প্রণয় প্রহেলিকা পর্ব-৩৭

0
664

#প্রণয়_প্রহেলিকা (কপি করা নিষিদ্ধ)
#৩৭তম_পর্ব

ফ্লাস লাইটটা হাতের কাছে মারতেই দেখলো টকটকে লাল তরল। অজানা ভয়টি ক্রমশ তীব্র হলো দীপ্তের। অমনেই চিৎকার করে জ্ঞান হারালো সে। এদিকে উপর তালার জানালায় কান লাগানো জমজেরা তার চিৎকার শুনেই হাই ফাইভ দিয়ে বলে উঠলো,
“চেরাগআলী এবার বাছা কই যাবা”

কথাটি বলেই তারা পৈশাচিক হাসি দেবার চেষ্টা করলো কিন্তু ব্যর্থ হলো। গলার স্বরে টান খেয়ে উভয় ই কাঁশতে লাগলো। এই পুরো বুদ্ধিটি এশা আশার। শিল্পী দাদীর নাতনী ফাইজা তাদের বান্ধবী, আসলে ঠিম বান্ধবী বলা চলে না। বি’চ্ছুদ্বয়ের সাথে তার সখ্যতার কারণ তাদের দ’স্যু’প’না। এই দ’স্যু’প’নার কারণে স্কুলে তাদের দাপট ই আলাদা৷ সারা ক্লাসের মেয়েরা তাদের ভয় পায়। বলা তো যায় কখন কার উপর তাদের ক্রোধানল বর্ষণ হয়। ঠিক একারণে ফাইজাও তাদের সমীহ করে চলে। আর বি’চ্ছু’রাও সেটার সম্পূর্ণ ফয়দা তুলে। আজ ফাইজার জন্মদিন বটে কিন্তু তাদের দাওয়াতটি তারা নিজেই নিয়েছে। শুধু তাই নয়, ফাইজাকে বলেছে আজ এবাড়িতে তারা থাকবে। ফাইজাও বাধ্য তাদের কথা মেনে নিলো। কেক কাটার পর তারা কেক দেবার উছিলাতে নিচে এসেছে। রোকসানা দরজা খুলেছিলো। রোকসানাকে কথায় ব্যস্ত রেখেছিলো আশা এবং ফাইসা। সেই সুযোগে এশা দীপ্তের ঘরে ঢুকে। দীপ্ত বাসায় না থাকার সুযোগে অনলের ঘর থেকে চুরি করা ছোট ব্লুতুথ স্পীকার ঘরের এক গুপ্ত জায়গায় রেখে দেয় এবং পলিথিনের এক ব্যাগ লা জল রং ঘোলা তার বিছানায় দিয়ে দেয়। তারপর দীপ্ত ফেরার অপেক্ষা করে।দীপ্ত ফিরতেই সারা বিল্ডিং এর মেইন সুইচ সিড়িঘড় থেকে বন্ধ করে দেয় আশা। ফলে লোডশেডিং এর একটা পরিবেশ তৈরি হয়। এশা তখন ঠিক দীপ্তের ঘরের উপর তালার ঘরে অবস্থান নিয়েছিলো। সেই জানালা থেকে একটি কর্কশীট কাটা নারী অবয়ব সুতোয় ঝুলিয়ে দীপ্তের জানালার সামনে ধরে সে। দীপ্তের ঘরের জানালা দেওয়া ফলে অন্ধকারে কর্কশীটের সেই কাটা অংশটিকে নিকষকালো নারী অবয়ব মনে হয়। দীপ্তে ফ্লাশ লাইট ধরার আগেই তা নিপুন ভাবে উঠিয়ে নেয় এশা। ফলে ফ্লাশ লাইট মারতেই অবয়ব হাওয়ায় মিলিয়ে যায়। উপরন্তু পুরোনো বিল্ডিং হওয়ায় উপর তালা থেকে খুব সহজেই ব্লুথুত কানেকশন পাচ্ছিলো তারা। ফলে ফাইজার মোবাইল থেকেই ভুতুরে হাসি এবং কথার রেকর্ডিং চালিয়ে দেয়। এই বাড়ির নামে গুজবটিও পাড়ায় তারাই ছড়িয়ে ছিলো। যা বিগত সপ্তাহখানেক দীপ্ত শুনেছে। তার ঘরটির সিলিং ফ্যানেই নাকি ঝু’লে মেয়েটি আ’ত্ম’হ’ত্যা করেছিলো। ডাক্তার হলেও মানুষের অবচেতন মনে ভীতি জন্মায়। সপ্তাহ খানেক এই ভীতিটা মনে সঞ্চার করেছিলো দীপ্ত। কিন্তু তোয়াক্কা করে নি। তবে আজ তার সাথে হওয়া ঘটনাগুলোয় সেই ভীতি প্রকোষ্ঠ ভেদ করে বেরিয়ে এসেছে। ফলে যখন ই বিছানায় রাখা ঘন তরল তার হাতে লেগেছে অমনি তার মস্তিষ্ক নিষ্ক্রিয় হয়ে উঠেছে এবং চিৎকার দিয়ে জ্ঞান হারিয়েছে দীপ্ত। অন্যদিকে নিজের ফাঁদে আটকানো ঘুঘুর চিৎকারে এশা আশার খুশি যেনো ধরে না। ফাইজা এক কোনায় দাঁড়িয়ে অসহায় কন্ঠে বললো,
“ভাইয়াটা ভালো, এমন করে ভয় দেখানোটা ঠিক হয় নি”

