- প্রহরের শেষাংশে |২|
লেখা : মান্নাত মিম
_______________বর্ণনাতীত সৌন্দর্যে মণ্ডিত কুশালের মতো যুবা পুরুষের সান্নিধ্য বারংবার আমাকে দুর্বল করে দিচ্ছিল। সকলের আকাঙ্ক্ষিত পুরুষটা যখন আগেপিছে ঘুরে প্রেমিক পুরুষ হওয়ার আহ্বান জানায়, তখন মন মস্তিষ্কের বিরুদ্ধে গিয়ে প্রেমের প্রস্তাবে সাড়া দেয়। যাত্রা শুরু হয় প্রেমের সাধারণের চেয়েও ভয়ংকর সেই যাত্রা।
পার্কে চলা হাত ধরাধরি, আসা হয় খুব কাছাকাছি। তবে ততোটা কাছে না যতটা কাছে এলে ঠোঁটে ঠোঁটে কথা বলা যায়। কৌতুহলী হয়ে নির্লজ্জের মতো সেবিষয়ে কুশাল’কে জিজ্ঞেস করে ফেলি,
“চুমুর স্বাদ কেমন?”
আমার কোলে তখন কুশালের মাথা, তার চুলে হাত বুলিয়ে দিচ্ছিলাম। আমার কথায় ফট করে ওঠে পড়ে। কিছুক্ষণ একদৃষ্টিতে তাকিয়ে চোখ সরিয়ে নেয়। তার বিষণ্ণ হওয়া মুখের রেশ আমার অন্তরে বিষণ্নতা ছেয়ে দেয়। তার কারণ অবশ্য আমার জানা। অনুষ্ঠানের দিন সন্ধ্যায় থাপ্পড় দিয়েছিলাম এই কারণবসত’ই। সম্ভবত সেটাই মনে পড়েছে তার, সম্ভবত না শিওরই। এগিয়ে গিয়ে কুশালের পিঠে মাথা রাখলাম। দু-হাতে জড়িয়ে ধরি পেছন থেকে আর অশ্রু বিসর্জন দিতে থাকি; সেদিনের ভুলের। বিষয়টা এখন ভুল ঠেকছে অথচ সঠিক-ভুলের মাত্রা পেরিয়ে গিয়েছে মন থেকে। ভালোবাসার পোকারা যে একটু একটু করে নিঃশেষ করছে আমায়। পিঠে ভেজার অস্তিত্বে কুশাল ঘুরে জড়িয়ে ধরে বলল,
“বোকার মতো কাঁদছ কেন?”
“তুমি এখনো রেগে আছ?”
তুমি-তে গড়িয়েছে সম্পর্ক।
“নাহ তো। বিষয়টা আর মনে রেখ না আমি-ও ভুলে গেছি। আচ্ছা, চুমুর স্বাদ কি আর মুখে বর্ণনা করা যায়? টেস্ট করে দেখ কেমন?”
কুশালের বুকে মাথা রেখেছিলাম, তার লাগামহীন কথা শোনে মাথা উঁচিয়ে দেখি; তার চোখে-মুখে দুষ্টুমি খেলা করছে।
“ছি! কি নির্লজ্জ কথাবার্তা!”
