#প্রাণস্পন্দন
#পর্বঃ৩৫
লেখনীতেঃতাজরিয়ান খান তানভি
বিছানায় ওঠে বসে আয়েন্দ্রি। নিভুনিভু চোখ দুটো মেলে ধরতেই সামনে দেখতে পায় নিষ্প্রাণকে। শান্ত দৃষ্টিতে চেয়ে আছে নিষ্প্রাণ। আয়েন্দ্রি ঘুম জড়ানো চোখে হাসে। অলস ভঙ্গিতে বলল—
“তুই ঘুমাসনি?
নিষ্প্রাণ ছোট্ট করে হাসে। সরস গলায় বলল—
“হাত, মুখ ধুয়ে নে। বাসায় যেতে হবে। আরাজ বসে আছে বাইরে।”
আয়েন্দ্রি প্রশস্ত পল্লব নাচিয়ে বলল—
“আরাজ যায়নি? বাকিরা কোথায়?”
“বাকিরা বাইরেই আছে। ওঠ।”
বিস্ময়কর কাজ করে আয়েন্দ্রি। নিষ্প্রাণের অধরের সম্মুখে নিয়ে আসে নিজেকে। ওষ্ঠাধর ছোঁয়ার আগেই নিষ্প্রাণের চশমা নাকে লেগে যায় আয়েন্দ্রির। বিব্রত হয় সে। আলতো হাতে নিষ্প্রাণের চশমাটা খুলে হাতে নিয়ে নেয়। উলটে পালটে দেখতে থাকে। টিমটিমে গলায় বলল—
“এইটা ছাড়া তুই দেখতে পাস?”
নিষ্প্রাণ অতরল হাসে। নিস্পৃহ গলায় বলল—
“পারব না কেন! মাইনাস পয়েন্ট সেভেন ফাইভ মাত্র। এই যে তোকে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি।”
“তাহলে আর পরবি না।”
নিষ্প্রাণ সংকীর্ণ গলায় বলল—
“কেন?”
“রোমান্সে নো বাঁধা।”
হৃষ্ট হাসে নিষ্প্রাণ। সপ্রতিভ গলায় বলল—
“বিয়ের পর লেন্স পরে নেবো। চল এখন। সবাই বসে আছে।”
আয়েন্দ্রি ফট করে নিষ্প্রাণের শার্টের কলার চেপে ধরে। কপালের সাথে কপাল ঠেকিয়ে লম্বা শ্বাস ফেলে। নিষ্প্রাণ কৃশ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। আয়েন্দ্রি আচ্ছন্ন গলায় বলল—
“বাবাকে রাজি করাতে পারবি তো তুই?”
দম বন্ধ হয়ে আসছে নিষ্প্রাণের। বেলি ফুলের তীব্র সৌরভ হুরহুর করে তার ঘ্রাণেন্দ্রিয়তে সাড়া জাগাচ্ছে। মেয়েটা এত কাছে কেন আসে!
নিষ্প্রাণ নিবারিত গলায় বলল—
“আমি চেষ্টা করব।”
চকিতে ভাবনাতীত কাজ করে বসে আয়েন্দ্রি। তার কুসুমকোমল ওষ্ঠাধরে আঁকড়ে ধরে নিষ্প্রাণের সরু অধর। হতচকিত নিষ্প্রাণ!
,
,
,
ঝুমঝুম করে চোখের পানি পড়ছে আয়েন্দ্রির।আগামীকাল তাকে দেখতে আসার কথা থাকলেও পাত্রপক্ষ আজ-ই চলে এসেছে। তারা বসার ঘরে বসে আছেন।
আয়েন্দ্রিকে তৈরি হওয়ার জন্য তাড়া দিচ্ছেন তার মা। ঝুমা মেয়ের এহেন কাজে দুঃখী। কী করবেন তিনি? তার কিছুই করার নেই। অত্যন্ত নরম গলায় মেয়েকে বললেন—
“দেখ আয়ু, এখন ঝামেলা করিস না। ওরা যখন এসেছে দেখে চলে যাক। তারপর না হয় আমিই তোর বাবার সাথে কথা বলব।”
আয়েন্দ্রি রাগান্বিত গলায় বলল—
“কী বলবে তুমি? কী বলবে? এতদিন কেন কিছু বললে না? করব না আমি বিয়ে। চলে যেতে বলো ওদের।”
ঝুমা মেয়ের মাথায় হাত বোলালেন। কপালে আদুরে চুমু খেয়ে বললেন—
“রাগ করে না মা! ওরা চলে যাক আমি সত্যিই তোর বাবার সাথে কথা বলব।”
কান্না আটকে নেয় আয়েন্দ্রি। মায়ের কথায় আশ্বস্ত হয়। অনিচ্ছা সত্ত্বেও মায়ের দেওয়া গাঢ় নীল রঙের সুতি শাড়িটা পরে নিজেকে গোছগাছ করে নেয়।
ছেলে তার মামা, মামীকে সাথে নিয়ে এসেছে। আয়েন্দ্রিকে তাদের সামনে এনে বসাল ঝুমা। মেয়েকে তাদের দেখার কিছু নেই। তথাকথিত নিয়ম মানতে তারা এসেছেন। তাদের আসল উদ্দেশ্য বিয়ের তারিখ ঠিক করা। আয়েন্দ্রি চোখে তুলে তাকাল না। ঘর্মাক্ত দুই হাত একে অপরের সাথে ঘষে চলছে। জল ছাপিয়ে আসায় চোখ দুটো ঝাপসা হয়ে আছে। আরাজ এক পাশে বসে আছে। রান্না ঘরের সাথে ঠেসে দাঁড়িয়ে আছে আরিশা। দরজায় করাঘাত পড়ে। হুলস্থুল হয়ে ছুটে যায় আরিশা। দরজা খুলতেই আশ্চর্যচকিত সে! নিষ্প্রাণ দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু স্বাভাবিক সে। আরিশাকে দেখে মুচকি হেসে জিজ্ঞেস করল—
“কেমন আছো?”