সাথে সাথেই তেঁতে উঠলো আশা৷ ধমকের সুরে বললো,
“অস্ট্রেলিয়ান চেরাগআলীর সাথে উচিত কাজ করেছি। আমাদের সাথে খুব ভাব দেখাচ্ছিলো। নে, এবার ভয়ে কুপকাত হ। আমাদের ধারাপুকে নিয়ে যাবার হু’ম’কি দেয়। কি সাহস! ওর সাথে আর কি কি করি দেখ!”

ফাইজা শুকনো ঢোক গিললো। এশা আশার পৈশাচিক হাসি দেখেই বোঝা যাচ্ছে দীপ্তের সাথে ভালো কিছু হবে না।

দীপ্তের চিৎকারে ছুটে আসলেন সেলিম এবং রোকসানা। ততসময়ে ঘরের লাইট চলে এসেছে। ঘরের লাইট জ্বালিয়ে দেখলেন দীপ্তের গা লালে রক্তিম হয়ে আছে। ছেলেটা মূর্ছা গেছে। পানি ছিটাতেই জ্ঞান ফিরলো তার। অস্পষ্ট স্বরে বললো,
“ভু…ভুত, এই ঘরে ভু…ত”
“কি বলছো দীপ্ত, আমি রোকসানা আন্টি”

সেলিম সাহেব উঠে বসালেন দীপ্তকে। দীপ্ত ঘন ঘন শ্বাস নিচ্ছে। তার জড়তা এখনো কাটে নি। বুকের স্পন্দন লাগাম ছাড়া। পালস অক্সিমিটারে মাপলে ১২০ এর উপর হবে হয়তো। সেলিম সাহেব তাকে বাড়ির গ্লাস এগিয়ে দিয়ে বললো,
“কি হয়েছে?”

দীপ্ত পানিটুকু এক নিঃশ্বাসে খেয়ে নিলো। তারপর একটু জিরিয়ে পুরো ঘটনাটা বললো। ঘটনাটি শুনতেই রোকসানা রক্তশুণ্য হয়ে গেলো। ভুতে তার বিশাল ভয়। সে উত্তেজিত হয়ে বললেন,
“আমি এখানে থাকবো না, আমি দেশে যাবো”

কিন্তু সেলিম সাহেব নির্বিকার। তপ্ত নিঃশ্বাস ছেড়ে একরাশ বিরক্তি নিয়ে বললেন,
“ডাক্তার হয়ে ভয় পাচ্ছো দীপ্ত! ভুত টুত হয় না। ফ্রেশ হয়ে খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ো। আর রোকসানা তুমি যেতে চাইলে আমি টিকিট কেটে দিবো”

সেলিম সাহেবের এমন নির্বিকার আচারণে বেশ রোকসানার মনক্ষুন্ন হলো৷ বরাবর এই লোকটির এমন দায়সারাভাব। এদিকে ভীত, সন্ত্রস্ত দীপ্ত এখনো থমথমে দৃষ্টিতে জানালার দিকে তাকিয়ে রইলো। তার মনে ভুল ছিলো কি সব!

***********

ক্যালকুলাসের বই এর প্রথম চ্যাপ্টার থেকে ম্যাথ করা শুরু করেছে ধারা। তাকে আজ থেকেই প্রস্তুতি নিতে হবে। তাকে প্রমাণ করতে হবে অনল ভাই প্রশ্ন দেয় নি তাকে। তার সাথে ভেদাভেদ করে নি। ভালোবাসাও বেশ অবাককর জিনিস। প্রণয়ের আবেগে মানুষ সব কিছু করতেও দ্বিধাবোধ করে নি। নয়তো যে ধারাকে বকেও অনল পড়াতে বসাতে পারে না সেই ধারা কিনা নিজে নিজে পড়তে বসেছে তাও ভার্সিটি থেকে আসার পর থেকেই। অনল অবশ্য এখনো ফিরে নি। ধারা তাকে ফোন ও করে নি। অভিমানটা বজায় রেখেছে। যদিও বড়মাকে দশবারের মতো জিজ্ঞেস করেছে, “তোমার ছেলে আসে না কেনো?”

