প্রাণস্পন্দন•পর্বঃ৪২

0
2065

#প্রাণস্পন্দন
#পর্বঃ৪২
লেখনীতেঃতাজরিয়ান খান তানভি

প্রভাতের রৌশনাই জ্বলে উঠেছে ঘণ্টা খানেক আগেই। তমসাচ্ছন্ন অম্বুর বিদীর্ণ করে গলিত সোনার ফলকের ন্যায় উদিত হয়েছে প্রভাকর। পত্রীরা ছুটে চলছে নামহীন গন্তব্যে। তাদের কিচিরমিচিরে শান্ত, নিশ্চল ধরণী কেঁপে কেঁপে ওঠে ক্ষণে ক্ষণে। ধরণীর বুক জুড়ে বহতা সুমিষ্ট প্রভঞ্জনে মেতে ওঠে নবপল্লব।

একটা সুবিশাল পুরোনো লোহার গেইটের সামনে এসে থামে রোদে চকচক করা ব্ল্যাক মার্সেডিজ। সেখান থেকে বেরিয়ে আসে দীর্ঘকায় এক পুরুষ। গাড়ি থেকে নেমেই পড়ন্ত শ্বাসে সৃষ্ট করল শব্দ। তীক্ষ্ম নেত্র দিয়ে চেয়ে দেখল অদূরে অবস্থিত অট্টালিকাটি। গাঢ় হাসিতে তার অধর ভরাল। অপর পাশে দরজা খুলে নেমে এলো লাস্যময়ী এক কামিনী। তার পরনের জলপাই রঙা শাড়িটি দমকা বায়ুতে উড়ে গিয়ে তার চোখের দর্পণ আটকাল। নারীদেহটি আলতো হাতে সেই শাড়ির আঁচল নামিয়ে আনে মুখের উপর থেকে। ঠাসা ঠাসা চোখ মেলে অট্টালিকাটি দেখে। সে উৎসুক হয়, হয় আগ্রহী। তার লোচনে যোগ হয় সন্দেহের বাতিক।

লোহার গেইটটির সামনে গিয়ে দাড়ায় নিষ্প্রাণ। হাতের মোবাইলে চোখ বুলিয়ে সংগোপনে বাঁকায় অধর। মোবাইলে কল লিস্টে গিয়ে নির্দিষ্ট নম্বরে কল করে লাইন কেটে দেয় নিষ্প্রাণ। আয়েন্দ্রি ছোটো ছোটো পায়ে এগিয়ে এসে নিষ্প্রাণের পাশে দাড়াল। নিষ্প্রাণ সহাস্য অধরে আয়েন্দ্রিকে বুকের একপাশে চেপে ধরে। তার কপালে শুষ্ক অধরের স্পর্শ এঁকে বলল—

“একটু দাড়া। ভেতর থেকে লোক আসবে।”

চোখের ইশারায় প্রত্যুক্তি করে আয়েন্দ্রি। সাবলীল দৃষ্টিতে আগ্রহী হয়ে আছে সে। ক্ষণকাল বাদেই সুবিশাল লোহার গেইটি ক্যাচক্যাচ শব্দ করে খুলতে থাকে। পুরোনো গেইটে নতুনের আবরণ। যেন নতুন জীবন তার!

গেইট খুলেই অর্ধ বয়সি এক ব্যক্তি বের হয়ে এলেন। মাথায় স্বল্প চুলে পাক ধরেছে। শীর্ণ হাসিতে রাঙিয়ে নেয় ঠোঁট। ফিকে রঙের হাঁটু অব্দি পাঞ্জাবি। পরনে সাদা আর নীলের মিশেলে লুঙ্গি। গলার উপর চড়ে আছে ছোট্ট গামচা। অমায়িক সম্ভাষণে তিনি বললেন—

“আইছেন ছোডো সাহেব! সেই সক্কাল থেইকা আফনার লাইগা বারান্দায় বইয়া রইছি। আহেন, আহেন।”

নিষ্প্রাণ মোলায়েম গলায় বলল—

“আপনি একা কেন চাচা? ”

পানের রস ঠোঁটের ফাঁক গলিয়ে বের হওয়ার আগেই মুছে নিল তা তালাব। সংকোচিত গলায় বললেন—

“হিকমত ভাইয়ের শরীলডা ভালা নাই। কাইল রাইতে জর আইছে। খ্যাতা মুড়া দিয়া শুইয়া আছে ঘরে।”

তাদের কথা বলা ফাঁকেই নজরুল এসে দাঁড়াল। লম্বা ছেলেটি ছিমছাম গড়নের। এসেই সালাম হাঁকাল।

“সালাম ছোডো সাহেব। আইতে দেরি অইয়া গেল। কই, মাল পত্তর কই? আমি নিয়া যাই।”

