#প্রাণস্পন্দন
#পর্বঃ২৯
লেখনীতেঃতাজরিয়ান খান তানভি
বিকেল পাঁচটা। ম্রিয়মান সূর্যের আলো। ধূসর আকাশ ধীরে ধীরে লুপ্ত হচ্ছে নীলাভ কালচে মেঘে। গুরুগম্ভীর মুখ করে বসে আছে আয়েন্দ্রি। চিন্তিত মুখশ্রীতেও চকচকে চোখ। প্রাবিশের ক্ষীণ গলার প্রশ্নে ধ্যান ভাঙ্গে আয়েন্দ্রির। হড়বড়িয়ে তাকাতেই ফিচেল হাসে প্রাবিশ।
“কী ভাবছিস?”
“কিছু না।”
আয়েন্দ্রি ভার্সিটির গেইটের দিকে চোখ স্থির রেখে মোলায়েম গলায় বলল—
“প্রাণ আজ আসেনি কেন?
প্রাবিশ সহজ গলায় বলল—
“ও গ্রামে গিয়েছে।”
আয়েন্দ্রি ভ্রু উঁচু করে তাকাল। চোখের কোণে ভাঁজ ফুটিয়ে বলল–
“কেন?”
“তা তো জানি না। সকালে ম্যাসেজ করেছিল। তারপর মোবাইল সুইচ অফ।”
আয়েন্দ্রি শঙ্কিত হলো। তাকে কিছু না জানিয়েই চলে গেল!
আয়েন্দ্রির চোখে, মুখের বিরসভাব বুঝতে পারে প্রাবিশ। আশ্বাসিত গলায় বলল—
“চিন্তা করিস না। চলে আসবে। হয়তো জরুরি কাজ ছিল। তাই হুট করে চলে গিয়েছে।”
আয়েন্দ্রির চিন্তা কমলো না। খুটখুট করছে নিষ্প্রাণের চিন্তা তার মস্তিষ্কে। কন্ঠে গভীরতা টেনে প্রশ্ন করল—
“তুই কখনো প্রাণের বাসায় গিয়েছিস?”
প্রাবিশ মাথা ঝাঁকালো। আয়েন্দ্রি তটস্থ গলায় ফের প্রশ্ন করে—
“ওর ঘরে গিয়েছিস? ওকে আমার আজব লাগে!”
চট করে হেসে ফেলে প্রাবিশ। তার চোখে চাটুকারিতা। ফিচেল গলায় বলল—
” দরিয়ার জল বলে, মৎস কইরো না ফরফরানি! আছি আমি,তোমারই সঙ্গে নিরবধি। এখন এইসব চিন্তা কেন তোর? আজাইরা!”
আয়েন্দ্রি বিষিয়ে উঠা কন্ঠে বলল—
“আরে এই! আমি তোকে ফাজলামি করার মতো কী বললাম?”
“ভালোবাসিস নিষ্প্রাণকে?
আয়েন্দ্রির কন্ঠে মৌনতা নেমে আসে। ঠোঁটের কোণের অনাবিল হাসিটা বন্ধ হয়ে যায়। নিষ্প্রভ চোখে নামে জলপুকুরের অথৈ জল। আয়েন্দ্রি পাশ ফিরে নিজেকে লুকাতে ব্যস্ত হয়। প্রাবিশ ঠান্ডা গলায় বলল—
“ছেলেটা খারাপ না। একটু অন্যরকম। কিন্তু তুখোড় মেধাবী! নিজেকে গুটিয়ে রাখে ঠিকই, কিন্তু প্রয়োজনে মেলেও ধরে। ও আসলেই একটু অদ্ভুত ! যতবারই ওর বাসায় গিয়েছি কখনো ঘরে প্রবেশ করার অধিকার পাইনি। নিচে দাঁড়িয়ে থাকি। ও ঘর থেকে বেরিয়ে আসে। এমনকি মেসের অন্যদের সাথেও তেমন সখ্যতা নেই নিষ্প্রাণের! কাউকে ওর ঘরে কখনো যেতে দেয় না।”
একাগ্রচিত্তে তা শ্রবণ করছে আয়েন্দ্রি। প্রাবিশ থামতেই হুট করে বলল—
“ওর বুয়া?”
“বুয়া পাশের ঘরে রান্না করে। খেতে ইচ্ছে হলে সেখান থেকেই খেয়ে আসে।”
আয়েন্দ্রির দৃষ্টি ক্রমশ প্রশস্ত হচ্ছে। টনটন করছে মস্তিষ্ক। কোনো মানুষ এত ইন্ট্রোভার্ট কী করে হয়!
