প্রাণস্পন্দন•পর্বঃ১২

0
2799

#প্রাণস্পন্দন
#পর্বঃ১২
লেখনীতেঃতাজরিয়ান খান তানভি

ঝলমলে শুভ্র, নির্মেঘ অন্তরীক্ষের দাবদাহে ভীষণ ক্লান্ত পরিবেশ।প্রভাকরের উষ্ণ লীলায় যেনো আজ কার্পণ্য নেই।বহমান সমীরেও নেই চঞ্চলতা।চক্ষুদর্পণে তা নিরাক ধরে নেওয়া যায়।দুপুর রোদের এই চাঞ্চল্যতায় মন ক্ষুন্ন বসুন্ধরার।বিধ্বস্ত সে,বিমূঢ় সে।

ক্যান্টিনের গোল টেবিলের ঠিক উপরে ভনভনিয়ে চলছে ফ্যান।ত্রিধার খোলা ক্যান্টিনের ভেতরেও নেই সামান্য শীতলতা।গরমে হাঁসফাঁস করা আয়েন্দ্রি তার স্বীয় ওড়নাটা গলদেশ থেকে কিঞ্চিৎ নামিয়ে বুকের অপর এনে দেই।তাতেও রক্ষে নেই।ঘুর্ণায়মান ফ্যানের কলকলানি বাতাস কাঁপালেও শরীরের লোম যেনো তা আস্বাদন করতে পারছে না।হাঁপিয়ে উঠা গলায় বললো আয়েন্দ্রি—

“এই গরমে তো মরে যাবো রে!

সীমান্ত একগাল হেসে বললো–

“আরে মরতি না।মাইয়া মানুষের জান কই মাছের জান।এতো সহজে ধরনী হালকা হইতো না।”

সীমান্তের কথায় হোঁচল খায় আয়েন্দ্রি।অক্ষিপল্লব বিস্তৃত করে বললো–

“তোর সমস্যা কী?সব সময় পেছনে লেগে থাকিস কেন?

সীমান্ত সরল দৃষ্টি দিয়ে নিজের আশপাশ দেখে বললো—

“কই দেখলি পেছন?আমি তো তোর সামনে।”

প্রাবিশ এতোক্ষণ হাসি চেপে রাখলেও এইবার ফট করে হেসে ফেলে।চোখ জোড়া মিনমিনে করে প্রাবিশের দিকে তাকায় আয়েন্দ্রি।নিষ্প্রাণ বইয়ে মুখ গুঁজে রেখেছে।তার গ্লাসের উপরের ফাঁক দিয়ে লম্বা পল্লব দেখে চলছে আয়েন্দ্রি।চকিতে নিষ্প্রাণের কাঁধে এক বিশাল থাবা বসায় সীমান্ত।ফিচেল হেসে বললো—

“মামা সাবধান।তুমি মামা বাঘিনীর নজরে পড়ছো।মাংস নিয়া টানাটানি করলে উই ডোন্ট নো।”

নিষ্প্রাণের ঠোঁটে সেই আলতো হাসি।হট করেই বলে উঠে আয়েন্দ্রি—

“তুই বেশি কথা বলিস।আজকেই তোর বাবার কাছে গিয়ে বলে আসবো।”

সীমান্ত প্রাণোচ্ছল হেসে বললো–

“কিতা কইবি বইনা?আমার বাপরে গিয়া ক এইসব কেমেস্ট্রি ফেমিস্ট্রি আমারে দিয়া হইবো না।বিয়া করাইতে আমরে।তোগোরে চাচ্চু আর ফুফু বানামু।”

“ছিঃ!অশ্লীল!

সীমান্ত ঠোঁট বাকিয়ে বললো—

“আ মর জ্বালা।বিয়ার কথা কইলেও অশ্লীল!

আয়েন্দ্রি তর্ক করা বন্ধ করে।সেখানে দৌঁড়ে আসে তৃণা।স্যার প্র্যাকটিসের জন্য ডাকছে আয়েন্দ্রিকে।আয়েন্দ্রি যেতে চাইছে না।তৃণা জোর করে নিয়ে যায় তাকে।

বই থেকে মাথা তোলে নিষ্প্রাণ।বই বন্ধ করে ব্যাগের ভেতর রেখে সামনে তাকাতেই সীমান্তের সন্দিগ্ধ চোখ জোড়া চকচক করে উঠে।সন্দিহান গলায় প্রশ্ন ছুঁড়ে—

“নিষ্প্রাইন্না !সমস্যা কী তোর?আন্দিরে দেখলেই সাপের মতো মোড়ামোড়ি করছ ক্যান?

