#প্রাণস্পন্দন
#পর্বঃ২৪
লেখনীতেঃতাজরিয়ান খান তানভি
প্রিন্সিপ্যাল গোলাম সারোয়ারের সামনে নীরব দাঁড়িয়ে আছে নিষ্প্রাণ। সেদিন যেই ছেলেটাকে সীমান্ত মেরেছিলো তারই সহচর এরা। গোলাম সারোয়ার অনেক কথা শোনালেন নিষ্প্রাণকে। মোটামুটি ভার্সিটির সকল শিক্ষকবৃন্দরা উপস্থিত সেখানে। হট্টগোল সামলাতে এগিয়ে আসে সারক। ছেলেদের শান্ত হতে বলে। একগাদা ছেলে দাঁড়িয়ে আছে গোলাম সারোয়ারের কক্ষের বাইরে। তারা তটস্থ,ব্যগ্র,ব্যস্ত।
গোলাম সারোয়ার দারাজ গলায় বললেন—
“কাজটা তোমার মোটেও ঠিক হয়নি। যে ছেলেটাকে কানে আঘাত করছে সে বধির হয়ে গিয়েছে। আর বাকি একজন আর কখনো তার ঘাড় সোজা করতে পারবে না।”
নিষ্প্রাণ নির্বিকার চাহনিতে অকপটে বললো—
“সীমান্তকে আঘাত করা কী ওদের ঠিক হয়েছে?
“সীমান্ত ভালো আছে।”
গোলাম সারোয়ার উচ্চ আওয়াজে বলে উঠলেন। চোখে হেসে তার সামনে গিয়ে দাঁড়ালো নিষ্প্রাণ। স্বাভাবিক দৃষ্টিতে চেয়ে মুঠো হাতটা গোলাম সারোয়ারের টেবিলের উপর রাখলো। সকলে উৎসুক চোখে চেয়ে আছে। নিষ্প্রাণ আলতো চোখে তাকিয়ে হালকা ঝুঁকে রহস্য হাসলো। বিভ্রান্ত হলেন গোলাম সারোয়ার। তিনি কপালের মাঝ বরাবর ভাঁজ অঙ্কিত করলেন। নিষ্প্রাণ তার হাতের মুঠো আলগা করতেই একটা কালো ভয়ংকর মাকড়সা সুরসুর করে বেরিয়ে গোলাম সারোয়ারে দিকে ধাবিত হয়। গোলাম সারোয়ার আঁতকে উঠেন। ত্রাসিত চোখে চেয়ে লাফিয়ে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন। উপায়ন্তর না পেয়ে টেবিলে থাকা পেপার ওয়েট দিয়ে মাকড়সাটিকে চেপে ধরলেন। উপস্থিত সকলের সন্ত্রস্ত দৃষ্টি। নিষ্প্রাণ হৃদয় ভেজা হেসে বললো—
“মাকড়সাটিকে মারলেন কেন স্যার?
গোলাম সারোয়ার সচকিতে বললেন—
“এইটা কী করলে তুমি! যদি মাকড়সাটা কামড়ে দিতো আমাকে?
নিষ্প্রাণ মুচকি হেসে আনম্র গলায় বললো—
“এখনো কামড়ায়নি তো স্যার। তবুও মেরে ফেললেন?
“আমি কী সেই পর্যন্ত অপেক্ষা করবো নাকি?
নিষ্প্রাণ চোখে হাসলো। সদর্পে বললো—
“তাহলে আমারও কি সীমান্তকে মেরে ফেলা অব্দি অপেক্ষা করা উচিত ছিলো?
অগনিত চক্ষুদ্বয় একে অপরের ভীত চোখে চেয়ে চোখে চোখে নিজের ভাবের আদান-প্রদান করছে। সারক নিষ্প্রাণের কাছে এসে অবলীলায় বললো—
“মানছি তোমার কথা। কিন্তু এইভাবে কাউকে আঘাত করা তোমার ঠিক হয়নি। ছেলেগুলোর অঙ্গহানি ঘটতে পারতো। এখনো যে ক্ষতির সম্মুখীন ওরা হয়েছে তা সারতেও বছর লাগবে।”
নিষ্প্রাণ ঝরা গলায় বললো—
“যদি তাই হয়ে থাকে তাতেও আফসোস নেই আমার। আপনারা আমাকে যেকোনো শাস্তি দিতে পারেন। যদি সত্যিই আমি অপরাধী হয়ে থাকে। দ্যাটস অল।”
কানাঘুষো শুরু হলো উপস্থিত জনতার মাঝে। সকলের মতামত অনুসারে সিদ্ধান্ত হলো নিষ্প্রাণকে এইবারের মতো ক্ষমা করা হবে। কিন্তু পরবর্তীতে এই ধরনের কাজে তাকে কঠিন শাস্তি দেওয়া হবে।
দাম্ভিকতার সাথে প্রিন্সিপ্যাল স্যারের কক্ষ থেকে বের হয় নিষ্প্রাণ। ছেলেগুলো সরোষে তাকিয়ে আছে। নিষ্প্রাণের সরু অধরে বাঁকা হাসি।
,
,
,
সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে আসে নিষ্প্রাণ। আয়েন্দ্রি দাঁড়িয়ে আছে সিঁড়ির দোরগোড়ায়। নিষ্প্রাণ সন্দিহান চোখে তাকিয়ে বললো–
“বাসায় যাসনি কেন?