“প্রেমিক পুরুষ বলে কথা।”
প্রথমেই বলেছিলাম অবাক হওয়ার প্রবণতা আমার মাঝে খুবই কম। কিন্তু সেটার জন্ম দিয়েছিল কুশাল। মানুষটার সৌন্দর্য মোহিত হয়ে সেদিন চূড়ান্ত অবাক হয়েছিলাম। এই সুন্দর মানুষটা আমার কেবলই আমার। মনে মনে আমি-ও তো তাকে চেয়েছিলাম স্বপ্ন পুরুষ হিসেবে। ভালোবাসার অসীমতা পেরিয়ে দু’জনই সেদিন তৃষ্ণার্তের মতো ঠোঁটের স্বাদ আস্বাদন করেছিলাম। স্বর্গীয় সুখ বোধহয় একেই বলে। সময় পেরিয়ে যায় ঠোঁটের স্বাদ উপভোগের চেয়ে আর দূরত্বে এগোয় না সম্পর্কের অংশ। চরম সুখ উপভোগের জন্য দু’জনই পাগলপ্রায়। তবে বিয়ে ছাড়া আর দূরে যাব না বলেছিলাম কুশাল’কে। সে-ও রাজি বিয়ের জন্য। কিন্তু পরিবারের চিন্তায় সকল চাহিদা বিফলে যায়। যেখানে প্রেমিক পুরুষ আমাকে কাছে পাওয়ার তীব্র বাসনার কথা ব্যক্ত করে, আমি-ও তাকে কাছে পাওয়ার আকুলতায় সেখানে পালিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দেই। হিতাহিতজ্ঞানশূন্য হয়ে পড়ি যখন শুনি আমাদের সম্পর্কের কথা কুশালের পরিবার জ্ঞাত হয়েছে। পালিয়ে যাওয়ার প্রবণতা বৃদ্ধি পায়। উপরন্তু আমাকে ছেড়ে দেয়ার আদেশ দেয় কুশাল’কে তার পরিবার। মনমরা হয়ে দুশ্চিন্তায় গ্রাসিত অবস্থা কুশালের। তার এলো চুলে হাত গলিয়ে ঠিক করে দিয়ে শীতল কণ্ঠে আশ্বস্ত বাণীতে বলি,
“চিন্তা করো না। পালিয়ে যাওয়া ছাড়া উপায় দেখছি না।”
তবুও তার কুণ্ঠিত কণ্ঠস্বর ব্যাহত রেখে জবাবে বলল,
“সংসার পাতা কি এতোই সহজ?”
দূঢ় কণ্ঠে তার চোখজোড়ায় চোখ রেখে বলি,
“আমাকে চাও না?”
কিছুটা দূরত্ব ঘুচিয়ে এগিয়ে এসে দু’হাতে আমার কোমরে হাত রেখে উঁচিয়ে ধরে।
“তোমাকে চাওয়ার চেয়েও বেশি চাই,
পাওয়ার লোভ আমার এতোটাই—
নিজের করব তোমাকে খুব শীঘ্রই।”বলেই ভ্রু নাচালো যার মানে কবিতা’টা কেমন হলো? আমি খিলখিল করে হেসে ওঠে তার মাথার চুলগুলো এলোমেলো করে দেই। আমার মুগ্ধ করার হাসির মাঝেই সে নাক ডুবিয়ে দেয় বুকের মাঝে। শিহরিত হয়ে খামচে ধরি গুচ্ছ ভরা চুল। আমার বুকে নাক ঘষতে থাকে, আরেক হাত পিঠে আঁকিবুঁকি চালায়। অনুভূতির উচ্চ শিখরে দু’জন যেতে চাই, কিন্তু বাধ্য হয়ে বাঁধা দিতে হয় আমায়। অবশ হওয়া কণ্ঠে কোনোমতে বলে ওঠি,
“কুশাল! আজ না।”
ঘোর কাটতে সময় নিলে ধাক্কা দিতে বাধ্য হই। করুণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে কুশাল। সেই দৃষ্টি উপেক্ষা করে বাসায় ফেরার তাড়া দেখাই। দীর্ঘশ্বাস ফেলে সে-ও হাত ধরে বেরিয়ে আসে পার্ক থেকে।
_______“অরু! তোর বড়ো ভাই ফোন করেছে।”
“আমারটায় না করে?”
“তোরটা আজকাল না কি ব্যস্ত দেখায়।”
কেমন মুখ ভেংচি সুরে কথাটা বলল ভাবি। তবুও কথা ঠিক, কুশালের সাথে দিন-রাত এতো কথা বলি যার দরুন আমাকে ফোনে পাওয়াও মুশকিল।
“আচ্ছা। আমারটা দিয়ে ফোন দিচ্ছি।”
কথাটা শুনে চলে যায় ভাবি। আমার খোঁজ-খবর নেওয়ার চেষ্টাও করে না। আমার-ও তো মন চায় মা’য়ের আদর-স্নেহ, ভালোবাসা দু’টো মোলায়েম কথা শোনার। ভাবি কি পারে না মমতা দিয়ে মাথায় হাত বুলাতে? প্রশ্নটা নিজের কাছেই কেমন যেন অবান্তর লাগে। যেখানে ভাবি আমাকে উটকো ঝামেলা মনে করে। সেখানে এতোটা আশা করা ঠিক না। মনে মনে নিজের প্রতিই কেমন যেন তাচ্ছিল্যের হাসি পায়। ভাবনার মাঝে ফোন বেজে ওঠে। কুশাল নামটা স্ক্রিনে জ্বলজ্বল করে নিজের জানান দিচ্ছে। বেখেয়ালে বড়ো ভাইকে ফোন করার কথাটা মাথা থেকে চলে যায়। ব্যস্ত হয়ে পড়ি কুশালের সাথে কথা বলাতে,
“কী বলে?”