নিষ্প্রাণ তার ট্রলি ব্যাগটা নিজের হাতেই ধরে আছে। ছোট্ট করে আপত্তি করে বলল, দরকার নেই। তার কাজ সে নিজেই করতে পারবে।
এতক্ষণে নিষ্প্রাণের পাশের মানুষটির দিকে নজর পড়ে নজরুল আর তালাবের। পানের পিকটা পিচ করে ফেলেই প্রসন্ন হাসল তিনি। হাতটা কপালে ঠেকিয়ে বললেন—

“সালাম নয়া মা। ক্ষেমা কইরা দেন, আফনারে খেয়াল করতে পারি নাই।”

নজরুল আঠারো বছরের সদ্য যুবা। বয়স্ক হেকমতের একমাত্র ছেলে। বাবা অসুস্থ তাই ছেলেকে ডাকা হয়েছে নিষ্প্রাণকে এগিয়ে নেওয়ার জন্য। হেকমত এখানেই থাকে তালাবের সাথে। নজরুল তার নিজ বাড়িতে মায়ের সাথে থাকে। জরুরি দরকারে বাড়ি গিয়ে দিনে দিনে ফিরে আসে হেকমত।

গেইট থেকে প্রায় তিন মিনিটের রাস্তা অতিক্রম করে নিষ্প্রাণদের বাড়ির অন্দরমহলে ঢুকতে হয়। সরু সিমেন্ট, বালুর পথের দুই পাশে লাগানো বড়ো বড়ো ঘাসে ফুটে আছে লাল, সাদা আর গোলাপী রঙের মিনি সাইজের ফুল। আয়েন্দ্রি খুশি দৃষ্টিতে তা দেখছে। বাড়ির একদম সামনে আসতেই অবাক চোখে চেয়ে থাকে আয়েন্দ্রি। সাদা রঙের দালানটির বাইরের দিকে আলপনা অংকিত। কপাল পেছনের দিকে ঝুঁকিয়ে উপরের দিকে তাকায় আয়েন্দ্রি। ছাদের দুই পাশে দুইটা গম্বুজের মতো। যার ভেতরটা ফাঁকা। সেখানে যাওয়ার জন্য হয়তো দালানের ভেতরে কোনো সিঁড়িও আছে। দালানটিকে একদম নতুন মনে হচ্ছে। হওয়ার-ই কথা। কয়েক বছর পর পর -ই বাড়িটি সংস্কার করা হয়। কিন্তু আয়েন্দ্রি বিস্মিত হয়, দালানটি থেকে একটু দূরে অবস্থিত ছোট্ট দালানটি দেখে। সেটি জীর্ণশীর্ণ। পলেস্তার খসে খসে পড়ছে। বৃষ্টি-বাদলে গায়ে পরা শ্যাওলা কালো বর্ণ ধারণ করেছে। একাংশ প্রায় ভেঙে পড়েছে। আরেক পাশ আপাতত ভালো থাকলেও হতপ্রায়। আয়েন্দ্রির হাত ধরে রাখা নিষ্প্রাণের হাতে। তাতে টান পড়তেই নিষ্প্রাণ চোখ রাখে আয়েন্দ্রির আতঙ্কিত মুখে। মুহূর্তেই চোখে হেসে বলল—

“বাড়ির ভেতরে চল। দাদু তোর জন্য অপেক্ষা করছে।”

আয়েন্দ্রি নিঃশব্দে মাথা ঝাঁকায়। বাড়ির ভেতরে পা রাখতেই আরেক দফা ধাক্কা খায় আয়েন্দ্রি। বিস্তৃত হলঘর। যার অর্ধ সীমানা থেকে বক্রাকৃতির সিঁড়ি উঠে গেছে দোতলায়। সিঁড়ির পেছনের দিকে নিচতলায় কয়েকটা কক্ষ। হলরুমের একপাশে বিশাল ডাইনিং টেবিল। প্রায় দশের অধিক মানুষ একসাথে বসে খাবার গ্রহন করা যাবে। অপরপাশের দেয়ালে সমান্তরাল প্রায় পাঁচটা জানালা সাত ফুট পরপর। তাতে সফেদ রঙের পর্দা ঝুলানো। হুরহুর করে প্রভঞ্জনের দমকে ঢুকছে মৃদু, শীতল প্রভঞ্জনের সাথে হলদে নরম রোদ। তাতে প্রতিচ্ছায়া তৈরি হচ্ছে ধূসর রঙা মেঝেতে। আয়েন্দ্রি একটা জানালার সামনে এসে দাঁড়ায়। পুরোদস্তুর শীর্ণ দালানটাকে এখান থেকে অবলোকন করছে আয়েন্দ্রি। তার কাঁধে হাত রাখে নিষ্প্রাণ। হৃষ্ট গলায় বলল—

“উপরে চল।”

আয়েন্দ্রির ঐৎসুক্য চাহনি আর সন্ধিগ্ধ মন বারংবার ওই অব্যবহৃত, অপরিচ্ছন্ন, অসাঢ়, ভূতগ্রস্তের মতো দাঁড়িয়ে থাকা দালানটাকে টানছে।

সিঁড়ি বেয়ে উঠছে দুই জন। আয়েন্দ্রি অত্যন্ত আগ্রহের সাথে দেখছে সব। এতবড়ো বাড়ি, এত সম্পদ! তবুও নিষ্প্রাণ নিজেকে অনাথ কেন বলেছিল!

