প্রহরের শেষাংশে |৬|
লেখা : মান্নাত মিম
______________
“তারপর, তারপর কী হলো আন্টি আর আপনাকেই বা ও’ই ভদ্রমহিলা এতকিছু বলল কোনো পাল্টা জবাব দিলেন না?”
“তাঁদের সাথে তো কোনো দ্বন্দ্ব নেই, দ্বন্দ্ব আমার নিজের সাথে। প্রতারিত হয়েছি ভালোবাসার মানুষের কাছ থেকে। তার পরিবার থেকে কিছু আশা করাও বোকামি। স্তব্ধ আমি সেখানে একার জোরে কি’বা জবাব দিতাম? খালামনি’কে ডাকা হলো হাসপাতাল থেকে আমাকে নিয়ে যেতে। আমার সেই দুর্বিষহতার দিনগুলোতে তিনি মনোবল জোগান দেন, সেবাশুশ্রূষা করে সারিয়ে তোলেন। সময় চলে যায় নিরবধিভাবে। লেখাপড়া বন্ধ করেছিলাম কুশালের জন্যই। সে-ই বলেছিল, একান্ত সময়গুলো আপাতত লেখাপড়ার পিছনে না দিয়ে তাকে যেন দেই। আমি-ও গাধি তার মুখের একটু খুশি খোঁজতে গিয়ে; নিজের জীবনের জলাঞ্জলি দেই। পরে খালামনি বহু বলেকয়ে আবার ভর্তি করান কলেজে। তবুও সেটা বেশিদূর এগোতে পারিনি। সমাজের নানা টিপনির মুখোমুখি হতে হতো প্রতিনিয়ত। অসহায়ত্ব যখন চারিদিক থেকে আবদ্ধ করে তখন নিরুপায় হয়ে লেখাপড়া বন্ধ করে দেই। এর ভেতর আবার খালামনি আমাকে তিলে তিলে শেষ হতে দেখে বিয়ে ঠিক করেন।”
“কিহ!”
“হুম। তাও আবার বড়ো খালামনির ছেলের সাথে। মনে আছে বলেছিলাম, মেঝো খালামনির সাথে বড়ো জনের যোগাযোগ আছে। একজন-ই ছেলে তাঁর।”
_______
“তুই আমাদের জানাবি না মেয়েটার অসময়ে পাশে তো থাকতে পারতাম।”
“কীভাবে বলতাম আপা? মেয়েটা’কে একহাতে সামলাতে হয়েছে। টেনশনে ভুলেই গিয়েছি আত্মীয়-স্বজনের কথা। বারবার সুইসাইডের চেষ্টা করত, সাথে সাথে ছায়ার মতো থাকতে হয়েছে। সবচেয়ে বেশি বাচ্চা দেখলেই শুরু হতো চিৎকার, চেঁচামেচি। মামুন তো অরুর সামনেই যেতে পারত না। আস্তেধীরে কাউন্সিলিং করে সুস্থ করি, তারপর ভালো হওয়ার লক্ষ্মণ দেখে কলেজে ভর্তি করলাম। কিন্তু কপালে সব সয় না। সেখানে সকলে ইঙ্গিতে আকারে কটাক্ষ করে ফলে অরু যেন আবারও মূর্ছা যায়। তাই আমি ওর ভালোর জন্য, এসব চিন্তা থেকে মুক্তির জন্য উপায় খোঁজে পেয়েছি।”
বেশ দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হতে দেখা গেলো দু’জনের অতঃপর বড়ো খালার এক কঠিন সিদ্ধান্ত উপনীত হলেন। বড়ো খালার ছেলে সাব্বির কোনোমতে এস. এস. সি পাশ করা। ছোটো একটা দোকান বাড়ির কোণেই। তবে বিবাহিত, বউ চলে গেছে সন্তান ছিল সাথে নিয়ে গেছে। তার জন্যও মেয়ে খোঁজ ছিলেন। যেহেতু মেয়ে ঘরেই পেয়ে গেলেন, তাও আবার একই ঘাটের মাঝি দু’জন; সেহেতু বিয়ের আবন্ধনে অতি শীঘ্রই বাঁধতে চান। সেখানে আমার ইচ্ছা বা মতামতের কেউ নেওয়ার প্রয়োজনও বোধ করল না। আসলে বলতে গেলে; দুনিয়াতে যার থেকেও কেউ নাই, তার আবার এতো মতের দাম