#প্রণয়_প্রহেলিকা (কপি করা নিষিদ্ধ)
#৩৮তম_পর্ব
মোবাইলের ছবিটি দেখতেই চোখ বিস্ফারিত হবার জোগাড়। ছবিতে মাধবীকে দেখা যাচ্ছে। সে একটি যুবকের সাথে কথা বলছে। যুবকটি আর কেউ নয় বরং দীপ্ত। দীপ্তকে মাধবীর সাথে দেখতেই মস্তিষ্ক শূন্য হয়ে গেলো ধারার। সে ভেবে পাচ্ছে না এদুজনের যোগসূত্র কি! ধারা জিজ্ঞাসু কন্ঠে দিগন্তকে শুধালো,
“এই ছবি কই থেকে পেয়েছিস?”
“কাল তোরা যখন বের হয়ে গেলি, তারপর আমি আর অভীক মাধবীর পিছু নেই। ও খুব চিন্তিত ছিলো। তারপর ও একটা গলির সামনে দাঁড়িয়ে ও কাউকে ফোন করলো। ফোন করার মিনিট পঁচিশের মধ্যেই এই ছেলেটা ওখানে উপস্থিত হয়। এই ছেলেটাই সেদিন ভার্সিটিতে এসেছিলো। তোর বিয়ের কথাটা ফাঁ’স করেদিলো। তাই সাথে সাথেই আমি ছবিটা তুলে নেই। ওরা বেশ কিছুসময় কথা বলছিলো। কিন্তু দূরে দাঁড়িয়ে থাকায় কিছুই শুনতে পাই নি”
ধারা এখনো চেয়ে রয়েছে ছবিটির দিক।তার মনে হাজারো সন্দেহ উঁকিঝুঁকি দিলো অন্তস্থলে। সাথে সাথেই সেলিম আহমেদের সাথে হওয়া শান্ত যু’দ্ধের কথা স্মরণে এলো। মনের ভেতরে সুপ্ত ঘৃণাটা মাথাচাড়া দিলো। বিদ্রোহ করে উঠলো অবুধ চিত্ত। তিতকুটে অনুভূতিতে মুখশ্রীতে জড়ো হলো বিরক্তি। বাবা হিসেবে না স্বীকার করলেও মানুষটি এতোটা নিচে নামবে কল্পনাও করে নি ধারা। ধারার শক্ত মুখশ্রী দেখে মাহি জিজ্ঞেস করলো,
“কি ভাবছিস?”
“ভাবছি কেউ এতোটা নিচে কিভাবে নামে!”
ধারার কথার মর্মার্থটা বুঝলো না বন্ধুমহলের কেউ। তবে নীরব বললো,
“আমরা ওকে এই ছবি নিয়ে ব্লা’ক’মে’ই’ল করতেই পারি, এটা নিয়ে আলোচনা করছিলাম। আর এতে আমাদের বিবিসি দিগন্ত আমাদের সাহায্য করতে পারে”
“হ্যা, আমি অলরেডি এই ছবি ছড়িয়েও দিয়েছি। মাধবীকে এবার ধরলেই ও আমাদের কাছে সব উগড়ে দিতে পারবে”
ধারা মলিন হাসি হাসলো। যেখানে নিজের বাবা তার সুখটা পায়ে পিসছে প্রতিনিয়ত, সেখানে তার বন্ধুমহল সর্বোচ্চ চেষ্টা করছে তার এবং অনলের অপবাদ মিটাতে। সত্যি, আপনজন রক্তের টানে হয় না, হয় আ’ত্মা’র টানে।
*******
সেলিম সাহেবের মুখ কঠিন হয়ে আছে, সে তন্ন তন্ন করে নিজের কাপড়ের মাঝে নিজের উইলের কাগজখানা খুঁজছেন। কিন্তু কিছুতেই পাচ্ছেন না। তার স্মরণশক্তি এতোটাও খারাপ নয়। তার স্পষ্ট মনে আছে সে কাগজখানা এখানেই রেখেছিলেন। তাকে বিধ্বস্ত লাগছে। কপালে জমেছে নোনাজলের বিন্দু। কাগজটি হারিয়ে গেলে পুনরায় আবারো তাকে বানাতে হবে। কাগজটি কি কেউ সরিয়ে নিয়েছে! এমন কাজ একজন ই করতে পারে! রোকসানা। ঠিক সেই সময়টিতেই রোকসানার আগমন ঘটলো ঘরে। তাকে দেখেই গম্ভীর কন্ঠে সেলিম সাহেব প্রশ্ন ছুড়লেন,
“তুমি আমার আলমারী ঘাটাঘাটি করেছিলে?”
