প্রাণস্পন্দন•পর্বঃ৩৭

0
1882

#প্রাণস্পন্দন
#পর্বঃ৩৭
লেখনীতেঃতাজরিয়ান খান তানভি

রেস্তোরাঁর ছাদে আধুনিকতার ছোঁয়ার বদলে ছনের চাল। চারপাশে ইট, পাথরের পরিবর্তে আছে বাঁশ আর কঞ্চি দিয়ে দাঁড় করানো বেড়া। চেয়ার, টেবিলগুলোও বেতের তৈরি। সন্ধ্যার সাঁঝবাতি জ্বলে উঠেছে অনেক আগেই। ধূসর আকাশ এখন নিকষ তমাসায় সমাহিত। ঘুটঘুটে তমসার চাদোঁয়া ভেদ করে উঁকি দিয়েছে চন্দ্র। তার আশেপাশের রূপালি আভার বলয়ে কেটে যায় অমারজনী। কুচি কুচি অসিত অভ্র অনুপল পরপর ঢেকে দিচ্ছে চাঁদকে। প্রভঞ্জনের গাঢ় মায়ায় বয়ে চলা অভ্র ওই চাঁদকে আড়াল করতে পারে না।

টেবিলের মাঝখানে একটা হ্যারিকেন জ্বালানো। ছনের ঘরটার চারকোনায় চারটা ম্রিয়মান হলুদ বাতি। যার ক্ষীণ আলোয় সবকিছু আবছা আবছা। হ্যারিকেনের টিমটিমে আলোতো আয়েন্দ্রির নিমগ্ন আননের চিন্তার ভাঁজ ধরা দিচ্ছে সামনে বসা সুদর্শন পুরুষটির চোখে। ছেলেটির লম্বাটে চেহেরায় মায়াময় ভাব। তীক্ষ্ম চোখ জোড়া। ছেলেটির দিকে বেশ সময় পর মুখ তুলে চাইল আয়েন্দ্রি। আহত গলায় বলল—

“প্লিজ, আপনি এই বিয়েটা ভেঙে দিন। বাবাকে গিয়ে বলুন আপনি বিয়ে করবেন না।”

রোমান বিগলিত হাসল। অনুচ্চ গলায় বলল—

“আপনার আরো আগে বলা উচিত ছিল এসব।”

আয়েন্দ্রি ভয় জড়িত গলায় বলল—

“দেখুন, সবকিছু এত দ্রুত ঘটে গেছে যে আমি সময়-ই পাইনি। প্লিজ, আপনি বাবাকে বলুন আপনি বিয়েটা করছেন না।”

“এতে আমার লাভ?”

ভ্রু কুঁচকায় আয়েন্দ্রি। আবেশিত গলায় বলল—

” আমি প্রাণকে ভালোবাসি। ও আমাকে ভালোবাসে। ও বাবার কাছে সময় চেয়েছিল। আপনি বিয়েটা ভেঙে দিলে ও আর কিছুদিন সময় পাবে বাবাকে বোঝাতে। প্লিজ রোমান।”

রোমান মুচকি হাসল। নম্র গলায় বলল—

“তাহলে বলুন তো কী বলে বিয়েটা ভাঙব আমি?”

আয়েন্দ্রির চোখ, মুখ মুহুর্তেই চকচক করে ওঠে। চটপটে গলায় বলল—

” আপনি বাবাকে বলবেন আমাকে আপনার পছন্দ নয়।”

গা দুলিয়ে হেসে ওঠে রোমান। আয়েন্দ্রি বিব্রত হয়। উসখুস চোখে চেয়ে বলল—

“হাসছেন কেন?”

রোমান জোরপূর্বক হাসি থামায়। মৃদু গলায় বলল—

“আপনাকে প্রথম দেখায় আমার পছন্দ হয়েছে। আমি নিজে আমার মামা, মামীকে দিয়ে বিয়ের প্রস্তা পাঠিয়েছি। প্রথম দেখাতেই আমাদের বিয়ের কথা ভেবে নিয়েছে। ইভেন আমি তো আমাদের বাচ্চাকাচ্চাদের নামও ঠিক করে ফেলেছি।”

আয়েন্দ্রি অবিশ্বাস্য চোখে চেয়ে আছে। বলে কী লোকটা!
প্রফুল্ল হাসল রোমান। ক্ষণপল পরেই বিষণ্ণ চোখে দুঃখী দুঃখী ভাব নিয়ে বলল—

“আচ্ছা। আমি কথা বলছি আপনার বাবার সাথে।”

আয়েন্দ্রি যেন আকাশের চাঁদ পেল হাতে! চেয়ার ছেড়ে উঠেই ঝুঁকে গিয়ে টেবিলে থাকা রোমানের হাত চেপে ধরল। উচ্ছ্বাসিত গলায় বলল—

“থ্যাংক ইউ, থ্যাংক ইউ। থ্যাংক ইউ সো মাচ।”

