প্রজাপতি উৎসব
#প্রেমের_গল্প #প্রজাপতি_উৎসব
পর্ব ৩৭
-ঠিক করে বলুন তো আপনারা কোথায় ছিলেন যখন বাচ্চাটা সমুদ্রে ডুবে গেলো?
কোস্টগার্ড আমাদের সাথে শান্ত কন্ঠে কথা বলছেন। কিন্তু এমনভাবে তাকাচ্ছে্ন মনে হচ্ছে আমরা কতগুলো নির্দয় পাষণ্ড, ঠান্ডা মাথার খুনি। এমন দুঃসময়ে ও রকম দোষী সাব্যস্ত করা ছুরির ফলার মত দৃষ্টি আমি নিতে পারছিলাম না। আমি কাঁদতে কাঁদতে বললাম,
-আমি তাবুতে ছিলাম। ওর বাবা ওকে নিয়ে তীর ধরে হাঁটছিল। ওর বাবা একটু সামনে এগিয়ে গিয়েছিল আর তখুনি ঢেউ এসে পদ্মপাতাকে ভাসিয়ে নিলো। আমি সঙ্গে সঙ্গে তাবু থেকে দৌড়ে গিয়েছি পদ্মপাতাকে বাঁচাতে কিন্তু ততক্ষণে যা হবার হয়ে গেছে।
এলিটা আমার পাশে চোরের মত দাঁড়িয়ে আছে। আমি এলিটার দিকে শীতল দৃষ্টিতে তাকালাম। এই মেয়ে মোহনের নারী ভার্সন। কেন যেন আমি কোস্টগার্ডকে এলিটার কথা বলতে পারলাম না। মনে হলো এলিটার কথা বলা মানে পুরো পৃথিবীকে জানিয়ে দেয়া আমার স্বামী আমার প্রতি আর আকৃষ্ট না, আমি মোহনকে মায়ার বাঁধনে জড়াতে পারিনি। আমি একজন ব্যর্থ স্ত্রী।
-আপনারা কি ব্রাইটন অ্যান্ড হোভ সিটি কাউন্সিলের ওয়েবসাইট দেখে আসেন নাই?
-না। কী দেখবো?
-আমাদের ওয়েবসাইটে পরিষ্কার করে বলা আছে পুরো ইউকের মধ্যে ব্রাইটন সি বিচে সর্বোচ্চ সংখ্যক লোক সমুদ্রে ডুবে মারা যায়। আর বাচ্চাদের মৃত্যুর ঝুঁকি সবচেয়ে বেশী। নিরীহ নিরালা ঢেউ চোরের মত এসে বাচ্চাদের ভাসিয়ে নিয়ে যায়।
মোহন এবার মুখ খুললো,
-আমরা জানতাম না ব্রাইটন সি বিচে ক্যাজুয়াল্টি সবচেয়ে বেশী। জানলে হয়তো গ্রেট ইয়ারমাউথ কিংবা সাউথেন্ড অন সি-এ যেতাম। কিন্তু এখন এ কথাগুলো বলে কী হবে? যা হবার তা তো হয়েই গেছে। কী ফর্মালিটিজ করতে হবে সেটা বললে ভালো হয়।
-ফর্মালিটিজ বলতে আমরা ভিক্টিমকে হাসপাতালে পাঠাচ্ছি। আপনাদের গাড়ি আছে না?
-হ্যাঁ, আছে।
-আম্বুলেন্সের পেছনে পেছনে অথবা আলাদা করে ব্রাইটন হাসপাতালে চলে যান। ওখান থেকে ভিক্টিমকে বুঝে নেবেন।
আমার মনটা হুহু করে উঠলো, কোনভাবেই কান্না সামলাতে পারলাম না। আহারে আমার পদ্মপাতা, আহারে আমার চাঁদের আলো। আমার কেন বারবার এমন হয়? আমি কেন এত দুর্ভাগ্য নিয়ে পৃথিবীতে আসলাম?
আমরা হসাপাতালে পৌঁছে দৌড়ে ইমারজেন্সিতে গেলাম। আমাদের পরিচয় দিলাম। একজন নার্স এসে আমাদের দিকে আর্দ্র দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন, আমাকে ফলো করুন। নার্সের পেছন পেছন আমরা একটা ঘরে ঢুকলাম। দেখলাম আমার পদ্মপাতার শান্ত শরীরটা সাদা চাদরে ঢাকা। শুধু মুখের অংশ খোলা। পদ্মপাতার মুখটা যেন আমার মুখ কেটে বসানো। মাতৃমুখী মেয়েরা কি দুর্ভাগা হয়?
পদ্মপাতার মুখে এখন অক্সিজেন মাস্ক বসানো। ডাক্তার বললেন,
-যদিও কোস্টগার্ড সময়মত কৃত্রিম শ্বাস দিয়েছে, সিপিআর করেছে তবু আমরা নিশ্চিত হতে চাই ওর ব্রেইনে যথেষ্ট অক্সিজেন যাচ্ছে। তাছাড়া বেশ অনেকক্ষণ তো সে পানিতে ডুবে ছিল, আমাদের এম আর আই স্ক্যান করে নিশ্চিত হতে হবে ব্রেইনের কোন ক্ষতি হয়নি।
আমি মনে মনে বললাম, হে আল্লাহ, আপনার কাছে হাজার শোকর আমার মেয়েটা বেঁচে আছে। প্রিয় কাউকে পেয়ে হারানোর মত কষ্ট পৃথিবীতে আর কি হতে পারে?
