প্রাণস্পন্দন•পর্বঃ৫৪

0
2637

#প্রাণস্পন্দন
#পর্বঃ৫৪
লেখনীতেঃতাজরিয়ান খান তানভি

মৃদু মলয়ে উঠেছে কাঁপন। সেই সাথে কাঁপছে নিষ্প্রাণের দীর্ঘ আঁখিপল্লব। পলক ফেলতে ভুলে গিয়েছে সে। উদ্ভাসিত চোখে তাকিয়ে বিস্ময়ভরা কণ্ঠে বলল—

“তুমি কী করে জানলে আমার ছেলে হবে?”

নয়নতারা ভুবন ভোলানো হাসল। চোখের পাল্লা নাচিয়ে অন্তরিন্দ্রিয়ের সুপ্ত খুশি ব্যক্ত করল। প্রসন্ন গলায় বলল—

“আমি তো সব জানি।”

নিষ্প্রাণের পাশে এসে বসল নয়নতারা। নিষ্প্রাণের চোখ খুশিতে টলটল করছে। আজ এতদিন পর তারা আবার তার সামনে এসেছে। কথা বলছে। আয়েন্দ্রির সাথে বিয়ের পর তারাকে দেখার দৃষ্টিভ্রম আর হয়নি নিষ্প্রাণের। নিষ্প্রাণ সরল চোখে কৌতূহল নিয়ে চেয়ে রইল। বলল—

“আর কী জানো তুমি?”

নয়নতারা ঝুমঝুময়ি হাসল। তার হাসিতে ঝরতে লাগল পর্বত শৃঙ্গের বুক ফেড়ে আসা শীতল, স্বচ্ছ প্রস্রবন। নিষ্প্রাণের সেই প্রস্রবনে নিজেকে সিক্ত করতে ইচ্ছে হলো। নয়নতারা নিঃশব্দে নিষ্প্রাণের পাশে বসল। সবজান্তার মতো আত্মবিশ্বাস নিয়ে বলল—

” এই যে তোর ধ্রুবতারা তোকে সত্যিই ভালোবাসে, এটাও আমি জানি।”

নিষ্প্রাণের অন্তঃকরণে উত্তাল ঢেউ ওঠে। নয়নতারার সামনে গিয়ে হাঁটু ভাঁজ করে ভর দিয়ে বসে। নয়নতারার দুই হাত নিজের মুষ্ঠিতে নিয়ে আবেগপূর্ণ গলায় বলল—

“তুমি সত্যি বলছ? ধ্রুবতারা আমাকে ভালোবাসে?”

সজীব হাসল নয়নতারা। চোখে উচ্ছ্বাসের তূরন্ত টান। অধর বিস্তৃত করে বলল—

“হ্যাঁ। তোর ধ্রুবতারা তোকে খুব ভালোবাসে। ওকে তোর কাছেই রাখিস। ওকে তোর থেকে দূর করিস না।”

“করব না। প্রমিজ, ওকে আমি কোথাও যেতে দেবো না।”

চোখে হাসল নয়নতারা। মোহবিষ্ট গলায় বলল—

“আমাকে যেতে হবে প্রাণ।”

“তুমি চলে যাবে? কেন চলে যাবে? আমার ছেলেকে তুমি দেখবে না?”

“কেন দেখব না? ওই যে আকাশ দেখছিস! ওখান থেকে দেখব। তোকে, তোর ধ্রুবতারাকে আর তোর ছেলেকে।”

“তুমি সত্যিই আমাকে ছেড়ে চলে যাবে? আর কখনো আসবে না?”

“না। এখন থেকে তোর ধ্রুবতারা তোর সাথে থাকবে। আগলে রাখিস ওকে। বুকের পাঁজরে রাখিস। আর খুব ভালোবাসবি। যতটা আমি তোকে ভালোবেসেছি।”

“বাসব। খুব ভালোবাসব ওকে। কিন্তু তুমি যেওনা প্লিজ।”

নয়নতারা ছোট্ট করে হাসল। বিগলিত গলায় বলল—

“তা হয় না প্রাণ। আমাকে যেতে হবে।”

সাশ্রুনেত্রে চেয়ে আছে নিষ্প্রাণ। নয়নতারা তার হাত গলিয়ে দেয় নিষ্প্রাণের চুলে। কপট রাগ দেখিয়ে বলল—

“গলুমলু প্রাণ, মন খারাপ করে না। আমি সবসময় চেয়েছি তুই ভালো থাক। এখন তো তোর পূর্ণতার সময়। তোর ধ্রুবতারা তোর কাছে, তুই বাবা হবি। ছোট্ট প্রাণ বাবা হবে।”