বড়মা মটরশুটি ছিলতে ছিলতে বললো,
“তুই ফোন দে”
“না, ওর সাথে কথা নেই”

বড় মা হাসতে হাসতে বললো,
“গোসা হয়েছে নাকি!”

ধারা উত্তর দেয় নি। গোসা হয়েছে বটে। খুব হয়েছে। এবং অনল যদি গোসা না ভাঙ্গায় তবে এই অভিমান থাকবেই। ধারা অংকটি কষতে কষতেই কেটে দিলো। মন বসছে না। মানুষটি আসে না কেনো! এতো দেরি তো হবার কথা নয়। উঠে বারান্দার দিকে যাবে তখন ই কলিংবেল বাজলো। ধারা আবার বসে পড়লো টেবিলে। মিনিট দশেক বাদে ঘরে প্রবেশ করলো অনল। ধারা বেশ মনোযোগী ভাব নিয়ে বসে আছে। অনল এক নজর তার দিকে তাকিয়েই টাওয়াল নিয়ে ওয়াশরুমে চলে গেলো। কোনো কথা৷ বললো না সে। তবে ধারাও কম নয়, সেও তার রাগ অক্ষত রাখবে। কিছুতেই দমাবে না সে। মিনিট দশেক বাদে গোসল সেরে বের হলো অনল। চুলের গোড়া থেকে পানির রেখা মুখ বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে। টিশার্টের গলার খানিকটাও ভেজা। টাওয়ালটি দিকে দায়সারাভাবে সে মাথা মুছতে লাগলো। মাঝে আড়চোখে একবার ধারাকেও দেখলো। সে চোখ মুখ খিঁচে তাকিয়ে আছে খাতার দিকে। মুখের ভঙ্গিমাতে অসম্ভব কাঠিন্য। অনল ঠিক তার পেছনে দাঁড়ালো। উঁকি দিতেই দেখলো অংকের একমাথায় এসে আটকে আছে ধারা। কিছুতে সামনে এগোতে পারছে না। অনল ঠোঁট বাকিয়ে হাসলো। তারপর পাশ থেকে একটি কলম নিয়ে ঝুকে পরের লাইনটি লিখে দিলো। অনল ঝুকতেই চমকে উঠলো ধারা। পাশ ফিরতেই অনলের সাথে চোখাচোখি হলো। অনলের ভেজা চুল থেকে এখনো জলরাশি পড়ছে। ধারার খাতাটাও ভিজলো কিঞ্চিত৷ ধারা চোখ সরিয়ে নিলো। ধারার এরুপ কাজে অনলের হাসি চওড়া হলো। সে একুয়েশন খানা লিখেই সোজা হয়ে ধারালো। গম্ভীর কন্ঠে বললো,
“শুধু শুধু তখন আমি রাগ দেখাই নি। মোল্লার দৌড় মসজিদ পর্যন্ত সেটা আমার জানা। ব্যাপারটা বিশ্বাস অবিশ্বাসের নয়। ফ্যাক্ট এর। কেউ বিদ্বান হলে ওরা তোমার উপরের জিনিস। প্রশ্নটি কত কঠিন হতে পারে ধারণা নেই! তারপর ও যদি কেউ মুখ ফুলিয়ে থাকে আমার করার কিছু নেই”

অনলের কথায় ধারার সুপ্ত জিদটা যেনো আরোও ধপ করে জ্ব’লে উঠলো। আত্মদাম্ভিক মেয়েটি ধারা। সে যতই অলসতা দেখাক, কিংবা অনাগ্রহ প্রকাশ করুক না কেনো! কেউ তার দক্ষতার উপর প্রশ্ন করলে সেটা মোটেই সহ্য হয় না তার। অনল এর আগেও তাকে ফেলুরাণী বলতো। তবে আজকের কথাটা যেনো আত্মসম্মানে লাগলো। মনে মনে স্থির করলো তাকে যদি পরীক্ষা দিতেই হয় সে দিবে, এবং সবাইকে দেখিয়ে দিবে তার মার্কটি নিজস্ব অর্জিত। ধারা তাই বিনাবাক্য ক্ষয়ে আরোও মনোযোগ দিয়ে অংক কষতে লাগলো৷ অনল ঈষৎ অবাক হলো৷ ভেবেছিলো হয়তো ধারা হতাশ হবে। কিন্তু না, সে আরোও দ্বিগুণ উৎসাহে পড়াশোনা করছে। যেনো সে প্রতীক্ষাবদ্ধ, যেভাবেই হোক তাকে এই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতেই হবে। অনল অপলক নয়নে চেয়ে রইলো ধারার দিকে। সেই চাহনীতে ছিলো শুধুই মুগ্ধতা।