আয়েন্দ্রি নিষ্প্রাণের প্রশ্ন উপেক্ষা করে। সরল গলায় বললো—
“কী বলেছে স্যার?
নিষ্প্রাণ হেয়ালি গলায় বললো–
“ওয়ার্নিং দিয়েছে। চল তোকে বাসায় পৌঁছে দেই।”
দ্বিরূক্তি করলো না আয়েন্দ্রি।
কাসার থালার মতো চন্দ্রের আলোতে সিক্ত ধরণী।খিলখিলে হাসি তার। সেই হাসিতে ঝরছে রুপালি জ্যোৎস্না।
রাত হওয়ায় রিক্সা নেয় নিষ্প্রাণ। তাদের মাথার উপরের উদিত চন্দ্র চলছে তাদের সাথে। অন্তরীক্ষ আজ খুশিতে হাসছে।
আয়েন্দ্রির মুখটা পাংশুবর্ণ। সে উদাসচিত্তে চেয়ে আছে সড়কের বামদিকে। নিষ্প্রাণ ক্ষীণ গলায় প্রশ্ন ছুঁড়ে—
“কিছু খাসনি তাই না?
কোনো প্রতিক্রিয়া করলো না আয়েন্দ্রি। নিষ্প্রাণ রিক্সা থামাতে বলে। আয়েন্দ্রি ত্রস্তে ফিরে তাকায়। দৃঢ় চোখ জোড়ায় তীব্র আতঙ্ক। রিক্সাওয়ালাকে ভাড়া দিয়ে বিদায় করে নিষ্প্রাণ। রাস্তার পাশেই ছোট্ট ফাস্টফুডের দোকান। থাই স্লাইড করে ভেতরে প্রবেশ করে নিষ্প্রাণ আর আয়েন্দ্রি। অর্ডার করে ফ্রেন্স ফ্রাই,শর্মা আর লাচ্চি। নিষ্প্রাণ খেলেও দুম ধরে বসে আছে আয়েন্দ্রি। ভারাক্রান্ত চোখে তাকিয়ে আছে সে। নিষ্প্রাণ মায়াময় গলায় বললো—
“খেয়ে নে ধ্রুবতারা।”
আয়েন্দ্রি চাপা কষ্টে ভুগছে। দ্বিধান্বিত সে। নিষ্প্রাণ তাকে বাধ্য করছে নিজেকে নিয়ে ভাবতে। নিজেকে মানাতে পারছে না আয়েন্দ্রি। সামনে এগুতে পারছে না সে। নিষ্প্রাণের শীতল স্বরও কাঁপন ধরিয়ে দেয় আয়েন্দ্রির শরীরে। দূরেও সরাতে পারছে না নিজেকে। বুকে ব্যাথা হয়। খুব বেশিই হয়। তা দমাতেও অনেক কষ্ট,যন্ত্রণা,তীব্র দীর্ঘশ্বাস।
নিষ্প্রাণ সরব গলায় বললো—
“কী হয়েছে তোর? খাচ্ছিস না কেন?