প্রশ্নটি কর্ণপাত হতেই চমকে উঠলো রোকসানা। আমতা আমতা করে বললো,
“না, আমি কেনো তোমার জিনিসে হাত দিবো?”
“তাহলে আমার উইলের কাগজটি কোথায়?”
রোকসানা থতমত খেয়ে গেলো। কথা ঘুরানোর চেষ্টা করলো, লাভ হলো না। সেলিম সাহেবের বিশ্বাস অটল। তিনি জে’রা শুরু করে দিলেন,
“কোথায় রেখেছো রোকসানা কাগজটা?”
“আমি দেখি ই নি কাগজ!”
“আমি আর একবার জিজ্ঞেস করবো! কোথায় আমার কাগজ?”
এবার সংযম হারালো রোকসানা। চিৎকার করে উঠলো সে,
“পুড়িয়ে দিয়েছি আমি!”
“কিহ!”
সেলিম সাহেবের মস্তিষ্কে কথাটা অনুধাবণ হতে সময় নিলো। কেউ কতটা ক্ষুদ্ধ হলে এমন কাজ করতে পারে! তীব্র স্বরে বলে উঠলেন,
“পুড়িয়ে দিয়েছো মানে?”
“মানে টা স্পষ্ট, আমি পুড়িয়ে দিয়েছি। আজব, যে মেয়ে তোমাকে বাবা বলেই মানে না তাকে তুমি সম্পত্তির অর্ধেক দিয়ে দিবে আর আমি বসে বসে দেখবো!”
“আমার জিনিস আমার মেয়েকে দিবো, তোমার থেকে তো শুনবো না আমি!”
“কেনো শুনবে না সেলিম! তোমার শুনতে হবে, এই মেয়ের জন্যই তুমি কখনো সন্তান নাও নি। এখন এই মেয়ের জন্য তুমি আমাকে ঠকাবে, আর আমি সেটা মেনে নিবো! অনেক হয়েছে আর নয়। আমি আর নিজের সুখের বিসর্জন দিতে পারছি না।”
রোকসানার কথাগুলো শুনতেই নিজেকে শান্ত রাখতে পারলেন না সেলিম সাহেব। তীব্র স্বরে বলে উঠলেন,
“তোমার সুখ বিসর্জিত হয়েছে! সত্যি রোকসানা! তাহলে সব জেনেশুনে আমাকে কেনো বিয়ে করেছিলে? আমি নাহয় স্বার্থপর মানুষ, তোমাকে বিয়ে করার উদ্দেশ্য ছিলো আমার উন্নতিতে যেনো বাঁধা না পড়ে। তুমি কেনো রাজি হয়েছিলে! আমি তো বলেই ছিলাম, আমার একটি মেয়ে আছে। আমি আর কোনো সন্তান চাই না। তখন তুমি রাজী হলে কেনো! তখন তো বেশ আনন্দিত ছিলে তুমি। কারণ তোমার কাছে তখন আমার বউ হওয়াটাই জরুরি ছিলো। তোমার কাছে আমার অর্থই সবথেকে অধিক গুরুত্বপূর্ণ ছিলো। বিসর্জন তুমি দাও নি রোকসানা। আমার জন্য যদি কেউ বিসর্জন দেয় সে সুরাইয়া। তুমি নও। আমি তো তোমার প্রাপ্যটা তোমাকে বুঝিয়ে দিয়েছি। তোমার হক কিন্তু আমি মারি নি। সুতরাং আমার মেয়েকে আমি কি দিবো না দিবো সেটা আমার একান্ত ব্যক্তিগত ব্যপার। এর মাঝে দয়া করে তুমি এসো না।”
বলেই ঘর থেকে বের হলেন সেলিম সাহেব। রোকসানা ঠাঁয় দাঁড়িয়ে রইলো সেখানে। চোখ মুখ রক্তিম হয়ে রয়েছে তার। লোকটির মনে আজ ও যেন সুরাইয়ার ই বসবাস। কখনোই যেনো সেই স্থান তার হবে না। বুঝতে বড্ড দেরি হয়ে গেছে তার। এখনো মনে আছে মুমূর্ষু সুরাইয়ার জন্য লেখা চিঠিগুলো এখনো সযত্নে উঠিয়ে রেখেছেন সেলিম সাহেব। কখনো পাঠানোর সুযোগটি ই হয় নি। কারণ সেই মানুষটি ই আজ নেই_______
ক্লাস শেষ হতেই মাধবীর মুখোমুখি হলো ধারা। ছবিটি সম্মুখে রেখে বললো,
“এই লোকটিকে কিভাবে চিনো তুমি?”
