প্রজাপতি উৎসব
#প্রেমের_গল্প #প্রজাপতি_উৎসব
পর্ব ৩৬
আমার শাড়ি পরতে দারুণ ভালো লাগে।
আমার ভঙ্গুর মনকে জগতের ম্লানিমা থেকে আড়াল করবার জন্য আমার পল্কা শরীরকে একেক দিন ঘিরে থাকে একেক রঙের শাড়ি।
তাই যে কোন নিমন্ত্রণে যাবার আগে আমি যত্ন করে শাড়ি পরি, কপালে শাড়ির রঙ্গ মিলিয়ে গোল টিপ দিই, ঠোঁটে খুব হাল্কা করে মাখি ওষ্ঠরঞ্জনী। পৃথিবীতে কে না চায় তাকে সুন্দর দেখাক? যে নিজেকেই সুন্দর দেখতে চায় না সে কীভাবে পৃথিবীকে সুন্দর দেখতে চাইবে?
কোথাও গেলে মেয়েরা আমার পরিমিত সাজের প্রশংসা করে। ছেলেরা মুগ্ধ হয়ে তাকায়। মোহন প্রশংসা করে না। আবার মন্দও বলে না। সে একটা গৌতম বুদ্ধ টাইপের নির্বিকার ভাব নেয়। জানি না কেন। অথচ রাতের অন্ধকারে আমার শরীর নিয়ে মোহনের লোলুপতার শেষ নেই। তো দিনের আলোয় আমার দিকে একটু মুগ্ধ চোখে তাকায় না কেন? একটু সুন্দর করে প্রশংসা করে না কেন? ওদিকে অন্য কোন লোক আমার সৌন্দর্যের প্রশংসা করলে সে তটস্থ হয়ে ওঠে, যেন রূপবতী হয়ে আমিই কোন অন্যায় করে ফেলেছি।
আজ সন্ধ্যায় লাল সিল্কের শাড়ি পরে সুন্দর করে সেজেছিলাম। হঠাৎ ইচ্ছে করছিল সৌন্দর্যের মূর্ছনায় মোহনকে মোহিত করতে, ওর মায়া পেতে। মোহন ফিরলো একটু রাত করে, ঘড়িতে তখন রাত পৌনে এগারোটা। পদ্মপাতা ঘুমিয়ে পড়েছে। দরজা খুলতেই মোহন হাল্কা মাতাল কন্ঠে বললো,
-কী রূপা, খুব মৌজ করছো? বসন্ত এসে গেছে বুঝি?
-মানে?
-কার জন্য সেজেছো?
আমি আহত হয়ে বললাম,
-কার জন্য সাজবো আবার? তোমার জন্য।
-তুমি জানো আমি ড্রিংক করলে দেরীতে ফিরি। কে আসে তখন ঘরে?
-কে আসবে ঘরে? কেউ আসে না। একদিন সাদিয়া আপু এসেছিল সেটা তো তোমাকে বলেছি।
-শাক দিয়ে মাছ ঢাকো, অ্যাঁ? সাদিয়া দিয়ে লম্পট বাতেনকে ঢাকো?
কবে আমাদের কমিউনিটির বাতেন ভাই আমার সঙ্গে ফ্লার্ট করার চেষ্টা করেছেন, ফেসবুকে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠিয়েছিলেন, মোহন সেটা নিয়ে এখনও লেগে আছে। আমি তো ভদ্রতার সীমা রেখেই বাতেন ভাইয়ের সঙ্গে কথা বলেছি, ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট অ্যাকসেপট করিনি। আমি আহত কন্ঠে বললাম,
-মোহন, তুমি আমার হাজবেন্ড। আমি কি তোমার জন্য সাজতে পারি না? একটা মেয়ে তো তার বরের জন্যই সাজে।
মোহন অবিশ্বাসের হাসি দিয়ে বললো,
-আমার সঙ্গে এসব লুলামি করো না প্লিজ। মেয়েরা কখন কেন আবেদনময়ী সাজ দেয় সব আমার জানা। তোমার এই নটিগিরি আমার জন্য না। প্লিজ, বলো আমি না থাকলে কে আসে বাড়িতে? লুচু বাতেন নাকি নতুন কোন নাগর?