থাকতে নেই। আমার-ও নাকি কপাল ভালো! প্রেমিক স্বামী থেকে ধোঁকা খাওয়া আমার বাচ্চা হারানো মেয়ের কপালে এই ঢেরবেশি জুটছে। নাহলে রিক্সাওয়ালা-ও জুটত না। কথাগুলো বাড়িতে আসা-যাওয়া প্রতিবেশীর। আমি-ও খালামনি’দের মুখে চেয়ে রাজি হলাম। তিনি তো কম তো করেননি আমাকে। তা যাইহোক বিয়ের বন্ধনে আবদ্ধ হলাম। ভাবলাম এই বুঝি দুর্ভাগ্য সৌভাগ্যে পরিবর্তন হলো। কিন্তু কথায় আছে; অভাগা যেদিকে যায়, সেদিকে সাগর শুকায়। নয়া বউয়ের মুখ দেখতে পাড়ার সকলে মনে হয় ভীড় জমিয়েছে। তখনই বোমা বিস্ফোরণের মতো বিস্ফোরিত হলো; আমার কালো অতীতের ঘটনা। জানতে পারিনি কে বা কারা ঘটনাটা-কে চাউর করছে। আমার বড়ো খালা বর্তমানে যিনি আমার শ্বাশুড়ি। তাঁর স্বামীর রেখে যাওয়া ভিটেমাটিতে যৌথ পরিবার নিয়ে থাকেন। শ্বশুর-শ্বাশুড়ি গত হয়েছেন বহুকাল আগেই। তিনি বাড়ির বড়ো বউ। জা আছে আরো চারজন। কিন্তু যে যার যার পথে। মাঝেমধ্যে সলাপরামর্শ নিতে আসে এই পর্যন্তই। সেই হিসেবে আমার শ্বাশুড়ির সাব্বিরের সাথে বিয়ের সিদ্ধান্তে কেউ নাক গলাতে আসেনি। এদিকে কানাঘুঁষা হচ্ছেই। আস্তে-ধীরে অত্র এলাকায় খবরটা পৌঁছে যায়। ছি ছি, হৈহল্লা, হায়-হাপিত্যেশ করার মাঝে প্রহরের শেষাংশে সকলেই যার যার পথে ছুটে। তখন জীবনের সাথে পরাজিত বিধ্বস্ত সৈনিকের মতো আমি বড়ো উঠানে চেয়ারে বসা। আস্তে-ধীরে সকলে ভীড় কমতেই ডাক পড়ে আমার। টলতে টলতে ওঠে শ্বাশুড়ির কাছে যাই। চৌচালা টিন শেডের বিরাট বাড়ির রুমগুলোও বড়ো বড়ো। আমাকে সাব্বিরের রুমে নিয়ে বিছানাতে বসানো হয়। ফুলে সাজানো বিছানা আমার কাছে কাঁটার মতো বিঁধল। শ্বাশুড়ি মাথায় হাত রেখে বললেন,
“খালামনি বলা বাদ। মা মনে কইরা আম্মা ডাকবি। আমার সাব্বিরায়-ও কষ্টে আছে বুঝলি। দুই কষ্টের মানুষ এক কইরা দিলাম। একজন আরেকজনের মনের কষ্ট বুঝবি।”
কী বুঝব? বোঝার মতো অবস্থা সম্পন্ন নাকি আমি? মনের মধ্যের বুঝাবুঝি চলছে তখনই বাইরে থেকে কারো কাশির শব্দে শ্বাশুড়ি পা চালিয়ে বেরিয়ে যান। কিছুক্ষণ পরে, শ্যামলা গাত্রের পুরুষালী অবয়বের আগমন ঘটে। বুঝতে পারি এটাই সাব্বির। যেখানে বিয়ে করার ইচ্ছেই ছিল না, তাকে দেখিওনি। সেখানে বাসর করার মতো মন-মানসিকতার মতো নিচু চিন্তাভাবনা মাথায় নেই। তাই অস্থিরচিত্ত বলে ওঠি,
“শোনেন, আপনি মনে হয় আমার অবস্থার বিষয়ে অবগত। তাই আমার থেকে কিছু আশা করা বোকামি।”
” আমি কিছু আশা করব, এমনটা মনে হলো কেন?”
এই প্রথম শোনলাম ভরাট কণ্ঠস্বরে সাব্বিরের কথা। কিছুটা কেঁপে উঠলাম। বিষয়টা সম্ভবত তার চক্ষুগোচর হলো। এগিয়ে এসে দাঁড়িয়ে থাকা আমার পাশ কাটিয়ে বিছানাতে বসে বলল,
“এক বিছানাতে শুতে তো কোন সমস্যা না?”