“মানানো যাচ্ছে না।”
“চলো না হারিয়ে যাই।”
“যেতে চাই। কোথায় যাব সেটাই তো মাথায় আসছে না।”
“জায়গা আছে একটা। এমনই মফস্বল এলাকা। যাবে?”
“আচ্ছা। তাহলে ফাইনাল করি সবকিছু। তুমি সোজা কাজি অফিসে চলে এসো। ঠিকানা ফোনে সেন্ট করে দেব।”
“আচ্ছা।”
কীভাবে কী হয়ে গেল বুঝতে বেশখানিকটা সময় লাগল। একদিকে মানুষটা’কে নিজের করে কাছে পাওয়ার তীব্র বাসনা পূরণ হতে দেখার উত্তেজনা কাজ করছে, তো অন্যদিকে কুশালের পরিবারের কথা ভেবে ভয়ে শরীর কাঁটা দিয়ে ওঠছে। কিন্তু কিছুই করার নেই, অনেকটা দূরে চলে গেছি আমরা। ফিরে আসার পথ নেই। না কি কেউ ইচ্ছে করেই সেই পথটা খোলা রাখেনি? প্রশ্নটা থেকে গিয়েছিল উত্তর সবশেষে মেলে।
______আমার মা’য়ের তিন বোন ছিল। বড়ো বোন পালিয়ে বিয়ে করে বিধায় বাড়িতে আর কখনো পা রাখেনি, তাই মেঝো বোন’কে প্রেম করারও সুযোগ দেয়া হয়নি সাথে আমার মা’কেও। অল্প বয়সেই বিয়ে দেয়া হয়েছে। যার ফলে সন্তানসম্ভবা হওয়ার আশা অকালে বিফলে হারায় মেঝো খালামনি। কিন্তু মেঝো খালা বাচ্চা দত্তক নেন। বড়ো খালার সাথে কখনো দেখা হয়নি। তবে মেঝো খালার সাথে যোগাযোগ থাকার কারণে জানতে পারি; তাঁর এক ছেলে এক মেয়ে আছে, স্বামী মারা গেছে। যাইহোক পলাতক হিসেবে ফেরারি পথে পাড়ি দিয়ে মেঝো খালার বাসায় ওঠি। খালামনি দত্তক নেয়া ছেলে মাসুম পাঁচ বছরের। যখন নিসন্তান ছিলেন তখন আমাকে তাঁর কাছে নিয়ে রাখতেন, সন্তানের মতো আগলে লালন-পালন করতেন। আজ যেহেতু অসময়ে তাঁকে দরকার পড়ল, তিনি মুখ ফিরিয়ে নেননি। সাহায্যের হাত বাড়িয়ে আমার পক্ষে বিয়ের সাক্ষী দিলেন। তাঁর বাড়িতে রেখে যত্ন-আত্তি শুরু করে দিলেন।
“এই অরু! তোমার খালামনি যে হারে জামাই আদর করছেন, আমার তো আজীবন এখানে থেকে যেতে মন চাইছে।”
“এ্যাহ আসছে জামাই আদরে বাঁদর হতে।”
“আমাকে বাঁদর বললে কেন?
বিছানায় শোয়া অবস্থা থেকে ওঠে রেগে তেড়ে আসে কুশাল আমার দিকে। ভয় পাওয়ার ভান করে পিছিয়ে যেয়ে ড্রেসিংটেবিলের সাথে ঠেকে যাই।
” ওহ্হ-রে নায়ক সাব’কে বাদর বলায় লাগল বুঝি?”