আরিশা বৃহৎ ঢোক গিলে মিইয়ে গলায় বলল—
“ভালো।”
ঘরে প্রবেশ করে নিষ্প্রাণ। সবাইকে দেখল সে। কিন্তু প্রতিক্রিয়াহীন! আলফাজ সাহেব ক্ষোভিত দৃষ্টিতে তাকালেন। তিনি বুঝতে পারলেন এসব তার মেয়ে করেছে!
নিজের রাগকে সংবরণ করলেন তিনি। আয়েন্দ্রি ছলছল চোখে একবার তাকাল। নিষ্প্রাণের অধরে নির্মল হাসি। সকলকে উদ্দেশ্য করে বলল—
“আসসালামু আলাইকুম।”
নিষ্প্রাণের এই মোলায়েম স্বরেও অন্ত:করণে তান্ডব শুরু হলো রাশেদের। ঘামতে শুরু করল সে। নিঃশ্বাস নিতেও ভয় পাচ্ছেন তিনি!
রাশেদ কোনোভাবেই বুঝতে পারলেন না নিষ্প্রাণ এখানে কী করে চলে এলো! নিষ্প্রাণের ধরা ছোঁয়ার বাইরে থাকার জন্যই হুট করেই তারা আজ চলে এসেছে। ভয়ে গলা শুকিয়ে এসেছে রাশেদের। টেবিলের উপর রাখা পানিভর্তি গ্লাস নিয়েই ঢগঢগ করে গিলে ফেলে। অতি দ্রুততার সাথে কাজটি করায় রাশেদের মুখের দু’পাশ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়ল। চমকিত হলেন আলফাজ সাহেব। ভ্রু কুঞ্চন করে চেয়ে রইলেন। নিষ্প্রাণ অধরের কোন কিঞ্চিৎ চওড়া করল। আয়েন্দ্রি দুই হাত কচলাতে থাকে। ইচ্ছে করছে এখনই দৌঁড়ে গিয়ে ঝাপিয়ে পড়তে নিষ্প্রাণের বুকে!
নিষ্প্রাণ আরিশার সাথে ভেতর ঘরে গেল। আরিশা কাচুমাচু করে বলল—
“আপুর কোনো দোষ নেই। তারাই হঠাৎ করে চলে এলো!”
নিষ্প্রাণ নৈঃশব্দে মাথা ঝাঁকাল। স্নেহার্দ্র গলায় বলল—
“আমি এমনিতেই এসেছি। আপুকে বলো আমি প্রাবিশদের বাসায় আছি। সুযোগ পেলে আসতে। চলি।”
নিষ্প্রাণ দাঁড়াল না। যা সে জানতে এসেছে জানা হয়ে গেছে। নিষ্প্রাণ যখন বের হচ্ছে তাকে দেখে আরেক দফা চমকাল রাশেদ। হাতে থাকা ভাঁজ করা রুমালটা মুখে উপর চাপতে লাগল। নিষ্প্রাণ বাঁকা হাসে।
,
,
,
আয়েন্দ্রির বাবা জরুরি কাজে বাইরে গিয়েছেন। সময় ব্যয় করল না আয়েন্দ্রি। আরিশাকে নিয়ে প্রাবিশদের বাসায় চলে আসে। দরজা খুলেও নিষ্প্রাণ। হুড়মুড়িয়ে তার বুকের উপর পড়ে আয়েন্দ্রি। সীমান্ত সেখানেই ছিল। বিরক্তি নিয়ে বলল—
“দরজার সামনেই এমন জড়াজড়ি করতাছোস কেন? যা, ঘরে যা।”
নিষ্প্রাণ আলতো করে আয়েন্দ্রির হাত ধরে তাকে প্রাবিশের বোনের কক্ষে নিয়ে আসে। বিছানায় দুইজন পাশাপাশি বসে আছে। আয়েন্দ্রি নীরব, নিস্তব্ধ, নির্লিপ্ত।
বুক ফুলিয়ে শ্বাস নিল নিষ্প্রাণ। স্বাভাবিক গলায় বলল—
“শাড়িতে সত্যিই তোকে প্রাণহারিনী মনে হয়!”
থমকে থাকা আয়েন্দ্রির উপর যেন কোনো অপার্থিব আত্মা ভর করল! উপর্যুপরি কিল, ঘুষি বসাতে লাগল নিষ্প্রাণের বুকে। কিছুক্ষণ তা নীরবে সহ্য করলেও পরক্ষণেই আয়েন্দ্রিকে জড়িয়ে ধরে বুকের সাথে নিষ্প্রাণ। তার মাথাটা চেপে ধরে। আয়েন্দ্রি দুই হাতে আঁকড়ে ধরে নিষ্প্রাণকে। ঝুমঝুমিয়ে কাঁদছে সে। নিষ্প্রাণের অন্তঃরিন্দ্রিয়তে তখন অসহায়ত্ব দুলে চলে। চেষ্টা করেও এই মেয়েটাকে সে মারতে পারছে না। তাকে কষ্টে দেওয়ার অধিকার কারো নেই। এই মেয়েটারও নেই। তবুও সে কষ্ট পাচ্ছে। এই মেয়েটাকে নিজের করে পাওয়ার জন্য কষ্ট পাচ্ছে। পৈচাশিক হাসে নিষ্প্রাণ। এর থেকে পরিত্রাণের একটাই উপায়। “মৃত্যু!”
চলবে,,,
( বি.দ্র:
সারপ্রাইজ😏😏😏)