রাতে আমার সোনাপাখি পদ্মপাতাকে ঘরে নিয়ে এলাম। মোহন আজ সত্যিই একটু মিইয়ে গেছে। মিথ্যা মোহের খেসারত কীভাবে দিতে হয় তার একটা আভাস আজ সে পেয়েছে। কাবার্ডে হুইস্কির বোতল আছে। আজ সেটা মোহন ছুঁয়েও দেখলো না। কিচেনে গিয়ে ইনস্ট্যান্ট সুপ গরম পানিতে গুলিয়ে একটা বাটিতে করে সে পদ্মপাতার জন্য নিয়ে এসেছে। এই প্রথম মোহন কিছু একটা নিজের হাতে রাঁধল।
কিন্তু মোহনের এই সংযত আচরণে আজ আর আমার মন দ্রব হলো না। এতদিন ধরে চিকন সুতার একটা বন্ধনে আমি আর মোহন কোনরকমে বিজড়িত ছিলাম। সেই বন্ধনটি আজ ছিন্ন হয়ে গেলো। মোহনের প্রতি আমার মন চিরতার রসের চেয়েও তিতে হয়ে গেছে। আমি মনে মনে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছি আর মোহনের সঙ্গে ঘর করবো না।
আশ্চর্য ব্যাপার হলো এই সিদ্ধান্ত নেবার পর আমার ভেতরের সব অস্থিরতা কর্পূরের মত উবে গেছে। আমি অদ্ভুত প্রশান্তি অনুভব করছি। মোহনের উপর আমার আর রাগ হচ্ছে না। কারণ মোহন এখন থেকে আমার কেউ না।
ব্রাইটনের ঘটনার পর দু সপ্তাহ চলে গেছে। হঠাৎ মনে হচ্ছে, আমাকে শিক্ষা দেবার জন্য সমুদ্র সৈকতের ঘটনাটি মোহন ইচ্ছে করে ঘটায়নি তো? সে তো কখনোই সন্তান চায়নি, আমার চাপে পড়ে সন্তান নিয়েছে। তা না হলে গত পরশু সে আবার কেন পদ্মপাতার গায়ে হাত তুললো? তরকারিতে ঝাল বেশী হওয়া এমন কী অপরাধ ছিল? ভাগ্যিস আমার পিএইচডি স্কলারশিপ হয়ে গেছে। এখন আমি নিজেকে নিয়ে ভাবতে পারবো।
গ্রসারি শপে আমি এখন বুধ এবং বৃহস্পতিবারও কাজ করি। ওই সময়টা পদ্মপাতা একটা ডে কেয়ার সেন্টারে থাকে। আজ দুপুরে হঠাৎ সোশাল সার্ভিসের দুজন মহিলা একজন পুলিশসহ বাড়িতে এসে হাজির। কী ব্যাপার জানতে চাইলে ওরা উল্টো জিগেসে করলো,
-আপনি কি পদ্মপাতার মা?
-জি।
-আমরা কি ভেতরে আসতে পারি?
-জি আসুন।
ওদেরকে লিভিং রুমে নিয়ে সোফায় বসতে বললাম। বয়স্ক মহিলাটির নাম মিসেস পার্কার। মিসেস পার্কার বললেন,
-আপনার জন্য একটা ব্যাড নিউজ আছে।
আমি বিচলিত হয়ে বললাম,
-কী নিউজ?
-পদ্মপাতার নার্সারি থেকে পুলিশে জানিয়েছিল পদ্মপাতার শরীরে অনেকগুলো আঘাতের চিহ্ন পাওয়া গেছে। যতবার জিগেস করা হয়েছে কেউ মারে কিনা, পদ্মপাতা ওর বাবার কথা বলেছে।
পুলিশের লোকটির নাম মিস্টার জোন্স। মিস্তার জোন্স বললেন,
-আপনার হাজবেন্ডকে আমরা অফিস থেকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য পুলিশ স্টেশনে নিয়ে গেছি। উনি স্বীকার করেছেন যে মেয়েকে মারেন। ওনাকে পুলিশ কাস্টডিতে রেখে কাল আদালতে নেয়া হবে।
মিসেস পার্কার বললেন,
-আপনি কি পদ্মপাতাকে একা দেখে রাখতে পারবেন? না পারলে সোশাল সার্ভিস কিছুদিন টেক কেয়ার করবে।
আমি আঁতকে উঠে বললাম,
-জি না, আমি পারবো।
মিস্টার জোন্স বললেন।
-আপনার হাজবেন্ড তো এখানে ওয়ার্ক ভিসায়?
-জি।
-আপনাকে সতর্ক করে দিচ্ছি, আদালতে অভিযোগ প্রমানিত হলে আপনার হাজবেন্ডকে এখান থেকে ডিপোর্ট করা হবে। সে ক্ষেত্রে আপনাকেও দেশ ছেড়ে চলে যেতে হতে পারে। আমি রেকমেন্ড করবো আপনি যত তাড়াতাড়ি সম্ভব কোন ইমিগ্রেশন লইয়ারের সঙ্গে কথা বলুন।
ওরা চলে যাবার পর আমি কিছুক্ষণ থ হয়ে রইলাম। ঘটনার দৈর্ঘ্য, প্রস্থ এবং গভীরতা বুঝতে আমার অনেকক্ষণ লেগে গেলো।
(চলবে)
পর্ব ৩৬ https://www.facebook.com/groups/Anyaprokash/permalink/1387457668435923/
পর্ব ৩৮ https://www.facebook.com/groups/Anyaprokash/permalink/1388305711684452/