর দৃষ্টি ফিরিয়ে আমার দিকে তাকালেন। মোহন বললো,
– বাবা, এটা রূপা, আমার বউ।
মোহনের বাবা ক্ষীণ স্বরে বললেন,
-কেমন আছো মা? খারাপ লাগছে না তো?
ওনার মা ডাকে কী যেন একটা ছিল, মনে হলো উনি আমাকে মেয়ের মত করেই মায়া করবেন। আমি বললাম,
-আমি ভালো আছি বাবা। সামান্য মন খারাপ লাগছে কিন্তু ঠিক হয়ে যাবে।
আমাদের কথার মাঝে মোহনের সৎ মা ট্রে করে এক গ্লাস দুধের শরবত এনে আমাকে দিয়ে বললেন,
-এটা খেয়ে নাও।
আমি কিছু না বলে দুধের শরবত খেয়ে নিলাম। একটু পর মোহন আমাকে ওর ঘরে নিয়ে এলো। বাসর রাতের জন্য সেগুন কাঠের কিং সাউজের বিছানাটা ফুল দিয়ে সাজানো হয়েছে। বিছানার পাশের দেয়ালে একটা বড় জানালা। জানালায় পর্দা দেয়া। চাঁদের আলোয় সেই পর্দা কেমন জ্বলজ্বল করছে। আমি পর্দা সামান্য সরাতেই বিরাট চাঁদটা আমার দিকে তাকিয়ে হেসে উঠলো। ঠিক তখুনি টের পেলাম আমার মেরুদন্ড আর তলপেটে কেমন মৃদু ব্যথা শুরু হয়েছে। এই ব্যথার সঙ্গে আমার প্রতি মাসে একবার পরিচয় ঘটে। বিয়েটা তাড়াহুড়া করে এগিয়ে আনা হয়েছে ঠিকই কিন্তু এই ব্যথা আসার কথা আরও এক সপ্তাহ পর। নানা চাপে নিশ্চয় সাইকেল বদলে গেছে। আজ সঙ্গে কোন ইমারজেন্সি ব্যবস্থাও নেই।
(চলবে)
পর্ব ২৩ https://www.facebook.com/groups/Anyaprokash/permalink/1369670466881310/
পর্ব ২৫ https://www.facebook.com/groups/Anyaprokash/permalink/1372051429976547/