প্রাবিশ নিজ থেকেই বলল—
“এইসব আমাকে সীমান্ত বলেছে। প্রথমে আমিও অবাক হয়েছে। পরে মনে হয়েছে স্বাভাবিক।”
“কেন?
প্রাবিশ দুর্বোধ্য হাসল। বিগলিত গলায় বলল—
“নিষ্প্রাণ ছোটোবেলা থেকেই একা বড়ো হয়েছে। মানুষের সাথে বিশেষ সখ্যতা গড়ে উঠতে একটু সময় লাগবেই। হয়তো ওর হেসিটেশন!
এই তোর কথাই ভাব না! কত দ্রুত ও তোকে ভালোবেসে ফেলেছে! কিন্তু চিন্তা কর্, গত ষোলো মাসেও ও তোকে খেয়াল করেনি। আর যখন করল..হায়!”
প্রাবিশের অধরে খেলে গেল দুষ্ট হাসি। আয়েন্দ্রি বরফের মতো জমে আছে। তরলে পরিণত হতে বেশ সময় লাগবে। তৎক্ষণাৎ দৌঁড়ে আসে তৃণা। কিছু বুঝে ওঠার আগেই আয়েন্দ্রির হাত ধরে তাকে টেনে তোলে। হকচকিয়ে ওঠে আয়েন্দ্রি। অধৈর্য গলায় বলল—
“কী হয়েছে তোর? পাগল হয়েছিস?”
তৃণা গালভর্তি উচ্ছ্বাস নিয়ে বলল—
“সারক স্যার তোকে ডাকছে। জলদি চল্।”
আয়েন্দ্রি প্রতিক্রিয়া করার সময় পেল না। তাকে জোর করেই টেনে নিয়ে গেল তৃণা।
টুং করে প্রাবিশের ম্যাসেজ টোন বেজে ওঠে। তা দেখে অধরে ঝুলে মিষ্টি হাসি।
,
,
,
প্রফেসর যামিনী তার ডিপার্টমেন্টের একটা প্রোগ্রাম করবেন। তাতে রবীন্দ্র সংগীত গাওয়ার জন্য তিনি একজন মেয়ে খুঁজছেন। প্রফেসর সারক তাকে আয়েন্দ্রির নাম রিকোমেন্ড করে। রবীন্দ্র সংগীত শুনেই মাথায় হাত আয়েন্দ্রির! সে কোনোভাবেই রাজি নয়। যামিনী তাকে রিকোয়েস্ট করে। অনুষ্ঠান হতে আরো একমাস। ততদিনে নিয়মিত চর্চা করলে ভালো কিছু হবে বলে তিনি আশা রাখেন। মনে সাহস সঞ্চয় হচ্ছে না আয়েন্দ্রির। সে নারাজ। আয়েন্দ্রিকে কমন রুমের একপাশে নিয়ে যায় সারক। বিনীত গলায় বলল—
“দেখো, তোমাকে কিন্তু রাজি হতেই হবে। আমি ম্যামকে কথা দিয়েছি।”
আয়েন্দ্রি অপ্রস্তুত গলায় বলল—
“স্যার রবীন্দ্র সংগীত! আমার পক্ষে অনেক টাফ একটা ব্যাপার!”
“আমরা তো আছি। আর অনেক সময়ও আছে। আমার দৃঢ় বিশ্বাস তুমি পারবে।”
“কিন্তু স্যার….।”
আয়েন্দ্রির কথার মাঝেই তার মোবাইলের বিরক্তিকর রিংটোন বেজে ওঠে। নিষ্প্রাণের নম্বরটা দেখে অপুপল ব্যয় না করেই ব্যস্তসমস্ত হয়ে রিসিভ করে। আশাভরা গলায় বলল—
“হ্যালো! হ্যালো! প্রাণ?
ওপাশ থেকে কোনো শব্দ হলো না। আয়েন্দ্রি নিরাশ হলো। ক্ষণপল পূর্বেই সোনালী রোদ্দুরে ঝকমকিয়ে ওঠা মুখটায় নিষ্প্রভতা ছেয়ে যায়। ক্ষুণ্ণ হয় তার মন। চোখে নামে কাতরতা !
টলটলে চোখ দুটো প্রশস্ত করতেই টুপ করে এক ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ে। বিভ্রান্তিকর এই পরিস্থিতি এড়াতে অন্যদিকে ফিরে চোখের পানি মুছে ফেলে আয়েন্দ্রি। সারক ভ্রু বাঁকায়। কুঁচকানো চোখে চেয়ে জিজ্ঞাসু গলায় বলল—
“তুমি ঠিক আছো তো?”