নয়তারা খলখলিয়ে হাসে। নিষ্প্রাণ অপলকে সেই হাসি দেখে। হাসি থামিয়ে নয়নতারা বলল—

“আমি আমার এই হাসি তোকে দিয়ে যাচ্ছি। যত্নে রাখিস। তোর ছেলের নাম।”

নয়নতারা নিষ্প্রাণের কানে ফিসফিসিয়ে কিছু একটা বলে। সোজা হয়ে চোখে হাসে। নিষ্প্রাণ আলতো গলায় প্রশ্ন করে—

“এর মানে কী?”

“শেষ হাসি। আমার শেষ হাসি। আমি আসি প্রাণ। ভালো থাকিস। আমি সবসময় তোকে ওই আকাশ থেকে দেখব। তোর ছেলের হাসি হয়ে হাসব। তোর ধ্রুবতারা চোখের তারায় থাকব। ভালো থাকিস।”

লুপ্ত হতে থাকে নয়নতারা। কাতর হতে থাকে নিষ্প্রাণের অক্ষিকোটর। জলসিক্ত চোখে চেঁচিয়ে ওঠে—

“তারা!”

ওঠে বসে নিষ্প্রাণ। সে স্বপ্ন দেখছিল। ভয়ংকর স্বপ্ন।
,
,
,
নিষ্প্রাণ হুলস্থুল হয়ে কক্ষে আসে। আয়েন্দ্রি জানালার পাশে দাঁড়িয়ে ছিল। সাদা, তুলোর মতো মেঘের অভয়ারণ্য। ধূসর আকাশের পরতে পরতে তা ভাসছে আপন ভঙ্গিমায়। প্রভাকরের তরল আভায় মেদিনীর বুকে আবছায়ার সৃষ্টি হচ্ছে। নিষ্প্রাণ ঝপ করে এসেই পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে আয়েন্দ্রিকে। আয়েন্দ্রি চকিত হয়। ফিরে তাকাতেই নিষ্প্রাণ দুই হাতের বলয়ে আবদ্ধ করে আয়েন্দ্রিকে। সে হতভম্ব। কিছুই বুঝতে পারছে না। তবে তার মস্তিষ্কে প্রতীত হচ্ছে নিষ্প্রাণের জোরালো বাঁধন যেকোনো সময় তার শ্বাস রুদ্ধ করে দেবে। নিষ্প্রাণ না পারছে আয়েন্দ্রিকে তার বক্ষস্থলে ঢুকিয়ে ফেলতে। আয়েন্দ্রি বিধুর গলায় বলল—

“প্রাণ, ছাড় আমাকে।”

নিষ্প্রাণ পিষে ধরল আয়েন্দ্রিকে। তার উচ্ছ্বাস ঝকঝকে নীল আকাশে স্পষ্ট হওয়া রংধনুর মতো সারা শরীরে আলোড়ন তুলল। বুকের হৃদপ্রকোষ্ঠে শীতল সমীরণে উদ্দাম হতে লাগল শ্বাসক্রিয়া। এক আকাশ উচ্ছলতায় মাতোয়ারা হয়ে নিষ্প্রাণের আবেগি স্বর—

“আমাদের ছেলে হবে ধ্রুবতারা। আমাদের ছেলে হবে। তারা ওর শেষ হাসি দিয়ে গেছে আমাদের।”

আয়েন্দ্রির শরীর তেঁতে উঠল। আর শুনতে পারল না সে। ক্ষুব্ধ হয়ে বলল—

“কী পাগলের মতো বলছিস! তারা নেই প্রাণ। নয়নতারা মৃত। মৃত মানুষ কখনো ফিরে আসে না। এইটা শুধুই তোর ভ্রম।”

নিষ্প্রাণ অপ্রশস্ত চোখে চেয়ে বলল—

“আমার তারা আছে ধ্রুবতারা। ও বলেছে আমাদের ছেলে হবে। ও আমাদের ছেলের নামও বলেছে। তুই কেন বিশ্বাস করিস না?”

