প্রাণস্পন্দন”পর্বঃ১

0
10468

ক্ষীণ দৃষ্টিতে সামনে থাকা পুরুষটির দিকে চেয়ে আছে আয়েন্দ্রি।চটপটে দুই চোখে আজ ম্লানতা।উচ্ছলতায় তরতরিয়ে থাকা আয়েন্দ্রি আজ নিভে যাওয়া মোমবাতি।তারা সারা অঙ্গ ভয়,আতঙ্কে বিবশ হয়ে আছে।পরনে তার লাল বেনারশি।চোখে মোটা কাজল হতে চুঁইয়ে পড়ছে লালিমাভরা দুই অক্ষির নোনতা,স্বচ্ছ,শীতল জলের নহর।মাথায় দেওয়া ঘোমটার বাইরের অংশে ঝুলে আছে টিকলি।তার সরু,লম্বা ভ্রু জোড়া মাঝ বরাবর কুঞ্চিত।কপালের ঠিক মাঝখানটায় দাঁড়িয়ে আছে ফিকে দুটো ভাঁজ।আয়েন্দ্রি কাঁদছে।কিন্তু তাতে শব্দের কোনো যোগান নেই।

দুরে কাউচে বসে আছেন আলফাজ সাহেব।ভদ্রলোক ভয়ে তটস্থ।নিজের মেয়ের এমন বেহাল দশায় মাথা চাপড়িয়ে আর্তনাদ করতে ইচ্ছে হচ্ছে তার।কিন্তু পারছেন না।ঠাঁয় স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বসে গুঙিয়ে যাচ্ছেন।হু,হু করে ভেতর কান্না গলধ্বকরণ করছেন তিনি।তার পাশেই প্রাণহীন হয়ে বসে আছেন ঝুমা বেগম।স্বামীর মতোই অবস্থা তার।কিন্তু তার চোখ দিয়ে পানি পড়ছে না।হয়তো কাঁদতে ভুলে গেছেন তিনি আর না হয় চোখের স্রোত শুকিয়ে গেছে।

ঘরের এককোণে কোনঠাসা হয়ে পড়ে আছে আরিশা আর আরাজ।আয়েন্দ্রির দুই সহোদর।প্রকম্পিত তারা।পনেরো বছরের আরিশা তার কলেজ পড়ুয়া ভাইয়ের দুই হাত বুকের সাথে চেপে ধরে বসে আছে।থরথরিয়ে যাচ্ছে তার শরীর।কান্না গিলে নিয়ে শুধু অশ্রুপাত করছে।
নব্য যুবা আরাজের লহু যেনো টগবগিয়ে তাকে ধিক্কার দিচ্ছে।বোনের এই মর্মান্তিক পরিস্থিতিতেও ভাই হয়ে এইভাবে হাত গুটিয়ে বসে থাকায়।আরাজের মস্তিষ্কের নিউরণগুলো ফেঁপে উঠেছে।নব্য তরুনদের রক্তে থাকে দুর্দমনীয় স্পৃহা।কিন্তু আরাজ নিস্পৃহ।তার পক্ষে এমন অবস্থায় কোনো অসাধ্য কাজ করা সম্ভব নয়।

ভয়চকিত চোখে চেয়ে সমস্ত ঘরে অবস্থিত মানুষের গুমোট অবস্থার বিষয়টা খতিয়ে দেখছেন কাজী সাহেব।কিন্তু তার মেকি ভাব ওয়ালা দারুণ মস্তিষ্ক কিছুই ঠাওর করতে পারলো না।মোটা ধূসর রঙের খাতাটা খুলে কলম ধরে বসে আছেন।

আয়েন্দ্রির সামনেই অত্যন্ত শীতল,নমনীয় আর প্রগাঢ় ভালোবাসা নিয়ে চেয়ে আছে নিষ্প্রাণ।এই যে ভয়ে ব্যতিব্যস্ত মানষগুলো তার ভয়ে জড়িয়ে আছে তাতে কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই নিষ্প্রাণের।আসন পেতে নিরবধি চেয়ে আছে আয়েন্দ্রির অশ্রু বিসর্জিত দুই চোখে।নিষ্প্রাণ ফিকে হাসলো।অদ্ভুত মোহনীয় গলায় বললো—

“ধ্রুবতারা,বল না কবুল।কেন বসে আছিস?বল কবুল।”

আয়েন্দ্রি নাক টেনে নিলো।আর কোনো প্রতিক্রিয়া করলো না।নিষ্প্রাণ আরেকটু কাছে এগিয়ে এলো।দুই হাতের অঞ্জলিতে আয়েন্দ্রি জলে সিক্ত মুখটা নিয়ে কাতর গলায় বললো—-

“কাঁদছিস কেন তুই?কাঁদিস না প্লিজ।প্লিজ,ধ্রুবতারা।”

আয়েন্দ্রি তার অক্ষিপল্লব অশিথিল করে রাখলো।তাকালো না নিষ্প্রাণের ওই সুশ্রী,ঘৃণিত মুখটার দিকে।নিষ্প্রাণ আকুতি ভরা কন্ঠে পুনরায় বললো—

“কী হলো?বল না কবুল।আমি তোর প্রাণ ধ্রুবতারা।আমি ফিরে এসেছি।একদম ভালো হয়ে ফিরে এসেছি।তোকে ভালোবাসতে ফিরে এসেছি।প্লিজ,কবুল বল ধ্রুবতারা।”