কটমট খেয়ে ফেলা দৃষ্টি নিক্ষেপ করে দেখে ফিক করে হেসে বলি,
“আমাকে যে তখন বললেন, কাঁদলে পেঁচার মতো দেখায়।”
আঁড়চোখে কুশালের দিকে তাকালেই সে করুণ গলায় বলে,
“বিয়ে শেষে ওভাবে একনাগাড়ে কাঁদছ দেখেই তো কান্না থামানোর জন্য কথাটা বললাম। সেটাকে তুমি এখনো ধরে রেখেছ?”
“কথাটায় আমার আরো বেশি কষ্ট লেগেছিল।”
কুশালের অসহায় গলায় বলা কথায় আমি যেন আহ্লাদী হয়ে ওঠি। মন খারাপের ভান করে মাথা নিচু করতে দেখে কুশাল সল্প দূরত্ব কমিয়ে নিচু হওয়া মাথা উঁচু করে বলল,
“আহারে কষ্ট পেলে তা কোথায় পেলে শুনি?”
আঙুল দিয়ে বুকের বাঁ পাশ দেখালেই কুশাল চট করে সেখানে গভীর চুমুর স্পর্শ ছোঁয়ায়। শিউরে ওঠে তার চুল খাচমে ধরে বলে ওঠি,
“কী করছ? দরজা লাগানো না।”
বুক থেকে মুখ ওঠিয়ে আমার কানে ফিসফিসিয়ে কুশাল বলল,
“জানো না কষ্ট বা ব্যথা পেলে চুমুতে সেরে যায়। বাচ্চারা-ও তোমার চেয়ে ভালো জানে।”
হতবিহ্বল আমি হকচকিত চোখে কুশালের দিকে তাকালেই সে চোখ টিপ দেয়।
“ফাজিল ছেলে! আমার সাথে ফাজলামো করো।”
একনাগাড়ে কথা বলতে থাকি আর কিল-ঘুষি মারতে থাকি কুশালের গায়ে।
“ভাইয়া তোমাকে মারছে কেন?”
খালামনির ছেলে মামুন দরজার সামনে এসে আমাকে কুশাল’কে মারতে দেখে প্রশ্নটা করে।
“ও-রে আমার প্রশ্নের ডিব্বারে। আমাকে মারছে কারণ আমরা কুস্তি লড়ছি।”
মামুনের এই একটা স্বভাব। এটা কী ওটা কী দেখলেই প্রশ্ন করে সেবিষয়ে জানতে চাইবে। তার জানার আগ্রহের প্রশ্ন করা দেখে কুশাল মামুনের নাম দিয়ে দেয়; প্রশ্নের ডিব্বা।
“কুস্তি এটা আমি জানি। আমার ক্লাসের ফার্স্ট বয় বলেছে, তার সাথে লড়ে জিততে পারলে; আমাকে ফার্স্ট বেঞ্চে বসতে দেবে। তা তুমি জিতলে কী পাবে?”
“আহা প্রশ্নের মতো প্রশ্ন করছিস শালা।”
আড়ঁচোখে আমার দিকে তাকাতেই কুশাল’কে উলটো চোখ রাঙাই আমি; যার অর্থ বাচ্চাকে কীসব ভাষায় ডাকছো। থতমত খেয়ে আমতাআমতা করে বলে,
“আমি জিতলে যা চাইব তাই দেবে। হয়েছে এবার? চলো আমরা বাইরে যাই।”
“ওহ্হ তোমাদের ডাকতেই তো এসেছিলাম। ভুলে গিয়েছিলাম।”
তিনজন ড্রইংরুমে গিয়ে দেখি খালামনি খালু থমথমে মুখ নিয়ে বসে আছেন।
“ডাকছিলে?”
কথাটা বলে খালামনির দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালেই তিনি আমাকে ফোন ধরিয়ে দিয়ে বলেন,
“তোর ভাই বিদেশ থেকে ফোন করেছে। কথা বল।
আমার হৃদপিণ্ড কেঁপে ওঠে। ভাইয়েরা কেউ-ই জানে না বিষয়টা। এরইমাঝে খবরটা তাঁর কানে পৌঁছাল কীভাবে?
চলবে….