#প্রাণস্পন্দন
#পর্বঃ৫৩
লেখনীতেঃতাজরিয়ান খান তানভি
ড্রেসিং টেবিলের পাশে একটা ছোট্ট ড্রয়ার। যার তিনটা তাক। তার ভেতরেই কিছু একটা খুঁজছে নিষ্প্রাণ। অলস ভঙ্গিতে বিছানায় বসে আছে আয়েন্দ্রি। নিষ্প্রাণ পরম যত্নে তার চুলে পনিটেল করে দিয়েছে। আয়েন্দ্রির কপালের সেলাইয়ের দাগ জ্বলজ্বল করে ধরা দিচ্ছে চোখে। গোল গোল চোখে চেয়ে প্রশ্ন করে আয়েন্দ্রি—
“আমরা ঢাকা কবে যাব?”
সুক্ষ্ম চোখে তাকায় নিষ্প্রাণ। একটা ছোট্ট হাসি উপহার দিয়ে বলল—
“তুই একটু সুস্থ হলেই।”
গাঢ় শ্বাস ফেলে আয়েন্দ্রি। কৌতূহলী গলায় ফের প্রশ্ন করে—
“কী খুঁজছিস?”
“একটা জিনিস। তোকে দেখাব। এখানে কোথাও ছিল। তুই দাঁড়া আমি খুঁজে দেখছি।”
আয়েন্দ্রি নীরব হয়। তার হাত চলে যায় উদরে। এখানেও একটা ছোট্ট প্রাণ আছে। ওই প্রাণহীন মানুষটার অংশ সে। একজন নারীর পূর্ণতা আসে তার সন্তান যখন তাকে মা বলে ডাকে। একটা ছোট্ট প্রাণ যখন কোনো নারী নিজ গর্ভে ধারণ করে তখন সে হয় পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ যোদ্ধা। যে দশমাস লড়াই করে নিজের সন্তানকে বসুমতির আলো দেখায়। মা হওয়ার খুশি এক সুপ্ত অনুভূতি। তা বলে বলে বোঝানো যায় না, যায় না কাউকে দেখানো। শুধু হৃদয়ের অন্তস্তলে খুব গোপনে তাকে লালন করা যায়, ভালোবাসা যায়, প্রেমে পড়া যায়। আয়েন্দ্রির আজ সেই অনুভূতি হওয়ার কথা। কিন্তু তার কোনো অনুভূতিই নেই। যেন সমস্ত অবারিত, অনাবৃত প্রেমাচ্ছন্ন অনুভূতিগুলো ভোঁতা হয়ে গিয়েছে।
নিষ্প্রাণ খুটখুট করে খুঁজে চলছে কিছু একটা। আয়েন্দ্রির মনে আচমকা এক অদ্ভুত প্রশ্ন জাগ্রত হলো। তার ইচ্ছে হলো সেই প্রশ্নের উত্তর জানতে। নিষ্প্রাণ তাকে মারবে না। আর ছাড়বেও না। এইটা আয়েন্দ্রি উপলব্ধি করে ফেলেছে। তাই ভনিতা না করেই নিজের মনের অদ্ভুত প্রশ্নটা সে করেই ফেলল।
“প্রাণ!”
নিষ্প্রাণ অস্পষ্ট জবাব দেয়।
“হুম।”
“তুই এই পর্যন্ত কতজনকে মেরেছিস?”
নিষ্প্রাণের হাত লাগে যা এতক্ষণ ধরে সে খুঁজে যাচ্ছিল। স্বমহিমায় উঠে দাঁড়িয়ে আয়েন্দ্রির দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসল। হাতের ছবিটার দিকে তাকিয়ে স্বাভাবিক গলায় বলল—
“ওয়ান নাইন। মানে নাইনটিন।”
আয়েন্দ্রির মনে হলো কেউ তার কলিজার উপর শত টনের পাথর চেপে দিয়েছে এবং তা ততক্ষণ পর্যন্ত সরবে না যতক্ষণ পর্যন্ত তার মৃত্যু না ঘটে।
নিষ্প্রাণ বিড়ালপায়ে আয়েন্দ্রির সামনে এসে বসে। ঠোঁটভর্তি হেসে বলল—
“ভয় পেয়েছিস? এখন আর কাউকে মারব না। চিন্তা করিস না।”
নিষ্প্রাণের সাবলীল কথায় আয়েন্দ্রির গলায় যেন ভারী কিছু আটকে গেল। সে শ্বাস নিতে পারছে না। নিষ্প্রাণ সহাস্য অধরে বলল—
“এর মধ্যে দুজন আমার খুব ভালো বন্ধু ছিল। যখন ইংল্যান্ডে ছিলাম তখন। তুই ই বল, রেগিং করতে হলে কাউকে মলেস্ট কেন করতে হবে?
মাথাটা খারাপ হয়ে গিয়েছিল আমার। নিজের হাতে মারিনি। একদিন ল্যাবে কাজ করছিলাম তখন কেমিকেলের ব্লাস্ট করিয়েছি। ব্যস! আর কি! আমার তেমন কিছু হয়নি। শুধু এই গলার কাছে একটা গরম কি এসে যেন গেঁথে গিয়েছিল। দেখ, এখনো দাগ আছে।”
আয়েন্দ্রি তার কথা বলার ভাষা হারিয়ে ফেলেছে। নিষ্প্রাণ এমনভাবে তার ক্রিমিনাল কনসপেরিসি ডিসক্রাইভ করছে যেন দুধ দিয়ে ভাত খাচ্ছে সে। যার অতিরিক্ত মিষ্টি তার বিরক্ত লাগছে। আয়েন্দ্রি তবুও শান্ত রইল। তার কাছে এসব পরিচিত মনে হচ্ছে। নিষ্প্রাণ ছবিটির দিকে তাকিয়ে হাসছে। তার মধ্যে কোনো অনুশোচনাই নেই। এ কেমন মানুষ! অনুভূতিশূন্য মানুষ কী আসলেই মানুষ
আয়েন্দ্রির ভাবনার ব্যাঘাত ঘটায় নিষ্প্রাণ। তার নরম অধরে গাঢ় ঘষা দেয় সে। আয়েন্দ্রি প্রতিক্রিয়াহীন। নিষ্প্রাণের সবচেয়ে বেশি আকর্ষণ আয়েন্দ্রির ওষ্ঠাধরে। তার সমস্ত অঙ্গ-প্রতঙ্গের মধ্যে এই ঠোঁটের উপরই কড়া শাষণ চালায় নিষ্প্রাণ। নিষ্প্রাণ আলতো করে ছোট্ট কামড় বসায় আয়েন্দ্রির নিচের ঠোঁটে। রক্ত লেগে যায় নিষ্প্রাণের স্বঅধরে। আয়েন্দ্রির অধরের রঞ্জিত মুছে নেয় নিষ্প্রাণ। ঘোরের চোখে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে ছবিটা ফট করে আয়েন্দ্রির সামনে ধরে। আয়েন্দ্রি নরম হাতে ছবিটা নেয়। রঙিন ছবিটাতে একটা মেয়ে। মেয়েটাকে পরী বললে ভুল হবে না। মেয়ে মানুষ এত সুন্দর কী করে হয়! আয়েন্দ্রি চিনতে পারল না তাকে।
“কে ও?”
আয়েন্দ্রির করা শীতল গলার প্রশ্নে নিগূঢ় হাসে নিষ্প্রাণ। প্রফুল্ল গলায় বলল—
“ভালো করে দেখে বলতো চিনিস কি না?”
আয়েন্দ্রি ছবিটাকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে। হঠাৎ তার নজরে পড়ে মেয়েটির ঠোঁট। শুধু মুখের ছবি হওয়াতে নয়নতারা ঠোঁটের তিল ধরা দিল আয়েন্দ্রির চোখে। অবিশ্বাস্য গলায় বলে উঠে সে—
“তারা!”
“আমার তারা। নয়নতারা।”
ভরাট চাহনিতে নিষ্প্রাণকে দেখে আয়েন্দ্রি। আমার তারা বলতেই নিষ্প্রাণের স্বাভাবিক আননে এক চমৎকার দীপ্ততা খেলে গেল। যেন হীরক খন্ড পেয়েছে সে। ছবিটার দিকে তাকাতেই চোখ ভর্তি জল নেমে আসে আয়েন্দ্রির। সে তারার মতো সুন্দর নয়, বরঞ্চ তারার সাথে তাকে দাঁড় করানোর কোনো যুক্তিকতাও নেই। দুধসাদা গায়ের রঙ, পদ্মলোচন আঁখি। চোখের তারায় যেন আবেগের ঢল! পল্লবে পল্লবে ঢেউ খেলানো তীর। ঠোঁটে নেমেছে বসন্ত! হাজারো প্রজাপ্রতি উড়ছে তার মধু আহরণে। নিষ্প্রাণ সহজ, সাবলীল গলায় ভালোবাসার চাঁদোয়া ভিজিয়ে রেখে বলল—
“আমার তারা আমার জীবনের দেখা সবচেয়ে সুন্দর নারী। আমার মাও এত সুন্দর ছিল না। ছিল কারো কালো থাবার ভোগ। কিন্তু তারা! ও সদ্য ফোঁটা এক লাল পদ্ম। অগাধ জলরাশিতে যার বিচরণ। স্রোতে স্রোতো যার মহিমা। পরতে পরতে যার অভিরাম। জগৎ মোহনীয় রূপের রাণি। ”
নয়নতারার কথা বলতে বলতে এক অন্য জগতে হারিয়ে গেল নিষ্প্রাণ আয়েন্দ্রির মনে হলো নিষ্প্রাণ যেন তার সামনে থাকা কোনো নৈসর্গিক প্রতিমার সৌন্দর্যের বর্ণনা দিচ্ছে। আয়েন্দ্রি নিজেও যেন সেই প্রতিমাকে দেখতে পাচ্ছে। সব জীবন্ত মনে হচ্ছে তার।
নিষ্প্রাণ আচমকা নিভে গেল। দমে গেল তার কণ্ঠস্বর। প্রশ্বস্ত হলো চোখের আয়তন। ক্ষিপ্ত হলো চাহনি। শক্ত হলো চোয়াল। ফুঁসে উঠে বলল—
“কিন্তু সব শেষ করে দিলো। সব।”
আয়েন্দ্রি বদ্ধশ্বাস ফেলল। এক অতলস্পর্শী সাগরে ডুবন্ত কেউ যখন পানির উপরে মাথা তুলে শ্বাস নেয়, আয়েন্দ্রির অবস্থা ঠিক তেমন হলো। সে মুক্ত শ্বাস নিয়ে বলল—
“শুধু এই কারণে তুই আমাকে বিয়ে করেছিস?”