“করব না। পাগল নই আমি। তুই পাগল। এক মৃত মানুষকে তুই জীবিত ভাবছিস। তোর চিকিৎসা প্রয়োজন প্রাণ। তুই সুস্থ নস।”

নিষ্প্রাণ কড়া চোখে তাকাল। তেড়ে এসে আয়েন্দ্রির চোয়াল চেপে ধরে তীব্র আক্রোশে। গনগনে শ্বাস ফেলে বলল—

“আমার তারা মিথ্যে বলে না। আমাদের ছেলেই হবে। তুই দেখে নিস। আমার ছেলের যেন কিছু না হয় ধ্রবতারা। ও আমার তারার শেষ হাসি। ওই হাসি আমি কিছুতেই হারাতে দেবো না।”

নিষ্প্রাণকে ধাক্কা মেরে সরায় আয়েন্দ্রি। তাপিত গলায় বলল—

“তারা, তারা, তারা! তারা নেই। তারা মরে গেছে। ও আর কোনোদিনও ফিরে আসবে না। কেন এক মৃত মানুষকে মনে করে নিজেকে অসুস্থ করে তুলছিস তুই? কেন অন্যের জীবন কেড়ে নিচ্ছিস? শাস্তি দেওয়ার জন্য আইন আছে, উপরওয়ালা আছে। তুই কাউকে শাস্তি দেওয়ার কে? তারার কথা ভেবে একের পর এক অন্যায় করে যাচ্ছিস তুই? তোকে কে শাস্তি দেবে তোর অপরাধের? ভুলে যা তারাকে। ”

নিষ্প্রাণ অদ্ভুত শান্ত গলায় বলল—

“ভুলে যাব তারাকে? যে তারা আমাকে আগলে রেখেছে ওকে ভুলে যাব? যে আমাকে বাঁচতে শিখিয়েছে ওকে ভুলে যাব? যে আমাকে সত্য দেখিয়েছে, তোকে আমার জীবন পাঠিয়েছে তাকে ভুলে যাব? পারব না আমি। পারব না। এই পৃথিবী ওকে ভুলে গেলেও আমি ভুলব না। তারারা মরে না। ওরা সারাজীবন ওই আকাশে থাকে, এই চোখের আলোতে থাকে। আমার তারাও থাকবে।”

আয়েন্দ্রি দগদগে গলায় বলল—

“তুই অসুস্থ! অসুস্থ তুই!”

নিষ্প্রাণ অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে। হাসতে হাসতে বলল—

“অসুস্থ! হ্যাঁ অসুস্থ। এই পৃথিবীর সব মানুষই অসুস্থ। যারা বাঁচতে চায় তাদের অসুস্থ হয়েই বাঁচতে হয়। সুস্থ হয়ে তারা বাঁচতে পারে না। এই সমাজ দেয় না তাদের বাঁচতে। কীসের শাস্তির কথা বলছিস তুই? আমি যাদের মেরেছি তারা কেউ শুদ্ধ নয়। একজন রেপড ভিক্টিমের শেষ পরিণতি কী জানিস? হয় নিজে মরবে, না হয় এই সমাজ তাকে মেরে দেবে। রাতের আঁধারে সব পুরুষেরই রাস্তায় চলার অধিকার আছে। তাহলে একজন নারীর নেই কেন? কাপড়ের দোষ, শালীনতা? তাহলে দুই বছরের শিশু কেন রেপড হয়? মায়ের বয়সী নারীকে কেন ছেলের বয়সী পুরুষের কাছে নির্যাতনের স্বীকার হতে হয়? ভীড় বাসে কেন একজন মেয়েকে তার বিনা অনুমতিতে নোংরা স্পর্শের স্বীকার হতে হয়? কেন মুখ বুঝে সহ্য করতে হয় পুরুষ শাষিত সমাজের নোংরা কথা? বোরখা পড়া মেয়েদেরও ধর্ষিত হতে হয়। স্বামীর সামনেও আজকাল স্ত্রী ধর্ষণ হয়। তখন কোথায় থাকে তোদের আইন? বল?”

আয়েন্দ্রি কেঁপে ওঠে নিষ্প্রাণের ভয়াল স্বরে। ঘনঘন শ্বাস ফেলছে সে। নিষ্প্রাণ রোবটের মতো বলতে থাকে—

“নিজের মাকে আমি রেপড হতে দেখেছি। তারাকে দেখেছি। তবুও আমি বেঁচে আছি। কেন জানিস? কারণ আমি অসুস্থ। সুস্থ হলে আমি বাঁচতে পারব না। একজন মানুষ যখন মানসিক রোগে আক্রান্ত হয় তার আগে তাকে কতটা নিগ্রহ, নিপীড়িত, যন্ত্রণা সহ্য করতে হয়ে তার ধারণা আছে তোর? নেই। তাহলে তুই বল, যদি সে মানুষটা আবার সুস্থ হয় তাহলে তাকে আবার সেই যন্ত্রণা কুঁড়ে কুঁড়ে খাবে। তাহলে তার সুস্থ হয়ে লাভ কী? অসুস্থ থাকাই তার শ্রেয়। কোনো যন্ত্রণা তাকে ছুঁতে পারবে না, কোনো তাপ তাকে গলাতে পারবে না। সে দৃঢ়, দুর্বোধ্য সে। ”

