প্রাণস্পন্দন•পর্বঃ৪০

0
2325

#প্রাণস্পন্দন
#পর্বঃ৪০
লেখনীতেঃতাজরিয়ান খান তানভি

নৈঃশব্দে নির্ঝরিনী গড়িয়ে পড়ছে আয়েন্দ্রির পদ্মলোচন হতে। থেমে থেমে তার ফোয়ারা স্ফীত হতেই বুক কামড়ে ওঠে আয়েন্দ্রির। প্রভাতের মিষ্টি রোদ এসে থাই গলিয়ে উঁকি দিচ্ছে নিষ্প্রাণের অরঞ্জিত পিঠে। হেঁচকি তুলে কান্না অবদমন করার পূর্ণ প্রয়াসে ব্যস্ত আয়েন্দ্রি বিছানার চাদর খামচে ধরে নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরে। সমানতালে বুকের উঠানামায় হাঁপিয়ে ওঠে আয়েন্দ্রি। উচলে আসা স্রোতে তাকে যে ভেসে যেতেই হবে!

ভোরের আকাশে উঁকি দিয়েছে শান্ত সূর্য । গাঢ় অন্ধকারে আবেশিত বসুন্ধরা শান্ত, নরম সূর্যের আলোয় ক্রমশ প্রলীন করছে তার অমানিশি। পত্রীরা মেতে উঠেছে নতুন দিনে। সূর্যের ম্লাণ আলোয় সূর্যস্নানে ব্যস্ত পত্রপল্লব।

ক্লান্ত কায়াটা বিছানার সাথে লেপ্টে আছে নিষ্প্রাণের। বেঘোরে ঘুমাচ্ছে সে। তার পাশে রোদনে আচ্ছন্ন আয়েন্দ্রি বিন্দুমাত্র ব্যাঘাত ঘটাচ্ছে না তার ঘুমের। চট করেই চোখ, মুখ মুছে ফেলে আয়েন্দ্রি। অতি সন্তর্পণে বিছানা থেকে নেমে কক্ষের দরজার নব নিঃশব্দে ঘুরিয়ে বাইরে চলে আসে। হন্তিদন্তি করে সিঁড়িতে চঞ্চল পা ফেলে নিচে নেমে আসে। ঘরের দরজার কাছে গিয়ে অজ্ঞাত পাসকোড টিপে তা এন্ট্রি করায়। দুই বার এন্ট্রি করার পরও ইনকারেক্ট পাসওয়ার্ড লেখা দেকেই ডুকরে ওঠে আয়েন্দ্রি। তৃতীয়বার এন্ট্রি চাপ দেওয়ার আগেই ভরাট পুরুষালী কন্ঠে আয়েন্দ্রির ভয়ে অনুরণিত দেহ ঝাড়া মেরে ওঠে। পেছন ফিরতেই দেখল শান্ত পায়ে সিঁড়ি বেয়ে নেমে আসছে নিষ্প্রাণ।

উলুথলু চুল। তন্দ্রালু চোখ। ক্লান্ত শরীর। অলস অভিব্যক্তিতে আড়ষ্ট নিষ্প্রাণকে দেখে আয়েন্দ্রির প্রাণআত্মা পাখা ঝাপটানো শুরু করে। আয়েন্দ্রির সামনে এসে দাড়ায় নিষ্প্রাণ। বৃহৎ হামি দিয়ে ঘুমো ঘুমো গলায় বলল—

“সকাল, সকাল কী শুরু করেছিস বলতো! একটু শান্তিতে ঘুমাতেও দিবি না?”

নিষ্প্রাণ দরজার দিকে তাকাল। মগ্ন দৃষ্টি রেখে বলল—

“আরেকবার ভুল পাসওয়ার্ড দিলেই তো দরজাটা পুরোপুরি লক হয়ে যেতো। তখন কী হতো বলতো?”

আয়েন্দ্রি এতসময় ধুম ধরে থাকলেও সহসা গুমড়ে ওঠে। তার শাড়ির আঁচল কাধ থেকে ছড়িয়ে লুটিয়ে আছে মেঝেতে। খসখসে চুল এলোমেলো হয়ে আছে মুখমন্ডলে। ঠোঁট দুটো লাল হয়ে ফুলে আছে। নিষ্প্রাণের পাগলামি আর নিরবধি কান্না, দুটোর-ই স্বীকার আয়েন্দ্রির কোমল অধর। ভেজা গলদেশে চিকচিক করছে স্বচ্ছ জল। সিক্ত চোখের পল্লব উঠানামা করছে ধীরগতিতে। যেন বেগ বাড়লেই সব ধ্বংস হয়ে যাবে। প্রগাঢ় মায়া আর নির্নিমিখ চেয়ে আছে আয়েন্দ্রির ক্রন্দনরত মুখের পানে নিষ্প্রাণ। ট্রাউজারে দুই হাত পুরে রেখেছে। আয়েন্দ্রি চেয়ে আছে নিচের দিকে। তার অশ্রুসিক্ত পল্লব বেয়ে খসে পড়ছে পানি। হাত দিয়ে পায়ের কাছে শাড়ি খামচে ধরেছে। কান্নার কোনো শব্দ নেই। পলে পলে শুধু নাক টেনে যাচ্ছে আয়েন্দ্রি। আয়েন্দ্রিকে এভাবে দেখে কোথাও সুক্ষ্ম ব্যাথার ইঙ্গিত পাচ্ছে নিষ্প্রাণ!