আয়েন্দ্রির পেলম, মসৃণ, তুলোর মতো হাতের স্পর্শে মৃদু কম্পন শুরু হয় রোমানের শক্ত পোক্ত দেহে। আয়েন্দ্রির দিকে ভালো করে তাকাতেই তার ক্লিভেজে চোখ আটকে রোমানের। পরক্ষণেই নিজেকে সামলে চেয়ারে বসে আয়েন্দ্রি। ঠান্ডা কফিতে চুমুক লাগায়। অধরে বদ্ধ হাসি। অন্তঃরিন্দ্রিতে তড়িৎ বেগে ছুটছে প্রেমের বহ্নিসখ।

কিন্তু রোমানের কামাতুর দুই চোখে আটকে গেছে আয়েন্দ্রির নিটোল উরজে।
,
,
,
থমথমে মুখ নিয়ে ভাসির্টি আমগাছটার নিচে বসে আছে নিষ্প্রাণ। অভিব্যক্তি শূন্য মুখটায় যেন চৈত্রের খরা। আয়েন্দ্রি নিষ্প্রাণের হাতটা বুকের সাথে জড়িয়ে ধরে তার হাতে মাথাটা শায়িত করে বসে আছে। ক্লান্ত গলায় বলল—

“এমন করছিস কেন? বল না কী হয়েছে?”

নিষ্প্রাণ নিশ্চেষ্ট গলায় বলল—

“কিছু না।”

আয়েন্দ্রি তবুও মানল না। কন্ঠে গাঢ়তা এনে বলল—

“প্লিজ বল না কী হয়েছে? কথা বলছিস না কেন তুই?”

নিষ্প্রাণ নিরুদ্বেগ চোখে তাকাল। আয়েন্দ্রির বিদুর মুখটা দেখে মায়া হলো। চকিতে ঠোঁটটা এগিয়ে নিল আয়েন্দ্রির ঠোঁটের কাছে। কিন্তু ছুঁল না। আজ আয়েন্দ্রি অবাক হয়নি। করেনি কোনো তীব্র প্রতিক্রিয়া। স্বাভাবিকভাবে চেয়ে আছে নিষ্প্রাণের নিষ্কম্প মুখটির দিকে। ঝট করে ঘাড় ফেরাল নিষ্প্রাণ। ভরাট গলায় রাগ মিশ্রণ করে বলল—

“কাল সন্ধ্যায় কোথায় গিয়েছিলি?”

শুকনো ঢোক গিলে আয়েন্দ্রি। এ নির্ঘাত আরিশার কাজ। ও নিশ্চয়ই নিষ্প্রাণকে জানিয়েছে। তবুও কথা কাটাতে কন্ঠ চাপা করে আয়েন্দ্রি বলল—

“কোকোথাও না তো।”

প্রকুপিত চোখে তাকিয়ে উঠে দাঁড়ায় নিষ্প্রাণ। পাশে রাখা ব্যাগটা হাতে নিয়েই হনহন করে চলতে থাকে। অসহায় গলায় ডেকে উঠে আয়েন্দ্রি—

“প্রাণ! প্রাণ!
আমার কথা শোন।”

নিষ্প্রাণ থমকে যায়। আয়েন্দ্রি দ্রুত পা চালায়। নিষ্প্রাণের সামনে গিয়ে কাঁদো কাঁদো গলায় নিরন্তর বলতে থাকে—

“আমি রোমানের সাথে দেখা করতে গিয়েছিলাম। সে বলেছে বিয়েটা ভেঙে দেবে। আমি তাকে সব বলেছি।”

খিঁচতি মেরে ওঠে নিষ্প্রাণের মস্তিষ্কের স্নায়ু। এই বিয়ে এমনিতেও হবে না। তার ব্যবস্থা সে করেছে।

নিষ্প্রাণ হট করেই হিংস্র দানবের মতো আয়েন্দ্রির দুই বাজু চেপে ধরে দাঁতে দাঁত নিষ্পেষণ করে বলল—

“আমি বলেছি তোকে যেতে? বল, আমি বলেছি তোকে? কথা বলছিস না কেন তুই?”

আয়েন্দ্রি কঁকিয়ে ওঠে। নিষ্প্রাণের প্রশ্বস্ত হাতের পাঞ্জার নিষ্করুণ চাপ সে নিতে পারল না। চোখ ভরে এলো তার। নিষ্প্রাণ ফোঁস করে দম ছাড়ল। রঞ্জিত চোখে চেয়ে সংক্ষুব্ধ গলায় বলল—

“তোকে আমার কাছ থেকে যে কেড়ে নিতে চাইবে আমি তার প্রাণ কেড়ে নেবো। তিনি তোর বাবা- ই হোক না কেন!”

আয়েন্দ্রি দাপিয়ে উঠে বলল—

“প্রাণ!

“না। নিষ্প্রাণ। নিষ্প্রাণ আমি। মনে রাখিস।”

আয়েন্দ্রির বুকের মাঝে তড়াক করে ওঠে। এই ছেলের এত রাগ! কখন কী করে বসে! ভয় হয় আয়েন্দ্রির! এই শান্ত মানুষগুলো যখন অশান্ত হয় তখন খুব ভয়ংকর হয়! খুব!

চলবে,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here