মোহনের কথায় আমার কান লাল হয়ে গেছে। পদ্মপাতা ঘুমিয়ে ছিল। হৈচৈ শুনে ওর ঘুম ভেঙ্গে গেছে। পদ্মপাতা বিছানায় উঠে বসেছে। ও আমাদের দুজনের দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে আছে। মোহন বিছানার কাছে গিয়ে ছোঁ মেরে পদ্মাপাতাকে দু হাতে পাতালি করে উঠিয়ে বললো,
-ঠিক করে বলো, কে এসেছিল? নইলে তোমার মেয়েকে মেঝেতে আছাড় মারবো।
পদ্মপাতা কি শুধু আমার মেয়ে, ওর কেউ না? আমি পুলিশে খবর দিতে পারি কিন্তু পুলিশ এলে ও উল্টো ইনিয়েবিনিয়ে বলবে আমিই পদ্মপাতাকে মেরেছি। আমি মোহনের কাছে গিয়ে ওর হাত ধরে বললাম,
-বিশ্বাস করো, কেউ আসেনি। তুমি পদ্মপাতাকে জিগেস করে দ্যাখো।
পদ্মাপাতা এখন ভয়ে কাঁদছে। পদ্মপাতার কান্না শুনে বোধহয় মোহনের সম্বিত ফিরলো। আমি মোহনের কাছে থেকে পদ্মাপাতাকে আমার কোলে টেনে নিলাম। পদ্মপাতা আমার ঘাড়ে মুখ গুঁজে রেখেছে। ওর শরীরটা আতঙ্কে কাঁপছে। আমি পদ্মপাতাকে বিছানায় নিয়ে অনেকক্ষণ চেষ্টা করে ঘুম পারালাম। পদ্মপাতা ঘুমিয়ে যাবার পর মোহন আমার কাছে এসে বললো,
-স্যরি রূপা, তুমি তো জানো আমার মাথা হঠাৎ আওলায়ে যায়, প্লিজ আমাকে মাফ করে দাও। আর এমন হবে না। বিছানায় চলো, খুব ইচ্ছে করছে, প্লিজ।
আমি কোন উত্তর দিলাম না। আমি জানি এটা একটা চক্রের মত। প্রতি এক দু সপ্তাহ পরপর একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হয়। প্রতিবারই ওর অত্যাচারের মাত্রা একটু একটু করে বাড়ছে। প্রতিবারই সে ক্ষমা চাচ্ছে। এর শেষ কোথায়? এভাবে আর কতদিন? প্রতিবার ভাবি, আর না, এবার সংসার ছেড়ে চলে যাবো। আবার মনে হয়, একবার চলে গেলে পদ্মাপাতা ব্রোকেন ফ্যামিলির মেয়ে হয়ে বড় হবে। সে কথা ভেবে মন দমে যায়।
দেখতে দেখতে সুখেদুঃখে এ দেশে প্রায় আড়াই বছর হয়ে গেলো। সোয়াস মানে স্কুল অফ ওরিয়েন্টাল অ্যান্ড আফ্রিকান স্টাডিজে আমার মাস্টার্স কমপ্লিট হয়ে গেছে। মোহন যে মাঝপথে আমার পড়া থামিয়ে দেয়নি সেটা বড়ই আশ্চর্য ব্যাপার। এ দেশে মাস্টার্সের ক্লাস সপ্তাহে একদিন কি দুদিন, আর থিসিস তো চাইলে ঘরে বসেই লেখা যায়। মোহন কিছু বুঝার আগেই আমার কোর্স শেষ হয়ে গেছে। রেজাল্টও খুব একটা খারাপ হয়নি। থিসিসে ডিস্টিংকশন ছিল, ওভারঅল মেরিট পেয়েছি।