আয়েন্দ্রি সশব্দে বললো—
“খাবো না আমি।”
নিষ্প্রাণ লাচ্চিতে সিপ দিয়ে আবাব থমকে যায়। পাশ ফিরে দেখে তাদের থেকে একটু দূরের আরেকটি টেবিলে বসে আছে একটি ছেলে। ছেলেটা বারংবার আড়চোখে তাদের দুইজনের দিকে তাকাচ্ছে। বিশেষ করে আয়েন্দ্রির দিকে। নিষ্প্রাণ নাকের পাটা ফুলিয়ে অতি স্বাভাবিক গলায় বললো—
“ওই দিকে তাকাবি না। জলদি খেয়ে নে। রাত হচ্ছে।”
আয়েন্দ্রি মেঘাচ্ছন্ন চোখে তাকায় নিষ্প্রাণের দিকে। কেমন অদ্ভুত ভয়ংকর সেই দৃষ্টি। আয়েন্দ্রি তবুও খেলো না। দৈবাৎ চেয়ার ছেড়ে উঠে যায় নিষ্প্রাণ। লাফিয়ে উঠে আয়েন্দ্রি। সেই সাথে তার কলিজা কাঁপতে থাকে। নিষ্প্রাণ সোজা গিয়ে সেই ছেলেটার কলার চেপে ধরে তাদের টেবিলে সার্ভ করা পাস্তার ডিশ থেকে কাটাচামচ উঠিয়ে তার চোখের সম্মুখে ধরে। চিৎকার দিয়ে উঠে আয়েন্দ্রি। ফাস্টফুডের ছেলেগুলোও আতঙ্কে আত্মহারা। নিষ্প্রাণের ভয়াল কান্ডে সন্ত্রস্ত তারা।ছেলেটা কাঁপতে থাকে। চোখের পল্লব বেয়ে টুপ করে জল খসে পড়লো ছেলেটার। নিষ্প্রাণ হট করেই ছেলেটার কলার ছেড়ে দেয়। হাতের কাঁটাচামচটা ফেলে দুই হাত উঁচুতে উঠিয়ে সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বললো—
“সরি!সরি এভরিবডি।”
ত্রাসের সহিত বিরক্তি ছেয়ে যায় সকলের চোখে,মুখে।ছেলেটার সাথে থাকা মেয়েটা শঙ্কিত গলায় বললো—
“এইসবের মানে কী! কী করছিলেন আপনি?
নিষ্প্রাণ ছোট্ট করে হেসে অনুনয় করে বললো—
“আই এম এক্সট্রেমলি সরি। আমার ধ্রুবতারার মনটা ভালো নেই। কিছুই খাচ্ছে না। তাই।”
মেয়েটা দাঁত,মুখ খিঁচে সক্রোধে বললো—
“আর ইউ ম্যাড?
নিষ্প্রাণ একগাল হেসে বললো—
“হয়তো।”
সকলের দিকে সরস চোখে তাকায় নিষ্প্রাণ। অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে নিষ্প্রাণকে পর্যবেক্ষণ করছে সকলে। দুই হাত দোষী সাব্যস্ত অপরাধীর মতো উঠিয়ে বিগলিত হেসে বললো—
“সরি,সরিইইই।”
নিষ্প্রানের আকুঞ্চিত ভ্রু জোড়ায় ঢেউ উঠেছে।আয়েন্দ্রির ওষ্ঠাধর তিরতির করে কাঁপছে।আবেশিত,আচ্ছন্ন,ভীত সে।
,
,
,
আয়েন্দ্রিকে বাসার সামনে পর্যন্ত এগিয়ে দেয় নিষ্প্রাণ। আধাঘন্টার পথে আর একটা কথাও বলেনি আয়েন্দ্রি। নিষ্প্রাণের প্রতি জমাট বাঁধা বিন্দু,বিন্দু ভয় হিমালয়ে রূপ নিচ্ছে। আয়েন্দ্রির ভাবুক মন নিষ্পেষিত হচ্ছে। কী করে কাটাবে এই ভয়!
নিষ্প্রাণের সামনে ম্রিয়মান বদনে দাঁড়িয়ে আছে আয়েন্দ্রি।তমসাচ্ছন্ন মায়ায় আয়েন্দ্রির মুখের দিকে তাকিয়ে আছে নিষ্প্রাণ। চকিতে নিষ্প্রাণ ঝড়ের বেগে আয়েন্দ্রির অধরের কাছে চলে আসে। আয়েন্দ্রি হুট করে চোখ বন্ধ করে ওড়নার দুই প্রান্ত খামচে ধরে। নিষ্প্রাণের চকিত স্পর্শ ওআ পেয়ে ধীরে ধীরে আঁখিপুট মেলে ধরে আয়েন্দ্রি। উদ্ভাসিত নয়নজোড়া হতবিহ্বল। নিষ্প্রাণ হৃদয় ভেজা হাসে।
আদুরে গলায় বললো—
“ভয় পাস না। যতদিন না তুই একান্ত আমার হচ্ছিস ততদিন তোকে আমি শুধু ভালোবাসবো। সেই ভালোবাসায় তোকে নিজের করে পাওয়ার তীব্র বাসনা থাকবে।কোনো কামনা থাকবে না।”
আয়েন্দ্রি নির্বিকার চোখে শ্রবণ করে নিষ্প্রাণের মায়াবী স্বীকারোক্তি। বাড়ির গেইটের সামনে যেতেই ডেকে উঠে নিষ্প্রাণ।
“ধ্রুবতারা!
আয়েন্দ্রি ফিরে তাকায় নিষ্প্রাণের দিকে। নিষ্প্রাণ আলতো করে হাত উঠিয়ে বিদায় জানায় তাকে।সরস গলায় বলে উঠে—-
“তোর চোখেই আমার বাস,সেই চোখেই আমার শ্বাস
তোর হৃদয় আমার ত্রাস,তোর নেশায় আমার সর্বনাশ।”
চলবে,,,