মাধবী খানিকটা চমকে উঠলো। সে গাইগুই করে এড়িয়ে যাবার চেষ্টা করলো। কিন্তু ধারার হুমকির সামনে জোর খাটলো না। ফলে একে একে সকল কথাটা ফাঁ*স করতেই হলো।
****
অনল ল্যাপটপের সম্মুখে বসে রয়েছে। তার মুখখানা শক্ত হয়ে আছে, বিশাল একখানা সুযোগ তার সামনে। অস্ট্রেলিয়ার বেশ বড় একটা কোম্পানি থেকে একটা চাকরির অফার পেয়েছে কাল রাতে। ইন্টারভিউটি হবে অনলাইনে। তারপর তারা জানাবে ফলাফল৷ চাকরির ঝামেলার কারণে অনল আজ সকালে ইন্টারভিউ দিয়েছে। এখন তাদের মেইল এসেছে। অনলের চাকরি হয়েছে। তারা নেক্সট সপ্তাহেই অনলকে জয়েন করতে বলেছে। কিন্তু ঝামেলা হচ্ছে, অনল তো প্রথমেই ধারাকে নিয়ে যেতে পারবে না। এখন কি করবে বুঝে উঠতে পারছে না। স্যালারিও বিশাল, সুযোগটি বেশ চমৎকার। কিন্তু ধারাকে ছেড়ে যাওয়াটা মন সায় দিচ্ছে না। বেশ কতক্ষণ তাকিয়ে রয়েছে ল্যাপটপের দিকে। কিছুই মাথায় আসছে না। কি করা উচিত! অফারটি ছেড়ে চাকরির এই টানাপোড়েন চলবেই। বুঝে উঠতে পারছে না অনল। মাথাটা ধরে এসেছে। একটু গড়িয়ে নিলে মন্দ হয়না। যে ভাবা সেই কাজ। ল্যাপটপ বন্ধ করে দিলো অনল। সাথে সাথেই ধারার ক্যালকুলাস বই টা পড়ে গেলো। মেয়েটি কালকে পড়ে এখানেই রেখে দিয়েছে বই। অনল নিঃশব্দে হাসলো। বইটি তুলতেই তার ভেতর থেকে একটি কাগজ পড়লো নিচে। সেটা তুলে হাতে নিতেই দেখলো গোটা গোটা করে কিছু লেখা। অনল পড়তে লাগলো লেখাগুলো।
অনলভাই,
এই চিঠিখানা বহু কষ্টে লিখতে বসেছি আজ। আমার মনের সকল অগোছালো চিন্তাগুলো একটা কাগজে উপস্থাপন করবো। এটা এতোটা কষ্ট হবে জানা ছিলো না। আমি নিজেও সে বিস্তার ভাবনার জোয়ারে ভাসছি গো। চিন্তাগুলো সব যেনো ভাসমান। আচ্ছা, এই ভালোবাসা কি! এই অনুভুতিগুলো কি! বহুপূর্বে একখানা চিঠি লিখেছিলাম। কই এতো তো কষ্ট হয় নি। এত এলোমেলো ছিলো না তো আমার চিন্তাগুলো। শব্দগুলো ছিলো সুসজ্জিত। তবে তোমার বেলায় এমন কেনো? তোমার বেলায় আমার মস্তিষ্ক অচল কেনো অনল ভাই। আজ মাহি আমায় প্রশ্ন করল, “ভালোবাসিস তাকে?” আমি উত্তর দিতে পারলাম না। কিভাবে পারবো বলো, এই ভালোবাসা নামক অনুভূতিটি যে অচেনা আমার কাছে। তুমি আমার কাছে কোনোকালেই প্রিয় ছিলে না, ছিলে অতি অপ্রিয় ব্যক্তি। বিরক্ত হতাম তোমার প্রতি কার্যে, অসামান্য রাগ হতো তোমার উপর। অথচ তোমার কাছে এক অকল্পনীয় শান্তি আছে। শতবিপদেও তোমার নামটি ই আমার কল্পনায় আসে অনল ভাই। তোমার জীবনে অন্যকেউ আসবে ভাবতেই তোমাকে হারাবার টলমলে ভয়ে বুক কেঁপে উঠে। এই বিয়েটায় আমার আপত্তিটি ছিলো সর্বাধিক। অথচ দেখো আজ তোমার থেকে দূরত্ব আমার সহ্য হচ্ছে না। সব থেকে তিতকুটে অনুভূতিটিও তোমার উপস্থিতিতে মধুর হয়ে উঠে। তোমার বড় বড় হাতের ফাঁকের উষ্ণতাটি যে আমার সবচেয়ে প্রিয়। তোমার দূর্বোধ্য স্নিগ্ধ হাসিতে বারবার হারাতে চাই আমি। তোমার বলিষ্ট বুকে মুখ গুজে তোমার মাদকতায় ডুবতে চাই। আমার একটা ছোট স্বপ্ন আছে অনলভাই জানো, যা আমাকে প্রায়শ ই ভাবায়। স্বপ্নটি তোমাকে নিয়ে। কোনো এক গোধূলীতে আমি বসে রয়েছি তোমার সাথে। তুমি গান গাইছো, আমি অধীর হয়ে চেয়ে রয়েছি তোমার পানে। কি অদ্ভুত তাই না! যদি আমার এই এলোমেলো চিন্তাগুলো, আমার বদ্ধ মস্তিষ্কে তোমার নামের আবেগ গুলোকে যদি প্রণয় বলে তবে হ্যা, আমি তোমার প্রণয়িনী। বিয়ের রাতে আমাকে জিজ্ঞেস করেছিলে, আমার কি মনে হয় তোমার মতো দাম্ভিক, আত্মজেদী মানুষটির ভেতর যে র’ক্ত”মাং’সে’র’সে’র হৃদযন্ত্রটি আছে তা আমার জন্য স্পন্দিত হয়! আমি সত্যি জানি না অনল ভাই, তবে তোমার জন্য আমার হৃদয় স্পন্দিত হয়। তোমার মতো আত্নদাম্ভিক, জেদি, রাগী, অসহ্য মানুষটির জন্যই আমার হৃদয় স্পন্দিত হয়, হাজার বার। তোমার প্রতি আমার প্রণয়টা বরাবর ই একটা গোলকধাঁধা, অনল ভাই; নিছক প্রহেলিকা। এই দূর্বোধ্য আবেগের উত্তর আমি আজও পাই নি। অথচ এই প্রণয় প্রহেলিকা যে আমার জীবনের অস্তিত্বে মিশে যাবে কে জানতো! কে জানতো! এই প্রহেলিকার চোরাবালিতে আমি একটু একটু করে গ্রাস হবো। কে জানতো বলো! আমার এই আবেগের কি উত্তর আছে তোমার কাছে অনল ভাই? আমার স্বপ্নটি সত্য হবে? তোমার উত্তরের অপেক্ষায় রইলাম।
আমি তোমার সঙ্গে বেঁধেছি আমার প্রাণ সুরের বাঁধনে——-
ইতি
তোমার প্রণয়িনী
ধারা
এই চিঠিটি ধারা বহুপূর্বে লিখেছিলো। দেবার সময় টি ই হয় নি। অনল অনুভব করলো তার হৃদস্পন্দন বেসামাল হয়ে উঠেছে। সাথে সাথেই সে ধারাকে ফোন লাগালো। ফোন বাজছে কিন্তু কেউ ধরছে না। এখন ধারার ছুটি হয়ে যাবার কথা। অথচ সে এখনো বাড়িতে ফিরে নি। ফলে বাধ্য হয়ে মাহিকে ফোন দিলো অনল।
******
লাগাতার কলিংবেল বাজছে। কেউ খুলছে না দরজা। জ্বরে ক্লান্ত দীপ্ত বাধ্য হয়ে উঠলো। গতকালের কান্ডের পর তার জ্বর এসেছে। ধুম জ্বর। সে কোনো মতে উঠে দরজা খুললো। খুলতেই খানিকটা চমকে উঠলো, কারণ বাহিরে ধারা দাঁড়িয়ে আছে………..
চলবে
মুশফিকা রহমান মৈথি