নিষ্প্রাণের মসৃণ কপালে বিরক্তির ভাঁজ পড়ে। নাকের ডগায় বিতৃষ্ণা ঝুলিয়ে বলল—
“কী বলছিস তুই?”
আয়েন্দ্রি রোদনে আচ্ছন্ন হয়ে বলল—
“তুই আমাকে ভালোবাসিস না। শুধু নয়নতারার এই চিহ্নকে আগলে রাখতে আমাকে নিয়ে তোর এত পাগলামি? এই জন্যই এত আকর্ষণ আমার ঠোঁটে?”
“কী পাগলের মতো কথা বলছিস তুই?”
“ঠিকই বলছি আমি। তুই তাহলে আমাকে ভালোবাসিসনি। আমার মাঝে তারাকে খুঁজেছিস। কেন করলি এমন? কেন?”
নিষ্প্রাণ দুই হাত আয়েন্দ্রির মাথার দুই পাশে শক্ত করে ধরে তার কপালের সাথে কপাল ঠেকিয়ে জমাট গলায় বলল—
“আমি তোকে ভালোবাসি ধ্রুবতারা। হাজারো মেয়ের মধ্যে আমার তারা তোকে আমার জন্য সিলেক্ট করেছে। কারণ, তুই স্পেশাল তাই।”
আয়েন্দ্রি হাত সরিয়ে ফেলে। ধরা গলায় কান্না গিলে নিয়ে রাগের স্ফুলিঙ্গ ছড়িয়ে বলল—
“না। মিথ্যে বলছিস। আমাকে তুই কখনো ভালোই বাসিসনি। আমার এই একটা অঙ্গই ছিল তোর এডিকশন, তোর অবশেশন। কারণ তুই তারাকে চেয়েছিস। আমাকে নয়।”
নিষ্প্রাণ অসহিষ্ণু গলায় চড়াও হয়ে বলল—
” আবোলতাবোল কথা বলবি না। তারা শুধুই তারা। আর তুই আমার সব। আমার ধ্রুবতারা। আমার সত্য। আমার স্থায়িত্ব।”
উঠে দাঁড়ায় নিষ্প্রাণ। মাথাভর্তি সুপ্ত রাগ নিয়ে বেরিয়ে আসে কক্ষ থেকে। হাতের ছবিটা ছুড়ে ফেলে আয়েন্দ্রি। আর সম্ভব নয় তার পক্ষে। আর ভালোবাসতে পারবে না এই মানুষটাকে সে। যে তাকে অন্য কেউ কল্পনা করে আজ পর্যন্ত ঠকিয়ে এসেছে। একজন মৃত মানুষকে খুঁজে চলছে নিষ্প্রাণ। আয়েন্দ্রির দেয়ালে মাথা ঠুঁকতে ইচ্ছে করছে। নিষ্প্রাণ এত পাগলামি করেছে, এতবার কনফেস করেছে, এত কমপ্লিমেন্ট করেছে তার ঠোঁটের, সে ভাবতে পারেনি এসবই তার জীবনের সবচেয়ে বড়ো কাল হয়ে দাঁড়াবে।
,
,
,
কাউচে শান্ত হয়ে বসে আছে নিষ্প্রাণ। নিষ্পেষিত হচ্ছে তার মস্তিষ্কের নিউরণ। কনকন করছে চোখের কোণ। মুদিত চোখেও সেই যন্ত্রণা অনুভূত হচ্ছে তার। অতর্কিতে একটা উষ্ণ হাওয়া দুলে গেল নিষ্প্রাণের গাত্রবরণে। শুনতে পেল মিষ্টি, মিহি কণ্ঠ—
“প্রাণ!”
অমিলীত চোখে তাকায় নিষ্প্রাণ। কাউচ থেকে সোজা হয়ে বলল—
“তারা! তুমি এসেছ?”
নয়নতারা প্রফুল্ল হাসল। বলল—
“আমার গলুমুলু প্রাণ বাবা হবে আর আমি আসব না! তা কী হয়?”
নিষ্প্রাণ কণ্ঠে অসহায়তা নিয়ে বলল—
“ধ্রুবতারা আমাকে ভালোবাসতে চায় না কেন বলোতো? ও কেন বিশ্বাস করে না আমি ওকে ভালোবাসি?
নয়নতারা চমৎকার হাসল। রহস্য করে বলল—
“তোর ছেলে কেমন আছে?”
নিষ্প্রাণ অবাক চোখে চেয়ে রইল।
চলবে,,,