ধীরেসুস্থে পা ফেলে আয়েন্দ্রির সামনে গিয়ে দাড়ায় সে। পকেট থেকে দুই হাত বের করে। আঁজলায় নিয়ে নেয় আয়েন্দ্রির ভেজা, স্যাঁতসেঁতে মুখটা। চোখের পাতা হতে শুষে নেয় নোনতা জল। কপোলের ভেজা আবরণে নিজের গাল ঘষে তা শুষ্ক করে। কপালে ছোঁয়ায় ঠোঁট। আয়েন্দ্রি নির্বিকার। একরাশ মুগ্ধতা আর অপরিমেয় ভালোবাসায় জড়িয়ে ধরে আয়েন্দ্রিকে। জমাট গলায় বলল—

“তুই কেন আমাকে মেনে নিতে পারছিস না?
তোর শরীর আমাকে মেনে নিয়েছে ধ্রুবতারা। তোর মন কেন আমাকে মেনে নিতে পারছে না?”

আয়েন্দ্রি ঠোঁট চেপে রাখে। দলিত কান্নার দরুন গলা ধাক্কিয়ে যাচ্ছে। তার হেতু বুক কেঁপে যাচ্ছে আয়েন্দ্রির। নিষ্প্রাণের বক্ষ:স্থলের পাটাতনে তা অনুভূত হচ্ছে। নিষ্প্রাণ জোড়ালো বন্ধনে আড়ষ্ট করল আয়েন্দ্রিকে। স্বীকারোক্তিমূলক কন্ঠে বলল—

“আমি কিন্তু সেদিন রোমানকে মারতে চাইনি। কিন্তু কী হয়ে গেল বলতো! তোকে ওই অবস্থায় দেখে আমার মাথা-ই কাজ করা বন্ধ করে দিলো। আর কিছুই ভাবতে পারলাম না আমি। ”

আয়েন্দ্রি ফুঁসলে ওঠে। নিষ্প্রাণকে জোরালো ধাক্কায় নিজের কাছ থেকে সরিয়ে গর্জন করে বলল—

“তাই বলে তুই ওকে খুন করবি? তাও এভাবে? তুই কী মানুষ? তুই একটা পশু! তুই একটা অসুস্থ জানোয়ার!”

নিষ্প্রাণ ঠোঁট কামড়ে মিষ্টি হাসে। চোখ জোড়া প্রশস্ত করে বলল—

“ওয়েল। যদি তোর তাই মনে হয় তাহলে তাই। তবে আমার ধ্রুবতারার দিকে যে তাকাবে তাকে আমি…।”

আয়েন্দ্রির দিকে অদ্ভুত দৃষ্টি নিপাত করল নিষ্প্রাণ। আঁতকে ওঠা চোখে চাইল আয়েন্দ্রি। ভয়ে থিতিয়ে গেল সে। নিষ্প্রাণ খুশ মেজাজে তার অধর বলয় করে সিটি বাজাতে থাকে। আয়েন্দ্রি কান চেপে ধরে। তার মনে হলো কেউ তার মাথার মগজে এসিড ঢেলে দিয়েছে। গলে মিশে যাচ্ছে তা। শরীরে ঢুকিয়েছে হাজার সূঁচ। মৃত্যুসম যন্ত্রণা হচ্ছে তার। যন্ত্রণা!
,
,
,
দুই দিনে অনেকটা সজীব হয়েছে আয়েন্দ্রি। তাদের মধ্যে প্রয়োজন ছাড়া কথা হয় না। আয়েন্দ্রি এখন ভয় পায়। সত্যিই নিষ্প্রাণ নামের মানুষটাকে সে ভয় পায়!