নির্বাক চোখে তার কার্যক্রম দেখে অকারণেই মাথা নেড়ে না বোঝালাম। কেন তার কথার উত্তর দিলাম নিজেও বোঝলাম না। শুধু মন খারাপটা মলিন হতে দেখলাম চোখে। আস্তে আস্তে আমার মনের সকল কৃষ্ণত্ব মুছে দিয়ে, কখন যে সেখানে সাব্বির নিজ নামের ভালোবাসার বীজ বপন করল টেরই পেলাম না। সম্পর্কটা গিঁট আরো গভীরভাবে বাঁধতে বিয়ের দু’বছর পরেই প্রথম ছেলে সন্তান এলো। তারপরের বছর ঘুরেই আবারও জমজ মেয়ের মা হলাম, সেই ধারা বজায় রেখে আজ এক ছেলে চার মেয়ের জননী আমি। আসলে কী জানো,
“মানুষ পরিবর্তনশীল কথাটা যথার্থ। হয়তো সমায়িক আঘাতে ক্ষত-বিক্ষত হয়। কিন্তু যে সে-সকল বাঁধা, দুর্গম পথ পেরিয়ে নিজে পরিবর্তন হতে চায়, নিজেকে নিয়ে ভাবতে চায়; সে-ই ভালো থাকার সুপথ খোঁজে পায় কিংবা ভালো থাকার জন্য কারো এগিয়ে নেয়ার মানুষ পায়।”
“আন্টি কার বাড়িতে যাচ্ছেন?”
“সব ক’জনের বিয়ে দেয়া শেষ, ছোটো মেয়ের-ই গতবছর বিয়ে দিয়েছি। জামাই প্রাইমারি স্কুলের টিচার। শ্বাশুড়ি নাই শ্বশুর মানুষটা’কে দেখাশোনা আবার ক’দিন আগে মেয়ের ছোটো বাচ্চা হলো। একলা মানুষ চলতে ফিরতে অসুবিধা হয়। বারবার বলছে গিয়ে ক’দিন থাকতে। তাই সেখানেই যাচ্ছি।”
“আন্টি আজো কি মনে পরে অতীত?”
“বোকা মেয়ে! মনে না পরলে তোমাকে বললাম কীভাবে? শোনো অতীত ছেড়ে সম্মুখে অগ্রসর হওয়া যায় না আবার অতীত আঁকড়ে বর্তমান বহমান নয়, আবার বর্তমান নষ্ট করে ভবিষ্যৎ গঠিত হয় না। জানো, রূপক পড়েছিলাম কিন্তু রূপের প্রকারভেদ পড়িনি কখনো। মানুষের রূপের প্রকারভেদ বই-তে রাখা উচিত। তাহলে বইয়ের বাইরের জগতের মানুষের মুখোশ ক্ষণে ক্ষণে বদলানোর বিষয়ে আগে থেকে অবগত হওয়া যেত। নাহলে আমার মতো প্রতি পদক্ষেপে বিধ্বস্ত হতে হতো। আর সবকিছু মেনে নিয়ে নতুন করে জীবনকে উপলব্ধি করাতে সাব্বিরের মতো মানুষ পাওয়া যায় না। তাই অনেক ক্ষেত্রে বিপদ থেকে টেনে তোলার জন্য কারো অপেক্ষায় না থেকে, নিজেকেই নিজের সাহায্যকারী তৈরি করা শ্রেয়। মনে রাখবে, আগে নিজেকে ভালোবাসতে শিখা উচিত।”
“আপনার সাথে অমনটা করল যে, তার শাস্তি?”
“অধিকাংশ শাস্তি সৃষ্টিকর্তা আমাদের দেখিয়ে দেন না। যেখানে আমাদের মতো অসহায়ের জন্য বিচার চাওয়ার মতো কেবল সৃষ্টিকর্তা-ই আছেন। তাই বিচার দিবসের আশায় আছি। বুঝলে? আচ্ছা, যাই এসে পড়েছি অনেক কথা হলো।”
“আন্টি! আমি কি আপনার কাহিনিটা গল্পাকারে ফেসবুকে লিখতে পারি?”
প্রহরের শেষাংশের সূর্যাস্ত যাওয়ার লালচে আভায় দেখছিলাম, অরুমিতা নামের জীবনযুদ্ধে নিজেকে টিকিয়ে রাখা এক নারীর চলে যাওয়াকে।
সমাপ্ত।
এডিট ছাড়া পর্ব। লেখালেখিতে বড্ড কাঁচা, শেষটা গুছিয়ে আনতে পারিনি। সবাই পড়েই হয়তো বুঝতে পেরেছেন। এ-র উপর চোখে ঝাপসা দেখছি। গল্পটা একজনের জীবন থেকে নেওয়া সেটাও অবশ্যই বুঝতে পেরেছেন শেষ বক্তব্যের মাধ্যমে। আমি বেশ অল্প সময় পেয়েছিলাম, তাঁর কাছ থেকে ঘটনা সম্পর্কে অবিহিত হতে। বাকিটা সাজিয়ে লেখা। ভালো-মন্দ মন্তব্যের আশায় রইলাম।