আয়েন্দ্রি চুপ করে রইলো।স্ফীত ধারায় নামতে লাগলো অক্ষিযুগলের ফোয়ারা।হুট করেই একটা দীর্ঘ চুমু খেলো আয়েন্দ্রির অধরে নিষ্প্রাণ।আয়েন্দ্রি জ্বলে উঠলো।সজোরে এক চড় বসিয়ে দিলো নিষ্প্রাণের গালে।নিষ্প্রাণ স্মিত হাসলো।অধর চড়িয়ে মৃদু হাসলো।অধর জোড়া প্রসারিত করে হাসির মাত্রা বাড়াতে থাকলো।বিস্তৃত অধরে ঘর কাঁপিয়ে হাসলো নিষ্প্রাণ।কেঁপে উঠলো কাজী সাহেবের অন্তরাত্মা।ভড়কে গেলো ঝুমা বেগম।আরাজ আর আরিশা স্তব্ধ হয়ে গেলো।

উন্মাদের মতো হাসতে থাকা নিষ্প্রাণ তার হাসি বন্ধ করে ক্রুর কন্ঠে বললো—-

“তুই তোর বাবা মাকে খুব ভালোবাসিস তাই না ধ্রুবতারা?তোর ভাইবোনদেরও?কিন্তু,কিন্তু আমি,আমি শুধু তোকে ভালোবাসি।খুব ভালোবাসি।দেখ,তাইতো আজ দুই বছর পরও আমি তোর কাছে ফিরে এসেছি।এতটা নিষ্ঠুর হোসনা ধ্রুবতারা।কবুল বল।কবুল বলে তুই আমার হয়ে যা।আমি সত্যিই ভালো হয়ে গেছি রে।তুই আমাকে আবার আগের নিষ্প্রাণ বানাস না।তাহলে আমি কাউকে ছাড়বো না।জানিস তো আমি প্রাণহীন।তাই কারো প্রাণ নিতে আমার বিন্দুমাত্র মায়া হয় না।কিন্তু তুই নিষ্প্রাণের প্রাণ।আমার হয়ে যা ধ্রুবতারা।আমি আমার জীবন পাল্টে নিবো তোর জন্য।একদম ভালো হয়ে যাবো।তোর প্রাণ হয়ে যাবো।”

অক্ষিপুট শিথিল করে তার উঠানামা করছে আয়েন্দ্রি।সামনে থাকা অতীব সুদর্শন কিন্তু ভয়ংকর,অতি নরম কিন্তু প্রকুপিত,মিষ্টভাষী কিন্তু হিংস্র পুরুষটিকে সহ্য হচ্ছে না আয়েন্দ্রির।কিন্তু ভাগ্য যে অসহায়।তার অসহায়ত্বের চরম বিপর্যয় আজ।আয়েন্দ্রি ভেঙে যাওয়া কাঁচের গুড়ো।যাকে নিষ্প্রাণ তার উত্তাপে বিগলিত করে নতুন রূপ দিতে চায়।কিন্তু তাতে নারাজ আয়েন্দ্রি।এই পুরুষটিকে সে ভালোবাসতে পারে না।কস্মিনকালেও না।

নিষ্প্রাণ অধৈর্য হয়ে উঠলো।তার শরীরের সমস্ত শিরা-উপশিরা বেয়ে খটমটিয়ে উঠলো শান্ত রক্তকণিকা।বসার ঘরের সমস্ত জিনিস এলোমেলো করে আরাজ আর আরিশার দিকে এগিয়ে যেতেই নিষ্প্রাণের কর্ণরন্ধ্রে ভেসে আসে সেই সুর।আয়েন্দ্রি তার নিষ্প্রভ গলায় বললো—

“কবুল।”

থমকে যায় নিষ্প্রাণ।চোখ বন্ধ করে এক দীর্ঘ শ্বাস টেনে নেয় বক্ষপিঞ্জিরায়।আবারো সেই চিকন,মনোহারীণি কন্ঠ।

“কবুল।”

নিষ্প্রাণের প্রাণ যেনো ক্রমশ তার ডালপালা মেলে বিচরণ করলো তার পুরো শরীরে।রক্তে রক্তে বয়ে চললো খুশির বার্তা।রুষ্ট,ক্রোধিত নিষ্প্রাণ ক্ষণপলেই শান্ত,সমাহিত হয়ে গেলো।আয়েন্দ্রি তার সুকন্ঠে পুনরায় জপ করে—

“কবুল।”

কাজী সাহেব তার আটকে রাখা নিঃশ্বাস ফেললেন।তড়িঘড়ি খাতাপত্রের কাজ শেষ করে প্রস্থান করলেন।পিছু ফিরে তাকালেন না।যেনো ক্ষুধার্ত বাঘের থাবা থেকে মুক্তি পেলেন তিনি।

নিষ্প্রাণ চঞ্চল পায়ে আয়েন্দ্রির সামনে এসে বসে।আয়েন্দ্রি নির্বিকার চেয়ে আছে।হতজীব সে।নিষ্প্রাণ গালভর্তি হাসলো।কৃতজ্ঞতার সুরে বললো—

“থ্যাংকস ধ্রুবতারা।আজ থেকে শুধু তুই আমার।শুধু আমার।তোর সর্বত্র শুধু আমার অধিকার।এই নিষ্প্রাণের প্রাণ তুই।আমার জীবনের একমাত্র সত্য তুই। আমার আঁধার আকাশের ধ্রুবতারা তুই।এই পৃথিবীর সমস্ত সুখ তোর পায়ে ভূলুণ্ঠিত করবো আমি।ভালোবাসবো তোকে আমি।আমার নতুন পৃথিবী সাজাবো তোকে নিয়ে।সেখানে শুধু তুই আর আমি থাকবো।আর কেউ না।”

চলব,,,
#প্রাণস্পন্দন
#পর্বঃ১
লেখনীতেঃতাজরিয়ান খান তানভি

(বিঃদ্রঃ
এইটা এখন থেকে গ্রুপেই পোস্ট করা হবে।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here