নিষ্প্রাণের আপাতত কোনো কাজ নেই। সারাক্ষণ পাখির ছানার মতো আয়েন্দ্রির আশেপাশে তার বিচরণ। আয়েন্দ্রিকে খুটিয়ে খুটিয়ে দেখা। তার কাজের ব্যাঘাত ঘটিয়ে নিজের অভিলাষ পূরণ করা। হুটহাট চুমু খেয়ে নেওয়া। আয়েন্দ্রি বাঁধা দেয় না। তার শরীর মেনে নিয়েছে এই প্রাণহীন মানুষকে। কিন্তু অন্ত:করণে যেখানে এই পুরুষের জন্য ভালোবাসার ছোট্ট ঘর বানিয়েছিল তা ধ্বংসপ্রাপ্ত। সেখানে আর কোনো ভালোবাসার ঘর উঠবে না।

কাঁচা হলুদ রঙের শাড়িতে মৃদু সমীরণে দোল খাওয়া সর্ষে ফুল মনে হচ্ছে আয়েন্দ্রিকে। কলাপাতা রঙের ব্লাউজের মাঝে দৃশ্যত তার পিঠ। কাউকে বসে ঐকান্তিক দৃষ্টিতে বুঁদ হয়ে চেয়ে আছে আয়েন্দ্রির অনাবৃত পিঠে, তার সংলগ্ন উদরে। রান্নাঘর থেকে খাবার এনে টেবিলে রাখছে আয়েন্দ্রি। তার খোলা চুলগুলো ছড়িয়ে ছিটিয়ে বিরক্ত করছে তাকে।
নিষ্প্রাণের অপলক দৃষ্টি আয়েন্দ্রির খোলা, অবাধ্য চুলে। তার ধ্রুবতারাকে সে ছাড়া অন্য কেউ বিব্রত করতে পারে না!

বিনা শব্দ করে কাউচ থেকে উঠে আসে নিষ্প্রাণ। আয়েন্দ্রির অগোচরেই তার পেছনে এসে দাড়ায়। কাজে ব্যস্ত আয়েন্দ্রি চকিতে ধাক্কা খেয়ে থমকে যায়। সমাচ্ছন্ন চাহনি নিষ্প্রাণের। আলতো করে আয়েন্দ্রির চুলগুলো তার কানের পেছনে গুঁজে দেয় নিষ্প্রাণ। প্রশ্ন করে—

“এত তাড়াহুড়ো করছিস কেন? বস। আমি খাইয়ে দিচ্ছি তোকে।”

নিষ্প্রাণের কথার পিঠে কোনো কথা বলল না আয়েন্দ্রি। যেন সে কোনো মোমের পুতুল। নিষ্প্রাণ যখন ইচ্ছে নিজের উত্তাপে তাকে গলিয়ে দেবে, আবার ইচ্ছে হলেই যে কোনো আকারে রূপ দিয়ে তৈরি করে নেবে!

চেয়ারটাকে নিজের সামনে এনে আয়েন্দ্রিকে বসায় নিষ্প্রাণ। ছোট ছোট লোকমা মুখে পুরে দিতেই তা গিলে নেয় আয়েন্দ্রি। কুন্ঠিত গলায় প্রশ্ন করে আয়েন্দ্রি—

“কেন করছিস আমার সাথে এমন? তুই যা চেয়েছিস তা তো তুই পেয়েছিস। এবার আমাকে যেতে দে প্রাণ। আমি তো তোর কোনো ক্ষতি করিনি।”

নিষ্প্রাণ বিস্তৃত করল ওষ্ঠাধর। বিগলিত গলায় বলল—

“কী চেয়েছি আমি তোর কাছে?তোর সাথে বিছানা বিলাস করতে? যদি তাই হতো তাহলে প্রথম দিন-ই আমি তা করতে পারতাম। এর পরেও অনেক সুযোগ ছিল। প্রাবিশের বার্থডের কথা মনে আছে?”

ঝমঝমিয়ে কাঁদতে থাকে আয়েন্দ্রি। তার কান্নার মাঝেই নিষ্প্রাণ ভাতের লোকমা ঠুসে দেয় তার মুখে। গলায় আটকে যায় তা। কেঁশে ওঠে আয়েন্দ্রি। পানির গ্লাস নিতেই তা ছোঁ মেরে নিয়ে নেয় নিষ্প্রাণ। আয়েন্দ্রির শ্বাস আটকে আসে। চোখের পাল্লা প্রশস্ত করে। জল জমে আসে চোখে। যেন মৃত্যু তাকে হাতছানি দিচ্ছে। ছটফটানি শুরু হয় আয়েন্দ্রির। নিষ্প্রাণ ভাবান্তরহীন। কিছু সময় পর আয়েন্দ্রির মুখের সামনে পানি ধরতেই উদ্ভ্রান্তের তা কেড়ে নিয়ে গিলতে থাকে আয়েন্দ্রি। বক্র হাসে নিষ্প্রাণ। সরব গলায় বলল—

“তোকে ছাড়া আমার এমনটাই লাগে। এখন বুঝলি তো কী চাই আমি তোর কাছে!”

আয়েন্দ্রি নির্বাক দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে নিষ্প্রাণের সতেজ দুই চোখে।

চলবে,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here