ধারার পড়া শেষ হলো বেশ রাতে। ঘড়ির দিকে তাকালো সে। তিনটা বাজে। বাহু জোড়া উঁচু করে শরীরে টান দিলো। মাজা ধরে এসেছে বসে থাকতে থাকতে। চোখ বুলালো ঘরে। অনল নেই। সে বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে। বারান্দার লাইট জ্বলছে না। ঘরের লাইট এবং বাহিরের নিকষ আধার মিলে আলোআধারী মায়া তৈরি করেছে। সেই মায়ায় অনলকে যেনো আরোও বেশি মায়াবী লাগছে। বিশাল দেহী মানুষটাকে ঘিরেই যেনো রাজ্যের মায়া। গাঢ় অভিমানের জন্য একটু যে কথা বলবে সে আর হলো না। তপ্ত নিঃশ্বাস ফেললো সে। তারপর বিছানাটা ঠিক করেই গা এলিয়ে দিলো ধারা। বিছানায় শুতেই রাজ্যের ঘুম এসে ভর করলো চোখে। কিছুসময় পর ই অনুভব করলো এক শক্ত হাত তাকে নিবিড় ভাবে জড়িয়ে ধরলো। কাঁধে মুখ গুজতেই উষ্ণ নিঃশ্বাস আঁছড়ে পড়লো ঘাড়ে। নরম কন্ঠটি কানে ভেসে এলো,
“আমি তোকে বিশ্বাস করি ধারা, নিজের থেকেও তোর উপর আমার অধিক বিশ্বাস। কিন্তু আমি যে তোর ক্ষতি হতে দেখতে পারবো না। কি উত্তর দিবো তখন নিজেকে। আমার জন্য তোর ক্ষতি হলে নিজেকে যে ক্ষমা করতে পারবো না রে। কখনই পারবো না”

ধারা চোখ খুললো না। ঘুমের প্রহরে স্বপ্ন এবং বাস্তবতাকে আলাদা করতে চাইলো না। থাকুক কিছু মিষ্টি স্বপ্ন, ক্ষতি কি!

ঘুম ভাঙ্গতেই নিজেকে আবিষ্কার করলো অনলের বলিষ্ট বুকে। কিছুসময় ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইলো। রাতের ওই কথাগুলো কি সত্যি প্রিন্স উইলিয়াম বলেছিলো নাকি তা নিছক স্বপ্ন ছিলো বুঝে উঠতে পারছে না। ধারা বেশি মাথা নষ্ট করলো না। আজ ক্লাস সকালে বিধায় ছুটে তৈরি হলো সে। কোনোমতে একটি রুটি গুজেই ছুটলো ক্লাসে।

বাড়ি থেকে বের হতেই ধাক্কা খেলো এশা আশার সাথে। তাদের বেশ উৎফুল্ল দেখালো। দুটো কি জানে আলাপ করছে আর হেসে কুটিকুটি হচ্ছে। কারণ বুঝে উঠতে পারলো না ধারা। জিজ্ঞেস করার সুযোগ ও পেলো না ধারা। ছুটলো সে ক্লাসের উদ্দেশ্যে।

ক্লাসে পৌছাতেই দেখা গেলো বন্ধুমহল জোট বেঁধে আছে। ধারা কাছে যেতেই তাদের কথা বন্ধ হয়ে গেলো। ধারা অবাক কন্ঠে মাহিকে শুধালো,
“কি হয়েছে? কি নিয়ে আলাপ করছিলি?”

তখন দিগন্ত একটি ছবি বের করে ধারার হাতে মোবাইলটা দিলো। মোবাইলের ছবিটি দেখতেই চোখ বিস্ফারিত হবার জোগাড়। ছবিতে মাধবীকে দেখা যাচ্ছে। সে একটি যুবকের সাথে কথা বলছে। যুবকটি আর কেউ নয় বরং দীপ্ত……..

চলবে

(দেরিতে দেবার জন্য ক্ষমাপ্রার্থী। কিছু টেকনিক্যাল ঝামেলার জন্য দেরি হয়েছে)

মুশফিকা রহমান মৈথি

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here