আমার থিসিস সুপারভাইজর মিসেস বেকহাম একটা বড় রিসার্চ গ্র্যান্ট পেয়েছেন। ওনার রিসার্চ প্রজেক্টের কাজ হলো ইউকেতে দ্বিতীয় প্রজন্মের বাঙ্গালীদের বাংলা ভাষার ব্যবহার এবং বাংলা ভাষার প্রতি তাদের মনোভাব বিশ্লেষণ করা। প্রজেক্টে একজন ফান্ডেড পিএইচডি স্টুডেন্ট নেয়া হবে। মিসেস বেকহাম আমাকে অ্যাপ্লাই করতে বলেছিলেন। আমি অ্যাপ্লাই করেছি কিন্তু এখনো মোহনকে জানাইনি। আগে থেকে মোহনকে জানালে ও হয়তো কোন ভুজুংভাজাং দিয়ে আমাকে অ্যাপ্লাই করতে মানা করবে। এই প্রোগ্রামের একটা এসেনশয়াল ক্রাইটেরিওন হলো ক্যান্ডিডেটকে বাংলা জানতে হবে এবং সিলেটি বুঝতে হবে। গতকাল জানলাম আমি শর্ট লিস্টেড হয়েছি। মঙ্গলবার দিন জুম ইন্টারভিউ । দেখা যাক কী হয়।
কাজটা পেলে চার বছরের টিউশন ফি ইউনিভার্সিটি দেবে। তারচেয়ে বড় ব্যাপার হলো প্রতি বছর ষোল হাজার পাউন্ড ভাতা পাওয়া যাবে, মানে মাসে তেরশ পাউন্ডেরও বেশী। এ দেশে স্কলারশিপের উপর কোন ট্যাক্স নেই। এই টাকা আর গ্রসারি শপের আয় মিলিয়ে আমি একটা স্টুডিও আপার্টমেন্ট ভাড়া করে থাকতে পারবো। মোহন হঠাৎ শায়লা, নায়লা কিংবা লায়লার সঙ্গে চলে গেলে আমি অন্তত মেয়েকে নিয়ে পথে পড়বো না। বৃত্তিটা পেলে মোহনের ভিসার উপর আমি আর ডিপেন্ডেন্ট থাকবো না। আমার ভিসা কনভার্ট করে আমি স্টুডেন্ট ভিসা নিয়ে নেবো। মঙ্গলবার আসতে এখনো চারদিন বাকি। তারপর বোঝা যাবে আমার ভাগ্যে কী আছে।
একটু আগে আমরা ব্রাইটন সি বিচে ডে ট্রিপে এসেছি। আমরা তিন ফ্যামিলি, আমি, মোহন আর পদ্মপাতা, সাদিয়া আপু আর সেলিম ভাই, এলিটা আর ওর হাজবেন্ড রাজু। শেষ পর্যন্ত এলিটা বাংলাদেশেই বিয়ে করেছে। ওর হাজবেন্ড রাজুর দুটো শর্ত ছিল, ওকে ইউকের সিটিজেনশিপ ম্যানেজ করে দিতে হবে আর এলিটাকে কুমারী হতে হবে। এলিটা টার্কিতে সার্জারি করে কুমারী হয়ে এসেছে, এখন শুধু রাজুর সিটিজেনশিপের অপেক্ষা। হয়তো সিটিজেনশিপের কারণেই রাজু এলিটাকে খুব সমঝে চলে।
বাইরে চড়া রোদ। আমি আধঘন্টা সৈকতে হেঁটে ক্লান্ত হয়ে তাবুতে বই হাতে বসেছি। সমুদ্রের তীরে শর্টস আর বিকিনি পরে অনেক ছেলে মেয়ে হাঁটছে, দৌড়ুচ্ছে, সাঁতার কাটছে। সমদ্রের উপর দিয়ে সি গাল দল বেঁধে উড়ছে, ভাসছে, ডানা ঝাপ্টাচ্ছে। রোদের প্রতাপে সিবিচের বালু চকচক করছে।
মোহন পদ্মাপাতাকে নিয়ে সমদ্রের তীরে পা ডুবিয়ে হাঁটছে। হাল্কা ঢেউ ওদের দিকে আসতেই ওরা লাফ দিয়ে ঢেউকে ফাঁকি দিচ্ছে। এই মাত্র এলিটা মোহনের দিকে হেঁটে গেলো। মোহন কি চকিতে এলিটার পিঠে হাত রেখেই হাত সরিয়ে নিলো নাকি আমি ভুল দেখলাম? ওরা দুজনএখন মন খুলে হাসছে। হাসতে হাসতে ওরা সামনে এগোচ্ছে। পদ্মপাতা পেছনে পড়ে দাঁড়িয়ে আছে, ওরা খেয়াল করছে না, ওরা দুজন দুজনে মশগুল।
হঠাৎ একটা প্রবল ঢেউ এসে পদ্মপাতাকে সমুদ্রে টেনে নিলো।
(চলবে)
পর্ব ৩৫ https://www.facebook.com/groups/Anyaprokash/permalink/1387048305143526/
পর্ব ৩৭ https://www.facebook.com/groups/Anyaprokash/permalink/1387795675068789/