আয়েন্দ্রি জমাট গলায় বলল—
“হুম।”
আচমকা আবার মোবাইল বেজে ওঠে। ব্যগ্র হয়ে তা রিসিভ করে কমন রুম থেকে বেরিয়ে আসে আয়েন্দ্রি। একনাগাড়ে বলতে থাকে—
“হ্যালো! হ্যালো! প্রাণ? কথা বলছিস না কেন তুই? হ্যালো!
কোনো উত্তর এলো না। আয়েন্দ্রি মোবাইল কান থেকে নামিয় বিষণ্ণ চোখ দুটো দিয়ে তাকাতেই দেখে কল কেটে গেছে। দৈবক্রমে নিজের কাঁধে কারো স্পর্শ পেয়ে সপ্রতিভ হয় আয়েন্দ্রি। পেছনে ফিরতেই চমকিত হয় সে।
“প্রাণ!”
নিষ্প্রাণ বজ্রদৃঢ় হাতে চেপে ধরে আয়েন্দ্রির হাত। তার রঞ্জিত চোখের দিকে তাকিয়ে আত্মা শুকিয়ে আসে আয়েন্দ্রির। ছটপটে পা দুটো লম্বা লম্বা ফেলে সিঁড়ি বেয়ে নামতে থাকে নিষ্প্রাণ। ভয়ে কম্পিত হচ্ছে আয়েন্দ্রির দেহ। নিষ্প্রাণের পায়ের সাথে পা মেলাতে পারছে না সে। তবুও চলছে। সিঁড়ি দিয়ে নামতে গেলে বাম দিকে কাউন্টার। সেখানের দেয়ালের সাথেই চেপে ধরে আয়েন্দ্রিকে নিষ্প্রাণ। ভয়ে নেত্রযুগল মুদিত করে আয়েন্দ্রি। শ্বাসরুদ্ধ করে নিষ্প্রাণের পরবর্তি কাজের জন্য অপেক্ষা করছে। কিন্তু আয়েন্দ্রিকে অবাক করে নিষ্প্রাণ!
কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে পিটপিট করে চোখের পল্লব মেলে ধরে আয়েন্দ্রি। সিঁড়ির শেষ প্রান্তটুকুতে তিন পাশেই ঘেরাও। একপাশে সিঁড়ি, অনপাশে কাউন্টার আর আরেকপাশে হাফ দেয়াল। সেই হাফ দেয়ালের পাশেই কাউন্টারের দেয়াল ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে নিষ্প্রাণ। বুকে হাত ভাঁজ করে এক হাঁটু ভেঙে দেয়ালে সেটে রেখেছে। আয়েন্দ্রির পাশ দিয়ে নেমে গিয়েছে কয়েকজন প্রফেসর। ভার্সিটি বন্ধের সময় হয়ে এসেছে। আয়েন্দ্রি বিতৃষ্ণা গলায় চিৎকার করে উঠে—
“পাগল হয়েছিস তুই? এমন করলি কেন?
মিষ্টি করে হাসল নিষ্প্রাণ। সরস গলায় বলল—
“আমি তো পাগলই।”
এই ছোট্ট বাক্যেই আয়েন্দ্রির গর্জে ওঠা রাগ স্থিমিত হলো। সকাতরে চেয়ে বলল—
“কখন এসেছিস তুই?”
নিষ্প্রাণ হালকা করে মাথাটা ঘোরাল। নমনীয় গলায় বলল—
“একটু আগেই।”
আয়েন্দ্রি অতলস্পর্শী চাহনিতে অবলোকন করে নিষ্প্রাণকে। এলোথেলো চুল, শুষ্ক ওষ্ঠাধর, ম্লাণ চোখ। ব্যথিত হয় আয়েন্দ্রি। ভেজা গলায় বলল—
“এখনো কিছু খাসনি?”
“বাসায় যাইনি তো! তোকে বাসায় পৌঁছে দিয়ে তারপর যাব।”
আয়েন্দ্রি আকুঞ্চনিত চোখে চেয়ে বলল—
“তাই বলে না খেয়ে থাকবি?”
চোখে হাসে নিষ্প্রাণ। নির্মল গলায় বলল—
“তোর বাসায় খাব। চল্।”
আয়েন্দ্রি চঞ্চল হেসে নিষ্প্রাণের মাথাভর্তি চুলে হাত গলিয়ে দেয়। ফিচেল গলায় বলল—
“চুল কাটিস না কেন তুই? কাকের বাসা!”
অত্যন্ত শান্ত স্বরে বলল নিষ্প্রাণ–
“কাটব।”
আয়েন্দ্রি মেকি রাগ দেখিয়ে বলল—
“আমি যেন এই কাকের বাসা আর না দেখি।”
“আচ্ছা। চল্ এখন। প্রচন্ড খিদে পেয়েছে আমার।”
ঝরা হাসে আয়েন্দ্রি।
চলবে,,,