আয়েন্দ্রির মুখ দিয়ে কথা বের হচ্ছে না। তার চোখের পাল্লা লাগামহীন কাঁপছে।

নিষ্প্রাণ সতেজ গলায় বলল—

“আমি সুস্থ হয়ে কী করব? সুস্থ হয়ে তারার মৃত্য দেখেছি। মায়ের মৃত্যু দেখেছি। আর অসুস্থ হয়ে সেই নরপশুদের শাস্তি দিয়েছি। যারা মেয়েদের শুধু ভোগের বস্তুই মনে করে। কাজের লোক বলে কী তারা আর মেরুনরা মানুষ নয়? ওদের সাথে হওয়া অন্যায়ের সাজা কে দিবে ওদের?”

আয়েন্দ্রি নৈঃশব্দে হেঁচকি তুলে যাচ্ছে। সমাহিত চোখে চেয়ে আছে সে। নিষ্প্রাণ বক্রোক্তি করে বলল—

“আমার তারা নেই। ওরা ওকে বাঁচতে দেইনি। আমার ধ্রুবতারা তো আছে। তার গায়ে আমি আঁচড়ও লাগতে দেবো না। কারো দৃষ্টিসীমায় আসবে না সে।”

সুপারি গাছের ডগার ন্যায় থরথর করে কাঁপছে আয়েন্দ্রি। নিষ্প্রাণের লাল বর্ণ চোখে কল্পনাতীত নেশা। যেন খুন করে ফেলবে যে কাউকে। নিষ্প্রাণ আয়েন্দ্রির কাছে এসে দাঁড়ায়। মধুর গলায় বলল—

“আমি সুস্থ হলে তোকে ভালোবাসব কী করে? আমি তোকে সুস্থ মানুষের মতো ভালোবাসতে পারব না। তোকে সারাজীবন এই অসুস্থ মানুষের সাথে কাটাতে হবে। যতদিন আমার শ্বাস আছে আমার প্রাণস্পন্দন হয়েই থাকতে হবে। কোথাও যেতে দেবো না তোকে আমি। ”

নিষ্প্রাণ হাঁটু মুড়ে নিচে বসে। আয়েন্দ্রির কোমড়ে কাছে জড়িয়ে ধরে তার উদরে কান পেতে বলল—

” আমি তোকে ভালোবাসি। এক আকাশসম ভালোবাসি, অতলান্তিক অম্ভোনিধির অগাধ জলরাশির প্রতিটি তরঙ্গমালার ন্যায় ভালোবাসি, অভ্রভেদী মেদিনীধরের শিখরসম ভালোবাসি, উত্তপ্ত ঊষরের বুকে চাতকের এক পশলা বৃষ্টির আহ্বানের মতো ভালোবাসি, নিবিড় কাননের সদ্যোজাত মহীরুহের ন্যায় ভালোবাসি, তমসাচ্ছন্ন নিশীথিনীর বিভাসিত বিধুর চন্দ্রাতপ হয়ে ভালোবাসি। আমার হৃদকুঠিরের একমাত্র সম্রাজ্ঞী তুই। আমার অন্তরিন্দ্রিয়তে ব্যাত্যা তোলা একনিষ্ঠ যোষিতা তুই। আমার দীর্ঘ বিষাদ জীবনের শোভিত সারাংশ তুই। ভালোবাসি তোকে আমি। ভালোবাসি।”

আয়েন্দ্রির টলটলে চোখের বান ছুটেছে। নিষ্প্রাণের নরম চুলে হাত গলিয়ে তার ছোট্ট মস্তিষ্কের কোণায় কোণায় এক অনিশ্চিত অনিবার্য ঘটনার পরিস্ফুটন হচ্ছে। যদি সত্যিই তাদের ছেলে হয়? তাহলে? নিষ্প্রাণ সত্যিই ভেবে নেবে তার তারা আছে। সে আছে।

আচমকা এক তপ্ত বাতাসে শিউরে ওঠে আয়েন্দ্রির স্থির দেহ!

চলবে,,,

(বি.দ্রঃ
রাতে আরেক পর্ব আসতে পারে। তবে😒😒😒)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here