নিষ্প্রাণ আলতো হেসে মোলায়েম গলায় বললো—

“এমন কিছু নয়।ওর কাছে আমার একটা নোট আছে।নিয়ে নিস।আমি গেলাম।”

প্রাবিশ কৌতূহলী গলায় বললো—

“কোথায় যাচ্ছিস?ক্লাস করবি না?

“না।মেসে যাচ্ছি।কাজ আছে আমার।ব্রেক আওয়ারের পর আসবো।আসি এখন।”

সীমান্ত আর প্রাবিশের অদৃশ্য চিন্তায় আবিষ্ট অক্ষিজোড়ার পল্লব ধীরে ধীরে উঠানামা করছে।
,
,
,
শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত একটা রেস্তোরাঁয় এসে ঢুকে নিষ্প্রাণ।একদম কোণার টেবিলের কাছে গিয়ে চেয়ার টেনে বসে পড়ে।গায়ের পোলোশার্টটা ঘেমে চেপে আছে শরীরের সাথে।ঘমার্ত মুখের চোয়াল বেয়ে নামছে উষ্ণ জলের স্মিত ধারা।ভ্রুযুগলের কার্ণিশে কার্ণিশে ঘামের নহর।সামনের চুলগুলো লেপ্টে আছে কপালে।নিষ্প্রাণ চোখের চশমাটা খুলে টেবিলের উপর রাখে।পকেট থেকে সফেদ রঙের একটা পাতলা রুমাল বের করে ঘামে ভেজা মুখটা মুছে নেয়।ফর্সা মুখে ঘামের ফোটা মুক্তোর মতো ঝুলছে।
নিষ্প্রাণের এই অবস্থা দেখে সামনের ভদ্রলোক অমায়িক হাসলেন।নির্বিঘ্ন গলায় বললেন—

” আর ইউ অলরাইট নিষ্প্রাণ?

নিষ্প্রাণ চট করেই রুমালটা পকেটে ঢুকিয়ে নেয়।চমৎকার হেসে বললো—

“ইয়েস।আই এম ফাইন।কেমন আছেন আপনি?

ভদ্রলোক ছোট্ট করে জবাব দিলেন—

“ভালো।”

“দাদু কেমন আছেন?তার বুকের ব্যথাটা কমেছে?

ভদ্রলোক চিরাচরিত ব্যবহারসুলভ নিষ্প্রাণের সামনে একটা খাম রাখলেন।মৃদু গলায় বললেন–

“জ্বী,তিনি ভালো আছেন।আপনার এই মাসের হাত খরচ।”

নিষ্প্রাণ খাম হাতে নিয়ে বললো—

“আমার কিছু বই কিনতে হবে।বাড়তি টাকার কথা বলেছি দাদুকে।তিনি কী তা দিয়েছেন?

ভদ্রলোক স্মিত হেসে বললেন—

“জ্বী।আপনার বইয়ের জন্য তিনি বাড়তি দু’হাজার টাকা দিয়েছেন।সব মিলিয়ে এখানে দশ হাজার আছে।”

নিষ্প্রাণ প্রসন্ন হাসলো।কৃতজ্ঞতার সুরে বললো—

“ধন্যবাদ।আমি তাহলে এখন আসি।আমার ক্লাস আছে।”

ভদ্রলোক উঠে দাঁড়ালেন।উষ্ণ আলিঙ্গন করলেন নিষ্প্রাণের সাথে।তার থেকে বিদায় নিয়ে চঞ্চল পায়ে হাঁটা ধরে নিষ্প্রাণ।ব্রেক আওয়ার শেষ হওয়ার আগেই তাকে ভার্সিটির প্রাঙ্গনে ঢুকতে হবে।
ভদ্রলোক রেস্তোরাঁ থেকে নিষ্প্রাণের যাওয়ার গতিপথ দেখলেন।মোবাইলটা নিয়ে কল করলেন কাউকে।অতি সানন্দে বললেন—

“হি ইজ ফাইন।পড়ালেখা নিয়ে ভীষণ ব্যস্ত।আপনার উপরও বিশ্বাসী।খামে দু’হাজার টাকা কম আছে।কিন্তু সে আমার কথা অনুযায়ী বিশ্বাস করে নিলেন সবটা।তাই আর খুলে দেখলেন না।”

ওপাশের ব্যক্তি শুধু শুনলেন।কোনো কথা বললেন না।

চলবে,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here