একটা কক্ষের সামনে স্থির হয় নিষ্প্রাণ আর আয়েন্দ্রি। তালাব আর নজরুল নিচেই রইল। তারা উপরে আসেনি। আয়ন্দ্রির হাতটা ধরে কক্ষের ভেতর প্রবেশ করে নিষ্প্রাণ। ঝুলন্ত পর্দার ব্যবচ্ছেদ ঘটিয়ে যখন ভেতরে ঢুকে আয়েন্দ্রি চকিত হয় সে। একটা হুইল চেয়ারে বসে আছেন একজন বৃদ্ধ। মাত্রাতিরিক্ত ফর্সা যাকে বলে! তার ভ্রুযুগলও শুভ্রতায় আচ্ছন্ন। মাথার সফেদ কেশে অবতার মনে হচ্ছে তাকে। আকাশ রঙা পাঞ্জাবি পরেছে সে। অদ্ভুতভাবে ঘাড়টা হেলানো বাম কাঁধে।

রাজন শিকদার চশমার কাচ গলিয়ে চাইলেন। আয়েন্দ্রির নিষ্প্রভ, ম্লান, প্রাণহীন মুখটা দেখে চঞ্চলতা দেখা দিলো তার মূর্তিমান চোখে। আয়েন্দ্রি ধীরগতিতে রাজন শিকদারের কাছে এলো। ঝুঁকে বসল সে। রাজন শিকদারের পদযুগল স্পর্শ করে কদমবুছি করল। কিছু না পেয়ে অস্বস্তি নিয়ে তার পায়ের কাছে মেঝেতে বসল। শান্ত গলায় বলল—

“কেমন আছেন দাদু?”

জলপুকুর ছাড়লেন রাজন শিকদার। দরদর করে তার চোখ হতে জল গড়িয়ে পড়ল। আয়েন্দ্রি উদ্বেলিত গলায় বলল—

“দাদু, কাঁদছেন কেন?”

রাজন শিকদারের মুখটা বাঁকানো। স্পাইনাল কর্ড ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় তিনি আর কখনো সোজা হতে পারবেন না। কোমরের নিজ থেকে অসাঢ় তিনি। আকস্মিক অ্যাটাকে তার কথা বলা অনেকটা কষ্টকর! অস্পষ্ট বুলিতে তিনি কিছু আওড়ালেন। কাঁপা কাঁপা হাতটা একটু উঁচু করতেই তা নিজের মাথার উপর রাখল আয়েন্দ্রি। রাজন শিকদারের হাতটা নিজের মাথায় নিয়ে মুখ তুলে তাকাল আয়েন্দ্রি। সরস হাসল সে। বুক ভরে আসলো রাজন শিকদারের। আয়েন্দ্রি নির্বিকার গলায় বলল—

“আপনি শান্ত দাদু।”

সময়ের ফাঁক সরিয়ে আয়েন্দ্রির পাশে এসে দুই হাঁটু মেঝেতে ঠেসে বসে নিষ্প্রাণ। দুঃখী গলায় বলল—

‘দাদু ইজ প্যারালাইজ। এখন এই হুইল চেয়ার-ই তাঁর ভরসা।”

আয়েন্দ্রি চট করেই প্রশ্ন করল—

“এসব কী করে হলো?”

নিষ্প্রাণ নিরুত্তাপ গলায় বলল—

“সিঁড়ি থেকে পড়ে গিয়েছে দাদু।”

চোখে জ্বলে উঠল উজ্জ্বলতা রাজন শিকদারের। ত্রসনে আচ্ছন্ন সে। নিষ্প্রাণের দিকে চোখের মনি ঘুরিয়ে বিধ্বস্ত নজরে চাইলেন তিনি। অনুভূতিশূন্য নিষ্প্রাণের ধারাল চাহনিতে কেঁপে উঠল রাজন শিকদার। তার পেছনে হুইল চেয়ারের হ্যান্ডেল ধরে দাঁড়িয়ে আছে রাজন শিকদারের প্রিয় ভৃত্য হাসমুল।

চলবে,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here